জাতীয় রাজস্ব আদায়ে আয়করের ভূমিকা
মো. জিল্লুর রহমানঃ দিন দিন বড় হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। ফলে বাড়ছে বাজেটের আকার এবং বর্ধিত বাজেট বাস্তবায়নের জন্য অধিক অর্থের দরকার হচ্ছে। কিন্তু বিদেশি অর্থের উৎস তুলনামূলকভাবে অনেক ছোট হয়ে আসায় এখন বাজেট বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা রাখছে অভ্যন্তরীণ উৎসগুলো, যার মধ্যে ভ্যাট ও আয়কর অন্যতম। সর্বশেষ তথ্যমতে, সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রায় ৬৯ শতাংশ আসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) খাত থেকে এবং বাকি ৩১ শতাংশ এনবিআর-বহির্ভূত খাত থেকে।
এনবিআর খাতের মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আয় হয় মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে ৩৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আয়কর খাত ৩২ দশমিক ৮৫ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে সম্পূরক শুল্ক এবং চতুর্থ অবস্থানে আমদানি শুল্ক। এ দুই খাতের অবদান ২৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আগে আমদানি শুল্ক থেকে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হতো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আয়কর থেকেই সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয়। বাংলাদেশেও এ খাত থেকে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
আরও দেখুন:
◾ টিন থাকলেই কি রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক?
◾ যাদের আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে
আয়কর আমাদের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ একটি ভিত্তি ও অনুষঙ্গ। সরকারের রাজস্ব আয়ের একটি বড় খাত আয়কর। নাগরিকদের দেয়া কর থেকে যে আয় হয়, সরকার রাষ্ট্রের উন্নয়নে এই অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের দেশের সক্ষম অনেকে আয়কর দেয় না। দেশের মোট সক্ষম জনসংখ্যার অনুপাতে মাত্র ৫২ লাখ ইটিআইএনের (রিটার্ন জমা দেন মাত্র ২০-২২ লাখ) সংখ্যাটি নিতান্তই হতাশাব্যঞ্জক। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে আয়করদাতার সংখ্যা বাড়াতেই হবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে আয়কর প্রদান ও আদায়ের হার বৃদ্ধি করতে হবে। যাদের আয়সীমা কর দেয়ার মধ্যে রয়েছে, তাদের উচিত সময়মতো কর পরিশোধ করা। কর ফাঁকি কিংবা কর দিতে অনীহা দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। মূলত যাদের মধ্যে কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা রয়েছে, তারা রাষ্ট্রকে ফাঁকি দিচ্ছেন না, আদতে নিজেকেই ফাঁকি দিচ্ছেন। আয়কর ফাঁকি দেয়ার অর্থ সরকার কর্তৃক পরোক্ষ করের আওতা বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় করে নেয়া এবং সেটা ধনী-দরিদ্র সবার ওপর আরোপ করা হয়।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
বাংলাদেশ সরকারের রাজস্বের প্রধান তিনটি উৎস হলো দুই প্রকার পরোক্ষ কর, যথা আমদানি শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর এবং দুই প্রকার প্রত্যক্ষ কর, যথা আয়কর এবং সম্পদ কর। এছাড়া কতিপয় পণ্যের দেশজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আবগারি শুল্ক আদায় করা হয়। উপরন্তু প্রয়োজনীয় রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যে আমদানি পর্যায়ে এবং স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক আদায় করা হয়ে থাকে। সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সংযুক্ত প্রতিষ্ঠান এনবিআর বাংলাদেশে করনীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করে।
