যাহা ‘রিবা’ তাহাই সুদ, প্রতিটি ধর্মেই সুদ নিষিদ্ধ
সাম্প্রতিককালে ইসলামিক ফাইনান্স বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে সম্মানিত স্কলারগণ প্রচলিত ব্যাংকের সুদকে হারাম জ্ঞান করেই এর বিকল্প হিসেবে মানুষের জীবনকে সহজতর ও আরামদায়ক করার লক্ষ্যে ‘প্রয়োজনীয়তার স্তর তত্ত্বের’ (Theory of levels of necessities) আলোকে মানুষের প্রয়োজনগুলোকে তিন স্তরে ভাগ করে (স্তরগুলো হলো- জরুরিয়াত বা অত্যাবশ্যকীয়, হাজিয়াত বা প্রয়োজনীয়, ও তাহসিনিয়াত বা সৌন্দর্ববর্ধক) নতুন নতুন শরীয়াহ প্রোডাক্টের আইডিয়া বিশ্লেষণ করে যাচ্ছেন। যা পরবর্তীতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের নিকট উন্নয়নের একটি মডেল হিসেবে গ্রহণযোগ্য, সমাদৃত ও প্রশংসিত হয়ে থাকে।
সুপ্রাচীন কাল থেকে দুনিয়ায় আসমানী ধর্ম হিসেবে প্রচারিত সকল ধর্মেই সুদ নিষিদ্ধ ছিল। তাই সুদ প্রতিটি ধর্মেই হারাম। ইহুদি, খৃস্টান ও হিন্দু ধর্মগ্রন্থেও সুদ নিষেদ্ধের বর্ণনা এসেছে পরিষ্কারভাবে। পাকিস্তানের সাবেক বিচারপতি ওয়াজিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘বেবিলনীয় যুগে (খৃস্টপূর্ব ১৭৫০-১৭১২) হাম্বুরাবি সংহিতায় সুদ লেনদেনসংক্রান্ত দৃষ্টান্তের অভিব্যক্তি পরিলক্ষিত হয়, সম্ভবত এর অনুকূলে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, ধর্মীয় অনুমোদন ছিল না। তবে হিন্দুধর্ম (মনুসংহিতা) এবং ইহুদী ও খৃষ্টধর্মে সুদকে হয় নিয়ন্ত্রণ করা হতো, না হয় রীতি মাফিক তা নিষিদ্ধ ছিল।’ তিনি আরো মন্তব্য করেছেন এভাবে, ‘মানব সভ্যতা যতটা পুরাতন সুদের ধারণাটিও ততটাই প্রাচীন। সুদের ওপর আল-কুরআনের নিষেধাজ্ঞা কার্যত আহলি কিতাবদের (ইহুদি ও খৃস্টান) ওপর এই বিষয়ে পূর্ব থেকে আরোপিত ও প্রযোজ্য বিধিনিষেধের ধারাবাহিকতা মাত্র’। Exodus- ২২ঃ২৪ (তাওরাত) এ বলা হয়েছে ‘তোমরা যদি আমার কোন লোককে অর্থ ধার দাও যারা গরীব, তবে তোমরা তার কাছে সুদ গ্রহীতার ন্যায় হয়ো না এবং তার কাছ থেকে সূদ আদায় করবে না’। Proverbs -২৮ : ৮ তে বলা হয়েছে ‘যে সুদ এবং অন্যায় উপার্জনের দ্বারা তার সম্পদ-সম্পত্তি বৃদ্ধি করে, সে তা নিজের জন্য পুঞ্জিভূত করে যা দরিদ্রের দুর্দশা বাড়ায়’।
Leviticus: 25:35-37 তে বলা হয়েছে ‘If your brother meets with difficult times, you shall give him shelter and lodging, though he be a stranger or a sojourner, that he may live with you. Do not exact from him any interest (riba) over and above that which you have spent on himv. You have the anger of God to fear. See to it that your brother has freedom to live with you. It is not permissible for you to receive interest (riba) on that you spend, or what write off’.
