সাম্প্রতিক ব্যাংক নিউজ

প্রস্তাবিত ব্যাংকিং কমিশন কী কী করতে পারে

প্রস্তাবিত ব্যাংকিং কমিশন কী কী করতে পারে- সম্প্রতি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি যে, মাননীয় অর্থমন্ত্রী বহুল প্রতীক্ষিত ব্যাংকিং কমিশন গঠন প্রক্রিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। এটি স্বাগত জানানোর মতো একটি উদ্যোগ। ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য ক্রমাগত দুর্বল থেকে দুর্বলতর হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) কয়েক বছর থেকেই একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং সাময়িক ব্যাংকিং কমিশন গঠনের মাধ্যমে অর্থনীতির জন্য এ গুরুত্বপূর্ণ খাতটির প্রকৃত অন্তর্নিহিত সমস্যা উদ্ঘাটন এবং তথ্য ও উপাত্তের সাহায্যে সমস্যাগুলোর বিশ্লেষণ করে ব্যাংকিং খাতের জন্য সহযোগী এবং উপযোগী সুপারিশমালা তৈরির জন্য দাবি উত্থাপন করে আসছে।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০১২ সালে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক অর্থ জালিয়াতির পর সিপিডি ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিয়ে একটি ডায়ালগ করে ৫ নভেম্বর ২০১২ সালে। সেখানে সুস্পষ্টভাবে সিপিডি আর্থিক খাতের জন্য একটি কমিশন গঠন করার কথা বলে এবং সেই কমিশনের ম্যান্ডেট বা কার্যপরিধি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে। সেখানে সিপিডি শুধু ব্যাংক নয়, পুঁজিবাজার এবং ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করে সামগ্রিক আর্থিক খাতের জন্য কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে।

এছাড়া সিপিডি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি ও উন্নয়নের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বছরে যে তিনটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করে, সেখানেও ব্যাংকিং খাতটির ওপর বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা উপস্থাপন করে এবং প্রতিটি আলোচনাতেই ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার জন্য সিপিডির সুপারিশ থাকে। বিভিন্ন সভায়, আলোচনা অনুষ্ঠানেও আমরা ধারাবাহিকভাবে ব্যাংকিং কমিশনের গুরুত্ব তুলে ধরে আসছি।

দুঃখজনকভাবে, সরকারের পক্ষ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অবশ্য মাঝেমধ্যে ব্যাংকিং কমিশন নিয়ে কথাবার্তা হয়ে থাকে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তাঁর সময়কালে কয়েকবার ব্যাংক কমিশন গঠনের কথা বলেছেন। বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন ব্যাংক খাত নিয়ে টাস্কফোর্স গঠনের কথা। তিনি একটি ব্যাংকিং কমিটি গঠনের মাধ্যমে খাতটির সংস্কারের কথাও উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটেও বর্তমান অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন যে, একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা যায় কিনা সে বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন। বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার কথাও বলেছেন তিনি।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

তাঁর সেই বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। গত বছরের আগস্ট ও নভেম্বরেও তিনি এ বিষয়ে বলেছেন। সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য হচ্ছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধানের জন্য বেশকিছু উদ্যোগ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে খেলাপিঋণ কমানো, ব্যাংকিং খাতের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য অগ্রগামী পদক্ষেপ, ঋণ পাওয়ার সুবিধা বাড়ানো এবং ব্যাংকিং খাতে প্রযুক্তি ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। এগুলো অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক প্রতিজ্ঞা ছিল।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত উদ্যোগ নেয়ার ক্ষেত্রে অনীহা রয়েছে। বরং ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের পরিবর্তে খাতটিকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। তাই ব্যাংকিং খাতটি ক্রমে অদক্ষতা, অসাধুতা ও খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা, যা ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের হিসাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ। কেননা ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হিসাবের মধ্যে ঋণ অবলোপন, অর্থঋণ আদালতে আটকে থাকা অর্থ এবং কু-ঋণ বা স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট পুনঃতফসিলের হিসাব অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।