সরকারি আয়ের প্রধান উৎস হলো কর রাজস্ব বাবদ সংগৃহীত অর্থ। মূলত প্রত্যক্ষ কর ও পরোক্ষ কর এই দুই ধরনের করের সমন্বয়ে কর রাজস্ব গঠিত এবং এ খাত থেকে সরকারের মোট আয়ের ৬৯ শতাংশের বেশি সংগৃহীত হয়। অবশিষ্ট ৩১ শতাংশ রাজস্ব সংগৃহীত হয় কর-বহির্ভূত বিভিন্ন খাতের রাজস্ব আদায় (ফি, মাসুল প্রভৃতি) থেকে। রাজস্ব সংগ্রহের হার একটি দেশের উন্নয়নের স্তর বা অবস্থান নির্ধারণের অন্যতম স্বীকৃত নির্ণায়ক। যে দেশের অর্থনীতি যত শক্তিশালী সেখানকার রাজস্ব সংগ্রহের হারও তত বেশি। আমাদের দেশে মোট ‘রাজস্ব-দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) অনুপাত’ ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরের আট দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ১১ দশমিক তিন শতাংশে উন্নীত হয়। কিন্তু ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা হ্রাস পেয়ে রাজস্ব জিডিপির অনুপাত ছিল ১০ দশমিক এক শতাংশ, যা হতাশাজনক চিত্র।
আয়কর হচ্ছে ব্যক্তি বা সত্তার আয় বা লভ্যাংশের ওপর প্রদেয় কর। আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর আওতায় কর বলতে অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রদেয় আয়কর, অতিরিক্ত কর, বাড়তি লাভের কর, এতৎসংক্রান্ত জরিমানা এবং সুদ বা আদায়যোগ্য অর্থকে বোঝায়। অন্যভাবে বলা যায় যে, কর হচ্ছে রাষ্ট্রের জনসাধারণের স্বার্থে রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারকে প্রদত্ত বাধ্যতামূলক অর্থ।
আয়কর যা আয় বা লভ্যাংশের পরিমাণভেদে পরিবর্তিত হয় এবং আমাদের দেশে প্রগতিশীল কর প্রয়োগ করা হয়। প্রগতিশীল কর হচ্ছে সেই কর ব্যবস্থা, যাতে করদাতার আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে করহার বৃদ্ধি হয়। আয়কর আরোপিত হয় করদাতার কর পরিশোধ করার ক্ষমতার ওপর। তাই আয়করকে প্রগতিশীল কর বলা হয়। আয়কর অধ্যাদশে ১৯৮৪ অনুযায়ী আয়ের খাতগুলো হচ্ছে বেতনাদি, নিরাপত্তা জামানতের ওপর সুদ, গৃহসম্পত্তির আয়, কৃষি আয়, ব্যবসা বা পেশার আয়, মূলধনি মুনাফা, অন্যান্য উৎস থেকে আয়, ফার্মের আয়ের অংশ এবং স্বামী-স্ত্রী বা অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের আয়। তবে রিটার্ন জমা দেয়ার সময় আয়ের খাতগুলো সম্পৃক্ত করতে হয়।
বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে গত ১০ বছরে আয়কর খাত থেকে রাজস্ব আদায় বেড়েছে। তবে প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। এনবিআর এখন প্রবৃদ্ধির হারও বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছে। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে আয়কর আদায় হয়েছিল ১৪ হাজার ২৭৪ কোটি ২১ লাখ টাকা। সরকারের প্রথম মেয়াদ শেষ ও দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুর বছর ছিল ২০১৩-১৪ অর্থবছর এবং তখন কর আদায় হয় ৪৩ হাজার ৮৪৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কর আদায় হয় ৬৫ হাজার ৬৯৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
আর এনবিআরের সর্বশেষ তথ্যমতে, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে এনবিআর সব মিলিয়ে প্রায় দুই লাখ ৫৯ হাজার ৯০০ কোটি টাকা শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং আয়কর আদায় হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকা কম। ২০২০-২১ অর্থবছরের পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছিল তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের মূল লক্ষ্য ছিল তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন লাখ এক হাজার কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ভ্যাট খাত থেকে ৯৭ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। বৃহৎ করদাতা ইউনিট সবচেয়ে বেশি ৪৯ হাজার ২৫১ কোটি টাকা ভ্যাট আদায় করেছে। ভ্যাটের পর আয়কর থেকে প্রায় ৮৫ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। আয়করের এলটিইউ সর্বোচ্চ ২৪ হাজার কোটি টাকার বেশি