আর্থিক বিপর্যয়ে ব্যাংকের ভূমিকা
অন্জন কুমার রায়ঃ আর্থিক খাতের বিশ্লেষণে অবদান রাখার জন্য এ বছর তিনজনকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। পুরস্কারপ্রাপ্ত তিনজনই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের ব্যবস্থাপনার সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেছেন। আশির দশকের গোড়ার দিক থেকেই তিন অর্থনীতিবিদ তাঁদের গবেষণার মাধ্যমে আর্থিক সঙ্কট মোকাবেলায় ব্যাংকের বহুমুখী ভূমিকা সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।
আর্থিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকের ভূমিকা কিংবা আর্থিক ব্যবস্থাপনায় কোনো দেশের ব্যাংকগুলোর পেশাদারি দক্ষতা এবং কার্যকলাপের উপর কিভাবে প্রভাব ফেলে তা তুলে ধরেছেন। অর্থনীতিতে ব্যাংকগুলোর ভূমিকা, বিশেষ আর্থিক সঙ্কটের সময় বাজারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের কার্যকলাপ অনুধাবন করতে এই তিন অর্থনীতিবিদ গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। মুলত, আর্থিক খাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতি আমানতকারীদের আস্তার সংকট, ঋণ মঞ্জুরের ক্ষেত্রে যাচাই-বাচাইয়ের গুরুত্ব, তারল্য ও মুলধন ঘাটতির ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন, সংকটাপন্ন ব্যাংককে বাঁচিয়ে রাখতে আমানতের উপর যথেষ্ট অঙ্কের বীমার ব্যবস্থা এবং যথাসময়ে সতর্ক না হওয়ার খেসারত হিসেবে পরবর্তী সময় দেউলিয়া ব্যাংককে বাঁচাতে সরকারের বড় অঙ্কের ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ব্যাংকিং ব্যবস্থার সম্ভাব্য সকল ধস রোধ করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে তাঁদের গবেষণা।
কেন আমাদের ব্যাংক প্রয়োজন, ব্যাংকের তারল্য নিরাপত্তা, কিভাবে ব্যাংকের কার্যক্রম গতিশীল রেখে ঝুঁকিমুক্ত রাখা যায়, একটি ব্যাংকের দেউলিয়াপনা আর্থিক সঙ্কটকে কিভাবে বাড়িয়ে তোলে এগুলোই মুলত আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত গবেষণার বিষয়বস্তু। বেন এস. বার্ন্যাঙ্কে, ডগলাস ডব্লিউ ডায়মন্ড ও ফিলিপ এইচ ডিবভিগ আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ। আর্থিক বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক সঙ্কট মোকাবেলায় তাঁদের পর্যবেক্ষণ বা গবেষণা অত্যন্ত বাস্তবিক গুরুত্ব বহন করে।
বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে বিনিয়োগকারীদের ঋণ প্রদান করে থাকে। এভাবে জনগণের সঞ্চয়কে বিনিয়োগের সঙ্গে সম্পর্কিত করার মাধ্যমে অর্থনীতিকে সচল রাখে। মানুষ যখন বিশ্বাস করতে পারে না ব্যাংক তাদের জমানো টাকা ফেরত দিতে পারবে তখনি ব্যাংকের প্রতি আমানতকারীদের অবিশ্বাসের জন্ম হয়। তখন আমানতকারীরা সকলে নিজেদের টাকা তোলে নিতে ব্যাংকে ছোটে। অর্থাৎ, যদি কোন বিশেষ সময়ে আমানতকারীরা গণহারে তাদের সঞ্চিত অর্থ ব্যাংক থেকে তোলা (Bank Run) শুরু করে, তাহলে ব্যাংকের তারল্য সমস্যা সৃষ্টি হয়ে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। ব্যাংক থেকে সকল আমানতকারীকে এক সঙ্গে টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতকারীদের টাকাই বিনিয়োগকারীদের ঋণ হিসেবে প্রদান করা হয়ে থাকে।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
অন্যদিকে, বিনিয়োগকারীদের ঋণ হিসেবে দীর্ঘ মেয়াদী এবং স্বল্প মেয়াদী ঋণ প্রদান করে থাকে। তবে তা আমানতকারীদের সঞ্চিত অর্থের তুলনায় দীর্ঘমেয়াদী হয়। ব্যাংক নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে টাকা ফেরত চাইতে পারে না। অবশ্যই বিনিয়োগকারীরা ঋণ নেওয়ার একটি নির্দিষ্ট সময় পর পরিশোধ করবেন। তাই, অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবাহে কোন বাঁধার সৃষ্টি হলে মেয়াদ অমিল বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে, ব্যাংকের তারল্য সমস্যা সৃষ্টি হয়ে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। সে পরিস্থিতিতে ব্যাংকটি ধসে পড়ার অবস্থা পৌঁছে যায়। ব্রিটানিকা ডটকমের তথ্যমতে, ১৭৭২ সালে লন্ডনে ব্যাংক রানের (Bank Run) ফলে ব্যাংকে তীব্র তারল্য সংকট দেখা দিয়েছিল। ১৭৬০-এর দশকের দিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তার ঔপনিবেশিক অঞ্চলগুলোতে বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে সম্পদ সংগ্রহ করে, যা ব্রিটিশ ব্যাংকগুলোকে দ্রুত প্রসারিত করতে সাহায্য করে।
