মানি লন্ডারিং কি? মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ব্যাংকারের ভূমিকা
মানি লন্ডারিং কি? কি কি উপায়ে মানি লন্ডারিং হয়ে থাকে? সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত আইনের আওতায় একজন ব্যাংকার কিভাবে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ করতে পারে।
মানি লন্ডারিং (Money Laundering):
Money শব্দের শাব্দিক অর্থ টাকা। আর Laundering শব্দের অর্থ পরিস্কার করা। একত্রে Money Laundering শব্দের অর্থ হবে টাকা পরিস্কার করা।
পারিভাষিক অর্থেঃ
কোন সম্পৃক্ত অপরাধের সাথে জড়িত অর্থকে বৈধ করার প্রক্রিয়াকে Money Laundering বলে।
এই প্রক্রিয়ায় অর্থের অবৈধ উৎস গোপন করা হয়। মানি লন্ডারিং হলো অবৈধ বা কালো অর্থকে লেনদেন চক্রের মাধ্যমে বৈধ করা বা স্বচ্ছতাদান করার একটি প্রক্রিয়া।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
অন্য কথায় সংগৃহিত অর্থের উৎস গোপন করে হস্তান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উক্ত তহবিলকে পর্যায়ক্রমে বৈধ আয় হিসেবে পরিগণিত করা। অর্থাৎ বিভিন্ন অবৈধ উপায়ে যে সব অর্থ আসছে সেগুলিকে ব্যাংকের মাধ্যমে ডিডি, টিটি, এমটি করে অথবা বিভিন্ন নামে এ্যাকাউন্ট খুলে তা পরবর্তীতে অন্য কোথাও বিনিয়োগের মাধ্যমে বৈধ করার যে প্রক্রিয়া তাকে মানি লন্ডারিং বলে।
(Stage of Money Laundering) মানি লন্ডারিং এর ধাপ সমূহঃ
Money Laundering করতে যে তিনটি ধাপ পার করতে হয় তাকে বলে Stage of Money Laundering (মানি লন্ডারিং এর ধাপ)।
Money Laundering এর Stage বা ধাপগুলো হলো-
১. Placement বা প্লেসমেন্ট
২. Layering বা লেয়ারিং ও
৩. Integration বা ইন্টিগ্রেশন।
Placement (প্লেসমেন্ট):
Placement হলো Money Laundering এর প্রথম ধাপ বা স্তর যে ধাপে Predicate Offense এর সাথে জড়িত অবৈধ অর্থ ব্যাংকে জমা করা হয়।
Layering (লেয়ারিং):
Layering হলো Money Laundering এর দ্বিতীয় ধাপ, যে ধাপে ব্যাংকে জমা করা অর্থ এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে বা এক শাখা থেকে অন্য শাখায় স্হানান্তর করার মাধ্যমে অর্থের প্রকৃত উৎসটা অনেক জঠিল করা হয়। এটা এমন একটা অবস্হা যে অবস্হা অবৈধ অর্থের উৎস অস্পষ্ট হয়ে যায়।
Integration (ইন্টিগ্রেশন):
Integration মানে হলো একাঙ্গীভুত অর্থাৎ Placement এবং Layering এই দুই ধাপ পার করতে পারলে অবৈধ অর্থকে আর অবৈধ হিসাবে চেনা যায় না। বরং উক্ত অর্থ দেশের মূল অর্থনীতির সাথে একত্রিত হয়ে যায়।
এ পর্যায় এসে উক্ত অর্থ যে অবৈধ উৎস থেকে এসেছে বা কোন এক পর্যায় অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ছিল তা আর বোঝা যায়না।
একটা ঘটনা বললে সবার কাছে বিষয়টা আরও Clear হয়ে যাবে আশা করি।
ঘটনা:
১: একবার একজন মহিলা গ্রাহক তার অনেক দিন ধরে ঘুষ হিসাবে পাওয়া ৫০ লাখ টাকা Money Laundering এর মাধমে বৈধ করতে চাইল, তাই সে তার অনেক দিনের পুরাতন সঞ্চয়ী হিসাবে ২০ লাখ টাকা জমা দিতে ব্যাংকে আসল। কাউন্টারে আসলে শাখার ক্যাশিয়ার তাকে সন্দেহ মনে করে Manager Operations এর নিকট পাঠাল। Manager Operation তাকে টাকার উৎস জানতে চাইলে সে বলল” আমার জমি বিক্রয় করা টাকা” তখন Manager Operation ক্যাশিয়ারকে জমা নেওয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করলে ক্যশিয়ার টাকাটা জমা রাখল। এভাবে কয়েকদিন জমা করার পর তার হিসাবে ৫০ লাখ টাকা জমা হল।
২: মহিলার ৫০ লাখ টাকা দিয়ে ঐ শাখায় কয়েকটা TDR বা FDR খুলল এই বলে যে সঞ্চয়ী হিসাবে লাভ কম এই জন্যে সে TDR A/C এ তার টাকা জমা রেখে দিবে। ব্যাংকারও তার কথা যৌক্তিক মনে করে তাকে TDR হিসাব খুলে দিল। কিছু দিন পর মহিলা এসে বলল সে FDR গুলি close করে দিবে। একথা শুনে সংশ্লিষ্ট অফিসার তাকে জিজ্ঞাসা করল” সে FDR গুলি Close করে কি করবে? মহিলা বলল “স্যার অন্য ব্যাংকে জমা রাখব কারণ এখানে Profit Rate কম” তার কথা মেনে নিয়ে ব্যাংকার তার FDR বা TDR হিসাব close করে তার সঞ্চয়ী হিসাবে জমা করে দিল।
এবার মহিলা অন্য ব্যাংকে গিয়ে বলল “সে ২০ লাখ টাকা FDR করবে কারণ অন্য ব্যাংকের চেয়ে এই ব্যাংকে rate ভাল। তার কথা শুনে ব্যাংকার তাকে একটা FDR খুলে দিল। এভাবে মহিলা তার ৫০ লাখ টাকা কয়েকটি ব্যাংকে FDR করে রাখল।
