বিশেষ কলাম

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও চলমান বিশ্বব্যবস্থা-২

নূরুল ইসলাম খলিফাঃ চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও চলমান বিশ্বব্যবস্থা-২: যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া ওয়েসলিবান কলেজের বিভাগীয় প্রধান ড. অ্যালেইন গ্যাবন ‘মিডলইস্ট আই’-এ এক নিবন্ধে এই বিষয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। গত ২০ জুলাই ২০১৯ নয়া দিগন্তে নিবন্ধটি ‘মুরসির মৃত্যু ও পাশ্চাত্যের প্রতারণা’ শিরোনামে বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘রাজনৈতিক ইসলামের ওপর বিশেষভাবে গবেষণায় নিয়োজিত দুই গবেষক শাদি হামিদ এবং মেরিদিত হুইলার ‘দি আটলান্টিক’-এর জন্য তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধে বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরেছেন। মুরসির এক বছর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনকালে তিনি মিসরের গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ন অংশীদার ছিলেন এবং তার কর্মকাণ্ড সে উদ্দেশ্যে ছিল নিবেদিত। স্বৈরতন্ত্র এবং গণতন্ত্র পরিমাপের জন্য অত্যন্ত ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত অন্যতম বাস্তবসম্মত পদ্ধতি দ্য পলিসি লাইন ইনডেক্স ব্যবহার করে হামিদ এবং হুইলার দেখান যে, গণতান্ত্রিক শর্তাবলি অনুযায়ী যদিও মিসরের ওই সময়ের পরিবেশে সেটি পালন করা সত্যিকারভাবে অসম্ভব ছিল, তবু মুরসির অপূর্ণাঙ্গ বা অকালপক্ব প্রশাসন এর আগের প্রশাসনের চেয়ে অনেক ভালো ছিল এবং পরে পশ্চিমা জগৎসমর্থিত সিসির ফ্যাসিবাদী, সর্বাত্মকবাদী, স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের তুলনায় উত্তম ছিল।’

‘সিসি মিসরের হাজার হাজার নির্দোষ নাগরিকের লাশ নিয়ে যে পাশবিক উল্লাস প্রকাশ করেছিলেন এবং পশ্চিমাদের সাথে যে লজ্জাজনক বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন, তারই কথা আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে মুরসির মৃত্যু। এ ঘটনা অবশ্যই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, তথাকথিত ‘সেকুলার, উদার গণতান্ত্রিক’ সরকারগুলো নির্যাতন, নৃশংসতা ও সিসি সরকারের গণহত্যায় পরিপূর্ণভাবে সহায়তা করেছে। তাদের নতুন আরব ‘লৌহমানব’ বিরোধী দলের হাজার হাজার রাজনৈতিক-কর্মীকে কারারুদ্ধ করে মিসরীয়দের ধ্বংস করে দিচ্ছে। পুরোটা সময় পশ্চিমা দেশগুলো এই স্বৈরাচারী সরকারকে সক্রিয়ভাবে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে গেছে। …মুরসির মৃত্যু আবার প্রমাণ করেছে যে, যখনই এই অঞ্চলে গণতন্ত্র হত্যার ঘটনা ঘটেছে, তখনই ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সরকার মধ্যপ্রাচ্যে ফ্যাসিবাদী সরকারগুলোর সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। ‘স্বাধীনতা ও মানবাধিকার’ নিয়ে অবিরাম বক্তব্যে কেবল শত্রুতা ও ভণ্ডামিরই প্রকাশ ঘটেছে।’ (নয়া দিগন্ত: ২০ জুলাই ’১৯)

আরও দেখুন:
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও চলমান বিশ্বব্যবস্থা-১

আমরা দেখছি, পৃথিবীর সর্বত্রই উদারতা, সহনশীলতার মতো মানবিক বোধ ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে এবং তার বিপরীতে এক ধরনের অসহিষ্ণুতা, উগ্রতা এবং মানুষে মানুষে বিভেদ বিভাজনের ভয়ঙ্কর ছোবল সভ্যতাকে গ্রাস করছে আশঙ্কাজনকভাবে। ভারত সারা বিশ্বে গণতান্ত্রিক উদারতার একটা মোটামোটি দৃষ্টান্ত ছিল। অন্তত তাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেমনÑ নির্বাচন কমিশন, বিচারবিভাগ এগুলো বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী তার পদত্যাগপত্রে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন তা বিশেষভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রিয়াজ গত ৭ জুলাই ২০১৯ দৈনিক প্রথম আলোতে ‘রাহুলের চিঠি: নতুন রাজনীতির খোঁজ’ শীর্ষক এক দীর্ঘ নিবন্ধে কিছুটা আলোকপাত করেছেন।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘রাহুল গান্ধী লিখেছেন, আরএসএসের যে ব্যক্ত উদ্দেশ্য ছিল আমাদের দেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে জবরদখল করা, তা এখন ষোলোকলায় পূর্ণ হয়েছে। আমাদের গণতন্ত্র মৌলিকভাবে দুর্বল হয়েছে। আসল বিপদের কথা হলো, ভারতের আগামী নির্বাচনগুলো দেশটির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের উপায় না হয়ে কেবল নিয়ম রক্ষার উপায়ে পরিণত হতে যাচ্ছে।’ কর্তৃত্ববাদী শাসনের এগুলো কেবল লক্ষণ নয়, তার প্রাণবস্তু। জনতুষ্টিবাদী কর্তৃত্ববাদের প্রধান কাজ হচ্ছে সব প্রতিষ্ঠানকে তার অধীন করা, আদর্শের বাতাবরণে এই কাজকে বৈধতা দেয়া। যে কারণে এই ধরনের ক্ষমতার বিন্যাসকে কেবল সরকার বলে বিবেচনা না করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এদের বলা হয় ‘রেজিম’ যা প্রচলিত সরকারের চেয়ে বেশি স্থায়ী ও প্রভাবশালী, কিন্তু রাষ্ট্রের চেয়ে কম স্থায়ী। এই ধরনের শাসন কেবল শাসন করে না, এগুলো সমাজের ক্ষমতা কাঠামো ও সংস্কৃতিকে বদলে দেয়। ভারতে বিজেপি সরকারকে, বিশেষ করে ২০১৯ সালের বিজয়ের পর, সেভাবেই বিবেচনা করা দরকার। এর উদাহরণ আরো আছে, এই অঞ্চলে এবং এর বাইরে।’

আমাদের বক্তব্য হচ্ছে- এভাবে দেশে দেশে ‘রেজিম’ প্রতিষ্ঠিত হয়ে সারা দুনিয়ার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোটাই ক্রমান্বয়ে বদলে যাচ্ছে যেখানে মানুষ ও মানবিকতা উপেক্ষিত হচ্ছে; গোষ্ঠী, বর্ণ এবং সম্প্রদায় বিশেষ প্রাধান্য পাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে যেকোনো উন্নয়নের সুফল থেকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হতে বাধ্য।

২০১৯ সালের মার্চে নিউজিল্যান্ডের মসজিদে একজন শ্বেতাঙ্গ যুবকের হামলায় নিহত হন পঞ্চাশের অধিক নিরীহ মুসলিম যাদের ‘অপরাধ’ ছিল শুধু মুসলিম এবং অশ্বেতাঙ্গ হওয়া। এটি কি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা? এ বিষয়ে ’শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের চাবুকের আরেক ঘা’ শিরোনামে নর্থ আলবামা ইউনিভার্সিটির কমিউনিকেশন্স বিভাগের ফ্যাকাল্টি মেম্বার মোহাম্মদ আল মাসরির একটি প্রবন্ধের অনুবাদ প্রকাশ করেছে দৈনিক প্রথম আলো ১৭ মার্চ, ২০১৯। প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, ‘একটি সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে যত সন্ত্রাসী হামলা হয় তার দুই-তৃতীয়াংশ হামলা চালায় উগ্র শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ব্যক্তি বা গ্রুপগুলো। সাউদার্ন পোভার্টিল সেন্টারের গবেষণা বলছে, কট্টর দক্ষিণপন্থীদের সহিংসতার সাথে সন্দেহাতীতভাবে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের যোগসূত্র রয়েছে।

সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুগ যুগ ধরে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবিরোধী কৌশলপত্রে কট্টর ডানপন্থীদের উত্থানকে উপেক্ষা করা হয়েছে।’ ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, এর সাথে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের যোগসূত্র রয়েছে।’ আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকায় সাদা-কালো বৈষম্য না থাকার বিধান থাকার পরও দেখা যায়, ঋণ কিংবা চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে অশ্বেতাঙ্গদের বেশি বেগ পেতে হয়। নিউজিল্যান্ড মসজিদের মধ্যে যে গণহত্যা হলো, তা থেকে আন্দাজ করা যায়, পশ্চিমা সমাজের শ্বেতাঙ্গবাদীরা মুসলিম এবং অভিবাসন পাওয়া তামাটে চামড়ার মানুষকে পুরোপুরি মানুষ মনে করে না।’ নিবন্ধটির উপসংহারে তিনি বলেছেন, ‘রাজনৈতিক মহল ও মিডিয়াÑ এই দুই শক্তি মূলত পশ্চিমা সমাজে মুসলিম, অশ্বেতাঙ্গ, অভিবাসী এবং অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের নেতিবাচকভাবে তুলে ধরে। আজকে যে লোকটি গুলি করে এতগুলো মানুষ মেরে ফেলেছে, সে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেননি। তাকে তার সমাজ অশ্বেতাঙ্গদের বিষয়ে যে ধারণা দিয়েছে; সেই ধারণা থেকেই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। এর থেকে মুক্তি পেতে ওই অশুভ শ্রেষ্ঠত্ববাদের ধারণাকে বদলাতে হবে।’

বিষয়টি থেকে পরিষ্কার যে, বর্ণবাদের বিষাক্ত ধারণা থেকে, সভ্যতা এবং মানবতার দাবিদার পশ্চিম একবিংশ শতাব্দীর এই দিনেও বের হয়ে আসতে পারেনি বরং দিনে দিনে তা আরো বিস্তার লাভ করেছে। এ অবস্থায় পশ্চিমের নেতৃত্বে যে বিশ্বব্যবস্থা আজ চালু আছে, এখানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে যে সুখ ও সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে, সে সুখের জোয়ার কোন পর্যন্ত পৌঁছবে তা আন্দাজ করা কি খুব কঠিন? বর্তমান বিশ্বেই তো আমরা দেখতে পাচ্ছি একদিকে প্রাচুর্যের বন্যা, আর অন্যদিকে সাব-সাহারান অঞ্চলের মনুষ্য শিশুদের কঙ্কালসার চেহারা। সুতরাং এই বিশ্ব ব্যবস্থায় চতুর্থ নয়, পঞ্চম শিল্পবিপ্লব হলেও তা বিশ্বের ধনিক শ্রেণীর কাছেই আশীর্বাদ হিসেবে পৌঁছবে; বঞ্ছিত মানবতা সেখানে উপেক্ষিতই থেকে যাবে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপের উল্লেখ করে নয়া দিগন্তে একটি সংবাদে বলা হয়েছে, ‘৮২ ভাগ মার্কিনি মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানরা বেশি বৈষম্যের শিকার। আর ৮০ ভাগ বলেছেন, কৃষ্ণাঙ্গরাও কিছুটা বৈষম্যের শিকার।’