শুধু রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোতেই নয়, ব্যক্তি খাতের ব্যাংকেও ঋণখেলাপি ও অনিয়ম বাড়ছে। সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে তাদের মোট ঋণের ৩১ দশমিক ৫ শতাংশই খেলাপি ঋণ। অন্যদিকে ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলোতে তাদের দেয়া মোট ঋণের ৭ দশমিক ৮ শতাংশ হচ্ছে খেলাপি ঋণ। মোট খেলাপি ঋণের সিংহভাগই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে, যা মোট খেলাপি ঋণের ৫১ শতাংশ। দেশের মোট খেলাপি ঋণের ৪৭ শতাংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন বাংকগুলোতে রয়েছে।

এছাড়া অন্যান্য সূচকেও ব্যাংকিং খাতের অবস্থা ভালো নয়। যেমন মূলধনের পর্যাপ্ততার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিয়ম ‘ব্যাসেল-৩’ অনুযায়ী ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য যে পরিমাণ মূলধন থাকা প্রয়োজন সরকারি ব্যাংকগুলোতে তার চেয়ে কম মূলধন রয়েছে। সরকারি ব্যাংকের ব্যয় ও আয়ের অনুপাত সবসময়ই বেশি। তার অর্থ হচ্ছে, এ ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ অনেক কম। আরো সহজভাবে বলতে গেলে ১ টাকা গড় আয় করতে তাদের ৮০ পয়সা খরচ করতে হচ্ছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে খরচ করতে হচ্ছে ৭৭ পয়সা আর বিদেশী ব্যাংকগুলোকে খরচ করতে হচ্ছে ৪৫ পয়সা।

অন্যদিকে সম্পদের ওপর রিটার্ন বা আয় হিসাব করলে দেখা যায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে সম্পদ থেকে কোনো আয়ই হচ্ছে না। উল্টো তাদের মূলধন ভেঙে খেতে হচ্ছে। কেননা সেখানে সম্পদ থেকে ঋণাত্মক আয় হচ্ছে। অথচ একটি ভালো ব্যাংকের ১০০ টাকা সম্পদ থাকলে তার রিটার্ন সাধারণত ২ টাকার কাছাকাছি হওয়ার কথা। বাংলাদেশে কার্যরত বিদেশী ব্যাংকগুলোতে এ রিটার্ন ২ দশমিক ৬ টাকা।

অন্যদিকে ঋণখেলাপিদের সুবিধার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশকিছু অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলোতে একই পরিবার থেকে বোর্ড সদস্য সংখ্যা ২ থেকে বাড়িয়ে ৪ করা এবং তাদের মেয়াদকাল ছয় বছর থেকে বাড়িয়ে নয় বছর করা। আরো ক্ষতিকর উদ্যোগ হচ্ছে ঋণখেলাপিরা শুধু ঋণের ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে তাদের ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবেন। তাছাড়া তারা এক বছর অতিরিক্ত সময় বা গ্রেস পিরিয়ড নিয়ে ১০ বছরে তাদের ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন। তার ওপর, পুনঃতফসিলকৃত ঋণ মাত্র ৯ শতাংশ সুদহারে ফেরত দেয়া যাবে। তাছাড়া এককালীন এক্সিটের মাধ্যমে ঋণখেলাপিরা ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড, ঋণের মূল পরিমাণ এবং বকেয়া অর্থ এক বছরের মধ্যে ফেরত দিয়ে বের হয়ে যেতে পারবেন।

এসব পদক্ষেপ খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের উৎসাহিত করার জন্য নেয়া হয়েছে। এগুলো সৎ ঋণগ্রহীতাদের প্রতি এক ধরনের অন্যায়। কেননা তারা নিয়ম মেনে বিদ্যমান সুদের হারে ব্যাংকের টাকা ফেরত দিয়ে যাচ্ছেন আর খেলাপিরা নানা সুবিধা নিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তার পরও খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ছে না। এটি কী ইঙ্গিত বহন করে? এ ধরনের ঋণগ্রহীতারা আসলে ইচ্ছাকৃত খেলাপি এবং তাদের অনেকের অর্থনীতিতে কোনো বিনিয়োগও নেই। তবে তাদের রয়েছে ব্যাপক প্রভাব ও ক্ষমতা।

