ব্যাংকার

ব্যাংকারদের অলিখিত রেগুলার অফিস টাইম

ওয়াহিদা নাজনিন পিংকিঃ প্রথম রমজান থেকে আমাদের (ব্যাংকারদের) অফিস টাইম সকাল ৯.৩০ টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত। যা অনেক সরকারি অফিসের (সবার না) অলিখিত রেগুলার অফিস টাইমের চেয়ে বেশী। অলিখিত বললাম এই জন্য যে, ৯-৫ টা কাগজে কলমে অফিস টাইম কিন্তু বেশির ভাগ অফিসে বিকাল ৩/৪ টার পরে অনেকেই থাকেন না। তাতে অফিসিয়ালি কোন ঝামেলায় পরতে হয় বলেও মনে হয় না। কিন্তু ব্যাংকারদের বেলায় অলিখিত একটা নিয়ম আছে যে, ব্যাংকে ঢুকার টাইম আছে, বের হওয়ার টাইম নাই, যা আমাদের সম্মানিত অগ্রজরা তৈরি করেছেন মেনেছেন আমাদেরও মানতে হয়।

আমাদের ১০টা মানে ৯.৫৯, ১০.১ নয় এবং আমাদের ৬ টা মানে ৫.৫৯ নয় তা ৭/৮/৯/১০ এমনকি ক্লোজিং এর সময় রাত ১/২/৩ টা। আমরা মেনে নিয়েছি, নিজে সাফার করি, আমাদের জন্য পরিবার বঞ্চিত হয়। আমরা সামাজিকভাবে অসামাজিক হয়ে যাচ্ছি দিন দিন। আর শারিরীক মানসিক চাপের কথা নাই বা বললাম। যার ফলশ্রুতিতে দীর্ঘ সময় বসে থেকে অংকের মত জটিল একটা বিষয় নিয়ে কাজ করার দরুন আমাদের বেশির ভাগ সহকর্মী জয়েন্ট পেইন, ডায়াবেটিস, মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত আর সাম্প্রতিক সময়ে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক জনিত মৃত্যুর ঘটনা ব্যাংকারদের আশংকাজনকভাবে বেড়েই চলেছে।

যাক আসি আসল কথায়, তো সকাল ৯.৩০ টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত অফিস টাইমে আমি যা খেয়াল করলাম, আমি যখন বের হই আমার মনে হয় কতদিন আকাশ দেখি নাই। বাসায় এসে ফ্রেস হয়ে আসরের নামাজটা তৃপ্তি নিয়ে বাসায় পড়ি, তারপর পরিবারের জন্যে ইফতার রেডি করে একসাথে ইফতার, পরে মাগরিবের নামাজটাও বাসায়। যা অফিসের স্বাভাবিক সময়ে ব্যাংকাররা ভাবতেই পারেন না। ছেলেরা যাও মসজিদে দৌড়ের উপরে যায় আর আসে, বেশির ভাগ কাজের ক্ষেত্রে মেয়েরা তাও পারে না। এর ফাকে অফিসে কাজের শারীরিক ক্লান্তিও চলে যায়, সন্ধ্যার পর থেকে নিজেকে সতেজ মনে হয়, পরিবারকে সময় দেয়া যাচ্ছে, বাচ্চাদের পড়ানো যাচ্ছে, মার্কেটে যাওয়া যাচ্ছে, আহা কত সময়। চাকরিটা বার্ডেন মনে হচ্ছে না।

কিন্তু এই যে সময় কমিয়ে দেয়া হল এজন্য ব্যাংকের একজন গ্রাহকও বলতে পারবে না আমি টাকা জমা দিতে পারি নাই, একাউন্ট খুলতে পারি নাই, এফডিআর করতে পারি নাই, পেনশন নিতে পারি নাই, স্যালারি উঠাতে পারি নাই, লোন নিতে পারি নাই, সকল কাজ নিজের গতিতে শেষ হয়েছে, হয়ত সেই বিকাল ৪ টার জায়গায় আমরা ৪.৩০/ ৫/৫.৩০ টায় এ কাজ শেষ করে বের হয়েছি। যেদিন যখন শেষ হয়েছে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

তাহলে এই সময় টাই কেন আমাদের নিয়মিত ওয়ার্কিং আওয়ার করা যায় না? এত দীর্ঘ টাইম কিলিং জব বোধ হয় বাংলাদেশে আর একটাও নেই যে একটা চেয়ারে বিরতি বিহীন ১০/১২ ঘন্টা কাজ করার। একে তো পাব্লিক ফাংশান তার উপর অংকের মত জটিল বিষয়/ টাকার মত সেন্সেটিভ বিষয় নিয়ে ১০/১২ ঘন্টা কাজ প্রতিদিন করা যায়? না যায় না, আমরা খুব কষ্ট নিয়ে কাজ করি, আমরা রাত ৭/৮/৯ টায় বাসায় ফিরে নিজে রেস্ট নিব? না বউ/ স্বামী, বাচ্চাকে সময় দিব, বাচ্চার পড়াশুনার খোজ নিব, না সংসারের খেয়াল করব, না বাবা মায়ের খেয়াল করব? আমরা কিছুই পারি না। শুধু রাতে একটু ঘুম দিয়ে পরের দিন অফিসের জন্য তৈরি হই। নানা টেনশান প্রেশার নিয়ে, নিজেকে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত করে শুধু দিন পার করি, এটার নাম জীবন নয়।