খৃস্টান ধর্মগ্রন্থ The Gospel of St. Luke এ বলা হয়েছে, Land, hoping for nothing again’ (ধার দাও, তার বিনিময়ে কিছু আশা না করে)। হিন্দুধর্মে ‘মনু’ এর (২য় শতাব্দী এডি) বিধিমালায় সুদের লেনদেন অবৈধ বা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। প্রাচীন হিন্দু সমাজে একটি প্রবাদ চালু ছিল যে, ‘নগচ্ছেৎ শুন্ডিকায়লং’; অর্থাৎ সুদখোরের বাড়িতে যেয়ো না। বৌদ্ধ ধর্মেও সুদকে ঘৃণা করা হয়েছে এবং সুদখোরদের ‘ভন্ড তপস্বী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘hypocrical ascetics are accused of practicing it.’ প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক প্ল্যাটো তার ‘লজ’ নামক পুস্তকে সুদকে মানবতাবিরোধী, অন্যায় ও জুলুম এবং কৃত্রিম ব্যবসা বলে তীব্রভাবে বিরোধিতা করেছেন’। প্ল্যাটোর শিষ্য এরিস্টোটলও কঠোর ভাষায় সুদের নিন্দা ও বিরোধিতা করেছেন। তিনি অর্থকে বন্ধ্যা মুরগীর সাথে তুলনা করেছেন যা ডিম দিতে পারে না।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
তিনি তার পলিটিক্স শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘The most hated sort (of wealth), and with the greatest reason, is usury, which makes gain out of money itself, and from the natural objects of it. For money was intended to be used in exchange, and not increase at interest of all modes of getting wealth, this is the most unnatural.’
সুদ মানবতার জন্য একটি জঘন্য অভিশাপ। সুদের অশুভ কালো হাত বা অনিষ্ট কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং এর কুফল ও ধ্বংশকারিতা মানব জীবনের নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়। ইসলাম কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট ও অকাট্য দলিল দ্বারা সূদকে হারাম করেছে এবং নিষিদ্ধ করণে অতি কঠোরতা দেখিয়েছে। এতে কোন চিন্তাবিদের চিন্তা কিংবা ইজতিহাদের সমর্থকের মন্তব্যের কোন স্থান নেই, কারণ যে বিষয়টি অকাট্য প্রমাণাদী দ্বারা সাব্যস্ত হয় তাতে ইজতিহাদ চলে না।
সুদের ভয়াভহ পরিণতি জানতে একজন মুসলমানের জন্য সূরা বাকারার শেষের দিকের আয়াতগুলো পাঠ করাই যথেষ্ট। আয়াতে কারিমায় নিহিত ভীতি প্রদর্শনের ভয়াবহতা ও শাস্তিদানের হুমকির তীব্রতায় তার বুকের মাঝে অবস্থিত হৃদয় বেরিয়ে যাবার উপক্রম হবে।
আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেন, “যারা সূদ খায় তারা সে ব্যক্তির ন্যায় দাঁড়াবে যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে। এজন্য সে তারা বলে ক্রয় বিক্রয় তো সুদের মতই, অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন। যার কাছে তার প্রতিপালকের উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে তবে অতীতে যা হয়েছে তা তারই এবং তার ব্যাপার আল্লাহর ইখতিয়ারে। আর যারা পুনরায় আরম্ভ করবে তারাই অগ্নির অধিবাসী সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ কোন অকৃজ্ঞ পাপীকে ভাল বাসেন না। আর যদি তোমরা সুদ না ছাড় তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের (জন্য প্রস্তুত হও) ঘোষণা দাও। (আল কুরআন -২: ২৭৫-২৭৬)
অসংখ্য হাদীসে রাসূল (সা.) সুদের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি বর্ননা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে সুদ খায়, যে খাওয়ায়, যে লেখে, যে স্বাক্ষী সবাই অভিশপ্ত (তিরমিযি, আবু দাউদ)।
আরেকটি বর্ণনায় এসেছে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘মিরাজের রজনীতে আমি সপ্ত আকাশে পৌঁছে যখন উপরের দিকে তাকালাম তখন বজ্রধ্বনি, বিকট ও প্রকট শব্দ শুনতে পেলাম। অতপর আমি এমন এক সম্প্রদায়ের নিকট এলাম যাদের পেট ছিল একটি ঘরের ন্যায় বিস্তৃত। তাদের পেট ছিল সর্পে ভরপুর। সর্পগুলো বাহির থেকে দেখা যাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাইল! এরা কারা? তিনি বললেন এরা হলো সুদখোর সম্প্রদায়’ (আহমদ, ইবনে মাযাহ)। রাসূল (সা.)