তাই অর্থমন্ত্রীর পরিকল্পনা যদি সত্যি সত্যিই বাস্তবায়ন হয়, তাহলে সেটি একটি ভালো উদ্যোগ হবে। আমরা মনে করি, সিপিডি ও অন্যান্য অনেকের নিরন্তর আলোচনা ও দাবি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখবে। তবে সরকারের ব্যাংকিং কমিশন বিষয়ে আমরা এখনো বিস্তারিত কিছু জানি না। তাই এ নিয়ে অর্থমন্ত্রীর কী ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে, সে ব্যাপারে এ মুহূর্তে মন্তব্য করতে পারছি না। তবে সিপিডি যেহেতু প্রায় আট বছর ধরে বারবার ব্যাংকিং কমিশনের কথা বলে এসেছে, তাই এ রকম একটি কমিশনের উদ্দেশ্য, কার্যপরিধি, সম্ভাব্য সুপারিশমালা এবং তা বাস্তবায়ন নিয়ে আমাদের কিছু মতামত রয়েছে। এখানে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা হলো।

প্রথমত, এ রকম একটি কমিশনের উদ্দেশ্য ও কার্যপরিধি হবে খুবই সুনির্দিষ্ট। এগুলো হলো: (১) ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক পরিস্থিতি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ এবং ব্যাংকের গ্রাহক এবং অর্থনীতির জন্য খাতটি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা নিরূপণ করা; (২) ব্যাংকিং খাতের সঠিক তথ্য ও পরিসংখ্যানের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে খাতটির প্রকৃত স্বাস্থ্য সম্পর্কে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা; (৩) ব্যাংকিং খাতের বিদ্যমান সমস্যার মূল কারণগুলো কী এবং সামনের দিনের চ্যালেঞ্জগুলো কী তা চিহ্নিত করা; (৪) ব্যাংকিং খাতের সমস্যার জন্য কারা এবং কোন কোন প্রতিষ্ঠান দায়ী তা চিহ্নিত করা; (৫) স্বল্প ও মধ্যম মেয়াদে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান সংকটাবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কী ধরনের প্রশাসনিক, আইনগত ও কাঠামোগত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, সে ব্যাপারে অর্থবহ ও সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা তৈরি করা।

দ্বিতীয়ত, কমিশনের সময়কাল কী হবে। আমরা মনে করি, এটি হবে একটি স্বল্পমেয়াদি অন্তর্বর্তীকালীন কমিশন। এর স্থায়িত্ব তিন থেকে চার মাস হওয়া উচিত। এর লক্ষ্য হওয়া উচিত ২০২০-২১ অর্থবছরের আগেই একটি খসড়া প্রতিবেদন তৈরি করা, যাতে সেটি আগামী অর্থবছরে বাস্তবায়ন করা যায়।

তৃতীয়ত, এ কার্যক্রমগুলো সম্পন্ন করার জন্য কমিশনকে একটি সার্বিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। এ কমিশনকে প্রতিবেদন তৈরির জন্য অন্তত চারটি পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে: (ক) বিদ্যমান তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণ; (খ) বিশেষ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাদা আলাদা আলোচনা; (গ) জনগণের জন্য উন্মুক্ত ডায়ালগ আয়োজন করা এবং গণশুনানির ব্যবস্থা করা; এবং সর্বোপরি, (ঘ) কমিশনকে সমাজের বৃহত্তর গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে, যারা ব্যাংকিং খাতের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল।

নীতিনির্ধারক, ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তা, সাধারণ গ্রাহক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ছোট ছোট সঞ্চয়কারী, বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকিং খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধি, নারী, যুবক, শহর ও গ্রামের জনগণ, তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠনগুলোর প্রতিনিধি, মিডিয়া—সব অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে প্রতিবেদনে তাদের মতামতের প্রতিফলন থাকতে হবে।

