দারিদ্র বিমোচনে ব্যাংকিং সেক্টরের ভূমিকা
ব্যাংকের প্রধান ও মৌলিক দু’টি কাজের প্রথমটি হলো আমানত সংগ্রহ করা আর দ্বিতীয়টি আমানতের টাকা ঋণ/বিনিয়োগ রূপে উপযুক্ত ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা। আমনত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণের সুবিধার্থে ব্যাংকগুলো এমন জায়গায় শাখা খুলে, যেখানে বিত্তশালী এবং বড় ব্যবসায়ীদের বসবাস। অনেকগুলো ধনী মানুষের টাকা একত্রিত করে কিছু ধনী মানুষের মাঝে ঋণ হিসেবে বিতরণ করার নামই ব্যাংকিং। অক্ষোকৃত কম মুনাফা/সুদ হারে সংগৃহীত আমানত বর্ধিত হারে বিতরণকৃত ঋণ/বিনিয়োগ আদায়ের পর প্রাপ্য সুদ/মুনাফার পার্থক্যই ব্যাংকের আয়ের প্রধান উৎস। ফলে ব্যাংকের সাধারণ ট্র্যাডিশন হলো বিত্তশালী কিংবা ধনীদের গলগ্রহ হওয়া এবং তাদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করা।
১৯৭২ সালে পাকিস্তান আমলের ১২টি ব্যাংককে ছয়টিতে একীভূত (Merge) করে সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা, পূবালী এবং উত্তরা নামে রাষ্ট্রীয় অধ্যাদেশে জাতীয়করণ করা হয়। এই ব্যাংকগুলো গতানুগতিক ধারায় পরিচালিত বলে কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের কৃষক এবং কৃষির উন্নয়নের প্রয়োজনে বিশেষায়িত একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলে ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির সহায়ক শক্তিতে কাজ শুরু করে।
কিন্তু জমির দলিলপত্র-জামানতের বিপরীতে ব্যাংকটির দেয়া কৃষি ঋণও এক শ্রেণীর ধনীদের ভাগে চলে যায়। যার জমি নেই তার পক্ষে জামানত দেবার কিছু না থাকায় ভূমিহীন প্রান্তিক গরীব কিংবা বর্গা চাষিরা বঞ্চিতই থেকে যায়। আশির দশকের সূচনাতে বাংলাদেশে প্রাইভেট সেক্টর ব্যাংকিংয়ের কার্যক্রমের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৮৩ সালে রাষ্ট্রায়ত্ব পূবালী এবং উত্তরা ব্যাংক দু’টিকে বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়া হলে ব্যক্তি মালিকানায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার দ্বার উন্মোচিত হয়। পরে ধাপে ধাপে ব্যাংক সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৫১টি দেশী এবং ৯টি বিদেশী ব্যাংক নিয়ে গড়ে উঠেছে ৬০ ব্যাংকের বাংলাদেশ ব্যাংকিং পরিবার।
ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংক (PCB)‘র কার্যক্রমের মূল লক্ষ্যও অধিক মুনাফা অর্জন। ফলে দারিদ্র বিমোচনের মতো কম লাভের কর্মসূচি তাদের পক্ষে নেয়া সম্ভব হয়নি। এমনকি সরাসরি কৃষি খাতের প্রতি মনোযোগী হতেও অনেক ব্যাংকের অন্তহীন অনীহা বিদ্যমান। এহেন প্রেক্ষাপটে ব্যাংকের সাথে দারিদ্র বিমোচনের সম্পর্ক খোঁজা অপ্রাসঙ্গিক। এমনকি দারিদ্র বিমোচনে ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে কোনো তথ্য গুগলের কাছেও নেই। গুগলে শতটা সার্চ দিলেও প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোনো ফল পাবেন না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এনজিওদেরই এনে হাজির করবে গুগল।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
দারিদ্র বিমোচনের নানা কর্মসূচি নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে শুরু থেকেই বহু এনজিও তৎপর। ব্র্যাক, আশা, গ্রামীণ ব্যাংক পপি, প্রশিকাসহ হাজারো ছোট বড় এনজিও এ লক্ষ্যে কাজ করছে। নব্বইয়ের দশক থেকে এনজিও’র কাজ দারিদ্র বিমোচনের পরিবর্তে এনজিও ব্যবসায় রূপান্তরিত হয়। তখন এনজিও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার হিড়িক পড়ে যায় দেশময়।
শুরুতে বিদেশি ডোনেশনের টাকায় এনজিওগুলো উচ্চ সুদে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করতো। বাংলাদেশের দারিদ্রকে বিদেশিদের কাছে তুলে ধরে ওদের সহানুভূতি আদায়ে যার পারঙ্গমতা বেশি ছিলো, তারাই পেতো বেশি ডোনেশন। অফেরৎযোগ্য এসব ডেনেশনের অর্থ লগ্নির এনজিও ঋণে যতটা না গ্রাহকের লাভ তার চেয়ে অনেক বেশি লাভবান হতো এনজিওগুলো নিজে। ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমে শীর্ষে থাকা এমন অনেক এনজিও বর্তমানে ব্যাংক এবং বিত্তশালী পরিবারের সন্তানদের জন্য ব্যয়বহুল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক।