আদায় করেছে। আদায় হওয়া রাজস্বের বাকি প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা শুল্ক খাত থেকে এসেছে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি পেরিয়ে গেছে, অথচ মাত্র ৫২ লাখের অধিক নাগরিকের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) আছে। কিন্তু বছর শেষে আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন জমা দেয় মাত্র ২০-২২ লাখ। তাদের মধ্যে সাত-আট লাখ সরকারি কর্মকর্তা। প্রতি মাসে বেতন-ভাতা প্রদানের সময় ‘পে রোল ট্যাক্স’ হিসেবে কেটে রাখা হয়। অন্যদিকে যারা বছর শেষে রিটার্ন জমা দেয়, তাদের কমবেশি ১০ শতাংশ শূন্য রিটার্ন জমা দেয়। এর মানে, তারা কোনো কর দেয় না। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে তাদের কোনো ভূমিকা থাকে না। মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র এক দশমিক এক শতাংশ মানুষ কর দেয়, যা খুবই হতাশাজনক চিত্র।
অথচ দক্ষিণ এশিয়ায় জনসংখ্যার অনুপাতে সবচেয়ে বেশি কর দেয় ভুটানের নাগরিকেরা। ভুটানের জনসংখ্যা সাত লাখ ৫৪ হাজারের মধ্যে গত অর্থবছরে প্রায় ৮৮ হাজার করদাতা রিটার্ন দিয়েছে। জনসংখ্যার ১১ শতাংশের বেশি প্রত্যক্ষ করের আওতায় আছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা নেপালের জনসংখ্যার দুই দশমিক আট কোটির মধ্যে ৩০ লাখ (প্রায় ১১ শতাংশ) করদাতা কর দেয়। পাকিস্তানের জনসংখ্যা প্রায় ২০ কোটি এবং তাদের মধ্যে ২৫ লাখের বেশি করদাতা আছে। তবে ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতে এক কোটি ৪৬ লাখ (দেড় শতাংশ) মানুষ কর দেয়।
আগে মানুষ কর দিতে ভয় পেত, কর কমিশনের লোকজনের কথা শুনলে মানুষ পালিয়ে বেড়াত। কিন্তু এখন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বদল হয়েছে। মানুষ নিজের ইচ্ছায় কর দিতে আগ্রহী হয়ে উঠছে, কারণ কর দিলে যে সম্মাননা পাওয়া যায়, সেটা পেলে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যায়। সরকার সর্বোচ্চ করদাতাদের পুরস্কৃত ও নানা সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। এ কারণেও অনেকে কর প্রদানে উৎসাহিত হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের মূল্য সংযোজন দ্বিগুণ হয়েছে। মাথাপিছু গড় আয়ও বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। কিন্তু তাল মিলিয়ে করদাতার সংখ্যা বাড়াতে পারেনি এনবিআর। এনবিআর প্রতিবছর নতুন করদাতার খোঁজে নানা ধরনের কর্মসূচি নেয়। এই কর্মসূচিতে শুধু টিআইএন দেয়া হয়। এতে টিআইএনধারীর সংখ্যা বাড়ে। কিন্তু টিআইএন নিয়ে পরের বছর থেকে কতজন রিটার্ন দিয়ে কর দিল, তা খুঁজে দেখে না এনবিআর। এক্ষেত্রে ছোট করদাতাদের চেয়ে বড় করদাতাদেরই কর ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ বেশি।
২০০৮ সালে দেশে প্রথম আয়কর দিবস পালন শুরু হওয়ার পর বহু করদাতা কর বিষয়ে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ হয়েছে। আয়করের প্রতি দেশের মানুষের আগ্রহ যেমন বেড়েছে, পাশাপাশি বেড়েছে আয়করদাতাদের সংখ্যাও। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছর একজন করদাতাকে নির্ধারিত সময়ে রিটার্ন জমা দিতে হয়। এই লক্ষ্যে কয়েক বছর ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নভেম্বর মাসে সারাদেশে আয়কর মেলা আয়োজন করে আসছে। গতবারের মতো এবারও এনবিআর করোনার কারণে এই আয়োজন থেকে বিরত রয়েছে, কিন্তু অনলাইনে রিটার্ন জমা দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি বছর ৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিটার্ন জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এবারও এর ব্যতিক্রম করা হয়নি। তবে এখনও টিআইএনধারী ও রিটার্ন জমাদানকারীর মধ্যে বিশাল পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। টিআইএনধারীরা যদি রিটার্ন দাখিল না করে তাহলে এনবিআরের কাছে তাদের তথ্য থাকে না। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো রিটার্ন দাখিল-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে অনেকে কর দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এক্ষেত্রে এনবিআরকে রাষ্ট্রের স্বার্থে করদাতাবান্ধব সর্বজনীন ফরম তৈরি ও সহজে বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে বাড়বে রিটার্ন দাখিলকারী, বাড়বে সরকারের রাজস্ব আয়।
