বিশেষ কলাম

ব্যাংক খাত নিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল, অতিকথন ও অতিরঞ্জন বন্ধ করুন

মোশারফ হোসেনঃ ব্যাংক খাত নিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল, অতিকথন ও অতিরঞ্জন বন্ধ করুন – বাংলাদেশের ব্যাংক খাত আজ যে সংকটের মধ্যে রয়েছে, তা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। বছরের পর বছর ধরে পরিচালনাগত দুর্বলতা, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় লুটপাট, অনিয়ম এবং সর্বোপরি রেকর্ড খেলাপি ঋণের কারণেই এই সংকট তৈরি হয়েছে। তবে সংকটকে আরও গভীর করে তুলেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু ভুল পদক্ষেপ, মিডিয়ার অতিরঞ্জন, এবং কিছু অসাধু ব্যাংকারের প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত গুজব ছড়ানো। এই বহুমুখী চাপে ব্যাংক খাতের উপর থেকে আমানতকারীদের আস্থা উঠে গেছে। অন্যদিকে, এই সংকট সমাধানের জন্য যতবারই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, ততবারই একটা জগাখিচুড়ি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে– প্রতিবারই আমানতকারীদের আতংক ও অনাস্থার মৌচাকে ঢিল মেরে তারপর তা প্রশমনের চেষ্টা করা হয়েছে। পরবর্তী আলোচনায় ব্যাংক খাতের এই বহুমুখী সংকটের গভীর কারণ এবং এর সুষ্ঠু সমাধানের পথ নিয়েই বিস্তারিত আলোকপাতের চেষ্টা করবো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুল ও অতি উৎসাহী পদক্ষেপ

ব্যাংকগুলোর দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি রেটিং থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদায়ী গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেওয়ার (জুলাই ২০২২) পরের মাসেই (আগস্ট ২০২২) দেশের ১০টি ব্যাংককে ‘দুর্বল ব্যাংক’ হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করে তা প্রকাশ করেন। যদিও ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি ১০ ব্যাংকের নাম প্রকাশ করেননি, দেশের সংবাদ মাধ্যম শিগগিরই সেই ১০ ব্যাংকের নাম জানতে বাকি রাখেনি। এর ফলে ওই ব্যাংকগুলোর আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা আমানত ভাঙাতে শুরু করেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে পরবর্তীতে স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংককেই বিজ্ঞপ্তি প্রচার (নভেম্বর ২০২২) করতে দেখা যায় যে, ‘বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাংকের আমানত তুলে নেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্রমূলক খবর প্রচারিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা অত্যন্ত সুদৃঢ় অবস্থায় রয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তারল্যের কোনো সঙ্কট নেই। উল্লেখ্য, দেশে স্বাধীনতার ৫১ বছরে কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়নি। আশা করা যায় আগামীতেও বাংলাদেশের কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না। ব্যাংকসমূহে জনগণের আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ রয়েছে।’

আরও দেখুন:
আগামী দিনের ব্যাংকিং কমিশন কেমন হওয়া চাই

এরপর চলতি বছরের মার্চ মাসে মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক আতি উৎসাহী পদক্ষেপের খবর—সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকগুলোর মার্জারের খবর। আমানতকারীদের ঘুমিয়ে পড়া আতংক আবারও জেগে ওঠে—আতঙ্কিত হয়ে নিজেদের আমানত হারানোর আশঙ্কায় দুর্বল ব্যাংকগুলো থেকে একযোগে তাদের আমানত উত্তোলন করতে শুরু করেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যাংকগুলো আপ্রাণ চেষ্টা করলেও অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না। এর মধ্যেই আবার হঠাৎ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি গোপন প্রতিবেদনের খবর ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে ব্যাংকগুলোকে লাল, হলুদ, ও সবুজ ট্যাগ দিয়ে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। এভাবে একের পর এক ধাক্কার কারণে দুর্বল ব্যাংকগুলো আরও দুর্বল হয়ে পড়ে, এবং তাদের সঙ্কট আরও তীব্রতর হয়।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

