বিশেষ কলাম

ইসলামী ব্যাংকের সংস্কার কোথায় কোথায় জরুরী-২

মুহাম্মদ শামসুজ্জামানঃ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি এর জনবলের পেশাগত দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও ডেজিকেশান দেশের ব্যাংক ইন্ডাষ্ট্রির জন্য এক অনুকরনীয় উদাহরন ছিলো। ২০১২-২০ সময়ে দেশে অনেক নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়, এর মধ্যে ইসলামীও ছিলো। তারা ইসলামী ব্যাংকের কেউ ব্যাংক সুইচ করতে চাইলে বিনা বাক্যে কয়েক ধাপ প্রমোশান দিয়ে নিয়ে নিত। আমার মনে আছে, SBAC সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারান এন্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক যথন হয় তার চেয়ারম্যান আমাকে তার বিজয়নগর অফিসে ডেকে ঐ ব্যাংকের এমডি হবার প্রস্তাব দেন, তখন আমার পদবী ইসলামী ব্যাংকে ইভিপি। আমি বললাম, ইভিপি তো ঐ পদে কাভার করে না। তিনি বললেন, ভাই ইসলামী ব্যাংকের ইভিপি তো অন্য ব্যাংকের এমডি’র চেয়েও এক্সপার্ট। সেই জনশক্তিকে ইসলামী ব্যাংক একরকম ধ্বংস করে দিয়েছে।

গত সাত বছরে মানহীন নিয়োগই শুধু হয়নি বরং অযাচিত, অপ্রয়োজনীয় নিয়োগও হয়েছে। ম্যানপাওয়ারের এসেসমেন্ট ছাড়া খুশিমতো নিয়োগ হয়েছে। যেখানে কোন এ গ্রেডের শাখায় ৫/৬ জন সাব স্টাফ হলেই চলে সেখানে দেয়া হয়েছে ১২/১৫ জন। ঢাকার বাইরে একটি জেলা সদরের শাখায় একবার গিয়ে দেখি সিড়ির নীচে অফিস সময়ে সাত, আট জন মিলে গল্প করছে। আমি ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করলাম, এদের কি কোন কাজ নেই। কাজ না থাকলে উইথড্র করতে বলো। তিনি সবিনয়ে জানালেন, এরা একটি বিশেষ কোটার, সুতরাং এ বিষয়ে তার করণীয় কিছু নেই। এখনো যদি প্রেপার এসেসমেন্ট করা হয় তাহলে শুধু সাব স্টাফ লেভেলে ৭০% জনবল কমানো সম্ভব। এর দ্বারা গত সাত বছরে ব্যাংকটির কত আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তাও জানা যাবে।

আরও দেখুন:
ইসলামী ব্যাংকের সংস্কার কোথায় কোথায় জরুরী-১

নিয়োগের চেয়ে আরো বেশী বিশৃংখলা হয়েছে কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের প্রমোশানে। এখানে রীতিমতো বিড়ালের পিঠাভাগ হয়েছে। জনশ্রুতি আছে, চট্টগ্রামের একটি শাখা থেকে এসব প্রমোশান নিয়নরন করা হতো। তিনি যে তালিকা প্রোভাইড করতেন, সে অনুযায়ী প্রমোশান হতো। অথচ এইচআর গাইডলাইনে প্রত্যেক গ্রেডে প্রমোশানের সুস্পসট ক্রাইটেরিয়া ফলো করার কথা বলা হয়েছে। যেখানে এসিআর, ডিপ্লোমা ও সামনা সামনি সাক্ষাৎকারে নম্বর বন্টন রয়েছে। এর বাইরে কোন কোন পদে লিখিত পরীক্ষারও প্রভিশান রয়েছে। আছে ব্যাংকিং পরিষেবায় পারফরমেন্স মূল্যায়নও। এসব কাজীর গোয়ালেই ছিলো, বাস্তবতায় নয়। এমনকি এমনও প্রমাণ আছে কয়েক ধাপ এগিয়ে পসন্দনীয় কাউকে কাউকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে এবং এর দ্বারা যোগ্য লোকদের বঞ্চিত করে অযোগ্যদের যোগ্য করে তোলা হয়েছে। একজন সিনিয়র অফিসার রেগুলার নিয়মে বড়জোর এভিপি হতে পারতেন, আলাদীনের চেরাগ বলে তিনি হয়েছেন ডিএমডি। এভাবে ব্যাংক এ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার চরম ঘাটতি সৃষ্টি করে ব্যাংকারের পরিবর্তে এখানে একদল অনুগত স্তাবক তৈরী করা হয়েছে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

একজন ডিএমডি’র কথা সাম্প্রতিক কালে খুব বেশী আলোচিত হচ্ছে। নামোল্লেখ না করেই বলি, তাকে অন্য ব্যাংক থেকে হায়ার করে আনা হয়েছে শুধুমাত্র চৌর্যবৃত্তিতে অভিজ্ঞ বলে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ‘বেনামি ঋণের’ মাধ্যমে অর্থ তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল চট্টগ্রামের একটি শাখা থেকে। যদিও তা ঠেকিয়ে দিয়েছে ব্যাংকের চৌকষ কিছু অফিসার। গত মঙ্গলবার ব্যাংক খোলার প্রথম দিনেই কর্মকর্তাদের তৎপরতায় ৮৮৯ কোটি টাকা উত্তোলন আটকে যায়। এসব অর্থ তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছিল ‘গ্লোডেন স্টার’ ও ‘টপ টেন ট্রেডিং হাউজ’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান। ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, টাকা উত্তোলন ঠেকিয়ে দেওয়া এই দুটি প্রতিষ্ঠানই ব্যাংকের মালিকপক্ষ গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। গ্লোডেন স্টার’ ও ‘টপ টেন ট্রেডিং হাউজ’ নামক প্রতিষ্ঠান দুটি মূলত ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি আকিজ উদ্দিনের সুবিধাভোগী বেনামি প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকেরই একজন ডিএমডি ব্যাংকের বেতন সুবিধা খেয়ে ব্যাংকে বসে ব্যবসা করতেন, এমন অদ্ভূদ কথা শোনা তো দূরে ভাবাও দুষ্কর। তাহলে এখানে নৈতিকতার কি কিছু অবশিষ্ট থাকে?