প্রতিবছর আয়কর মেলায় অংশ নেয়া মানুষের ভিড় দেখেই বোঝা যায়, মানুষ আয়কর দিতে কতটা আগ্রহী। লক্ষ করার বিষয় হলো, আয়কর মেলায় প্রতি বছর ভিড় বেড়েই চলেছে। কিন্তু এ বছরও করোনাভাইরাসের কারণে আয়কর মেলা হচ্ছে না। তবে আয়কর প্রদানে আগ্রহীদের একটি বড় অভিযোগ হলো, আয়কর প্রদানের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। এক্ষেত্রে সর্বজনীন অনলাইনে রিটার্ন জমা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে এবং এ জটিলতা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে সাধারণ মানুষের করভীতি দূর হবে। দীর্ঘদিন ধরে সর্বজনীন অনলাইনে রিটার্ন জমা দেয়ার কথা শোনা যাচ্ছে, কিন্তু এ বিষয়ে অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এ বছর অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের ব্যবস্থা করলেও সে সম্পর্কে অনেক আয়করদাতাই অবহিত নয়। আয়করদাতাদের সচেতন করতে এটি ব্যাপক প্রচারের দরকার। সাধারণ মানুষের করভীতি দূর করতে না পারলে কাক্সিক্ষত মাত্রায় আয়কর আদায় সম্ভব নয়।
অনেক করদাতার অভিযোগ, তারা পূর্ববর্তী বছরগুলোয় আয়কর মেলা কিংবা অফিসে রিটার্ন জমাদানপূর্বক প্রাপ্তি রশিদ ও আয়কর সনদ সংগ্রহ করার পরও পরে কোনো কোনো আয়কর সার্কেল অফিস আয়কর প্রদানকারীদের চিঠি দিয়ে তলব করে। তখন তাদের জানানো হয়, তাড়াহুড়ো করে রিটার্ন জমা নেয়ার সময় তাদের রিটার্ন ফরম যথাযথভাবে হিসাব বা পরিমাপ করা যায়নি। এক্ষেত্রে তাদের কাছে অতিরিক্ত অর্থ ঘুষ (তাদের ভাষায় বকশিশ) হিসাবে দাবি করা হয় এবং চাহিদামতো প্রদান না করলে আয়কর মামলা বা এ ধরনের জটিল অবস্থায় ফেলার ভয় দেখানো হয়। রিটার্ন জমা দিয়ে আয়কর সনদ সংগ্রহের পরও এ ধরনের পরিস্থিতি খুবই বিব্রতকর, লজ্জাজনক এবং বড় ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করে। অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে দাবীকৃত অর্থ পরিশোধ করে রফাদফা করে থাকে, কিন্তু এর পরও তার মধ্যে পরবর্তী বছরের ভীতিকর অবস্থা কাজ করে।
নিজেদের অর্থে যদি আমরা দেশের উন্নয়ন করতে পারি, তাহলেই আমরা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব। বিশ্বব্যাংক বা অন্য কোনো বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সহায়তা নি?য়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলে তা পারব না। তাই আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে আয়কর দিতে হবে এবং দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে। এই করের টাকা দিয়ে দেশের বড় বড় উন্নয়ন করা সম্ভব হচ্ছে। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল প্রকল্প, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজ এ করের টাকায়ই হচ্ছে।
একসময় বাজেটের একটি বড় অংশ বিদেশি দানের ওপর নির্ভর করতে হতো, কিন্তু এখন অনেকটাই দেশীয় রাজস্ব আহরণ থেকে জোগান দেয়া হচ্ছে। এটা দেশের জন্য অবশ্যই ইতিবাচক ও স্বস্তিদায়ক খবর। অনেকে কর দেয়ার সময় যতটা সম্ভব কম দেয়ার চেষ্টা করেন, এটা ঠিক নয়। সঠিক সময়ে যথাযথভাবে স্বেচ্ছায় কর প্রদান ও রিটার্ন জমা দেয়া দেশপ্রেমের একটি অনন্য উদাহরণ। তাই সঠিকভাবে সবার কর দেয়া উচিত। এ জন্য আসুন সবাই মিলে কর দিই, দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে সবাই মিলে ভূমিকা রাখি।
মো. জিল্লুর রহমানঃ ব্যাংক কর্মকর্তা ও ফ্রিল্যান্স লেখক।