তার এই FDR করতে তেমন কেউ তাকে টাকার উৎস জিজ্ঞাসা করল না কারণ সবাই ভাবল অন্য ব্যাংকে রাখা টাকা তাই তাকে কোন সন্দেহ করল না।
৩: মহিলা তার এলাকায় Flat এর শেয়ার বিক্রয় হবে দেখে সে তাদের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা দিয়ে দুটি share কিনে নিল এবং তাদেরতে ব্যাংক হিসাব close করে Pay Order দিয়ে দিল। পরবর্তীতে সকলে মিলে জমিতে Building উঠালে মহিলা দুটি Flat এর মালিক হয়ে গেল। এ পর্যায়ে কেউ তাকে তার অর্থ সম্পর্কে সন্দেহ করল না বরং সবাই ধরে নিল সে অনেক সাধনা করে ব্যাংকে টাকা জমিয়েছিল সে খুব মিতব্যায়ী।
এই ঘটনার মধ্যে ১ নম্বর অবস্হাকে বলে Placement (প্লেসমেন্ট) আর ২ নম্বর অবস্হাকে বলা হবে Layering (লেয়ারিং) এবং সবশেষে ৩ নম্বর অবস্থাকে বলা হবে Integration (ইন্টিগ্রেশন)।
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তাঃ
এ কথা বলা নিষ্প্রয়োজন যে যারা মানি লন্ডারিং করে থাকে তারা দেশ, অর্থনীতি তথা সমাজের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে। সাধারণত চোরাচালানী, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ট্যাক্স ফাঁকি, রাজনৈতিক দুর্নীতি, অস্ত্র চোরাচালান ইত্যাদি মানি লন্ডারিং এর মাধ্যমে করা হয়। এতে দেশে আইন শৃংখলার অবনতি ঘটে। চোরাচালানীর ফলে রাজস্ব আয় হ্রাস ঘটে এবং জনসাধারণ এ পথে আকৃষ্ট হয়, অর্থনীতিতে কালো টাকার প্রভাবে বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দেয়, স্মাগলিং, বিনিয়োগে অসন্তুষ্টি, ট্যাক্স ফাঁকি ইত্যাদির প্রভাবে অর্থনীতি দূর্বল হয়ে পড়ে। যা প্রতিরোধ করা অবশ্যই প্রয়োজন।
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ব্যাংকারের ভূমিকাঃ
মানি লন্ডারিং নিয়ন্ত্রনে পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশই আইন প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশ ও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। ২০০২ সালের ৭ ই এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক মানি লন্ডারিং সম্পর্কে গাইড লাইন তৈরি করে সমস্ত ব্যাংকগুলোকে তা মেনে চলার জন্য পরামর্শ প্রদান করেছে। যেহেতু লেনদেনের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং হয়ে থাকে সেজন্য মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকার অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী একজন ব্যাংক কর্মকর্তা নিম্নোক্তভাবে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেন।
ক) গ্রাহকদের পরিচয়ের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংরক্ষণ করবেন। হিসাবধারী গ্রাহক ব্যতিত অন্য কারো অনুরোধে অর্থ প্রেরণের জন্য কোন ড্রাফট/টিটি/এমটি ইস্যুর ক্ষেত্রে অনুরোধকারী পক্ষের পূর্ণ নাম ও ঠিকানার সঠিক তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিত নির্দেশক অনুসরণ করতে হবে।
খ) গ্রাহকের হিসাবের লেনদেন বন্ধ হওয়ায়ার ক্ষেত্রে উক্তরূপ বন্ধ হওয়ার দিন হতে অনূন্য পাঁচ বৎসরকাল বিগত সময়ের লেনদেন হিসাবে সংরক্ষণ করবেন।
গ) মানি লন্ডারিং প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে প্রত্যেক ব্যাংক একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে প্রধান কার্যালয়ে একটি কেন্দ্রীয় পরিপালন ইউনিট এবং শাখা পর্যায়ে একজন কর্মকর্তা অভ্যন্তরীন পরিবীক্ষণ ও নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা করবে। এক্ষেত্রে শাখায় কর্মরত ব্যক্তি লেনদেন পরিবীক্ষণ অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রন নীতি ও পদ্ধতিসমূহ দেখবেন।
ঘ) অস্বাভাবিক লেনদেন সনাক্তকরণ ও গ্রাহকের হিসাবের সম্ভাব্য লেনদেনের অনুমিত মাত্রা সম্পর্কে গ্রাহকের ঘোষণা সংগ্রহ করবেন।
ঙ) অস্বাভাবিক লেনদেন সংঘটিত হচ্ছে মনে করলে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জ্ঞাত করানো যেতে পারে। মনোনীত কর্মকর্তা প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর প্রধান কার্যালয়ে রিপোর্ট পেশ করবেন। মোট কথা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সার্কুলার মোতাবেক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধের ক্ষেত্রে উক্ত বিধানসমূহ সুষ্ঠুভাবে পালন করাই একজন ব্যাংক কর্মকর্তার মূল দায়িত্ব।