বানিজ্যিক ব্যাংক পরিচালনায় সফলতা ও বিচ্যুতি
জিএম সরওয়ার বিশ্বাসঃ এ কথা আজ সর্বজন স্বীকৃত যে, সফল ও প্রগতিশীল ব্যাংকিং ব্যাবস্থা একটি দেশের তথা গোটা বিশ্বের উন্নয়নের মূল মন্ত্র বা চালিকাশক্তি। যে দেশের ব্যাংকিং ব্যাবস্থা যত উন্নত, সে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো তত মজবুত এবং জাতীয় উন্নতি সফলতার উচ্চ শিখরে। এই ব্যংকিং ধারার সাথে যুক্ত আছে সমাজের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ। গতিশীল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড একমাত্র সুষ্ঠু ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই সম্ভব।
এই ব্যাংকিং ধারাকে টিকিয়ে রাখতে সারা বিশ্বে বিভিন্ন প্রকারের ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়। যেমনঃ
– বাণিজ্যিক ব্যাংক
– বিনিয়োগ ব্যাংক
– মার্চেন্ট ব্যাংক
– বিশেষায়িত ব্যাংক
– সমবায় ব্যাংক
– সমবায় ভূমি উন্নয়ন ব্যাংক
– প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক
– কমিউনিটি উন্নয়ন ব্যাংক
– কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক
– শিল্প উন্নয়ন ব্যাংক
– ইসলামী ব্যাংক
– অফশোর ব্যাংক।
এ ছাড়াও আরো এক প্রকার ব্যাংক দেখা যায় সেটি হলো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই ব্যাংকটি হলো সকল ব্যাংকের মোড়ল ব্যাংক। একটি দেশের অভ্যান্তরে যত ব্যাংকই থাকুক না কেন সব ব্যাংকের মনিটরিংয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া যত ব্যাংক আছে সকল ব্যাংকের মূল উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন করা অর্থাৎ বানিজ্যিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংক।
এই সকল ব্যাংক পরিচালনার জন্য প্রয়োজন সঠিক ও মজবুত নীতিমালা। এই সকল নীতিমালা এবং আইন প্রণয়নের দায়িত্বে নিয়জিত রয়েছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সাধারণতঃ ধরে নেয়া হয়, যে ব্যাংক যত মুনাফা অর্জন করতে পারে সে ব্যাংক তত ভালো, আসলে ব্যাপারটি মোটেও তা নয়। মুনাফা অর্জন লক্ষ্য হলেও একটি ভালো ব্যাংকের অনেকগুলি প্যারামিটারে যুক্ত থাকতে হয়। যেমনঃ
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
১। সামঞ্জস্যপুর্ণ আমানত
২। কোয়ালিটি বিনিয়োগ
৩। দক্ষ ও সৎ কর্মী বাহিনী
৪। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
৫। আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বানিজ্যে গৃহীত চুক্তি সম্পাদনের সক্ষমতা
৬। আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার
৭। দায় পরিশোধের যোগ্যতা
৮। হিসাবের সচ্চতা
৯। রিজার্ভ
১০। সামাজিক কার্যক্রম।
এই সকল মাপকাঠিতে যে সব ব্যাংক শতভাগ কার্যক্রম চালাতে সক্ষম অবশ্যই ধরে নেয়া যায় ঐ ব্যাংকগুলি তাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। যে সকল অনিয়ম ও বিচ্যুতিগুলি থাকার কারণে কোন ব্যাংক তার সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারে না, সে ব্যাপারে symbolic আলোচনার চেষ্টা করছি।
১। ত্রুটিপূর্ণ ব্যাবস্থাপনাঃ
ব্যাংক পরিচালনায় যারা অংশ গ্রহন করবেন, তাদেরকে অবশ্যই সৎ ও যোগ্য হতে হবে। শুধু যোগ্যতার বিচারে ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্ব দিলে অনেকটা তলাবিহীন ঝুরির মত অবস্থা দেখা দেবে। তাই যোগ্য হওয়ার সাথে সাথে অবশ্যই তাকে সৎ হতে হবে।
২। রাজনৈতিক প্রভাবঃ
ব্যাংক একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। দেশের অর্থনীতির চাঁকা সচল রাখার একমাত্র মাধ্যম এটি। এর নিজস্ব গতি ধারায় ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ দিতে হবে। এখানে রাজনৈতিক অসমুচিত প্রভাব খাটালে সাধারণ কার্যক্রম ব্যহত হবে। ফলে সফলতায় ঘটবে বিপত্তি তবে কেন্দ্রীয় ও উচ্চ শিখরে অবস্থানরত পর্ষদের নিয়োগ বানিজ্যের ফলে অযোগ্য কর্মী বাহিনী ব্যাংক অভ্যান্তরে প্রবেশ করেন। ফলে তাদের আচরণে ব্যাংক জনগনের আস্থা হারায়।