কারেক্টিভ অ্যাকশন নেওয়ার জন্য দুর্বল ব্যাংকগুলোকে চিহ্নিত করা জরুরি, কিন্তু এসব নেগেটিভ রেটিং পাবলিক করার আগে ব্যাংকগুলোকে মিনিমাম একটা সময় দেওয়ার দরকার ছিল, যা ব্যাংকগুলোকে দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। একইসাথে, আমানতকারীদের প্রতিক্রিয়া এবং অর্থনীতিতে এর সম্ভাব্য প্রভাব বিবেচনায় নেয়া হয়নি। ফলে, হঠাৎ করেই করা এসব নেতিবাচক শ্রেণীবিন্যাস সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে, ব্যাংকগুলোর পজিশনিং দুর্বল করেছে। অন্যদিকে, এই সুযোগে পজিটিভ রেটিংপ্রাপ্ত ব্যাংকগুলো এমন এক ধরনের স্বয়ংক্রিয় সুবিধা পেয়েছে, যা তাদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে। যাই হোক, দুর্বল ব্যাংকগুলোর তদবির, বিভিন্ন ধরনের অঙ্গীকার, কর্মীদের প্রতিবাদ এবং বিভিন্ন মহলের সমালোচনার ফলে অন্তত ব্যাংক মার্জারের প্রসঙ্গটি সাময়িকভাবে দৃশ্যপটের বাইরে চলে যায়। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করে।

এরপর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর, নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিনি ব্যাংকগুলোর অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার কন্ঠে কথা বলতেন। দায়িত্ব গ্রহণের পরও তিনি একই স্টাইলে ব্যাংকগুলোর সমালোচনা করতে থাকেন। তিনি প্রকাশ্যে মন্তব্য করেন যে, ‘কিছু ব্যাংক দেউলিয়া পর্যায়ে চলে গেছে।’ তবে, বাস্তবতা হচ্ছে গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণের আগে এবং পরে তাঁর বক্তব্যের প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে দুই রকম– এটা বোধহয় তিনি মাথায় রাখেননি। এখন তিনি ব্যাংক খাতের সর্বোচ্চ অভিভাবক, এবং সেই অভিভাবকের মুখে যদি ব্যাংকগুলোর দেউলিয়ার ঘোষণা আসে, তাহলে আমানতকারীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। যেমন কোনো বাবা যদি তাঁর মেয়ের জন্য ‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপন এমনভাবে প্রকাশ করেন যে, ‘আমার ধর্ষিতা মেয়ের জন্য সুযোগ্য পাত্র চাই,’ তাহলে সম্ভাব্য পাত্রপক্ষের প্রতিক্রিয়া কী হবে তা সহজেই অনুমেয়। এটা বুঝতে রকেট সায়েন্সের জ্ঞান প্রয়োজন নেই। একইভাবে, নতুন গভর্নর মহোদয়ের বক্তব্যের পর দেশের ব্যাংক খাতের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংকট সৃষ্টি হয়েছে; চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কিছু ব্যাংকের চেক ও পে-অর্ডার গ্রহণ না করার ঘোষণা আসে, করপোরেট গ্রাহকরাও মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে কিছু ব্যাংক থেকে। কয়েক দিনের মধ্যেই বেশ কিছু ব্যাংকের ভল্ট খালি হয়ে যায় এবং সাধারণ গ্রাহকরা হাজার টাকার চেকের বিপরীতেও নগদ টাকা উত্তোলন করতে পারছে না।

তাই বর্তমান সময়ের এই সংকটের দায় বাংলাদেশ ব্যাংককেও নিতে হবে। দেশের ব্যাংক খাতকে দুর্বল করার পেছনে যদি কারো দায় থাকে, তা কারোর একার দায় নয়; ব্যাংকগুলোর বোর্ড এবং ম্যানেজমেন্টের দায় থাকলেও, সমান বা তার চেয়ে বেশি দায় স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংককেই এবং সরকারেরও নিতে হবে। তিন পক্ষের দায় শুধু ব্যাংক কর্মকর্তাদের এবং বোর্ডের উপর চাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া বা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কখনোই যৌক্তিক হতে পারে না।

