ব্যাংক

লাভজনক বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং নৈতিক বিপত্তি তত্ত্ব

ড. শহীদুল জাহীদঃ বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর ধাক্কায় অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের অনেক খাতেই যেখানে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে, সেখানে বাণিজ্যিক ব্যাংকের উচ্চ পরিচালন মুনাফা অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চারের জন্য আশাজাগানিয়া বটে। বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মুনাফা করবে তা সর্বজনবিদিত। মুনাফা অর্জনের জন্যই বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের যেকোনো দেশের ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আর্থিক মধ্যস্থতাকারী (ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টারমিডিয়ারি) প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান কাজ হলো আমানত সংগ্রহ এবং ঋণ প্রদান। যুগের পরিক্রমায় বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানত সংগ্রহ এবং ঋণদান কার্যক্রমের ব্যাপ্তি এবং ধরনে পরিবর্তন-পরিবর্ধন ঘটেছে।

আমানত গ্রহণ এবং ঋণদান কার্যক্রমের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংক মুনাফা অর্জনের নানামুখী কার্যক্রমে নিজেদের সংযুক্ত করেছে। ব্যাংকিং পরিভাষায় এসব অফ-ব্যালান্স-শিট অ্যাক্টিভিটি হিসেবে পরিচিত। সুতরাং বাণিজ্যিক ব্যাংকের মুনাফার প্রধানতম খাত হচ্ছে দুটি, যথা নিট সুদ মার্জিন এবং অফ-ব্যালান্স-শিট আয়। বাণিজ্যিক ব্যাংক তার অন্যতম তহবিল উৎস তথা আমানতের ওপর সুদ দিয়ে থাকে, যা ব্যাংকের জন্য সুদ ব্যয়। আবার ব্যাংক ঋণ প্রদানের বিপরীতে সুদ অর্জন করে, যা তাদের জন্য সুদ আয়। সুদ আয় ও সুদ ব্যয়ের পার্থক্যই হলো বাণিজ্যিক ব্যাংকের নিট সুদ মার্জিন আয়। প্রকারান্তরে ব্যাংক তাদের সংজ্ঞায়িত কার্যক্রমের বাইরে বৈদেশিক বাণিজ্যিক কার্যক্রমে সহায়তাসহ নানা কাজে প্রচুর কমিশন, চার্জ, ফি ইত্যাদি আদায় করে থাকে, যা তাদের অফ-ব্যালান্স-শিট আয়।

আরও দেখুন:
এক অদম্য ব্যাংকারের পথ চলা
একজন ব্যাংকারের স্যালারি কেন বেশি হওয়া উচিত!
এক অসহায় ব্যাংকারের আত্মসমর্পণ
ব্যাংকারদের পেশাজীবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং এর প্রাসঙ্গিকতা
ব্যাংকারদের দৈনন্দিন জীবন

এসব কাজে তাদের কিছু ব্যয় আছে, যেসব অফ-ব্যালান্স-শিট ব্যয় বলে অভিহিত। অফ-ব্যালান্স-শিট আয় এবং ব্যয়ের পার্থক্যকে নিট-অফ-ব্যালান্স-শিট আয় বলে অভিহিত করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯৯ সালে প্রণীত গ্রাম-লিচ-ব্লিলে (Gramm Leach Bliley Act, 1999) আইনবলে সেখানকার বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং বিনিয়োগ ব্যাংকের মাঝে তত্কালীন বিদ্যমান কার্যক্রম সীমারেখা তুলে দেয়া হয়। এ আইনের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক বিনিয়োগ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে। আর্থিক জগতে এ আইনের প্রবিধ প্রভাব রয়েছে। বর্তমান শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিশ্বব্যাপী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একীভূতকরণ, পুনর্গঠন এবং সংস্কার, যা এ আইনের হয় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রমের পাশাপাশি বিনিয়োগ এবং বণিক (ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড মার্চেন্ট) ব্যাংকিং কার্যক্রমে নিয়োজিত থেকে আয় করে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।
রিলেটেড লেখা

সম্প্রতি এ দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ২০২১ সালের প্রথমার্ধের পরিচালন মুনাফার হিসাব প্রকাশ করেছে। দৈনিক বণিক বার্তায় প্রকাশিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা কারো কারো ৫০ শতাংশের ঘর পেরিয়েছে, এমনকি একটি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা গত বছরের তুলনায় ৪৮৩ দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, আবার সংখ্যার অংকে কারো মুনাফা হাজার কোটির ওপরে (দেখুন বণিক বার্তা, জুলাই ২, ২০২১)। যদিও রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের হিসাব উল্লিখিত সময়কালে পাওয়া যায়নি। তাই রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার চিত্র কী, সে সম্পর্কে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

ব্যাংকারদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় জানা যায়, করোনা মহামারীর কারণে ঋণ পরিশোধে নীতি ছাড়ের জন্য যদিও অনেক ব্যাংকেরই আদায় কমেছে কিন্তু ব্যাংকগুলো কৌশলে অনাদায়ী সুদও আয় হিসেবে দেখিয়েছে। অন্যদিকে কথিত নয়-ছয় সুদহারের সফল বাস্তবায়নের কারণে তাদের নিট সুদ মার্জিনও কমেনি। করোনার কারণে অনেক দেশীয় শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও রফতানিমুখী সব প্রতিষ্ঠানই করোনার শুরু থেকেই পূর্ণোদ্যমে খোলা রয়েছে। এসব রফতানিমুখী শিল্প ও কলকারখানায় উৎপাদিত সামগ্রী স্বাভাবিক নিয়মেই রফতানির গতি ধরে রেখেছে। রফতানি বাণিজ্যে সহায়ক ভূমিকা পালন করে ব্যাংকগুলো যথেষ্ট আয় করেছে। রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিও স্বাভাবিক এবং ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন হওয়ায় এ খাতেও ব্যাংকের কমিশন আদায়ে টান পড়েনি।

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থেকেও ব্যাংকের ভালো আয় হয়েছে তা বোঝা যায়। এসবের পাশাপাশি করোনা মহামারীর কারণে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা খরচও কমার কথা। গত বছর তো বটেই, এ বছরও ব্যাংক ঘড়ি ধরে স্বাভাবিকের তুলনায় কম সময় খোলা রেখেছে। ব্যাংকাররা বাসায় থেকে যেমন ব্যাংকিং সেবা দিয়েছেন তেমনি ব্যাংকের কাস্টমাররা অনলাইন, ইন্টারনেট ইত্যাদি ব্যাংকিং পরিষেবায় অভ্যস্ত হচ্ছেন এবং ব্যাংকিং করছেন। এসব কারণে ব্যাংকের পরিচালন খরচও কমার কথা এবং তার প্রতিফলন বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার প্রবৃদ্ধির মাঝে দেখা যাচ্ছে।

একথা স্বীকার্য যে পরিচালন মুনাফা ও নিট মুনাফা এক নয়। পরিচালন মুনাফা থেকে অনাদায়ী সঞ্চিতি এবং সরকারি কর পরিশোধের পর নিট মুনাফা হিসাব করা হয়। কিন্তু এটা ঠিক যে পরিচালন মুনাফা বাণিজ্যিক ব্যাংকের উপার্জন ক্ষমতা নির্দেশক। পরিচালন মুনাফা বেশি হলে ব্যাংকের নিট মুনাফাও স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পাবে তা সহজেই অনুমেয়। উচ্চ পরিচালন মুনাফা তখনই অর্জন সম্ভব যখন ব্যাংকগুলোর ব্যবসায়িক ঝুঁকি কম থাকে। ব্যবসায়িক ঝুঁকি কম হলে ব্যাংক ব্যবস্থাপকরাও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

প্রশ্ন হলো, লাভজনক বাণিজ্যিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে নৈতিক বিপত্তি তত্ত্ব বা মোরাল হ্যাজার্ড থিওরি কীভাবে প্রযোজ্য? যেমনটি বলা হয়েছে যে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংক মুনাফা করবে, তা ঠিক দোষের কিছু নয়। এমনকি পুরনো হিসাব বছরের তুলনায় বর্তমান হিসাব বছরে ব্যাংকের মুনাফা বেশি হবে, তা ব্যাংকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল সবসময়ই প্রত্যাশা করে। তবে এও ভুলে গেলে চলবে না যে অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ব্যাংক ব্যবসার ধরন স্বতন্ত্র। ব্যাংক ব্যবসায় স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল অন্যান্য ব্যবসার তুলনায় বেশি। যেমন ব্যাংকের ঋণদান তহবিলের সবচেয়ে বড় উৎস হলো সংগৃহীত আমানত। ঋণযোগ্য তহবিলে মোট আমানতের তুলনায় মালিক কর্তৃক সরবরাহকৃত মূলধন পরিমাণে বেশ কম। অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ব্যাংকের ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়ন্ত্রণ ঢের বেশি। ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট কাস্টমার এবং তাদের লেনদেনের প্রকৃতিও ভিন্ন। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক দায়ও বাণিজ্যিক ব্যাংক নির্বাহ করে থাকে।

