বিশেষ কলাম

রেমিটেন্সেই সমাধান আশা

মো: মোসলেহ উদ্দিনঃ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রায় প্রবাসীদের অবদান অসামান্য। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রথম জনশক্তি রফতানি শুরু হয়। ১৪ হাজার জনের প্রথম দলটি কাজের সন্ধানে মধ্যেপ্রাচ্যে যায় সরাসরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায়। সেবছরই তাদের মাধ্যমে দেশে পাঁচ কোটি ডলার রেমিটেন্স প্রবেশ করে। এরপর থেকে প্রতিবছর বিদেশগামিদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। একই সাথে মধ্যেপ্রাচ্যের বাইরেও এশিয়া ইউরোপ এবং আমেরিকাসহ বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশে জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্র বিস্তৃতি হয়। পর্যায়ক্রমে বিদেশগামি মানুষের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এক সময় তা কোটি ছাড়ায়।

বর্তমানে ১৩ মিলিয়ন বা এক কোটি ত্রিশ লাখ বাংলাদেশী প্রবাসী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত আছেন। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অভিবাসী বা প্রবাসীর তালিকায় সর্বাধিক বিশটি দেশের মধ্যে চতুর্থ। তবে আয় বিচারে শীর্ষ দশ দেশের মাঝে এর অবস্থান সপ্তম। প্রধানত: অদক্ষ কর্মী প্রেরণ এবং পোস্ট মাইগ্রেশন সুপাভিশনের অভাবই জনশক্তিতে চতুর্থ থাকার পরও আয় সূচকে সপ্তম অবস্থান। অধিকন্ত অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়, ভিসা বিড়ম্বনা এবং এয়ার টিকেট হয়রানি তো আছেই। যার সর্বশেষ দেখা গেল করোনা পরবর্তী প্রবাসিদের বিদেশ গমনে ঘাটে ঘাটে ঘটে যাওয়া নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার চিত্র থেকে।

২০২০ সালের শুরুতে কিংবা সামান্য আগে স্বাভাবিক সময়ে ছুটিতে দেশে আসা প্রবাসীরা আচমকাই আটকা পড়েন বিশ্বময় কোভিড ১৯ এর কারণে। এর মাঝে বাধ্য হয়ে পুরো বছর দেশে কাটানোয় তাদের অনেকের ছুটির মেয়াদ, অনেকের আবার ছুটি এবং ভিসা উভয়টির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। যাদের ভিসা এবং আনুষাঙ্গিক কাগজপত্র ঠিক আছে তারা ফিরে যাবার ব্যাপারে আশাবাদী থাকেন। চাকুরীদাতা কোম্পানী এবং ব্যক্তি তরফে বলা হয় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাদের ডাক পড়তে পারে। এমনই আশা-নিরাশার দোলাচলে যাপিত সময়ের পর প্রবাসীরা হন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখী। প্রথম দিকে সৌদি আরবে কর্মরত শ্রমিকদের কর্মস্থলে ফেরার ডেটলাইন ২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ফেরার শেষ সুযোগ হয়ে দাঁড়ায়। অথচ নানা কারণে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে। শুরু হয় ফের নয়া অনিশ্চয়তা।

প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মস্থলে ফেরা নিয়ে প্রথম বিরোধ বাধে বাংলাদেশ বিমান এবং সৌদি এয়ারলাইন্সের মাঝে পরিবহন ইস্যু নিয়ে। সৌদিয়া একাই সব যাত্রী বহন করতে চাইলে সঙ্গত কারণে বাধ সাধে বিমান। সপ্তাহ ব্যবধানে উভয় এয়ারলাইন্সের সম্মতিতে সমঝোতমূলক সমাধান হয় যে, উভয়েই যাত্রি বহন করবে। প্রবাসী শ্রমিকরা আশ্বস্ত হয় এবং টিকেটের জন্য দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশ বিমান এবং সৌদি এয়ারলাইন্স অফিসে। কিন্তু নানা অজুহাতে টিকেট প্রাপ্তিতে বিলম্ব ঘটে। এখানে ওখানে দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত এবং অনিশ্চিত টানপোড়েনে পড়ে শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ ‍শুরু করে। এহেন পরিস্থিতিতে সক্রিয় হয় পররাষ্ট্র এবং প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। অতপর কিছু লোকের হাতে টিকেট পৌঁছায় নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি টাকায়।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