আসুন কিছু জব নেচার এক নজরে দেখি
১. সরকারী কলেজে যারা জব করেন কলেজে জরুরি কোন কাজ না থাকলে শুধু ক্লাস টাইম, পরিক্ষার হল ডিউটি। যাওয়া আসার কোন বাধা বাধ্যবাধকতা নেই।
২. মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিফটিং ৬ ঘন্টা করে, ক্লাস টাইম না থাকলে রেস্ট।
৩. প্রাথমিক বিদ্যালয় সবচেয়ে এগিয়ে কিছু হলেই আন্দোলন। আম কাঠালের বন্ধ, শীতের পিঠার বন্ধ, রোজার বন্ধ, পূজার বন্ধ, আর সারা বছর বিভিন্ন বন্ধ তো লেগেই আছে। যেখানে আমাদের ৩/৪ দিনের একসাথে ছুটি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
৪. মেডিকেল প্রফেশানে যারা আছেন ৬ ঘন্টা শিফটিং, নাইট করলে ডে অফ, সাপ্তাহিক ছুটি এর বাইরে। আরো অনেক আছে। (এখানে স্বাভাবিক ওয়ার্কিং আওয়ারের কথা বলা হয়েছে, বিশেষ পরিস্থিতি নয়)

আমরা তো খুব-ই গুরুত্বপূর্ণ একটা সেক্টরে কাজ করি যা কোন ভাবেই অন্য কোন প্রফেশন থেকে কোন ভাবেই অবহেলা করার মত নয়। আসুন আমরা আমাদের ব্যাপারে সচেতন হই, তাদের এসোসিয়েশন যেভাবে তাদের স্বার্থটা দেখে আমার আমাদের সেই ভাবে আগলে রাখি। ছোট্ট কয়েকটা উদ্যোগ হয়ত এই কষ্টদায়ক, দীর্ঘ ক্লান্তিময় কাজ থেকে স্বাভাবিক জীবন যাপনে সহায়ক হতে পারে।
১. ওয়ার্কিং আওয়ার ৯.৩০ টা থেকে ৪ টা করা, লেনদেন ৩ টা পর্যন্ত।
২. সঠিক জনবল সকল শাখায় নিশ্চিত করা। যে সকল অঞ্চলে জনবল ঘাটতি আছে প্রয়োজনে অঞ্চল ভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে পোস্টিং সহজিকরণ করা।
৩. ওয়ার্কিং আওয়ারের মধ্যে সকল কাজ শেষ করতে বাধ্য করা।

আজকালকার যৌথ পরিবার ভেংগে একক পরিবারের যুগে সময় কতটা মুল্যবান তা আমরা সকলেই জানি। সব কিছু একা হাতে সামলানো অনেক কঠিন আর তার মাঝে যদি সময় না থাকে তা হলে তা আরো কঠিন। কর্মে উদ্দিপনা আনয়নে মানসিক, শারীরিক ও পারিবারিকভাবে ভাল থাকা খুব জরুরি। যেখানে সময় একটা বড় ফ্যাক্ট।

আরও দেখুন:
ব্যাংকারদের লেন‌দেন সময় ও টা‌র্গেট ক‌মা‌নো উচিত

তাই যারা আমরা বিভিন্ন সরকারী ব্যাংকে আছি সকল ব্যাংকের জন্য এই দাবীগুলি এক ও অভিন্ন। আমি বিশ্বাস করি, আমরা যদি এক হয়ে নিজেরা নিজেদের পিছনে না লেগে, একটা জায়গা থেকে কাজ করি নিজেদের জীবনটা আরো সুন্দর হয়ে উঠবে এটা আমার বিশ্বাস।

আশা রাখছি, যারা বিভিন্ন সংঘটনের নেতৃত্বে আছেন তারা বিষয়টি ভেবে দেখবেন। টার্গেট, আদায়, বিতরন কোন কিছুর-ই ব্যাঘাত হবে না, আগে যখন ব্যাংকে ১টা পর্যন্ত দেনদেন ছিল তখন ব্যাংক চলেছে এখনো চলছে, ভবিষ্যতেও চলবে। আসুন নিজেরা নিজেদের ব্যাপারে সচেতন হই।

লেখকঃ ওয়াহিদা নাজনিন পিংকি, ব্যাংকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button