এনজিও কর্মীদের বিপণন দক্ষতায় অনতিবিলম্বে এসব ক্ষুদ্রঋণ ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়। দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত সেসময়কার পরিস্থিতিতে সুবিধাবঞ্চিত তৃণমূলের অনুন্যোপায় কোটি মানুষ তা লুফে নেয়। ধীরে ধীরে দেশের মূলধারার অর্থ ব্যবস্থার সামন্তরালে আবির্ভূত হয় ক্ষুদ্রঋণ কর্মকাণ্ড। পরিস্থিতি এমনও হয় যে, এনজিওগুলো সরকারি বিধিনিষেধ মানার পরিবর্তে ক্ষেত্রবিশেষে সরকারেরও সমীহ আদায় করতে সক্ষম হয়।
তবে সময় যতোই এগুতে থাকে ততোই এনজিও ক্ষুদ্র ঋণের ভয়ংকর ফাঁকগুলো জনসম্মুখে প্রকাশিত হতে থাকে। আর ঋণচক্রে আটকে পড়া মানুষগুলোও এই বেড়াজাল ভেঙ্গে বের হবার পথ খুঁজতে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, ক্ষুদ্র ঋণের আলোচনা এবং সমালোচনার মাঝে এর বিকল্প ব্যবস্থা কেউ হাজির করেনি কিংবা করতে পারেনি।
এহেন পরিস্থিতিতে দেশ এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটিডে এগিয়ে আসে। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠার এক যুগ পর ১৯৯৫ সালে পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প (আরডিএস) নামে একটি পাইলট প্রজেক্ট নিয়ে ইসলামী ব্যাংকটি কাজ শুরু করে। কৃষি, আত্মকর্মসংস্থান, দারিদ্র বিমোচন, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও গ্রামীণ আবাসন, এবং শিক্ষা উন্নয়নের সমন্বিত কর্মসূচিভিত্তিক কার্যক্রম প্রচলিত এনজিও কার্যক্রমের যথার্থ বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়। প্রাথমিক সফলতার স্তর পেরিয়ে এটি অনতিবিলম্বে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
বর্তমানে এ ব্যাংকের ৩০০টি শাখার মাধ্যমে দেশের চৌষট্টি জেলার প্রায় পঁচিশ হাজার গ্রামের সাড়ে বারো লাখ সদস্যের মাঝে এ প্রকল্পের কাজ চালু রয়েছে। গত পঁচিশ বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ করে তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর টেকসই উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে প্রকল্পটি। বর্তমানে এ খাতে বিনিয়োগ স্থিতি ৩ হাজার ২শত কোটি টাকারও বেশি। বিনিয়োগের আদায় হার ৯৯.০৯%।
লেনদেনে ইসলামী শরীয়া নীতির অনুসরণ, বিনিয়োগের বিপরীতে সর্বনিম্ন মুনাফা আদায় হার (RR), ভালো সদস্যদের প্রণোদনা বিহিত এবং সদস্যদের প্রতি মানবিক আচরণের ফলে সদস্যরা এখানে খুবই স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। পাশাপাশি সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনার অধীনে সমস্যাগ্রস্থ সদস্যদের মাঝে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম, সদস্যদের সন্তানদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনা, মেধাবি সন্তানদের মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষা বৃত্তি, সদস্যদের দক্ষতা বৃদ্ধি প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য সেবা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের মতো কার্যক্রমও পরিচালিত হয় নিয়মিত। ইসলামী ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমে আরডিএস বিশ্বে সর্ববৃহৎ।
তবে ইসলামী ব্যাংকের আরডিএস’র মতো একটি সাকসেসফুল মডেল সামনে থাকার পরও ব্যাংকিং সেক্টরের অন্যরা তা কাজ লাগাতে এগিয়ে আসেনি। কয়েকটি ব্যাংক কাজ শুরু করলেও তা সীমাবদ্ধ, যা দেশব্যাপী সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেই। কিন্তু ব্যাংকিং সেক্টরের মাধ্যমে দেশের দারিদ্রতা দূর করার বিরাট সুযোগ রয়েছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আনতে পারে বৈপ্লবিক উন্নয়ন।
লেখক: মো: মোসলেহ উদ্দিন, কবি, কলামিস্ট ও ব্যাংকার