কথা হলো, নৈতিক বিপত্তি তত্ত্বানুযায়ী ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষ তার স্বার্থ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কিনা? নৈতিক বিপত্তি তখনই ঘটে যখন ব্যাংকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষ তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে কোনো পন্থাই অবলম্বন করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ব্যাংক ব্যবস্থাপক ও মালিকপক্ষের স্বার্থের দ্বন্দ্ব। ব্যাংক মালিক বা শেয়ারহোল্ডাররা ব্যাংকে মূলধনের জোগানদাতা। কিন্তু ঋণ প্রদানে গ্রাহক নির্বাচনের ক্ষেত্রে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা তেমন ভূমিকা রাখতে পারেন না। ব্যাংকঋণ আদায়ে বিপাকে পড়ে গেলে সে দায় এসে পড়ে শেয়ারহোল্ডারদের ওপর। উচ্চ পরিচালন মুনাফার বিপরীতে ব্যাংক ব্যবস্থাপকরা যে উচ্চহারে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করেন অথবা তাদের উচ্চহারে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়, তার পরোক্ষ দায় বহন করতে হয় সাধারণ শেয়ারহোল্ডার বা মালিকপক্ষকেই।

সরকার নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন এবং কর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার ওপর কর ধার্য এবং আদায় করে। নৈতিক বিপত্তি তত্ত্বে সরকারের স্বার্থহানির সম্ভাবনা এক্ষেত্রে কিছুটা কম। সরকার যেহেতু আনুপাতিক হারে কর আদায় করে থাকে, তাই ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কম-বেশি হলে সরকারের করের পরিমাণও কম-বেশি হয়। সেক্ষেত্রে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেশি হলে সরকার বরং খুশিই হয়।

বাণিজ্যিক ব্যাংকে নৈতিক বিপত্তি ঘটলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন আমানতকারীরা। প্রথাগতভাবে চলতি আমানতকারীরা এমনিতেই কোনো সুদ পান না। নানা শর্তের বেড়াজালে সঞ্চয়ী হিসাবে আমানতকারীরাও নামমাত্র সুদ পেয়ে থাকেন। অন্যদিকে নয়-ছয় সুদনীতির কারণে মেয়াদি আমানতে সর্বোচ্চ সুদহার ৬ শতাংশ। বিভিন্ন হিসাবে প্রাপ্ত আমানতকারীদের সুদের ওপর সরকার কর আদায়ের পাশাপাশি বিভিন্ন শুল্কও আরোপ করে। সেক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকে আমানত রেখে আমানতকারীদের প্রকৃত আয় খুবই কিঞ্চিত্কর। এক্ষেত্রে স্মর্তব্য যে ব্যাংক ব্যবস্থাপকরা খুব সফলতার সঙ্গে সরকার ঘোষিত নিম্ন সুদহার নীতি বাস্তবায়ন করছে কিন্তু তার চূড়ান্ত দায়ভার এসে পড়ছে সাধারণ আমানতকারীদের ওপর।

প্রশ্ন হলো, বাণিজ্যিক ব্যাংকের উচ্চ পরিচালন অথবা নিট মুনাফা যা-ই হোক না কেন, এখানে আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কি? এর এক কথায় সরল উত্তর হচ্ছে, না। বিপরীতে অবশ্য ব্যাংক ব্যবস্থাপনা নানা যুক্তি দেখাতে পারে। যেমন উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থা। ব্যাংকাররা বলবেন, তাদের আমানত সংগ্রহের নীতি চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে। এমনকি তারা এও বলতে পারেন, বাজারে অধিক তারল্যের কারণে আমানতের ওপর এর চেয়ে বেশি সুদ দেয়া সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানতকারীরা তাদের দুর্ভাগ্যের জন্য শুধু নৈতিক বিপত্তি তত্ত্বকেই দুষতে পারেন।

লেখকঃ ড. শহীদুল জাহীদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button