প্রান্তিক মানুষের সেবায় এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের সাফল্য ও ভূমিকা
মো. জিল্লুর রহমানঃ এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বাড়ছে প্রান্তিক মানুষের সেবা ও লেনদেনের পরিমাণ। দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এজেন্ট ব্যাংকিং। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ বেসরকারি ব্যাংকগুলো যেখানে তাদের শাখাগুলোতে সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রসার ও সাফল্য চোখে পড়ার মতো। কারণ এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে ব্যাংকগুলোর তেমন খরচ নেই এবং সেক্ষেত্রে ব্যাংকের এজেন্টকেই সব খরচ বহন করতে হয়। এজেন্টরা শুধু ব্যাংক নির্ধারিত কমিশন পায়। এজন্য এজেন্ট ব্যাংকিং প্রান্তিক মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩১টি তফসিলি ব্যাংককে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। গ্রামীণ জনজীবনে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে। এটা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির একটা সোনালী সোপান ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার বড় ভিত্তি। দেশের সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও অনেক ব্যাংকের শাখা নেই। এসব অঞ্চলের মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতার বাইরে রয়ে গেছে। সেসব অঞ্চলে ব্যাংকের আউটলেট খুলে মানুষকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।
জানা যায়, লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে মূলত এজেন্ট ব্যাংকিং ধারণার উৎপত্তি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ ব্যাংকিং ধারণা চিলি, কলম্বিয়া, পেরু ও মেক্সিকোয় ছড়িয়েছে। কেনিয়াসহ আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোতেও বিস্তৃত হয়েছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশে প্রতিবেশী ভারতেও সেবাটি চালু করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালু করার জন্য ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এজেন্ট ব্যাংকিং নীতিমালা জারি করে ২০১৪ সালে ব্যাংক এশিয়া প্রথমে সেবাটি চালু করে। কেন্দ্রিয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুসারে, তফসিলি ব্যাংক কর্তৃক এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে জনগণকে ব্যয়সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর ব্যাংকিং সেবা প্রদানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র বিমোচন ও আন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করা হয়। এজেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে বর্তমানে চেকের মাধ্যমে নগদ টাকা উত্তোলন ছাড়া যাবতীয় ব্যাংকিং কার্যক্রম করা যাচ্ছে।
আরও দেখুন:
◾ কলমানি বনাম মুদারাবা পদ্ধতিতে ধার গ্রহণ
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের নভেম্বরের শেষে এজেন্টের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৫৬টি এবং এর বিপরীতে ২০ হাজার ৬২১টি আউটলেট রয়েছে। এর মধ্যে গ্রামে আউটলেট ১৭ হাজার ৭৭৮ ও শহরে ২ হাজার ৮৪৩টি। তাছাড়া, নভেম্বরে এই সেবার গ্রাহক বেড়ে হয়েছে ১ কোটি ৭২ লাখ ৫১ হাজার। ২০২১ সালের নভেম্বরে গ্রাহক ছিল ১ কোটি ৩৫ লাখ ৭ হাজার এবং এক বছরে প্রায় ৩৭ লাখ গ্রাহক বেড়েছে। আর ২০২০ সালের মার্চে গ্রাহক ছিল ৬৪ লাখ ৮৫ হাজার। অর্থাৎ করোনা শুরুর পর ১ লাখ ৮ হাজার গ্রাহক বেড়েছে। তার মানে ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালে যত গ্রাহক পেয়েছে, তার চেয়ে বেশি গ্রাহক পেয়েছে বিগত তিন বছরে।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
২০২২ সালের নভেম্বরে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা, যা ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৭ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা। তিন বছরে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় আমানত বেড়েছে ৩০০ শতাংশের বেশি। তবে আমানত সংগ্রহের বিপরীতে ঋণ বিতরণে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং। ২০২২ সালের অক্টোবরে মোট ৬৭৪ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে, যা আগের মাসের চেয়ে ১১ কোটি টাকা কম। সেপ্টেম্বর মাসে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৬৮৫ কোটি টাকা। বিতরণ করা ঋণের মধ্যে গ্রামে ৪৩৩ কোটি টাকা এবং শহরে ২৪০ কোটি টাকা বিতরণ হয়।
এজেন্ট ব্যাংকিং দেশে রেমিট্যান্স আহরণেও বিপ্লব ঘটিয়েছে এবং এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আসা প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকার মাইলফলক ছাড়িয়েছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নতুন ধারার এ ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ১ লাখ ৬ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা এবং এর প্রায় ৯৬ শতাংশই এসেছে কেবল পাঁচটি ব্যাংকের এজেন্টদের মাধ্যমে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড একাই সংগ্রহ করেছে ৫২ শতাংশ রেমিট্যান্স। এবং গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৫ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা রেমিট্যান্স এসেছে এ ব্যাংকটির এজেন্টদের মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত তিন বছরে এজেন্টদের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। ২০১৯ সাল শেষে এজেন্টের মাধ্যমে আসা মোট রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৫ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে যা ১ লাখ ৬ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ হিসাবে তিন বছরেরও কম সময়ে এসেছে ৯১ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। অন্য ব্যাংকগুলোর তুলনায় বেশ দেরিতে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ এজেন্ট ব্যাংকিং শুরু করলেও আমানত সংগ্রহ ও রেমিট্যান্স আহরণে ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান সবার শীর্ষে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে-এই এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করার জন্য বৃহৎ কোনো অবকাঠামোর দরকার হয় না। বৈধ চুক্তি এই কার্যক্রমের অন্যতম শর্ত। ফলে দেশের কোথাও ইউনিয়ন পরিষদের অফিস, কোথাও ওষুধের ফার্মেসী কিংবা ছোট-খাট আকারের দোকানেও চালু হচ্ছে এজেন্ট ব্যাংকিং। বিষয়টি এখন এতোটাই সহজ যে, ঘর থেকে বের হয়ে দোকানে গিয়ে মোবাইলে রিচার্জ করার মতোই ব্যাংকের সেবা নিচ্ছে গ্রামের মানুষগুলো। যদিও এখন শহরেও এজেন্ট ব্যাংকিং চালু হয়েছে।
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সহজে এবং স্বল্প খরচে ব্যাংকিং সেবা প্রদান করা যাচ্ছে। যেমন- একজন গ্রাহক সহজেই খুব সামান্য পরিমান চার্জ প্রদান করেই নিকটস্থ এজেন্ট সেন্টারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিল প্রদান করতে পারছেন। এছাড়া খুব সহজে অন্যান্য ইউটিলিটি সেবা প্রদানকারীর বিলও প্রদান করতে পারছেন। সামান্য পরিমাণ চার্জ প্রদান করে বিইএফটিএন, আরটিজিএস এবং এনপিএসবি -এর মাধ্যমে সহজেই ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ স্থানান্তর করতে পারছেন এবং বৈদেশিক রেমিট্যান্সের অর্থ উত্তোলন করতে পারছেন। গ্রাহককে এজন্য অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে ব্যাংকের শাখায় যেতে হচ্ছে না।
আর্থিক অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে ব্যাংকিং সুবিধা বঞ্চিতদের সেবা দিতে ২০১৪ সালে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালু করা হয়। গ্রামাঞ্চলের মানুষকে সেবা দেওয়া এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মূল লক্ষ্য। ব্যাংকের শাখা নেই এসব এলাকায় নিজস্ব বিক্রয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে, এমন ব্যক্তি ব্যাংকের এজেন্ট হতে পারেন। কোনো ধরনের বাড়তি চার্জ ছাড়া এ সেবা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে কোনোভাবেই গ্রাহক যেন প্রতারিত না হন, সে জন্য ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি নিয়োগের আগে অবশ্যই তার ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা, বিশ্বস্ততা ও সততার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার কথা রয়েছে। প্রথমে শুধু পল্লী এলাকায় এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের অনুমোদন দেওয়া হলেও, বাংলাদেশ ব্যাংক পরে পৌর ও শহরাঞ্চলেও এজেন্ট ব্যাংকিং করার অনুমতি দিয়েছে।
ব্যাংকিং সেবা বাড়াতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এজেন্ট ব্যাংকিং। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য করা হয় এজেন্ট ব্যাংকিং, বিশেষ করে স্কুল, পথশিশু, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিক, চর এলাকা ও দ্বীপবাসীর কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে ছোট ব্যবসায়ীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এজেন্ট ব্যাংকিং।
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে হিসাব খোলা, টাকা জমা ও উত্তোলন, ক্লিয়ারিং চেক ও ঋণের আবেদন গ্রহণ, বিতরণ ও কিস্তি সংগ্রহ, রেমিট্যান্স অর্থ প্রদান, বিদ্যুৎ বিল জমা, ভাতা বিতরণ, অ্যাকাউন্ট ব্যাল্যান্স জানা ও সংক্ষিপ্ত বিবরণী প্রদান, ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা, চেক বই, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড সুবিধা, বীমা প্রিমিয়াম সংগ্রহ, দৈনিক লেনদেনে ব্যাংক ও এজেন্টের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সৃষ্টি এবং সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা প্রোগ্রামের অধীনে নগদ অর্থ প্রদান করা ছাড়াও যে কোনো ব্যাংকের হিসাবে টাকা পাঠানো যায় এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদিত যে কোনো ধরনের ব্যাংকিং সেবা নেওয়া যায়।
শাখা পরিচালনার সব খরচ যেখানে ব্যাংকের, সেখানে এজেন্ট ব্যাংকিং পরিচালনার সব দায় এজেন্টের। নির্দিষ্ট একটি কমিশনের মাধ্যমে ব্যাংকের পক্ষে সেবাটি দিয়ে থাকেন এজেন্টরা। জনবলের বেতন, ভবন ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ বাদে মাস শেষে লাভ-লোকসান তাকেই বহন করতে হয়। তবে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রমকে গ্রামের কিছু কিছু স্বল্প শিক্ষিত লোকজন এনজিও বা কোন বহুমুখী সমিতির শাখা মনে করে। এসব ভ্রান্ত ধারণা পরিহার করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন বা সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো উচিত।
ব্যাংকের শাখাগুলো সাধারণত বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ও শহুরে এলাকায় অবস্থিত। অনেক উপজেলা বা জেলা সদরেও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর শাখা নেই। এখন এসব এলাকায়ও ব্যাংকিং সেবা দেয়া যাচ্ছে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। এতে গ্রামীণ মানুষ যেমন হাতের কাছেই ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছে, তেমনি নতুন কর্মসংস্থানও তৈরি হচ্ছে এলাকায়। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, জামানত তুলনামূলকভাবে কম লাগে। অল্প জায়গায় এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। লোকবলও কম লাগে। এ কারণে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম দ্রুত বিস্তার লাভ করছে এবং প্রান্তিক মানুষের কাছে দিনকে দিন ব্যাপক জনপ্রিয় ও প্রসারিত হচ্ছে।
লেখকঃ মো. জিল্লুর রহমান: ব্যাংকার ও কলামিস্ট।