বিশেষ কলাম

বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য দূরীকরনে করনীয়

দীপক আঢ্যঃ দারিদ্র্য বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা এবং সে কারণেই এদেশের জন্য যেকোনো উন্নয়ন-কৌশলের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে দারিদ্র্য দূরীকরণকে চিহ্নিত করতে হবে। কিন্তু লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত হলেই তা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় করণীয় সমূহ সহজেই নির্ধারিত হয়ে যায় না। এমনকি যদিও বা এ ক্ষেত্রে করণীয়সমূহ নির্ধারিত করা যায়, সে সবের বাস্তবায়ন কিভাবে হবে সে সমস্যা তখন প্রবল হয়ে দেখা দেয়। কেন দারিদ্র্য দূরীকরণের মতো জাতীয় অগ্রাধিকারসম্পন্ন বিষয়ে এত বক্তৃতা-বিবৃতি-ঘোষণা সত্ত্বেও খুব সামান্যই অগ্রগতি এক্ষেত্রে অর্জিত হয়েছে, সে প্রশ্ন আজ উঠতেই পারে। সীমিত সম্পদের ভেতর থেকে আমরা দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য কি কি পদক্ষেপ এখনই নিতে পারি সেটি নির্ধারণ করা আজ নানা কারণে জরুরি হয়ে পড়েছে।

প্রথমত বিপুল পরিমাণ দারিদ্র্যের বোঝা নিয়ে জাতি হিসেবে আত্ম-সম্মানের সাথে বিশ্বসভ্যতায় দাঁড়ানো যায় না। দ্বিতীয়ত, চরম দারিদ্র্যের ভেতরে দেশের অধিকাংশ মানুষকে যদি বছরের পর বছর ধরে বাস করতে হয়, তবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যবহৃত হতে বাধ্য। তৃতীয়ত, আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতা অনেকখানি নির্ভর করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অবস্থার উন্নতির ওপর। আমাদের সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠীই হচ্ছে দরিদ্র, ধনিক গোষ্ঠীর সংখ্যা অত্যন্ত ক্ষুদ্র। কাজেই গণতন্ত্র যদি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্যে অর্থবহ না হয়ে ওঠে কেবল ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করে, তাহলে জনগণের কল্যাণ সাধন হবে না। দেশের অর্থনীতির ভিতর শক্তিশালী হবে না। কাজেই আগামী বছরের জন্য বাজেট প্রস্তুত হওয়ার পূর্বে কিভাবে এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অবস্থান উন্নতি করা যায় তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্পভিত্তিক বা সমাজ-কল্যালমূলক, ছিঁটে ফোঁটা অনুদান বা ঋণ বিতরণ বা খয়রাতি সাহায্য হিসেবে কর্মসূচি গ্রহণ করলে চলবে না, জাতীয় উন্নয়ন ও উৎপাদনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে স্থায়ী ভিত্তিতে কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। জনগণের জীবনের মানোন্নয়ন এবং ভাগ্য পরিবর্তনের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তিযুক্ত জীবন-ব্যবস্থার যতখানি সম্ভাব্য সুযোগ-সুবিধা তাদের আয়ত্তের মধ্যে আনতে হবে। গণতন্ত্র যদি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্যে অর্থবহ না হয় তার ভিত্তি দুর্বল থেকে যেতে বাধ্য। আজকের এই লেখাটি সেই তাগিদ থেকেই রচিত।

আরও পড়ুন:
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন

বাংলাদেশে দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য কি কি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত সে সম্পর্কে কিছু কিছু চিন্তা-ভাবনা ইতোমধ্যেই হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে এসব চিন্তা-ভাবনাকে একত্র করে একটি জাতীয় কর্মসূচির রূপ দিয়ে দারিদ্র্য দূরীকরণের ওপর যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে না। আমি একটি উদাহরণ এ প্রসঙ্গে টানবো। অন্তবর্তীকালীন সরকারের আমলে গঠিত টাঙ্ক ফোর্স রিপোর্টে দারিদ্র্য দূরীকরণের বিষয়ে বেশকিছু সুচিন্তিত পরামর্শ রাখা হয়েছিল। সেসব পরামর্শ নিয়ে সরকারি দল-বিরোধীদল সবাই মিলে বিস্তৃত আলোচনা করুন- এ পরামর্শ আমি রেখেছিলাম। দুঃখের বিষয়, টাক্স ফোর্সের সেসব সুপারিশ শুধু যে বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে প্রতিফলিত হয়নি তাই নয়, এ সম্পর্কে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা অনুষ্ঠানের ন্যূনতম আগ্রহ পর্যন্ত সরকার দেখাননি। বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা অবশ্যই তর্ক-বিতর্ক করবেন। তাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা যারা রাজনীতির সাথে জড়িত, তাদেরকে প্রতিনিয়তই সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয় এবং তাদের সমস্যা ও তার সমাধানের বিষয়ে তাদের মতামত শুনতে হয়। এই সূত্রেই দারিদ্র্য দূরীকরণের সম্ভাব্য পথ সম্পর্কে আমার মনে যেসব প্রশ্ন জেগেছে তা এখানে উপস্থাপন করতে চাইছি।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা তিন ধরনের কর্মসূচির কথা বলেছেন। তারা বলেছেন অর্থনীতির, বিশেষত কৃষি ও শিল্পের প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর কথা। তারা বলেছেন মৌলিক সামাজিক সেবাখাত তথা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের সম্প্রসারণের কথা। অর্থাৎ দরিদ্র জনগোষ্ঠী যাতে কাজ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের সুযোগ পর্যাপ্ত পরিমাণে নিতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়াও চরম দরিদ্র পরিবারের জন্য বিশেষ কর্মসংস্থান প্রকল্প গ্রহণের উপর তারা জোর দিয়েছেন। এ ধরনের একটি ত্রিমূখী কর্মসূচির সাথে সকলেই মোটামুটিভাবে একমত হবেন বলে আশা করা যায়। দারিদ্র্য যেহেতু বহুমাত্রিক একটি সমস্যা, সেহেতু শুধুমাত্র দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় এবং কর্মসংস্থান বাড়ালেই চলবে না, তার খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ মোকাবেলার ক্ষমতাও বৃদ্ধি করতে হবে। বাড়াতে হবে তার অধিকার-সচেতনতা, তার সংগঠন করার ক্সশতা স্থানীয় পর্যায়ে স্ব-শাসিত সরকারে (Local Self-government) কার্যক্রমে তার অংশগ্রহণের মাত্রা।

উন্নত দেশের অর্থনৈতিক নীতিমালা আর অনুন্নত দেশের নীতিমালা ঠিক একই রকম হতে পারে না। অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত দেশের অর্থনৈতিক নীতিমালা এমন হওয়া উচিত যাতে সেই দেশ উন্নত দেশে উন্নীত হতে পারে। একবার উন্নতি করতে পারলে তবেই একই ধনের নীতিমালা করা যেতে পারে। কৃষি খাতে ভর্তুকি দেবার প্রশ্ন রয়েছে- ভর্তুকি ছাড়া যদি কৃষকরা চলতে পারত আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম এবং কৃষি উপরণের ভর্তুকি না দেবার পক্ষেই মত দিতাম। তবে, আমাদের দেখতে হবে এতে প্রবৃদ্ধি অর্জন বৃদ্ধি পাবে কিনা। বাস্তব অবস্থা হল, আমাদের গ্রামীণ আর্থিক অবস্থার এমনই দৈন্যদশা যে সে সম্ভাবনা নেই, কাজেই যতদিন পর্র্যন্ত চাহিদা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জণ না হয় ততদিন পর্যন্ত কৃষি উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির প্রয়োজনে কৃষি উপকরণের ওপর ভর্তুকি দিতে হবে।

শহরের রুগ্ন শিল্প সমূহের বড় পুঁজির মালিকেরা, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের বড় বড় কর্পোরেশনগুলি যদি ভর্তুকি পেতে পারে, তাহলে গ্রামের দরিদ্র চাষিরা ভর্তুকি পাবে না কেন? প্রতিটি উৎপাদনশীর খাতকে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। কিন্তু যদি কোনো বিশেষ কারণে সাময়িকভাবে কোনো খাতকে ভর্তুকি দিতে হয়, তাহলে সেটা যাতে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উপকৃত করে তা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে সে খাত যেন উৎপাদনশীল হয় তাও নিশ্চিত করতে হবে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে কৃষি উপকরণের সরবরাহ, কৃষিঋণ ও কৃষিপণ্যের ন্যূনতম মূল্য সমর্থনকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

দারিদ্র্য দূরীকরণ কার্যক্রমকে যদি বাস্তবিক শক্তিশালী করতে হয়, সরকারি ব্যয়-বরাদ্দের কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস করা প্রয়োজন। অবশ্য কাঠামোগত পুর্নবিন্যাসের আগে প্রয়োজন হল পরিচ্ছন্ন তথ্যের। আমাদের জানতে হবে-প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিরা সরকারি কৃষি ঋনের মোট কতটা পাচ্ছে, ভূমিহীনদের বিশেষ কর্মসংস্থান কর্মসূচিকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, শিল্পখাতে মোট বরাদ্দের কতটুকু যাচ্ছে গ্রাম ও শহরের ক্ষুদ্রে উৎপাদকের পেছনে। একইভাবে, স্বাস্থ্য কত বরাদ্দ হয়েছে সেটুকু জানানোটাই যথেষ্ঠ নয়। স্বাস্থ্য খাতের ভেতরে গ্রামীন স্বস্থ্য খাতে কতটা গেল, এবং তার ভেতরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা খাত কতটা পেল সেটা আলাদা করে জানতে হবে।

মোটাদাগে বলতে গেলে আমাদের জীবনের সকল সমস্যা, সমাজের সবকিছুর চাহিদা পূরণের জন্য আমরা বোধ হয় অতিমাত্রায় রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। এই ধারা ব্রিটিশ আমল থেকেই চলে আসছে। বিদ্যাদতান থেকে জলদান, স্বাস্থ্যব্যবস্থা থেকে সড়ক নির্মাণ, আইন-শৃঙ্খলা থেকে সংস্কৃতি চর্চা সবকিছুর জন্যই আমরা হাত বাড়িয়ে অনুদান চাইছি রাষ্ট্রের কাছে। যেন রাষ্ট্রের দ্বারস্থ হওয়া ভিন্ন আমাদের করণীয় কিছু নেই বা তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা নেই। এই চরম রাষ্ট্র-নির্ভরতা ভেতরে ভেতরে সমাজের নিজস্ব উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষমতাকে অবশ করে দিচ্ছে। যে কাজ সমাজের করার কথা তা রাষ্ট্র নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছে। অতীতে আমাদের গ্রামগুলো আত্মনির্ভরশীল ছিল। কোনো গ্রামে কোনো দ্রব্যের ঘাটতি থাকলে পাশের গ্রাম থেকে বিনিয়োগের মাধ্যমে তা পূরণ করে নিত। রাষ্ট্রই যে সব সমস্যা সমাধান দেবে তা আশা করত না কিন্তু ব্রিটিশ আমলে থেকে ক্ষমতার প্রয়োগ বিস্তার করবার প্রবণতা গোটা সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে শুরু করে। রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করবার এই মানসিকতা বজায় থাকলে দারিদ্র্য দূরীকরণের মতো একটি প্রধান জাতীয় সমস্যার সমাধান কখনোই হবে না। খাদ্য, বাসস্থান, প্রাথমিক শিক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, দুর্যোগ মোকাবেলা, অবকাঠামো নির্মাণ, সুস্থ সংস্কৃতি-চর্চার বিকাশ ও সবকিছুর অর্জনে প্রথমে সমাজকেই নিজস্ব উদ্যোগ ও উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় রাখতে হবে। তাতে রাষ্ট্রীয় সহায়তা এলে খুবই ভালো, না এলেও আত্মশক্তিতেই কাজ চালিয়ে যেতে পারে।

এ লক্ষ্যে দেশ নিয়ে যারা ভাবেন সেসব রাজনৈতিক দল, সামাজিক শক্তি ও ব্যক্তিবর্গের প্রতি আমার আবেদন, ‘সমাজের কাজ সমাজেরই করা দরকার’ এই ঐতিহ্যগত ভাবনাকে আমাদের প্রাত্যহিক কর্মকান্ড আসুন আমরা ফিরিয়ে আনি। এতে করে এদেশের দারিদ্র্য দূরীকরণই শুধু ত্বরান্বিত হবে তা-ই নয়, রাষ্ট্র ও সমাজের গণতন্ত্রায়ণও গভীরতর তাৎপর্য লাভ করতে সক্ষম হবে।

দীপক কুমার আঢ্য: ব্যাংকার, লেখক ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button