আধুনিক বিশ্বে সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ। ফোর্থ স্টেট নামে কথিত এই সংবাদমাধ্যমে মানুষ দেশ, সমাজ ও সভ্যতার অনেক অজানা বিষয় জানতে পারে। সংবাদমাধ্যম সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের জন্য জনমত গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং কোনো বিষয়ে জনমত গঠিত হলে রাষ্ট্রের কর্ণআরো তার প্রতি গুরুত্ব দিতে এবং নিজেদের স্বেচ্ছাচারী আচরণ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। এমন অসংখ্য উদাহরণ বিশ্বে আছে। এ কারণেই স্বৈরশাসকরা কথা বলার স্বাধীনতা তথা সংবাদমাধ্যমকে দারুণ ভয় পায় এবং সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে। গণতান্ত্রিক আদর্শে সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকরা তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু বর্তমান বিশ্বে এই সংবাদমাধ্যমও করপোরেটদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। ফলে গোষ্ঠীবিশেষের স্বার্থ রক্ষার্থে সংবাদমাধ্যমগুলো তিলকে তাল করে আড়ালে যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে বিপর্যস্ত করে পৃথিবী, লাখ লাখ মানুষের রক্তে ভিজে যায় জমিন। নিকট অতীতে ইরাকের বিরুদ্ধে একটি অযৌক্তিক যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে পশ্চিমা বিশ্ব আমেরিকার নেতৃত্বে যে মিথ্যাচার চালিয়েছে, মিডিয়া সে আগুনে ঘি ঢেলেছে যা সভ্য মানুষের জন্য অত্যন্ত লজ্জাকর। কিন্তু অর্থ ও বিত্তের কাছে আত্মবিক্রীত মিডিয়ার মানুষগুলো কর্পোরেটদের অ্যাজেন্টের ভূমিকা পালন করেছে। লাখ লাখ বনি আদমের রক্তে সিক্ত হয়েছে মরুর বালু; কোটি মানুষ হয়েছে সর্বহারা। অথচ মিডিয়া ন্যায়সঙ্গত ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করলে এই অন্যায় যুদ্ধ হয়তো প্রতিরোধ করা যেত; কমপক্ষে এর ব্যাপকতা এড়ানো যেত।

কিন্তু গণতন্ত্রের এ গুরুত্বপূর্ণ পিলারটিও তার স্বকীয়তা হারিয়ে ধনিক ও বর্ণবাদী গোষ্ঠীর হাতের পুতুল হয়েছে। কলকাতার সাংবাদিক শান্তনু দে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা নিয়ে তার এক লেখায় বিষয়টি বিশ্লেষণ করে মন্তব্য করেছেন, ‘কয়েক দিন আগেও সংবাদমাধ্যমকে দেখা হতো ‘গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ’ হিসেবে। কোথায় ফোর্থ এস্টেট? এত রিয়েল এস্টেট। আগে রিপোর্টারদের ছিল আলাদা মর্যাদা। এখন কোথায় রিপোর্টার? প্রায় সবই তো স্টেনোগ্রাফার। আগে সংবাদমাধ্যম ছিল ওয়াচডগের ভূমিকায়। এখন কোথায় ওয়াচডগ? সংবাদমাধ্যম এখন ল্যাপডগের ভূমিকায়।’ (দৈনিক প্রথম আলো: ৪ মার্চ ২০১৯)। তার এই মন্তব্য বর্তমান বিশ্বে সংবাদমাধ্যমের প্রকৃত চিত্রই প্রকাশ পেয়েছে। এভাবেই পুরো বিশ্ব এখন একটি বিভাজিত বিশ্বে পরিণত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক দেশগুলো পুরো বিশ্বের সম্পদ দখল করতে চায়Ñ এ বিষয়টি দুনিয়ার সবার কাছে পরিষ্কার। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফকে তারা ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে এবং যারা তাদের কথা শুনবে না তাদের ‘শাস্তি’ দেয়ার বিষয় ওপেন সিক্রেট। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে বিশেষ করে স্নুায়ুযুদ্ধের সময়ে তারা যাকে শাস্তি দিতে চেয়েছে তাদেরকে ‘কমিউনিস্ট’ আখ্যা দিয়েছে; বর্তমানে ‘ইসলামী জঙ্গি’ বানানোর একটা খেলা চলছে। তুরস্কের দৈনিক ইয়েনিশাফাকে ইব্রাহীম কারাওলি একটি নিবন্ধে বলেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদকে একটি রক্তক্ষয়ী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এটি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে খাওয়ায় এবং জন্ম দেয়, তাদের অস্ত্র দেয় আর অন্য দেশকে আক্রমণ করার জন্য তাদের ব্যবহার করে। তারপর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচারণা শুরু করে। আর ঘোষণা করে- তাদের অধীনে যারা থাকবে না সেসব দেশ সন্ত্রাসের পক্ষে।’ তিনি বলেছেন, ‘যেসব দেশ তাদের সম্পদ শোষণ লুণ্ঠন করতে দেয় না এমন দেশগুলোকে ল্যাবেল দেয় ‘ব্যান্ডিট স্টেটস।’ আমরা এটা পরিষ্কার বুঝতে পারি, বর্তমানে আরব বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পলিসি এবং ইরান, তুরস্ক কিংবা ভেনিজুয়েলার সাথে তাদের আচরণ দেখে।

বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকারের বুলি উচ্চারিত হয় মানবাধিকার দলনের লক্ষ্যে। এখানে দারিদ্র্য দূরীকরণের স্লোগান দেয়া হয় দারিদ্র্য চাষের লক্ষ্যে। সম্পদের সুষম বণ্টনের কথা বলা হয় এক শতাংশ মানুষের হাতে ৯৯ শতাংশ সম্পদ কেন্দ্রীভূত করার জন্য। অসংখ্য স্ববিরোধিতায় ভরা একুশ শতকের এই পৃথিবীটা। তদুপরি এখানে বিদ্যুৎবাতির ঝলকের নিচে ঘন অন্ধকার। এই বিশ্বে চতুর্থ বা পঞ্চম যেকোনো শিল্পবিপ্লবই আসুক না কেন, বৃহত্তর মানবতা বঞ্চিতই থাকবে; থাকতে বাধ্য। প্রযুক্তির উন্নয়ন থেমে থাকবে না। অতএব, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আসবেই। কিন্তু আমাদের কথা হচ্ছে এমন একটি সম্ভাবনাকে যদি সমস্ত পৃথিবীর মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা যায়, তাহলে পৃথিবীটা আলোয় আলোয় হেসে উঠতে পারে। কাজেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে একটি মানবিক ও শান্তিময় পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানবিক নেতৃত্ব।

‘মানবিক নেতৃত্ব’ বলতে আমরা বোঝাতে চেয়েছি, রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে যারা নেতৃত্ব দিয়ে সভ্যতাকে এগিয়ে নিচ্ছেন, তাদের কয়েকটি মৌলিক নীতি অনুসরণ করার মতো উদার হতে হবে। যেমন- পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই এক স্রষ্টার সৃষ্টি। বর্ণ, ভাষা, লিঙ্গ বা গোত্রের নিরিখে তাদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করার কোনো সুযোগ নেই। সবাই সমান। আফ্রিকার একটি নিগ্রো শিশু, ফিলিস্তিনের একটি শিশু এবং ওয়াশিংটন কী তেলআবিবে জন্ম নেয়া একটি সাদা বর্ণের শিশুকে সমমর্যাদার মনে করতে হবে। মানুষের মর্যাদা নিরূপিত হবে তার কর্ম ও চরিত্রের দ্বারা; ভাষা, বর্ণ, লিঙ্গ বা গোত্র দ্বারা নয়। কেননা এর কোনটার জন্যই মানুষ নিজে দায়ী নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও এসব বিষয়ের ভিত্তিতে কোনো তারতম্য করা যাবে না। অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে শুধু অপরাধকেই বিবেচনায় নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বংশ, গোত্র, কিংবা ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি বা আত্মীয়তাকে বিবেচনায় নেয়া একটি বড় ধরনের নৈতিক অপরাধ, যা সমাজ দেহে মারাত্মক ক্ষত সৃষ্টি করে। মানুষের বোধ, বিশ্বাস ও চিন্তার স্বাধীনতাকে সম্মান করতে হবে। ধর্মীয় বিশ্বাস লালন মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি যা মানুষের ইতিহাসের মতোই পুরনো। এই বিশ্বাস লালনের ক্ষেত্রে জবরদস্তি প্রয়োগ করা মানবাধিকারের পরিপন্থী। শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে মানুষের ওপর জুলুম নির্যাতন, দেশ ছাড়া করার মতো নিষ্ঠুরতাকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে।