ধর্ম ও জামায়াতকে আফিম আখ্যা দিয়ে জামায়াত মুক্ত করার সংকল্প তবে কেন করা হয়েছিলো তা বুঝার জন্য তো আমাদের বিএসটিআই লাগবেনা। এরাই এখানে বসে বসে সরকারী দপ্তরে সিএসআর এর নামে টাকা বন্টন করতেন। বঙ্গবন্ধু হা-ডু-ডু, বঙ্গবন্ধু ফুটবল, বঙ্গবন্ধু কাবাডি প্রতিযোগিতার নামে কোটি কোটি টাকা ডোনেশান দেওয়া হয়েছে। এসব থেকে উদ্দীপনামূলক বোনাসও কর্মকর্তাগণ হাতিয়ে নিয়েছেন অথচ এসবই আমানতকারীদের টাকা, ব্যাংকের ছাপানো টাকা নয়। অন্যদিকে ষ্টাফ সাব ষ্টাফদের যেটুকু সুয়োগ সুবিধা পূর্বে বহাল ছিলো তাও কেটে নেওয়া হয়েছে। চাকুরীক্ষেত্রে জানি, একবার কোন একটি সুবিধা প্রদান করা হলে তা প্রত্যাহার করা হয় না। অথচ ইসলামী ব্যাংকে ২০১৭ পরবর্তী সময়ে নীচের লেভেলের কম বেতনের কর্মচারী বিশেষ করে পরিচ্ছন্নতা কর্মী, সিকিউরিটি গার্ড, ম্যাসেঞ্জার কাম গার্ড, জুনিয়র অফিসার, এসিস্ট্যান্ট অফিসার এবং আরডিএস অফিসারদের চরমভাবে সুবিধাবঞ্ছিত করা হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি শামীম আফজালের পরিকল্পনা ছিলো আরডিএস বিলুপ্ত করে দেয়া অথবা তার কর্তৃত্বে নিয়ে নেওয়া। এমর্মে তিনি বোর্ডের কাছে একবার আরডিএস ট্রেনিং এর নামে বেশ বড় অংক হাতিয়ে নিবার উদ্দেশ্যে একটি পরিকল্পনাও দিয়েছিলেন যা বোর্ড সরাসরি নাকচ করে দেয়।

এমন বহু পদেই ইসলামী ব্যাংকে অসাম্য ও সুবিচারের পরিপন্থী বিধান রয়েছে যা ইমমিডিয়েটলি রিভিউ করা প্রয়োজন। এখানে আমার বিবেচনায় কয়েকটি এমন-
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প (আরডিএস) ব্যাংকিং জগতে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি একটি মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচি, যা গ্রামের নিম্ন আয়ের নারী ও পুরুষদের আর্থিক সেবা প্রদান আর নৈতিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক মর্যাদা সৃষ্টির জন্য কাজ করে থাকে। গ্রামের দুস্থ ও কর্মঠ নারী-পুরুষের আত্মকর্মসংস্থান তৈরিতে ইসলামী শরিয়াহ ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা করে আরডিএস। ইসলামী ব্যাংক গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের শুধু অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ করে না, নৈতিক, ধর্মীয় ও নাগরিক সচেতনতা বিষয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সদস্যদের মধ্যে যথার্থ পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক দায়িত্ববোধ সৃষ্টির কাজ করে থাকে।

ইসলামী ব্যাংক ১৯৯৫ সালে ৩১ জুলাই দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টি করতে পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প চালু করে।

আরডিএস হচ্ছে কোনো ব্যক্তি অথবা কিছু গ্রামীণ দরিদ্র সদস্যকে সমিতিবদ্ধ করে জামানতবিহীন অল্প পরিমাণ মূলধন ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক প্রকল্পে বিনিয়োগ করা। যার মাধ্যমে স্ব-কর্মসংস্থান তৈরি করে, সংসারের স্বাভাবিক আয়ের সঙ্গে বাড়তি আয় সৃষ্টি করে। মোটাদাগে এর মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে জামানতবিহীন অল্প পুঁজি, দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারীরা হচ্ছে এর প্রধান গ্রহীতা। ব্যক্তি বা সমিতি দুটোর মাধ্যমে লেনদেন হয়। সাপ্তাহিক বা মাসিক কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ, আয় থেকে ঋণের দায় পরিশোধ, স্বকর্মসংস্থান বা মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি। নিয়মিত সাপ্তাহিক সভায় নির্দিষ্ট একটি স্থানে লেনদেন যা আরডিএস কেন্দ্র নামে অভিহিত করা হয়। সদস্য ও সদস্যদের দোরগোড়ায় আর্থিক সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য ইসলামী ব্যাংকের ফিল্ড অফিসার তথা কর্মকর্তারা আরডিএস সদস্যদের বাড়িতে গিয়ে সেবা নিশ্চিত করেন।

কিন্ত এই প্রকল্পে নিয়োজিত জনশক্তি এখন সবচেয়ে বেশী অসহায়, ব্যাংক কর্তৃপক্ষের চরম জুলুমের শিকার। আগামী পর্বে বিস্তারিত ইনশাআল্লাহ।

লেখকঃ মুহাম্মদ শামসুজ্জামান [সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button