আরেকটি হাদীসে বলেছেন ‘সুদের ভিতর সত্তরটি গুনাহ রয়েছে, তম্মধ্যে সর্বনিম্ন গুনাহ হলো নিজের মায়ের সাথে ব্যাভিচারে লিপ্ত হওয়ার সমতুল্য’। (মেশকাত শরীফ) তিনি আরো বলেছেন, জেনেশুনে সুদের এক দিরহাম গ্রহণ করা ছত্রিশ বার যিনা করার চেয়ে মারাত্মক অপরাধ (বায়হাকী ও ইবনে মাযাহ)। আরেকটি হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘সুদখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ (মুসতাদরাকি হাকীম)। তিনি আরো বলেছেন,‘ আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সুদ সমৃদ্ধি আনে, কিন্তু সুদের চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে অভাব ও সংকোচন। (মুসনাদে আহমদ)
আরবী পরিভাষায় যাকে ‘রিবা’ ইংরেজিতে যাকে Usury/interest, উর্দু, ফার্সি এবং বাংলায় তাকে ‘সুদ’ বলা হয়ে থাকে। সুদকে ব্যবহারিক বাংলায় ‘কুসিদ’ও বলা হয়।
আরবী ‘বিরা’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে- প্রবৃদ্ধি, বাড়তি, অতিরিক্ত, বিকাশ, সম্প্রসারণ, বিনিময় ছাড়া বৃদ্ধি প্রভৃতি। ইসলামে ঐ বৃদ্ধিকে ‘বিরা’ বলা হয় যা প্রদত্ত ঋণের উপর ঋণের শর্ত হিসেবে অতিরিক্ত ধার্য করে আদায় করা হয়। ড. ওমর চাপরা লিখেছেন, ‘রিবা সেই অতিরিক্তকে বুঝায় যা ঋণের শর্ত হিসেবে অথবা ঋণের মেয়াদ বৃদ্ধির দরুণ ঋণগ্রহিতা ঋণদাতাকে তার প্রদত্ত ঋণের আসলসহ পরিশোধ করতে বাধ্য হয়’।
প্রাথমিক যুগ থেকেই মুসলিম বিশেষজ্ঞগণ ‘রিবা’কে সর্বসম্মতভাবে এই অর্থেই বুঝে আসছেন। আধুনিক কালে ইসলামী আইনবেত্তাদের বেশ কয়কটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তম্মধ্যে, মুতামার আল-ফিকহ আল-ইসলামীর উদ্যোগে ১৯৫১ সালে প্যারিসে এবং ১৯৬৫ সালে কায়রোতে, ওআইসি ও রাবেতা ফিকহ কমিটির উদ্যোগে ১৯৮৫ সালে কায়রোতে এবং ১৯৮৬ সালে মক্কায় উল্লেখযোগ্য। এ সব সম্মেলনসহ ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার আগে ইসলামী বিশ্বের ভেতরে ও বাইরের বিভিন্ন দেশের রাজধানীতে বিশেষ বৈঠক, মিটিং, কনফারেন্স, সেমিনার ও সম্মেলন করা হয়েছে। সব সম্মেলনেই ‘রিবা’ সম্পর্কে উক্ত রূপ রায় দেয়া হয়েছে এবং ব্যাংকের মুনাফা হারাম হওয়ার ব্যাপারে সকলের অকাট্যভাবে ঐকমত্য পেশ করা হয়েছে। সুতরাং একথাও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে ব্যাংকের মুনাফাই হারাম, ঘোষিত সূদ।
এ প্রসঙ্গে ড. ইউসুফ আল-ক্বারযাভী বলেন, ‘সব সময় আমার একথাও স্মরণ হয় যে কিভাবে শাহ আব্দুল আজীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে তিনশরও বেশি অর্থনীতি ও আইন শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ স্কলার বিশ্বের বিভিন্ন দেশ হতে মক্কা মুকাররমায় অনুষ্ঠিত ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন, তাদের মধ্যে একজন ও ব্যাংকের মুনাফা হারামে দ্বিমত পোষণ করেননি; বরং সকলেই এ থেকে রক্ষা পাওয়ার আবশ্যিকতার প্রতি গুরুত্বারোপ করে সুদমুক্ত ব্যাংকিংয়ের পরিকল্পনা পেশ করেন। এরই বরকতময় পরিণতি হলো ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুদি ব্যাংকের শরয়ী বিকল্প আবিষ্কার’।
বর্তমানে সুদের বৈধতার জন্য যে সব যুক্তি উপস্থাপন করা হচ্ছে তন্মধ্যে বলা হয়ে থাকে কুরআনুল কারীম যে সুদকে হারাম করেছে তা হলো চক্রবৃদ্ধি সুদ। স্বল্প পরিমাণ সুদ যেমন ৮% বা ১০% এগুলো নিষিদ্ধ সুদের আওতায় পড়ে না। এটা মূলত গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে উত্থাপিত সন্দেহ, কুরআনুল কারীমের সুরা আলে-ইমরানে বর্ণিত আয়াতে এর সামান্যতম মুনাফা বাদ দেয়ার দাবি করা হয়েছে।
আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদারগণ তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেও না, আল্লাহকে ভয় কর, যেন সফল হতে পার (সূরা আল-ইমরান : ১৩০)।