মিডিয়া ট্রায়াল এবং সংবাদের অতিরঞ্জন

দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে সরকারের কর্তা ব্যক্তি, সুশীল নাগরিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ যে যা পারছে তাই বলছে। সংবাদপত্র, টেলিভিশন মিডিয়া যেমন ইচ্ছে তেমন শিরোনাম করছে। ইউটিউবার-ফেসবুকারদের কথা না-ই বললাম। আমরা জানি, লজ্জাবতী পাতা খুবই সংবেদনশীল; আলতো স্পর্শেই সে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। তেমনি, মানুষের বিশ্বাসের ওপর গড়ে ওঠা ব্যাংক খাতও অত্যন্ত সংবেদনশীল। আমানতকারীদের বিশ্বাসে সামান্য চির ধরলে তাদের ধরে রাখা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। তাই ব্যাংক নিয়ে মন্তব্য করার আগে বুঝেশুনে করা উচিত, মন্তব্যের নেতিবাচক ও ইতিবাচক–উভয় প্রভাব বিবেচনায় নেওয়া উচিত। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের দেশের মিডিয়া অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাংক খাত নিয়ে জাজমেন্টাল সংবাদ পরিবেশন করে– বিভিন্ন ব্যাংকের নামের আগে ইচ্ছেমতো বিভিন্ন নেতিবাচক বিশেষণ ব্যবহার করে, যেমন- ‘দুর্বল ব্যাংক’, ‘সংকটে অমুক ব্যাংক’, ‘ব্যাংক খাতের কঙ্কালসার অবস্থা’, ‘অনেক ব্যাংকেরই মরমর অবস্থা’। এসব নেতিবাচক এবং জাজমেন্টাল বিশেষণ আমানতকারীদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে তাদের ব্যাংক বিমুখ করেছে।

কিছু সংবাদ মাধ্যম তাদের উপস্থাপিত সংবাদের নৈতিকতা বা প্রভাব বিবেচনা না করে শুধুমাত্র প্রচার সংখ্যা এবং ভিউ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। প্রচার সংখ্যা এবং ভিউ বাড়ানোর নেশায় এসব সংবাদ মাধ্যম হিরো আলমের খবরকেও প্রাধান্য দিতে পিছপা হয় না। তাঁরা শুধু নেতিবাচক বিশেষণ ব্যবহার করেই ক্ষান্ত হোন না, শিরোনামকে করেন অতিরঞ্জিত, আর বিষয়বস্তুকে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে করেন বিরাট! শিরোনামগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয় যেন দর্শক বা পাঠক ওই সংবাদে ক্লিক করতে বাধ্য হয়। এই ক্লিক-বাণিজ্যের প্রতিযোগিতায়, কিছু কিছু মিডিয়া অতিসংবেদনশীল ব্যাংক খাত নিয়েও দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করে। যেমন: “মূলধন খেয়ে ফেলছে ১৫ ব্যাংক,” “দেউলিয়ার পথে ১৪ ব্যাংক,” “ব্যাংক খোলা, কিন্তু টাকা উধাও,” অথবা “৯ ব্যাংকে লাল, ২৯টিতে হলুদ বাতি” ইত্যাদি পুনরাবৃত্ত ও অতিরঞ্জিত শিরোনাম আমানতকারীদের মধ্যে ভীতি বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে তাদের একটা বড় অংশ একযোগে ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এর ফলে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট আরও তীব্র হয়েছে এবং সংকট সমাধান আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।

প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাংকারদের রটনা ও গুজব ছড়ানো

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে কিছু অসাধু ব্যাংকারের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাংকের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গুজব ছড়ানোর অপচেষ্টা। অনেক ব্যাংকার নিজের ব্যক্তিগত আমানতের টার্গেট অর্জন করতে অন্য ব্যাংকের গ্রাহক ভাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। এই প্রক্রিয়ায় তারা নিজেদের ব্যাংককে শক্তিশালী হিসেবে উপস্থাপন করতে প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাংককে গ্রাহকের কাছে দুর্বল বা অনিরাপদ হিসেবে তুলে ধরেন। তাছাড়া কিছু ব্যাংকার আছেন যাদের কাছে কোনো গ্রাহক একবার পড়লে গ্রাহকের যেন জাত-মান দুটোই যায় যায় অবস্থা! বিশেষত, কিছু ব্যাংকার কনভেনশনাল ব্যাংকগুলোকে ‘সুদি’ ব্যাংক বলে অবজ্ঞা করেন এবং এসব ব্যাংকে ব্যাংকিং করাকে নৈতিকভাবে ‘নীচু’ কাজ হিসেবে উপস্থাপন করেন। তারা এমনকি গ্রাহকদের ধর্মীয় ভীতি দেখিয়ে এসব ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাকে ‘জাহান্নামী’ কর্ম হিসেবে চিহ্নিত করেন। অপপ্রচারে আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে গ্রাহকের মাঝে নানা রকম আতংক ঢুকিয়ে দেন– ‘অমুক ব্যাংকের ডাবল স্কিমে টাকা রেখেছেন, দেখেন টাকা ডাবল হওয়া পর্যন্ত ব্যাংকই থাকে কিনা!’ ব্যাংক মার্কেটিংয়ের এমন অপকৌশলের ফলে গ্রাহকরা আতঙ্কিত হয়ে তাদের আমানত তুলে নিতে শুরু করে। আর এই অপকৌশল এবং গুজব যদি প্রকৃত অর্থেই কিছুটা দুর্বল ব্যাংকের বিরুদ্ধে হয়, তাহলে ওই ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করে, এবং তাদের আর্থিক অবস্থা আরও অবনতির দিকে যায়। এই ধরনের অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা কেবল একটি বা দুটি ব্যাংকের জন্য ক্ষতিকর নয়, এটি পুরো ব্যাংকিং খাতেই একটি অস্থিরতা ও অনাস্থার পরিবেশ তৈরি করে।

সংকট সমাধানে করণীয়

বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর নীতি প্রণয়ন ও দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা প্রদানঃ বাংলাদেশ ব্যাংকের এখন সময় এসেছে দীর্ঘদিন ধরে ঘটে আসা অনিয়ম ও লুটপাটের সমস্ত পথ বন্ধ করে দিয়ে ব্যাংকগুলোর জন্য কার্যকর নীতি প্রণয়ন ও দীর্ঘমেয়াদি তারল্য সহায়তা প্রদান করার। ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের মতো বৃহৎ ব্যাংকগুলো, যারা তাদের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ও বহুমুখী সেবার মাধ্যমে দেশের ব্যাংক খাতের জায়ান্টে পরিণত হয়েছে, তাদের সংকটে পড়া মানে অর্থনীতি স্থবির হয়ে যাওয়া। এসব ব্যাংকের কোটির উপর গ্রাহক, বিশাল কর্মী বাহিনীর কর্মসংস্থান ও তাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে, বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত এসব ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তবে, তারল্য সহায়তার সুদহার এমন হতে হবে যাতে ব্যাংকগুলো আর্থিকভাবে চাপের মধ্যে না পড়ে। উচ্চ সুদের সহায়তা ব্যাংকগুলোকে পুনরুদ্ধারের পরিবর্তে সুদখেলাপিতে পরিণত করতে পারে, যা আরও বড় সংকট তৈরি করতে পারে। এছাড়া, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের সংখ্যা বাড়ানোও গুরুত্বপূর্ণ, যাতে ব্যাংকের রিক্যাপিটালাইজেশন নিশ্চিত হয়। কারণ, স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা বেশি হলে ব্যাংকের জন্য তাদের দায়বদ্ধতা বা আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। আদালত ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় এবং একইসাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সহায়তার মাধ্যমে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়কে সর্বোচ্চ বেগবান করতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত এমন নীতি থেকে বিরত থাকা, যা দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থাকে আরও সংকটে ফেলতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মিডিয়া সচেতনতা ও দায়িত্বশীল প্রতিবেদনঃ বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত যেকোনো প্রতিবেদন প্রকাশ বা মিডিয়া ব্রিফিংয়ের আগে অর্থনীতি এবং আমানতকারীদের ওপর এর সম্ভাব্য প্রভাব গভীরভাবে বিবেচনা করা। মিডিয়াতে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এমনভাবে বক্তব্য রাখা উচিত, যাতে ভুল তথ্য প্রচার বা অযথা আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যাংক খাতে কোনো ধরনের অনিশ্চয়তা বা অস্থিতিশীলতা তৈরি না হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সবল ব্যাংকের তালিকা প্রকাশঃ বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত দুর্বল ব্যাংকগুলোর তালিকা প্রকাশ না করে প্রতিবছর সফল বা সবল ব্যাংকগুলোর তালিকা প্রকাশ করা, যা তারা সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্টের মাধ্যমে কয়েক বছর ধরে করে আসছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতের নেগেটিভ বিষয়গুলিকে পজিটিভ আঙ্গিকে তুলে ধরা সম্ভব হবে। দুর্বল ব্যাংকের তালিকা প্রকাশ করলে যে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হয়—যেমন, গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক, ব্যাংক থেকে আমানত উত্তোলন এবং তারল্য সংকট—সেসবের পরিবর্তে সবল ব্যাংকের তালিকা প্রকাশ ব্যাংক খাতে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করবে। এই ধরনের পদক্ষেপ ব্যাংকগুলোর মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি করবে এবং অন্য ব্যাংকগুলোকে উন্নতি করতে উৎসাহিত করবে।

