অর্থনীতি

অর্থনীতির নুতন কালচার ‘ডিপোজিট খেলাপি’

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে পুরো দেশজুড়ে। তৈরি হচ্ছে- পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্নফুলি টানেল, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট, উড়াল সেতু, এয়াপোর্ট। বাড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, জিডিপি ও সরকারি দলের অপ্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। সবকিছু মিলিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকেই যায়- আমরা আসলে কতখানি এগোচ্ছি? বা আমাদের এই এগোনো ও উন্নয়ন কতখানি টেকসই?

টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ারের মধ্যে অন্যতম একটি হলো ‘মানি মার্কেট’ বা টাকার বাজার। টাকার বাজারে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি আমাদের দেশে আগেও ছিল এখনও আছে; যদিও সম্প্রতি জ্যামিতিক হারে তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এর সঙ্গে নুতন আরেকটি সংস্কৃতির উত্থান ঘটেছে, সেটি হলো- ডিপোজিট খেলাপি। বিশেষত নন-ব্যাংকিং ফিন্যান্সিয়াল অরগানাইজেশনগুলোর ডিপোজিট বা ফান্ড কিছু ঋণখেলাপি লুটেপুটে নেওয়ায় তারা এখন গ্রাহকদের আমানতের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। তৈরি হচ্ছে ডিপোজিট খেলাপি।

সংকট এখন কেবল নন-ব্যাংকিং ফিন্যান্সিয়াল সেক্টরেই সীমাবদ্ধ নেই, সরকারি, বেসরকারি ব্যাংকেও তা ছড়িয়ে পরছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। যা ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত ছিল ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। তিন বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় শতভাগ। গেল বছরের প্রথম নয় মাসেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা।

প্রায়ই সরকারি বাজেটে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির জন্য বিশেষ বরাদ্ধ রাখা হয়। এখন প্রশ্ন হলো- মুলধনে ঘাটতি কেন? উত্তর একটাই- খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলোকে বেশি প্রভিশন করতে হয়েছে। তাই লোকসান বেড়ে ব্যাংকগুলোর মূলধনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। দেশের প্রান্তিক মানুষও সরকারকে কর দেন। তারা গাছের কলা বেচে যে লুঙ্গি কেনেন সেখানেও প্রদত্ত ভ্যাটের টাকা দেন। আর সেই টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হন হলমার্কের তানভীরদের মতো ব্যবসায়ীরা। কাজেই ঋণখেলাপিদের কারণে সরকারি ব্যাংকের মূলধনের ঘাটতি মেটানো কতখানি উচিত বা নৈতিক?

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সর্বপ্রথম প্রয়োজন মূলধনের যোগান ও বিনিয়োগ বাড়ানো। আর এই মূলধনের যোগান দিতে হলে প্রয়োজন জাতীয় সঞ্চয় বৃদ্ধি। মূলধনের যোগান না হলে বিনিয়োগ বাড়বে কিভাবে? বিনিয়োগ যদি না বাড়ে, উচ্চ প্রবৃদ্ধি আসবে কোথা থেকে? তাই সর্বপ্রথম যা প্রয়োজন সেটি হলো- সঞ্চয় বৃদ্ধি ও মূলধনের যোগান দেওয়া। দেশের গরিব, নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত মানুষ সঞ্চয় বাড়ায়। এই সঞ্চয় বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন সুগঠিত মানি ও ক্যাপিটাল মার্কেট।

শেয়ারবাজার নিয়ে বিশেষ কিছুই লিখতে চাই না। কথায় আছে, ছাইয়ে বাতাস দিলে ওড়ে বেশি। তেমনি দুঃখ নিয়ে বিলাপ করলে সেটাও বাড়ে বেশি। তাই আজ শুধু মানি মার্কেট নিয়েই বলতে চাই।

সম্প্রতি পিপল’স লিজিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। আর্থিক খাতের কোনো প্রতিষ্ঠানের নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার ঘটনা দেশের ইতিহাসে প্রথম। শুনেছি অবসায়নে সরকার সদয় সম্মতিও দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করায় আমার মতো সাধারণ খেটে খাওয়া অনেক মানুষেরই কষ্টার্জিত সঞ্চয় চরম ঝুঁকিতে পড়েছে। যারা ডিপোজিট রেখেছেন তারা এবং যারা শেয়ারবাজার থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনেছেন তারাও রয়েছেন বিরাট ঝুঁকির মধ্যে।

একটা প্রতিষ্ঠান ডুবলে দেশের সাংঘাতিক বড় কোনো ক্ষতি হয়ে দেশ দেউলিয়া হবার কথা নয়। তবে এতে সাধারণ মানুষের আস্থার অভাবে অন্যান্য নন-ব্যাংকিং ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউট এবং ব্যাংকগুলোর ডিপোজিট সংগ্রহে চরম অসুবিধা হবে। মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে ভয় পাবে। ফলে দেশের জাতীয় সঞ্চয় বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লিকুইডিটি কমে ঋণ প্রদানের সক্ষমতা কমে যাবে, অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমে যাবে, জাতীয় প্রবৃদ্ধিও চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।

মাত্র কয়েকদিন আগেই আমরা পত্রিকায় রিপোর্ট দেখেছি যে, ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে। এর দুটি অর্থ দাঁড়ায়- এক. দেশে জাতীয় প্রবৃদ্ধি বা অর্থনৈতিক কার্যক্রম কমে যাচ্ছে, দুই. মানুষ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে; তাই তারা নগদে লেনদেন শুরু করেছে। সম্ভাব্য দুটি সম্ভাবনার মধ্যে কোনটি সত্য? জাতীয় নীতি নির্ধারকদের তা খুঁজে বের করে ওভারকাম করার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে আমি মনে করি, ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন কমার পেছনে পিপলস লিজিংয়ের ডুবে যাওয়া অবশ্যই একটি কারণ।

বাংলাদেশের রেগুলেটরি বডিগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে সব সময়ই অগ্রগামী মনে করা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার কারণে তাদের ভূমিকার কার্যকরিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। পিপলস লিজিংয়ের মতো আরও একটি বড় ঘটনা হলো- বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি। সাবেক অর্থমন্ত্রীকে এই সেদিনও বেসিক ব্যাংকের প্রধান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিষধগার করতে শোনা গেছে। যদিও ক্ষমতায় থাকতে তিনি বেসিক ব্যাংক প্রধানের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। জানি না পুতুল নাচের সূতা কার হাতে। বাচ্চু সাহেবরা কি সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীর থেকেও বেশি প্রভাবশালী? তাদের ক্ষমতার উৎস কোথায়? নাকি সরিষাতেই ভূত?

শুধু বেসিক ব্যাংক বা পিপলস লিজিং-ই নয়, আর্থিক খাতের আরও অনেক প্রতিষ্ঠানই খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে। অনেক লিজিং কোম্পানি ডিপোজিটরদের অর্থ যথাসময়ে ফেরত দিতে পারছে না। কারণ মানুষ তাদের কাছে নুতন করে অর্থ জমা রাখতে আর আস্থা পাচ্ছে না। আর্থিক খাতের একটি প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া ঘোষণা করার আগে নীতি নির্ধারকদের ভাবা উচিত ছিল- মানুষ আত্মীয়-স্বজনের কাছে অর্থ জমা রাখতে আস্থা পায় না। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে জমা রাখতে আস্থা পায়।

কিন্তু রেগুলেটরি বডি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কি মানুষের সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছে? রাখেনি। ফলে মানুষ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। এরই মধ্যে আরও আট থেকে নয়টি ব্যাংকের মূলধনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সেগুলোর ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে, সময়ই তা বলতে পারবে।

অনেকেই হয়তো প্রশ্ন করবেন, প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে টাকা গেল কোথায়? উত্তরটা সবারই জানা। কিছু খেলাপিঋণ ব্যবসায়িক লোকসানের কারণে আর সিংহভাগ নামে-বেনামে অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলেছে। তবে এই টাকা সরিয়ে ফেলা ব্যক্তিরা বিচারের মুখোমুখি না হয়ে বরং আরামে পাজেরো চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

পৃথিবীর সব সভ্য দেশেও খুন, ধর্ষণ, চুরি, রাহাজানি, বাটপারি- এসব হয়। কিন্তু অসভ্য দেশের সঙ্গে সভ্য দেশের পার্থক্য হলো- সভ্য দেশে প্রত্যেকটি অনিয়মের যথাযথ বিচার হয়, অন্যায়কারী শাস্তি ভোগ করেন। কিন্তু অসভ্য দেশে অন্যায়কারীর বিচার হয় না; ক্ষমতার দাপটে আরও সে দিগুণ উৎসাহে বুক ফুলিয়ে সমাজে ঘুরে বেড়ায়। সাধারণ বিচার প্রক্রিয়ায় আমাদের দেশের বড়বড় অপরাধীরা প্রায়ই পার পেয়ে যায়। প্রশ্ন হলো- গরিবের অর্থ চুরি করে যারা একটি দেশের সঞ্চয়, ব্যাংকিং খাত, শিল্প ও অর্থনীতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, তারা কেন বড় অপরাধী বলে গণ্য হবেন না?

লেখক: জ্যোতিষ মন্ডল, এফসিএ, ফেলো চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। [প্রকাশিত এই লেখাটি লেখকের একান্তই নিজস্ব। ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখা ও মতামতের জন্য ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ দায়ী নয়।]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button