বিশেষ কলাম

ইসলামী ব্যাংকের সংস্কার কোথায় কোথায় জরুরী-১

মুহাম্মদ শামসুজ্জামানঃ বাইরে থেকে দেখতে একইরকম মনে হলেও ভেতরে ভেতরে অনেকটাই বদলে গেছে ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটির মালিকানা বদলের পাশাপাশি যেমন বদলে গেছে এর ব্যবস্থাপনা পরিষদ তেমনই পাল্টে গেছে এর মৌল দর্শন। তাই সাধারণ গ্রাহকদের কাছে এই ব্যাংকটি নিয়ে এখন একটাই প্রশ্ন, কোন আদর্শের ভিত্তিতে এখন চলছে এই ব্যাংক? অন্য অনেক কিছু আপনি সংখ্যায় বিবেচনা করে হ্রাস বৃদ্ধি করতে পারলেও নীতি আদর্শের ব্যাপারে আপোস কিংবা নমনীয়তা খুবই ভয়াবহ। এটা মুরাবাহা ও মুশারাকার মতো কনসেপসুয়াল অবস্থানে তো বটেই উপরন্ত ইসলামের যে ইনসাফ নামক প্রিন্সিপল, সেখান থেকেও ইসলামী ব্যাংক অনেক দূরে সরে গিয়েছে। আমি আরো অগ্রসর হয়ে বলবো, বহু ক্ষেত্রে জুলুমের সাক্ষ্য এবং ক্ষতও এখন এর মধ্যে দৃশ্যমান।

একটু পিছনে তাকালে দেখবো, মূলতঃ ২০১০ সাল থেকেই ব্যাংকটির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে ওই সময়ে সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে সৌদি সরকারকে একটি চিঠি দিয়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে জামায়াত ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে মতামত নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের সাবেক উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে শেয়ার কিনতে থাকে স্থানীয় কিছু সরকার সমর্থক উদ্যোক্তা। একই সঙ্গে বিদেশিরাও কেউ স্বেচ্ছায় শেয়ার ছেড়ে চলে যেতে থাকে। জানামতে, কোন কোন বিদেশী উদ্যোক্তা পরিচালককে রীতিমতো গোয়েন্দা দিয়ে বিব্রত করে শেয়ার ছাড়তে বাধ্য করা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও শেয়ার ছাড়তে থাকে। এসব শেয়ার কিনে নিতে থাকেন দেশি উদ্যোক্তারা।

আরও দেখুন:
মুহাম্মদ শামসুজ্জামান প্রকাশিত লেখাসমূহ

চূড়ান্তভাবে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে ব্যাংকটিকে জামায়াতমুক্ত করতে ২০১৬ সালের ২ জুন ব্যাংকটির ৩৩তম বার্ষিক সাধারণ সভায় নতুন শেয়ারহোল্ডার পরিচালক ও স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য নতুন নতুন কোম্পানি তৈরি করে ব্যাংকটির পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। ঐ সাধারণ সভাটি হঠাৎই পূর্বের দিন রাত এগারোটায় এমডিকে ফোন করে স্থান ও লোকজন নিশ্চিত করে জানানো হয়। হোটেল র্রেডিসনের ঐ সভায় গোয়ান্দারা সকাল থেকেই ঘিরে রাখে,আমাদের কাছ থেকে সমস্ত ইলেকট্রনিক ডিভাইস জব্দ করে নেয়া হয় এবং উপস্থিত সকলকে সার্বক্ষণিক নজরদারীতে রাখা হয়।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

বিশ্বাস অর্জনের জন্য প্রথমবারে পেশাদার ও স্বনামধন্য কয়েকজনকে পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এদের মধ্যে দীর্ঘকালের অর্থসচিব আরাস্ত খান স্যার, ইসলামী ব্যাংকের প্রথম এমডি এম.আজিজুল হক, সেনাবাহিনীর ইঞ্জি. কোরের মেজর জেনা. আবদুল মতিন, পূবালী ব্যাংকের সুদীর্ঘকালের এমডি হেলাল উদ্দিন চৌধুরী, বিবডবিএল এর এমডি জিল্লুর রহমান, এফসিএ হুমায়ূন কবির অন্যতম। একই সাথে মন্দ শ্রেনীরও কয়েকজনও ছিলেন যেমন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এহসান ও ইসলামিক ফাউন্ডেশানের শামীম আফজাল। শেষোক্ত দুইজন প্রকাশ্যে বোর্ড সভায় আমিসহ অনেক অফিসারকে অনবরত রাজাকার গালিসহ গুলি করারও হুমকি দিয়েছেন। এদের কাজই ছিলো সময়ে সময়ে ব্যাংকিং নানা তথ্য সরকারের গোয়েন্দাদের সরবরাহ করা, লোকদের হেনস্তা করা এবং জামায়াত সংশ্লিষ্টটার অভিযোগে ডিজিএফআইকে দিয়ে চাকুরিচ্যুতির নোটিশ দেয়া। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত এক বোর্ডসভায় তো শামীম আফজাল অশ্লীল গালাগাল, চরম হট্টগোল ও বিশৃংখলা করে বোর্যডসভার পরিবেশ নোংরা করলে এস আলমের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে বোর্ডসভা শেষ হয়।