চতুর্থত, কমিশনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। কমিশন নিয়মিতভাবে তার কার্যক্রমের অগ্রগতি ও ফলাফল বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সর্বদা অবহিত করবে। কমিশনের খসড়া প্রতিবেদন নিয়ে জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় করতে হবে। এছাড়া জনগণের মতামতের জন্য প্রতিবেদনটি ওয়েবসাইটে রাখতে হবে।

পঞ্চমত, কমিশনের প্রধান ও সদস্য নির্বাচন প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে দক্ষতা, যোগ্যতা, বিচক্ষণতা, নিরপেক্ষতা ও সততাই হবে একমাত্র যোগ্যতা, যাতে তারা নির্মোহভাবে কাজ করতে পারেন।

ষষ্ঠত, কমিশনের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা। কমিশনকে তার কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী প্রভাবমুক্তভাবে কাজ করতে দিতে হবে।

সপ্তমত, কমিশনের সুপারিশমালা সরকার কীভাবে এবং কখন বাস্তবায়ন করবে, সে ব্যাপারে কমিশন গঠনের সময়ই সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা এবং অঙ্গীকার থাকতে হবে। এক্ষেত্রে একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ থাকতে হবে। আর কমিশনের সুপারিশমালা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা এবং তার ফলাফল ও প্রভাব ব্যাংকিং খাতের ওপর কীভাবে পড়ছে, সে সম্পর্কে তথ্য ও উপাত্ত নিয়মিতভাবে প্রকাশ করতে হবে।

এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকিং খাত বিগত সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আশির দশকে বেসরকারীকরণের মধ্য দিয়ে ব্যাংকিং খাতের সংস্কার শুরু হয়। মূলত বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের তত্ত্বাবধানে আর্থিক খাতের সংস্কার চলে নব্বই এবং এর পরের দশকেও। ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে চারটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর করপোরেটাইজেশন করার উদ্যোগ নেয়া হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল ব্যাংকগুলোর দক্ষতা বাড়ানো এবং সেগুলোকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা।

তবে এর বাইরে বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকিং কমিশন এবং ব্যাংকিং কমিটি গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের নির্দেশে ১৯৮৪ সালে ন্যাশনাল কমিশন অন মানি, ব্যাংকিং অ্যান্ড ক্রেডিট গঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯০ সালে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও ইউএসএআইডির সহায়তায় আর্থিক খাতের সংস্কার প্রকল্প হাতে নেয়, যেটি ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত চলে। ১৯৯৮ সালে ব্যাংকিং কমিশন এবং ২০০২ সালে ব্যাংকিং রিফর্ম কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়া ২০০৩ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালীকরণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল ব্যাংকিং খাতের জন্য কার্যকরী আইনগত এবং তদারকি ব্যবস্থা তৈরি করা।

২০০৩ সালে ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের জন্য জাতীয় সংসদে একটি বিল পাস করা হয়। এখানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগটি ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক অ্যামেন্ডমেন্ট বিল ২০০৩, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করার এবং মুদ্রানীতি প্রণয়নের অনুমোদন পায়। এ উদ্যোগগুলোর ফলে ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য অনেকটাই পুনরুদ্ধার হয়। যদিও বিভিন্ন সরকারের অনীহার কারণে এবং বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর চাপের কারণে সব সুপারিশ গ্রহণ করা হয়নি।

বর্তমান সময়ে যদি একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠিত হয় এবং সেটিকে যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া হয়, তাহলে খাতটির ওপর জনগণের হারানো আস্থা ও বিশ্বাস কিছুটা ফিরে আসবে। তবে কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সংকল্প। সেখানেই বোঝা যাবে ব্যাংকিং খাতের উন্নতির জন্য সরকারের সত্যিকারের আগ্রহ কতখানি।

দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে প্রস্তাবিত ব্যাংকিং কমিশনের গঠন প্রক্রিয়া, কার্যকর সুপারিশমালা এবং সেগুলোর বাস্তবায়ন আমরা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করব এবং সে ব্যাপারে মতামত তুলে ধরব। বাংলাদেশের জনগণও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে অর্থনীতির হূিপণ্ডস্বরূপ এ খাত কবে প্রাণ ফিরে পাবে।

ড. ফাহমিদা খাতুন: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button