আরবী ভাষার প্রয়োগ পদ্ধতি এবং আরবী ভাষা সম্বন্ধে যাদের কিঞ্চিৎ ধারণা রয়েছে তারা জানে যে “রিবা” শব্দটির বিশেষণ (চক্রবৃদ্ধি হারে) শুধুমাত্র বাস্তবতা ও এর ভয়াবহতার বিভৎস চিত্র তুলে ধরার জন্য উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ সেকালের আরব উচ্চহারে চক্রবৃদ্ধি সুদ গ্রহণের শেষ সীমায় উপনিত হয়েছিল। এ ধরনের বিশেষণ শর্ত হিসেবে ধর্তব্য হবে না সুতরাং চক্রবৃদ্ধি না হলে যে তা বৈধ হবে এমনটি নয়।
এটার উদাহরণ হলো যেমন আজকাল বলা হয়ে থাকে বিনাশী মাদকের মোকাবেলা কর যা মানুষকে সমূলে ধ্বংস করছে। এখানে মাদকের বিশেষণ “বিনাশী” বাস্তবতার বর্ণনা যা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং সমগ্র ভয়াবহতা ছাড়িয়ে গেছে, এ কথা বলার কারণে নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিরোধ হতে কোন প্রকার মাদককে বাদ রাখা উদ্দেশ্য নয়। বরং হতাশাব্যঞ্জক বাস্তবতার বিভৎস চিত্র ও ভয়াবহতার কথা বলা হয়েছে যেন সকলে মিলে সর্ব প্রকার মাদকতার মুকাবেলা ও প্রতিরোধ করার জন্য কাজ করে।
ইসলামে কোন বস্তু হারাম ঘোষিত হওয়ার পদ্ধতি হলো বেশিতে পতিত হওয়ার আশঙ্কার কারণে কম হতে নিষেধ করা এবং বিপর্যয়ের হাওয়া প্রবাহিত হতে পারে সে সন্দেহে দরজাই বন্ধ করে দেয়া।
সমগ্র মানবতার উপর ইসলামের অনুগ্রহ হলো যে ইসলাম সুদকে সাবলীল ভাষায় হারাম করেছে। বিকৃত তৌরাতের মত বলেনি, যে ইহুদীদের পারস্পারিক লেন-দেনের ক্ষেত্রে সুদ গ্রহণ হারাম তবে অ-ইহুদীদের সাথে লেন-দেনে সুদ দেয়া-নেয়া বৈধ। ইসলাম, মুসলিম-অমুসলিম সকলের সাথে লেন-দেনে সুদ দেয়া-নেয়া উভয়টাকেই হারাম করেছে। ইসলাম দ্বিমুখী কথা ও দ্বৈত রীতি অবলন্বন করার সুযোগ দেয়নি। সুদ কার্পণ্য, স্বার্থন্ধতা, হৃদয়হীনতা, নিষ্ঠুরতা প্রভৃতি অসৎ গুণাবলী মানুষের মাঝে সৃষ্টি করে। সুদ বিভিন্ন জাতির মধ্যে শত্রুতার বীজ বপন করে। মানুষের মধ্যকার সহানুভূতি ও পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতার সম্পর্ক ছিন্ন করে। ইমাম রাযী তার তাফসিরে লিখেছেন, ‘কোনরূপ বিনিময় ছাড়াই সুদ লোকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে। সুদের মাধ্যমে অর্থাগমনের উপর নির্ভরশীলতা মানুষকে পরিশ্রম করে উপার্জন করা থেকে বিমুখ ও অনুৎসাহী বানিয়ে দেয়’।
সুদের বিকল্প হচ্ছে অধুনা ইসলামী ব্যাংকিং ও ফাইনান্স। ইসলামী ব্যাংকিং এমন একটি সুদের কারবারহীন কৌশল ও পরিচালনা, যা ব্যবসায়িক উদ্যোগের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ইসলামী শরীয়াহ নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবার কারণে এ ব্যাংকের সকল লেনদেন সুদের নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত এবং সেই সাথে আর্থ-সামাজিক সুবিচার ও মানুষের সার্বিক উন্নয়ন এ ব্যাংকিংয়ের লক্ষ্য। এ ব্যাংকব্যবস্থায় পরিচালিত প্রকল্পগুলো সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষের শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথাই চিন্তা করে না; বরং সামাজিক এবং নৈতিক উন্নয়নের উপরও গুরুত্বারোপ করে।
গত বছরের ২৬-২৭ অক্টোম্বর মালয়েশিয়ার ‘কুয়ালালামপুর কনভেনশনাল সেন্টারে’ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ব্যাংকিং কনফারেন্স’ (আইআইবিসি-২০১৪)। মালয়েশিয়ার অর্থমন্ত্রী আহমদ হুসনি মুহাম্মদ হানাযিলাহ উক্ত সম্মেলনের উদ্ভোধনী বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘Malaysia`s success in the development and expansion of Islamic Finance is undisputed. We are proud to have been a pioneer in many areas of Islamic Finance.’
সারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন ধর্মের চার শতাধিকেরও অধিক বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও শরীয়াহ স্কলার উক্ত সম্মেলনে যোগদান করেন। মালয়েশিয়ার ‘ব্যাংক রাকাত’ কর্তৃপক্ষ তাদের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এ সম্মেলনটির আয়োজন করেন। আমন্ত্রিত হয়ে আমি ও আমার দুই বন্ধু সম্মেলনটিতে যোগ দিই এবং মাহাথিরের দেশে ১০ দিন অবস্থান করে সেদেশের ইসলামিক ব্যাংকিং এবং ফাইনান্সের সমৃদ্ধি,অগ্রগতি ও সৌন্দর্য স্বচক্ষে অবলোকন করার সুযোগ লাভ করি।
সম্মেলনে আমরা আমাদের দেশের ইসলামিক ব্যাংকিং এবং ফাইনান্সের বিভিন্ন দিকের অগ্রগতি ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরি। বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং এবং ফাইনান্সের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি এবং সম্ভাবনা উপস্থিত স্কলারগণ একবাক্যে স্বীকার করেন, বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন। সম্মেলনের অর্থমন্ত্রীর চমৎকার বক্তৃতা, ইসলামী ফাইনান্স এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে তার অগাধ পান্ডিত্য, আমাদের প্রতি তার অকৃত্রিম আন্তরিকতা সর্বোপরি বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং প্রশাংসা, সত্যিই অতুলনীয়।
ইসলামিক ফাইনান্স মানব জীবনের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক উভয় দিককে উন্নতির শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আজকের ‘মালয়েশিয়া’। সামগ্রিক ব্যাংকিংয়ের ১৮ শতাংশ ধারণ করে মালয়েশিয়ার ইসলামী ব্যাংকিং দুনিয়াব্যাপী শরীয়াহ ব্যাংকিংয়ের অন্যতম কেন্দ্রভূমির (Hub) পরিচিতি লাভ করেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ আরো ২% এগিয়ে রয়েছে। অপার সম্ভাবনাময় এ দেশ অগ্রগামী পাঁচ স্বল্পোন্নত দেশের একটিতে পরিণত হয়েছে। অন্তর্ভুক্ত হয়েছে উদিয়মান এগার দেশের কাতারে। হতে যাচ্ছে মাধ্যম আয়ের দেশে।
এমতাবস্থায় মালয়েশিয়ার মতো আমরাও যদি আলাদা ইসলামী ব্যাংকিং আইন, শিক্ষা কারিকুলামে ইসলামী ব্যাংকিং, ইসলামী ফাইনান্স বিশ্ববিদ্যালয়, সুকুক গবেষণা, উচ্চমানের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, গবেষকদের যথার্থ মূলায়ন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনার্স-মাস্টার্স, এমফিল-পিএইচডি, কিংবা ডিপ্লোমা পর্যায়ে ইসলামিক ব্যাংকিং/ফাইনান্স/ইন্স্যুরেন্স সাবজেক্ট চালু প্রভৃতির মাধ্যমে আমাদের সম্ভাবনাময় বাজারকে সমৃদ্ধ করতে পারি তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আমরা আশাবাদী যে আমাদের অর্থমন্ত্রী সুদের সাফাই গাওয়া ও ইসলামী ব্যাংকের পরিবর্তে সংসদে কিংবা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দাঁড়িয়ে মালয়েশিয়ার অর্থমন্ত্রীর মতো বুক ফুলিয়ে বলতে পারবেন ‘ইসলামিক ফাইনান্সের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সফলতা বিতর্কের ঊর্ধ্বে। আমরা ইসলামিক ফাইনান্সের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগামী হওয়ায় গর্ববোধ করছি’।
লেখকঃ ড. মুহাম্মদ ওমর ফয়সল, ব্যাংকার।