জুন ২০১৬ পরবর্তী নতুন পরিষদ শুরুতেই ব্যাংকটিতে সরাসরি রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ ঘটায়। কোনকালে কোন ব্যাংক কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করার নজীর বাংলাদেশে নেই। ইসলামী ব্যাংকের লোকদের প্রত্যেকটি জাতীয় দিবস যেমন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস পালন করতে বাধ্য করা হয় এবং কেউ অনুপস্থিত থাকলে অফিসিয়ালী তিরস্কার করা হয়। প্রত্যেক শাখাকে আগের দিন এ সংক্রান্ত সভা করাও বাধ্যতামূলক ছিলো। ট্রেড ইউনিয়নের মতো ব্যানারসমেত মিছিল করে শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধে গভীর রাতে উপস্থিত থাকতেও অফিস আদেশ করা হতো।

ইসলামী ব্যাংকের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিলো এর উচ্চমানের জনশক্তি। রিক্রুটমেন্ট, প্রমোশান ও বিহেভিঅরাল একটি স্বচ্ছ ও ইনসাফভিত্তিক সার্ভিস রুল কার্যকর ছিলো। বলাবাহুল্য নিয়োগের ক্ষেত্রে শতভাগ মেধা ও আদর্শিক কমিন্টমেন্ট নিরপেক্ষ পদ্ধতিতে যাচাই বাছাই করে নিয়োগ দিবার বিধান ছিলো। নতুন বোর্ড প্রথমেই সেখানে হাত দেয় এবং ব্যাংকের লোকবল নিয়োগে পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনে। ফলে সেটা তথাকথিত বাজারভিত্তিক হয়ে পড়ে এবং নীতি নৈতিকতা ও আদর্শের পতন ঘটে। একটি ইসলামী ব্যাংকের লোক নিয়োগে ইসলামী জ্ঞান ও আমলের চাইতে সনাতনী প্রথা অগ্রাধিকার পায়। সার্ভিস রুলে নিজেদের ইচ্ছামতো গ্রেডিং চালু করা হয়। মন্দের ভালো এমন হলেও কথা ছিলো। এসবেরও ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোন এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অভিসে বাক্স স্থাপন করে বিশেষ অঞ্চলের লোকদের দরখাস্ত আহবান করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। জনশ্রুতি আছে যে চট্টগ্রামের একটি স্কুলমাঠে তাবু খাটিয়ে ঢাকা থেকে এইচআর এর লোকজন গিয়ে জনবল নিয়োগ করেছে। ২০১৭ পর লোকবল নিয়োগে এরকম স্বেচ্ছাচারীতাই চলেছে। এখন,ঠেলার নাম বাবাজী, বলা হচ্ছে ২০১৭ পরবর্তী সকল নিয়োগ বাতিল করা হবে। কিন্তু কেন? এই লোকগুলোর অপরাধ কি? তোমরা অপরাধ করে তাদের বেকার করবে কোন কারণে? তারা কি বলেছিলো, আমাদের মেধা যোগ্যতা বাছাই ব্যতিরেকে এমন নিয়োগ দিতে?

আগেই বলেছি, জনবল ছাটাইয়েও ইসলামী ব্যাংক সবার উপরে। ২০১৬ পরবর্তী প্রথমে একজন এএমডি, তিনজন ডিএমডি ও একজন ইভিপিকে বাধ্যতামূলক চাকুরীচ্যুত করা হয়। শীর্ষ পদে সেস্থলে আওয়ামী রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রতি অনুগত কর্মকর্তা পদায়ন বা নতুন নিয়োগ দেয়া হয়। একইভাবে পরে আরো ধাপে ধাপে উচ্চ ও মধ্যম পদে কমপক্ষে চল্লিশজন সুদক্ষ ও মেধাসম্পন্ন অরিজিন্যালী ইসলামী ব্যাংকারকে কোন অপরাধ ব্যতীত বিদায় করে দেওয়া হয়। এএমডি ও ডিএমডিগণকেও কোন কারণ না দর্শিয়ে বলা হয়, “আগামীকাল থেকে আপনি আর আসবেন না”। তবে একজন ব্যতীত সবাইকেই যার যার ভবিষ্যত পাওনা খুব দ্রুততার সাথে নিষ্পন্ন করে দেওয়া হয়। সেই একজন (নাম উল্লেখ করলাম না) পরে জেনেছি, দুর্ভাগ্যবশতঃ সে সময়ের এমডি মহোদয়ের না হক দৃষ্টিতে পড়েছিলেন।

লেখকঃ মুহাম্মদ শামসুজ্জামান [সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button