৪। অযৌতিক ও অপর্যাপ্ত বেতন কাঠামোঃ
মনে রাখতে হবে, একটি ব্যাংকের সম্মূখ যোদ্ধা হল তার কর্মী বাহিনী। দিনের অধিকাংশ সময় তাদেরকে ব্যাংকে ব্যয় করতে হয়। ব্যাংকের বাহিরে কোন কার্যক্রম পরিচালনা করা একজন কর্মীর পক্ষে সম্ভব নয়। এমনকি পরিবার পরিচালনার ক্ষেত্রেও ব্যাংক কর্মীকে হিমসিম খেতে হয়। এ জন্য তার আর্থিক দৈনতায় যাতে না পড়তে হয় সে দিকে খেয়াল রেখে বেতন কাঠামো তৈরী করতে হবে। যে ব্যাংকের বেতন কাঠামো যত মজবুত সে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি তত মজবুত।
৫। প্রেষণা দানে অনীহাঃ
কর্মীদের কর্মস্পৃহা ও মনোবল ধরে রাখার জন্য তাদেরকে প্রেষণা দেয়া একটি মোক্ষম হাতিয়ার। এ গুলির মধ্যে-
(ক) প্রোমশন
(খ) ইনসেনটিভ বোনাস
(গ) রিওয়ার্ড
(ঘ) স্পোর্টস ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
(ঙ) দেশিয় ও আন্তর্জালিক ফোরামে অংশগ্রহণ
(চ) কর্মের স্বীকৃতি স্বরুপ সনদ প্রদান ইত্যাদি উল্লেখ করা যায়।
এ গুলির মধ্যে পদোন্নতির বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সহিত বিবেচনা করা উচিত কেননা পদোন্নতি একজন কর্মীর সম্মান বৃদ্ধি করে এবং অধিক মাত্রায় মনোবল বাড়িয়ে তোলে। পদোন্নতি দেয়ার ক্ষেত্রে একটি বিষয় গুরুত্বের সাথে খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে, সম গোত্রীয় জুনিয়রকে যেন সিনিয়র করা না হয় তাতে আভ্যন্তরীণ অসন্তোষ বৃদ্ধি পায় এবং প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতি বাঁধাগ্রস্থ হয়। এ ছাড়া উপর্যুক্ত সকল ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের প্রতক্ষ নজরদারিতে রাখা উচিৎ নতুবা সার্বিক কার্যক্রম ব্যহত হবে।
৬। কোন ব্যাক্তি ও গোষ্ঠীর একক নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক পরিচালনাঃ
এই সব ক্ষেত্রে প্রায়শঃ দেখা যায়, ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অযোগ্য লোক বসিয়ে স্বাভাবিক ক্রমোন্নতিকে বাঁধাগ্রস্থ করছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন ব্যক্তি বা এলাকার প্রাধান্য পাচ্ছে। কোন নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। ফলে যোগ্যতার যাঁচাই-বাছাই ঠিকঠাক করা হয় না, যা একটি ব্যাংকের অসফলতার জন্য দায়ী।
৭। নন-ব্যাংকিং কার্যাবলিতে জড়িয়ে পরাঃ
কখনো দেখা যায় জনগনের ডিপোজিটের টাকা দিয়ে অধিক মুনাফার আশায় শেয়ার বাজার হতে শেয়ার ক্রয় করে লোকসানের ঘানি টানতে হয়।
৮। সামাজিক দায়বদ্ধতা (CSR) বাস্তবায়নে অনীহাঃ
ব্যাংক একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। পেশাদারিত্বের সাথে সেবাকর্ম করার পরেও কিছু সামাজিক কাজকর্ম সয়ংক্রিয়ভাবে এসে যায়। যাতে অংশগ্রহন করা অপরিহার্য হয়ে যায়। এ গুলির প্রতি সৈথিল্য ব্যাংকের সফলতা বাধাগ্রস্থ করে।
৯। আভ্যন্তরীণ কর্ম পরিবেশ রক্ষায় ব্যর্থতাঃ
ব্যাংকের স্বার্থ না দেখে নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং বা দলাদলিতে ব্যাস্ত থাকে যা প্রতিষ্ঠানের উন্নতি ব্যহত করে।
১০। সমন্বয়হীনতাঃ
বিভিন্ন উইং বা বিভাগ-উপবিভাগ এর মধ্যে সমন্বয় না থাকলে তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে বাঁধাগ্রস্ত হয়। ফলে টেকসই উন্নতি আশা করা যায় না।
উপসংহারঃ
একটি ব্যাংক সফলতার উচ্চ শিখরে নিয়ে যেতে হলে সকল ক্ষেত্রে আপডেট থাকতে হবে। প্রযুক্তির সর্বশেষ ব্যবহার সহ জনসাধারণের চাহিদার প্রতিফলন ঘটিয়ে কার্যকর ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি কল্যাণমূখী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা আমাদের সকলের ব্রত হোক।
লেখকঃ জিএম সরওয়ার বিশ্বাস, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।
আরও দেখুন:
◾ সফল জীবনের কল্পকথাঃ যাকাতভিত্তিক অথনীতি-১
◾ সফল জীবনের কল্পকথাঃ যাকাতভিত্তিক অর্থনীতি-২