বিড়ম্বনা এবং প্রতারণার শিকার হয় কোভিড টেস্ট নিয়েও। রিপোর্ট প্রাপ্তিতে বিলম্ব, বেসরকারি হাসপাতালের অতিরিক্ত ফি এবং রিপোর্ট জালিয়াতির শিকার হয়ে দিশেহারা প্রবাসীদের ’ছাইড়া দে মা কাইন্দা বাঁচি’ অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়। এভাবেই ত্যক্ত বিরক্ত প্রবাসীরা নানা জটিলতার মাঝেই পর্যায়ক্রমে দেশ ছাড়েন। কর্মস্থলে পৌঁছা অনেক প্রবাসী এখনো সেসময়কার বিভীষিকাময় অবস্থার কথা বলতে হাঁপিয়ে উঠেন। বলেন, এমন অবস্থা বিশ্বের আর কোনো দেশের প্রবাসীদের ক্ষেত্রে ঘটেনি।

করোনা সংকটকালের দু’বছর বলতে গেলে প্রবাসীদের রেমিটেন্সের অতিপ্রবাহ আমাদের অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি ধরে রাখতে সহায়তা করে। কিন্তু জাতি হিসেব আমরা প্রবাসীদের প্রতি তাদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ন্যূনতম সৌজন্যতা বা কৃতজ্ঞতাবোধ দেখানোর গরজ আগে যেমন বোধ করিনি তেমন করে এবারও ব্যর্থ হয়েছি। আর সেকারণেই হয়তো এখন তাদেরকে দাবি করে বলতে পারছি না, ভাইসব দেশের স্বার্থে আপনাদের রেমিটেন্সের সমুদয় টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলেই পাঠান। রেমিটেন্সের টাকার উপর দুই থেকে আড়াই পার্সেন্ট প্রণোদনা যোগ করে ভাব দেখানোর চেয়ে তাদের প্রতি সম্মান দেখানোটা যে বেশি জুরুরি তা কিন্তু আমাদের কল্পনায়ই আসেনি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের প্রধান অপর মাধ্যমটি হলো রফতানি আয়। যদিও রফতানি পণ্য তৈরির কাঁচামাল এবং মূলধন মেশিনারিজ আমদানিতে রফতানি আয়ের একটা বড় অংশ ফের বিদেশেই চলে যায়। সেক্ষেত্রে রেমিটেন্স আয়ই মূলত বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ভারসাম্য নিশ্চিত করে। বর্তমান বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে রফতানি আয়ের নিম্নমুখীতায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যখন চাপ তখন রেমিটেন্স প্রবাহের ভাটা নয়া শংকার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। টাকার বিপরীতে ডলারের রেটের দ্রুত উলম্ফনের ধারায় প্রবাসীরাও প্রভাবিত হন। ব্যাংকের চেয়ে বেশি রেটের হুন্ডিমুদ্র বাজারের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলে।

এখন দেশের স্বার্থে রেমিটেন্স যোদ্ধা প্রবাসীদের মন গলাতে রাষ্ট্রীয় পক্ষে উদ্যোগ নেয়াটা বেশি জরুরি। সেলক্ষ্যে বেশি রেমিটেন্স উৎসের দেশ সমূহে রেমিটেন্স সেবায় বিশ্বস্ত এবং অগ্রগামী ব্যাংকার সমন্বয়ে সরকারি/‌ বেসরকা‌রি প্রতিনিধি দল পাঠানো যায়। পাশাপাশি প্রবাসিদেরও ন্যূনতম সম্মান এবং সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য অবস্থান থেকে আশ্বস্ত করতে হবে। অভিবাসন ব্যয় ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা, প্রবাসীদের পক্ষে দূতাবাসসমূহের সহায়ক ভূমিকা পালন, মানবপাচারকারিদের দৌরাত্ম ও বিমানবন্দরের হয়রানি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চয়তা দিতে হবে ইত্যাদি।

বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের কারণে রফতানিকারকরা রাষ্ট্রের কাছে সম্মানিত এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত হতে পারলে প্রবাসীরা কেন নয়? তাই আসুন, জাতীয় কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে প্রবাসীদের উদ্দেশ্যে পূর্বেকার ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য একবার হলেও ”সরি” বলি, তাদেরকে ধন্যবাদ দেই এবং আবেদন জানাই তাদের রেমিটেন্সের টাকার শতভাগ যেন ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠিয়ে বরাবরের মতোই দেশের পাশে থাকেন।

লেখকঃ মো: মোসলেহ উদ্দিন: ব্যাংকার, কবি ও কলামিস্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button