ব্যাংকার

এক অদম্য ব্যাংকারের পথ চলা

অন্য সবার মতো স্বাভাবিক না হওয়ায় আমি কলেজে যেতে পারতাম না। আমার বন্ধুরা আমাকে সাইকেলের সামনে বসিয়ে কলেজে নিয়ে গেছে। ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা আমার জন্য অপেক্ষা করেছে। ক্লাস শেষে তারা আবারো আমাকে সাইকেলে চড়িয়ে বাসায় পৌছে দিয়ে বাড়ি গেছে।

এরপর আবার প্রাইভেটের সময় তারা আমার বাসায় এসেছে। আমাকে নিয়ে প্রাইভেটে গেছে। প্রাইভেট শেষে আবারো বাসায় পৌছে দিয়ে তারা তাদের বাড়ি গেছে। আমার সফলতার গল্প বলতে গেলে সবার আগে আমার বন্ধুদের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে হবে। কারণ তাদের আন্তরিকতা এবং সহযোগিতায় আজ আমি সফল। অনেকের জীবন নাকি শেষ হয়ে যায় বন্ধুর পাল্লায় পড়ে। এক্ষেত্রে আমি ব্যতিক্রম। কারণ আমাকে উঁচুতে তুলে ধরতে মই হিসেবে কাজ করেছে আমার বন্ধুরা।

ছবিঃ অফিসে কাজের ফাঁকে চন্দন কুমার বনিক

বিকেলে নিজ অফিসে বসে এভাবেই বন্ধুদের সহযোগিতার কথাগুলো উল্লেখ করে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছিলেন ঠাকুরগাঁও সোনালী ব্যাংকের একজন অফিসার। বলছিলেন, সেই ছোটবেলা থেকে নিভু নিভু প্রদ্বীপের মাঝে কীভাবে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছেন তারই গল্প। নিজের গল্প শোনানোর আগে তিনি জানিয়ে দিলেন তার কিছু স্বপ্নের কথা যে স্বপ্নগুলো বাস্তব করতে অনেক কষ্ট করেছেন। তাই তিনি চান না একই কষ্ট তার মতো অন্যরা করুক।

স্বপ্নের কথাগুলো বলতে গিয়ে সবার আগে তিনি বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ে একটি প্রতিবন্ধী কল্যাণ ট্রাস্ট গড়ে তুলতে চাই। সেই কল্যাণ ট্রাস্টের সহযোগিতায় মেধাবী প্রতিবন্ধিরা লেখাপড়া করে শিক্ষিত হয়ে উঠবে। তিনি বললেন, আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধিরা এখনো অনেক অবহেলিত। অভিভাবকরা প্রতিবন্ধী সন্তানদের নিয়ে সব সময় বিপাকে থাকেন। সমাজের কাছে সহযোগিতা পেলে প্রতিবন্ধিরা এগিয়ে যাবেই যাবে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম সেই ভদ্রলোকের নাম চন্দন কুমার বনিক। পেশায় একজন ব্যাংকার; সোনালী ব্যাংকের ঠাকুরগাঁও প্রিন্সিপাল অফিসের কর্মকর্তা। সকল প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে ২০১৫ সালে চাকরি পেয়েছেন তিনি। উনার উচ্চতা তিন ফুট। স্ট্রেচারের সাহায্য ছাড়া হাঁটা-চলা করতে পারেন না। জন্মের পর থেকেই এমন। এই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েই ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন।

ছবিঃ চন্দন কুমার বনিক স্ট্রেচারের সাহায্য ছাড়া হাঁটা চলা করতে পারেন না

অদম্য এই মানুষটিকে জীবনে অনেক কঠিন পথ পারি দিতে হয়েছে। হাজারো কটুক্তি শুনেও থেমে যাননি। শুধুমাত্র মেধা আর নিরলস প্রচেষ্টার জোরে বলার মতো একটা পর্যায়ে এসেছেন। আর্থিক ও পারিবারিক সঙ্কটকে রূপান্তর করেছেন শক্তিতে। চন্দন দা এখন পর্যন্ত ২০টি চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে দশটি পরীক্ষা তিনি সুদূর ঠাকুরগাঁও থেকে ঢাকায় এসে দিয়েছেন। সোনালী ব্যাংকসহ চারটি ভাইবা দিয়ে আগের তিনটি চাকরি পাননি। কিন্তু তিনি থেমে যাননি। কোথাও কোনো কোচিংও করেননি। আবার নতুন করে শুরু করলেন। সোনালী ব্যাংকে প্রিলি ও লিখিত পাস করলেন। অবশেষে জীবনের চতুর্থ ভাইবা দিয়ে সফল হলেন; চাকরি পেলেন।

একবার ভাবুন তো- যে মানুষটি শারীরিকভাবে স্বাভাবিক নয়, স্ট্রেচার ছাড়া হাঁটতে পারেন না; পারিবারিক ও সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তিনি যদি নিজ যোগ্যতায় চাকরি পেতে পারেন, তাহলে আপনি কেন পারবেন না? অনেকেই বলতে পারেন- চন্দন দা’র তো কোটা ছিল। হ্যাঁ ছিল, কিন্তু সেটা তো লিখিত পরীক্ষায় পাস করার পর কার্যকর হয়। নিজ মেধার যোগ্যতায় লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছেন তিনি। অনেক কষ্টের বিনিময়ে ভালো চাকরি পেয়েছেন। বিয়েও করেছেন, নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন…।

গুনে গুনে বলুন তো- আপনি জীবনে মোট কয়টা পরীক্ষা দিয়েছেন? এর মধ্যে কয়টা পরীক্ষা যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে দিয়েছিলেন? চন্দন দা কিন্তু দশটি পরীক্ষা প্রস্তুতি নিয়ে দিয়ে সফল হয়েছেন। আসলে আমাদের প্রস্তুতি আর মনোবলের ঘাটতি রয়েছে। যার ফলে অল্পতেই হতাশ হয়ে যাই। আপনি-আমি চন্দন দা’র থেকে অনেক ভালো অবস্থায় আছি। উনি পারলে আমরাও পারবো। মানুষ চাইলে পারে না- এমন কিছুই নেই!

সেই চন্দন এখন ব্যাংক কর্মকর্তা
১৯৮৬ সালে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বড়গাঁও ইউনিয়নের কদম রসুল গ্রামে অন্যান্য সব সাধারণ শিশুদের মতোই ভালো ভাবেই জন্ম হয় চন্দন কুমার বণিকের। জন্মের ৩ বছর বয়সে হাঁটতে হাঁটতে পড়ে গিয়ে তার পায়ের হাড় ভেঙে যায়। তার বাবা রোহিনী চন্দ্র বণিক অনেক ডাক্তার ও কবিরাজ দেখান তাতেও চন্দনের পায়ের হাড় জোড়া লাগাতে পারেনি কেউ।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, জন্মের ৩ বছর বয়সে হাঁটতে হাঁটতে পড়ে গিয়ে পায়ের হাড় ভেঙে যাওয়ার পর তৎকালীন ঠাকুরগাও সদর হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার ওমর আলীর কাছে নিয়ে যান এবং তিনি চিকিৎসার শুরুতেই জানান, চন্দন পোলিও রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তার শরীরের হাড় খুব নরম। একবার ভাঙলে সেটি জোড়া লাগানো অসম্ভব। পরে চন্দনের বাবা তাকে চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজের তৎকালীন ডাক্তার পার্থ সারর্থীর কাছে নিয়ে গেলে তিনিও একই কথা বলেন।

সর্বশেষ চন্দনের বাবা একমাত্র ছেলেকে ভালো করার জন্য এলাকার নানান রকম মাহাত-মুন্সি, তাবিজ-কোবজসহ নানা রকম কুসংস্কারপন্থি কাজ করেন। চন্দনের দুই বোন। তারা অবশ্য স্বাভাবিক। চন্দনের বাবা সদর উপজেলার ভুল্লী বাজারে একটি জুয়েলার্সের দোকানে কাজ করেন। অনেক কষ্ট করে তাদের পরিবার চালাতে হতো। চন্দনের পড়ালেখার খরচ জোগাতে পারছিল না তার পরিবার। চন্দন শহরে নিজে প্রাইভেট পড়িয়ে লেখাপড়া চালিয়ে শিক্ষা জীবন শেষ করে আজ কর্মজীবনে সফল হয়েছেন।

প্রাথমিক স্কুল হিসেবে বাড়ির পার্শ্বে কদম রসুল প্রাথমিক স্কুলে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত কেটে যায় তার। পরবর্তীতে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে কদম রসুল উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে ভর্তি হয় সে। সেখান থেকে সাফ্যলের সঙ্গে উর্ত্তীণ হয়ে একাদশ শ্রেণিতে ভুল্লী ডিগ্রি কলেজে ভালো ফলাফলের সঙ্গে উর্ত্তীণ হয়। পরে বাবার ইচ্ছেই ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিষয় নিয়ে অনার্সে ভর্তি হয়। সেখানে অনার্স প্রথম বিভাগে পাশ করে চন্দন। ২০১০ সালে দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে মাস্টার্স করেন।