এক কথায় গোটা পৃথিবীকে স্রষ্টার একটি পরিবার হিসেবে বিবেচনা করার মতো উদারতা প্রদর্শন করতে হবে এবং রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনায় নিজেদের সব কর্মকাণ্ডের বিষয়ে নিজেদের বিবেক, জনগণ ও সর্বোপরি স্রষ্টার কাছে জবাবদিহির মানসিকতাসম্পন্ন হতে হবে। উল্লিখিত মৌলনীতিগুলো বিশ্বস্রষ্টা প্রদত্ত এবং এগুলো নিয়েই পৃথিবীতে নবী-রাসূলরা এসেছিলেন। এসব নীতিমালা বাস্তবায়নে তাঁরা তাদের সবটুকু মেধা-যোগ্যতা উজাড় করে দিয়েছেন।

প্রখ্যাত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ও দার্শনিক আর্নল্ড জে টোয়েনবি তার সাড়া জাগানো গ্রন্থ ঈরারষরুধঃরড়হ ড়হ ঞৎরধষ এর ওংষধস, ঃযব ডবংঃ ্ ঃযব ঋঁঃঁৎব অধ্যায়ে পশ্চিমা সভ্যতার ধ্বংসাত্মক উপসর্গ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বর্ণবাদ ও অ্যালকোহল বা মাদক। তিনি এর নিরাময় ও প্রতিষেধক হিসেবে ইসলামের মূল্যবোধ চর্চার কথা এবং এ বিষয়ে ইসলামের সফলতার কথা উল্লেখ করেছেন। বিদ্বেষমুক্ত মন নিয়ে দেখলে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, শুধু এই দুটো নয়; আজকের পৃথিবীর মারাত্মক সব সমস্যার সমাধানই ইসলামের মধ্যে আছে। ইসলাম কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর বা সম্প্রদায়ের ধর্ম নয়,এটি গোটা বিশ্বের মানুষের জন্য। এটি স্রষ্টা প্রদত্ত মৌলনীতিমালা যা নিয়ে নবী-রাসূলরা এসেছিলেন, সেই শিক্ষার সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ যা বর্ণ, ভাষা ও দেশ কালের ঊর্ধ্বে গোটা মানবজাতির জন্য মহৌষধ।

একটি বঞ্চনামুক্ত, সাম্য ও সমতাভিত্তিক মানবিক পৃথিবী গড়তে তাই এই নীতিমালাকেই আঁকড়ে ধরতে হবে বিশ্বকে। এ সত্য যত তাড়াতাড়ি আজকের সভ্যতাগর্বী বিশ্ব নেতৃত্ব বুঝবেন, ততই মঙ্গল ও কল্যাণ। তাহলেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবসহ সব নব নব আবিষ্কার সফল হবে। সমৃদ্ধির সাথে সুখ ও সম্প্রীতির ছোঁয়ায় ভরে উঠবে আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী।

লেখকঃ নূরুল ইসলাম খলিফা, সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ও সাবেক প্রিন্সিপাল, ট্রেইনিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button