দায়িত্বশীল শিরোনাম এবং সংবাদ পরিবেশনঃ মিডিয়াকে অবশ্যই দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে এবং শিরোনাম ও খবর পরিবেশনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক বিশেষণ ব্যবহার পরিহার করতে হবে। আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো বা ব্যাংক খাতের সংকটকে আরও জটিল করে তোলার মতো সংবাদ প্রচার থেকে বিরত থাকা উচিত। একইসাথে গ্রাহকদেরকে গুজব ও মিথ্যা সংবাদের বিরুদ্ধে সচেতন করার কাজটিও মিডিয়াকে করতে হবে।

মিডিয়া মনিটরিং উইংঃ বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস, বাংলাদেশ (এবিবি) এর যৌথ উদ্যোগে মিডিয়া মনিটরিং উইং গঠন করে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত অসত্য ও আতঙ্ক সৃষ্টিকারী সংবাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ব্যাংক খাত নিয়ে অসত্য তথ্য ছড়ানো চ্যানেলগুলোকে ফেইসবুক/ ইউটিউবে রিপোর্ট করা যেতে পারে। এর ফলে গুজব রটনা কিছুটা হলেও বন্ধ করা সম্ভব হবে।

প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাংকারদের আচরণ নিয়ন্ত্রণঃ ব্যাংক খাতের প্রতিযোগিতা সুষ্ঠু রাখতে প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও তদারকির মাধ্যমে গুজব রটানোর অভিযোগ উঠেছে এমন ব্যাংকারদের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। পাশাপাশি, গ্রাহকদের ব্যাংক সুইচ সংক্রান্ত একটি বিশদ নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে, যা ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা এবং ন্যায়সঙ্গত প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করবে।

পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান সংকট উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংকের পরিচালক ও কর্মী, গ্রাহক, মিডিয়া এবং দেশের জুডিশিয়ারির সমন্বিত অংশগ্রহণ অপরিহার্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঠিক নীতি ও দায়িত্বশীল আচরণ বর্তমান পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল করতে পারে। ব্যাংক পরিচালকদের লুটের জন্য নয়, ব্যাংককে বাঁচিয়ে রেখে ব্যবসার মানসিকতা নিয়ে বোর্ডে থাকতে হবে। ব্যাংকারদেরও অন্যে ব্যাংকের দোষের মার্কেটিং না করে, নিজের ব্যাংকের গুণের মার্কেটিংয়ে মনোযোগী হতে হবে। বিশেষ কথা হচ্ছে, মেরে ফেলার জন্য হয়তো বন্দুকের একটি গুলিই যথেষ্ট, কিন্তু মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন হয় একটি সফল সার্জারির এবং একটা দীর্ঘ সময়ের শুশ্রষা। তাই মেরে ফেলার মধ্যে কোন কৃতিত্ব নেই, শ্রেষ্ঠত্ব নেই; বরং সুস্থ করে তোলা এবং বাঁচিয়ে তোলার মধ্যেই কৃতিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত থাকে। তাই বর্তমান গভর্নর যদি বাংলাদেশের দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল করে তুলতে পারেন তাহলেই ইতিহাস তাকে স্মরণে রাখবে।

লেখকঃ মোশারফ হোসেন, সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার ও ডেপুটি হেড, এমআইএস এন্ড রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড, প্রধান কার্যালয়, ঢাকা

একটি মন্তব্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button