পড়ালেখা শেষ করে ৩ বার বিভিন্ন ব্যাংকে পরীক্ষায় উর্ত্তীণ না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েন চন্দন কুমার বণিক। অবশেষে ২০১৫ সালের জুন মাসে সোনালী ব্যাংকের অফিসার পদে উর্ত্তীণ হয়েছেন তিনি। অবসান ঘটিয়েছেন প্রতিবন্ধকতার।

চন্দনের শিক্ষা জীবন সম্পর্কে তার গ্রামের বাড়ির কদম রসুল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম জানান, ছোটবেলা থেকে চন্দন খুব মেধাবী ও প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিল। সে প্রতিটি ক্লাশে প্রথমস্থান অধিকার করেছে। সে আজ আমাদের গ্রামের গৌরব। ইচ্ছে থাকলে সফল হওয়া যায় সেটা চন্দন দেখিয়ে দিয়েছে।

ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রধান রফিকুল ইসলাম জানান, সরকারি কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র ছিল চন্দন। তার নিয়মিত কষ্ট করে কলেজে আসা আমাকে অবাক করেছিল। আমি চন্দনকে বলেছিলাম সে একদিন সফল হয়ে কলেজের মান উজ্জ্বল করবে। সে পেরেছে সফলতা অর্জন করতে। চন্দনের মতো প্রতিটি ছেলে যদি নিয়মিত লেখা-পড়া করে তাহলে আমাদের দেশে শিক্ষার হার এগিয়ে যাবে।

চন্দনের সহপাঠী আব্দুল আওয়াল জানান, চন্দন ঠাকুরগাঁও কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সবচেয়ে ভালো ছাত্র ছিল। আমি চন্দনের কাছে হিসাববিজ্ঞানের অঙ্কগুলো বুঝিয়ে নিতাম। আজ সে শিক্ষা জীবন শেষ করে কর্মজীবন শুরু করেছে। সে অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতো জীবন চালিয়ে নিচ্ছে। চন্দনের সংগ্রামী জীবন কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের অবাক করে দিয়েছে।

চন্দনের বাবা রোহিনী চন্দ্র বণিক জানান, আজ আমি একজন সফল বাবা। চন্দনের কলেজে যখন টাকা দিতে পারতাম না বাসায় খুবই কান্না করতাম। তবুও চন্দন হতাশ হয়নি। সে সব সময় আমাকে স্বান্তনা দিত। আর প্রাইভেট পড়িয়ে লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে নিতো। আমার চন্দন এখন সফল। সে ভুল্লী জালালী বানিয়া পাড়া এলাকার গৌরব। তার এই সফলতা আরো অন্যান্য প্রতিবন্ধিদের এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আশা করি।

শারীরিক প্রতিবন্ধী ঠাকুরগাঁও সোনালী ব্যাংকের অফিসার চন্দন কুমার বনিক জানান, নিজেকে আজ সার্থক মনে হচ্ছে এই ভেবে যে এখন আমি একটা ভালো চাকরি করছি। গ্রামে গেলে লোকজন আমাকে দেখতে আসে। পরিবারের লোকজনের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি। এখন ঠাকুরগাঁওয়ে একটি বাড়ি করে বাবা-মাকে শহরে নিয়ে চলে আসবো।

তিনি আরো বলেন, কলেজ জীবনের আমি আব্দুল আওয়াল, আনোয়ার, জাহেদুল ইসলাম, জাহাঙ্গীরসহ কয়েকজন বন্ধুর কথা কখনো ভুলতে পারবো না। আমি হাটতে পারতাম না তারা আমাকে সাইকেলে করে কলেজ ও প্রাইভেটে নিয়ে গেছে। তাদের ওই সহযোগিতার কারণে আমার জীবনের সফলতা সহজ হয়েছে। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধিরা অবহেলিত। শিক্ষার দিক থেকে প্রতিবন্ধিরা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। আমার মতো প্রতিবন্ধিরা যেন শিক্ষিত হতে পারে তাই তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই।

ছবিঃ অফিসে কর্মরত অবস্থায় চন্দন কুমার বনিক

ঠাকুরগাঁও সোনালী ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সামছুল আলম জানান, চন্দন কুমার বনিক ব্যাংকের একজন কর্মঠ অফিসার। তার কাজের মান আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাকে সকল প্রকার সহযোগিতার জন্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তার প্রতিবন্ধকতার জয় আমাদের সমাজের গর্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button