ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের লাগাম শক্তভাবে টেনে ধরতে হবে
মো. জিল্লুর রহমান: দেশের ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না। দিন দিন উদ্বেগজনক হারে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। খেলাপি ঋণ এখন ব্যাংকিং সেক্টরের গলার কাঁটা। মূলত ব্যাংক খাতে দুর্নীতি, অনিয়ম, ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাব, সুশাসনের অভাব, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ শিথিলতা প্রভৃতি কারণে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে নানারকম নেতিবাচক চিত্র উঠে আসে। তবে খেলাপি ঋণের স্ফীত চিত্র দেশের ব্যাংক খাত, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের অশনি সংকেত। তবে এ কথা সত্য, কভিডকালীন চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এ কারণে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি এবং ডলার সংকট ব্যাংকিং ব্যাবস্থাকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা এবং এর মধ্যে এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা ছিল খেলাপি, যা দেশের ব্যাংক খাতের মোট বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ৩১ মার্চ দেশের ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা এবং এর মধ্যে খেলাপি ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকার ঋণ। ওই সময়ে বিতরণকৃত মোট ঋণের ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ ছিল খেলাপির খাতায়। আর ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ তিন হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। এ হিসেবে গত ছয় মাসে ব্যাংক খাতে ২১ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
উপর্যুক্ত তথ্যমতে, গত মার্চ থেকে জুন এ তিন মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ছয় হাজার ৬৯২ কোটি টাকা। জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত এ ছয় বাণিজিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৫ হাজার ৪২৯ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ২১ দশমিক ৯৩ শতাংশই বর্তমানে খেলাপি। গত তিন মাসে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে চার হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা। জুন শেষে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ছয় শতাংশ বর্তমানে খেলাপি।
খেলাপি ঋণ না কমে বরং দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে সময়মতো যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়া। কভিড পরিস্থিতি এ অবস্থাকে আরও নাজুক করে তুলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ অনুসারে কাউকে নতুন করে খেলাপি বলা যাচ্ছে না এবং একইসঙ্গে ঋণ আদায়ের জন্য কোনো জোরালো তাগাদা বা কঠিন আইনি ব্যবস্থাও নেয়া যাচ্ছে না।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
কয়েকজন অর্থনীতিবিদ বলছেন, মুষ্টিমেয় অসাধু কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক দুষ্টচক্রের দাপট ও আধিপত্যের কারণে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি খেলাপি ঋণের প্রসার ঘটায়। মিথ্যা তথ্য ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেয়ার পর তা খেলাপিতে পরিণত করার প্রবণতা শুরুতেই যদি ব্যাংকগুলো রোধ করতে পারত কিংবা এখনও পারে, তাহলে ঝুঁকি এড়ানোর পথ থাকত। জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা না থাকায় সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংকসহ আরও কিছু ব্যাংকের বড় ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। আমাদের সমাজে বস্তুত ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করার প্রবণতা এক ধরনের অপসংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। খেলাপি ঋণের বিস্তার ব্যাংকগুলোর ভিত্তিকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করছে।
২০০৯ সালে বর্তমান সরকার যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। আর এখন তা এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। একটা সময় ছিল যখন ব্যাংকে টাকা আমানত হিসেবে রাখলে মাত্র ছয় বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে যেত। কিন্তু আমানতকারীদের সেই রমরমা অবস্থা আর নেই। সে জায়গা দখল করে নিয়েছে ঋণখেলাপিরা। ফলে মাত্র ১৩ বছরেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে পাঁচ গুণের বেশি। আর যদি অবলোপন করা ঋণ ধরা হয়, তাহলে তা এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি চলে যাবে। এখন পর্যন্ত অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এটাকে গোপন খেলাপি ঋণ বলা যায়। তাছাড়া পুনঃতফসিল করে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ ঢেকে রাখা হয়, বছরের পর বছর অপরিশোধিত অবস্থায় থাকে।
ব্যাংকগুলোর ওপর তদারকি ও নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে কালক্ষেপণ না করে কঠোর আইন প্রণয়নের বিষয়টি ভাবতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা না গেলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়তেই থাকবে এবং তা ভবিষ্যতে আরও গভীর সংকট সৃষ্টি করবে। মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার পাশাপাশি সুশাসনের প্রভাব ব্যাংক খাতের অন্যতম প্রধান সমস্যা।
অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল করতে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনার দিকে আরও গভীরভাবে মনোনিবেশ করা জরুরি। এ সত্য অস্বীকার করা যাবে না যে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত, বিভিন্ন শিল্প-কারখানাসহ দেশে বড় ধরনের উন্নয়ন অবকাঠামো উন্নয়নে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যাংকগুলোর অর্থায়ন ছাড়া এত বড় অর্থায়ন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে সম্পন্ন করা নিশ্চয়ই কঠিন হয়ে দাঁড়াত। ঋণখেলাপি যাতে না হয়, সেজন্য বিদ্যমান নীতিমালার ব্যাপারেও নতুন করে ভাবতে হবে। গ্রাহকের আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে ব্যাংক ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। সুতরাং ব্যাংকারদের সৎ থাকা ছাড়া উপায় নেই। রাজনৈতিক ও পেশিশক্তির প্রভাবমুক্ত থেকে বস্তুনিষ্ঠভাবে ব্যাংকাররা যাতে কাজ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে।
খেলাপি ঋণের মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে যুগোপযোগী আইন যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন বিশেষ বেঞ্চ গঠনের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা। শুধু অর্থঋণ আদালতে এসব মামলার নিষ্পত্তি সময়মতো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। খেলাপি ঋণ নিয়ে বহু আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে; কিন্তু কাজের কাজ কতটা কী হয়েছে, সেটা একটি প্রশ্নের বিষয়। সরকারের উচিত জনগণের গচ্ছিত আমানতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ব্যাংক খাতকে আমাদের রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করা।
মূলত, মহামারি কভিড-১৯-এর কারণে অর্থনীতির অধিকাংশ খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের সংকট ও সব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি। এসব কারণে অনেক শিল্প, সেবা ও ব্যবসা খাত তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। তাই ঋণ/বিনিয়োগ গ্রহীতার ব্যবসায়ের ওপর কভিডের নেতিবাচক প্রভাব সহনীয় মাত্রায় রাখার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পরিশোধ ও শ্রেণিকরণের জন্য বিভিন্ন সময় নির্দেশনা দিয়েছে।
দেশের ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ। তবে এটাও ঠিক যে খেলাপি ঋণ আমাদের দেশের একার সমস্যা নয়, বরং এটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা। বিশ্বের সব দেশেই খেলাপি ঋণ আছে। কোথাও বেশি, আবার কোথাও কম। যুক্তরাষ্ট্রের সাবপ্রাইম মর্টগেজ-সংক্রান্ত খেলাপি ঋণ কেলেঙ্কারির কথা অনেকেরই জানা। কিছুদিন আগে ভারতের ব্যাংক খাতে যে খেলাপি ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হয়েছে, তা সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথেষ্ট শক্তিশালী এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তদারকি করার ক্ষেত্রে তাদের রয়েছে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা। তাই সেখানে উচ্চ হারের খেলাপি ঋণ মোটেই প্রত্যাশিত ছিল না। গ্রিস ও ইতালিতে অনেক পদক্ষেপ নেয়া সত্ত্বেও তাদের ব্যাংক খাত এখনও খেলাপি ঋণ সমস্যা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।
কভিড সংক্রমণ হওয়ার পর থেকেই ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় অনেক কমেছে। এ সময়ে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য বিক্রি করতে না পারায় আয় কমে যাওয়ার ফলে তারা ঋণের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরেদের আয় কমে যাওয়ায় ব্যক্তিপর্যায়ের ঋণের টাকাও ফেরত আসেনি। অনেকের বাসাবাড়ি খালি থাকায় হাউজ লোনের কিস্তিও বকেয়া পড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই খেলাপি ঋণ বাড়ার কথা। অনেকের সামর্থ্য থাকার পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের শিথিলতার কারণে ইচ্ছা করেই ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করছে না।
আরও দেখুন:
◾ ব্যাংকে রেখে যাওয়া মৃত ব্যক্তির আমানত কে পাবে?
তাছাড়া ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ের জন্য কোনো কঠিন পদক্ষেপ বা আইনি ব্যবস্থাও নিতে পারছে না। অন্যদিকে কভিডকালে দীর্ঘদিন আদালত বন্ধ থাকায় পূর্ববর্তী মামলায়ও কোনো গতি আসছে না। ফলে অনেক খেলাপি গ্রাহক স্বচ্ছন্দে সময় পার করছে। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ নির্দেশনা ও ছাড়ের কারণে কভিডকালে খেলাপি ঋণ সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো লুকিয়ে ছিল, যা কভিড-পরবর্তী সময়ে লাভা উদ্গিরণ করেছে। তবে কভিড-পরবর্তী এসব সুপ্ত খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাত ও অর্থনীতির জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ এবং যেভাবেই হোক শক্তভাবে এর লাগাম টেনে ধরা দরকার।
লেখকঃ মো. জিল্লুর রহমান, ব্যাংক কর্মকর্তা ও মুক্ত লেখক।