লন্ডনের ব্যাংকিং হাউস নিল, জেমস, ফোরডিস এবং ডাউন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (ইআইসি) স্টকের অনুমানে ৩০০,০০০ পাউন্ড হারিয়ে ব্যাংকিং খাতে তীব্র অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। ফলে, ব্যাংকে ভয়াবহ তারল্য সংকট দেখা দেয়। ব্যাংকের ক্রেডিট সীমাবদ্ধতা এবং বিল অব এক্সচেঞ্জ মার্কেটে ব্যাঘাত ঘটে যা সংকটকে আরও দ্রুত ছড়িয়ে দেয়। আমানতকারীরা তা জেনে ফেলে। তাই, আমানতকারীরা তাৎক্ষণিক নগদ টাকা তুলে নেওয়ার ব্যাংকে ছুটে আসেন। ব্রিটিশ ব্যাংকগুলোর সামনে দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। ইউরোপে অতি দ্রুত সংকট ছড়িয়ে পড়ে। এটি স্কটল্যান্ডের প্রায় প্রতিটি প্রাইভেট ব্যাংককে দেউলিয়া করে দেয় এবং ইউরোপের আর্থিক কেন্দ্র আমস্টারডাম থেকে হামবুর্গ, সেন্ট পিটার্সবার্গ, জেনেভা, স্টকহোম এবং প্যারিস পর্যন্ত সংকটকে ঘনিভূত করে তুলে। তাই তাঁরা গবেষণায় দেখিয়েছেন, ব্যাংকের চরম সংকটকালীন মুহূর্তে সরকারের আমানত বীমা প্রদান শেষ অবলম্বন হিসেবে কাজ করবে।
তাঁরা আরো দেখিয়েছেন ঋণ যাতে ভাল বিনিয়োগে ব্যবহৃত হয় তা নিশ্চিত করা ব্যাংকের কাজ। সেক্ষেত্রে বেন এস. বার্ন্যাঙ্কে দেখিয়েছেন ২০০৭-০৮ সালে আমেরিকার ব্যাংকগুলো গ্রাহকের আমানতের টাকা বিনিয়োগ করেছিল এমন সম্পদে যার ফলে উৎপাদনশীল বিনিয়োগের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছিল। আবাসন খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ বেশি হওয়ায় লাগাম টানার জন্য সুদের হার আরো বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে, ঋণগ্রহীতাদের সুদ পরিশোধ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেকেই ব্যাংকে বন্ধক দেওয়া সম্পত্তি বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। যার ফলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট দেখা দেয়। যা ব্যাংকিং ইতিহাসে সাবপ্রাইম মর্টগেজ (Sub Prime Mortgage) ক্রাইসিস নামে পরিচিত। এই সঙ্কটের ফলেই ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক লেম্যান ব্রাদার্স নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছিল। ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ ব্যবস্থা এবং আর্থিক খাতের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনাই মূলত অর্থনীতি মন্দার জন্য দায়ী। সাব প্রাইম সঙ্কটে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাত চরম মন্দার সময় মার্কিন মুদ্রানীতি প্রণয়নের ভার বেন এস. বার্ন্যাঙ্কে হাতে ন্যস্ত ছিল। তিনিই প্রধান নীতি নির্ধারক হয়ে দেউলিয়াত্বের হাত থেকে উদ্ধার করেছেন এআইজি (American International Group) এর মতো বীমা প্রতিষ্ঠানকে।
আরও দেখুন:
◾ সুদের হার বেঁধে রেখে কার লাভ?
তাঁদের গবেষণায় ব্যাংকিং চ্যালেঞ্জের সর্বোত্তম সমাধান নির্দেশ করতে পেরেছেন বলে মনে করে নোবেল কমিটি। গবেষণায় বলা হয়েছে, চরম সংকটকালীন মুহূর্তে সর্বশেষ উৎস হিসেবে সরকারের তরফ থেকে তহবিল দেওয়া হবে এমন নিশ্চয়তা যদি বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে দেওয়া হয়, সেটি ব্যাংকিং ব্যবস্থার অন্যতম রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে।
লেখকঃ অন্জন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট।