‘ক্ষুদ্র ঋণ’ ও ‘দারিদ্র্য বিমোচন’ সাম্প্রতিক সময়ের খুব আলোচিত পরিভাষা। অভাবগ্রস্থ মানুষের দরিদ্রতাকে কাজে লাগিয়ে ঋণের প্রদানের মাধ্যমে লাভজনক ব্যবসা পরিচালনার নাম ‘ক্ষুদ্র ঋণ’ (Micro Credit)। এর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন তো হয় না বরং তৃণমূল পর্যায়ে সুদের বিস্তৃতি ঘটে, তৈরী হয় নতুন কাবুলিওয়ালা। কিছু দিন আগে ডেনমার্কের সাংবাদিক টম হাইনেমান (Tom Heinemann) কর্তৃক নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত ‘ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদ’ (Caught in Micro Debt) নামক প্রামাণ্য চিত্রের মাধ্যমে এ কথা স্পষ্ট হয়েছে যে, ‘ক্ষুদ্র ঋণ’ দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যর্থ।
তিনি চট্টগ্রাম, দিনাজপুর ও সাভারের বিভিন্ন গ্রাম সরেজমিনে ঘুরে দেখেছেন গরীব নারী-পুরুষ গ্রামীন ব্যাংক, ব্রাকসহ একাধিক এন.জি.ও থেকে ঋণ নিয়ে কোন বিনিয়োগ করতে পারেনি। সব সংস্থা নানা প্রলোভন ও মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে দরিদ্র্য জনগণকে ঋণ নিতে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। ঋণের টাকা কোথায় ব্যয় হয় সে খবর কেউ রাখে না। অনেকে ঋণের টাকায় যৌতুক, সন্তানের পড়া-লেখা, ধার-দেনা শোধ ও গৃহস্থালী আসবাবপত্র কেনায় খরছ করে ফেলে। পরবর্তীতে সুদে আসলে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে তারা সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। ঋণগ্রহীতার জীবন যাত্রার মানে উন্নয়ন ঘটেনি।
ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন। |
স্বামীর অগোচরে ঋণ নেয়ায় তালাক ও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। যারা হাঁস-মুরগি পালন করতো তারা বড় খামার করতে পেরেছে এমন নজিরও নেই। বরং ঋণ গ্রহীতার উপকারের চাইতে চুড়ান্ত পর্যায়ে ক্ষতি ডেকে নিয়ে আসে। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্থা জমজমাট ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এবং সুদের বিস্তৃতি ঘটছে তৃণমূল পর্যায়ে। একা গ্রামীণ ব্যাংক ২৫৬৪টি শাখার মাধ্যমে দেশের ৮১ হাজার ৩১৭টি গ্রামে ৮৩ লাখ সদস্যকে ঋণের জালে আটকে ফেলেছে। এ খাতে গ্রামীণ ব্যাংকের বিনিয়োগের পরিমাণ ৮ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের উচ্চ হার বানিজ্যিক ব্যাংকের চাইতেও বেশী।
চালু হওয়ার ৩৫ বছর পরও এমন কোন প্রমাণ নেই, যাতে মনে হতে পারে ক্ষুদ্রঋণ গরীব মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে পারে। তবে এটা প্রমাণিত সত্য ঢাকডোল পিটিয়ে যাঁরা এ দেশের গরীব মানুষের দারিদ্য দূর করতে মাঠে নেমেছেন, তাঁরা শত শত কোটি টাকার মালিক বনেছেন। ক্ষুদ্রঋণ যদি সফল হতো তা হলে আজো কেন ৭কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে রয়েছে? গ্রামীণ ব্যাংকের প্রথম ঋণ গ্রহীতা চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার জোবরা গ্রামের সুফিয়া খাতুন বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। চিকিৎসার টাকা যোগাতে তার পরিবারের সদস্যরা দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করেছেন।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
বাংলাদেশের হতদরিদ্র মানুষ ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে ৬৭ শতাংশই ব্যয় করে অনুৎপাদনশীল খাতে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে কোন ভূমিকাই রাখে না। তাই ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন সম্ভব নয়। সম্প্রতি দেশের দূর্যোগপ্রবণ আট জেলার খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) পরিচালিত এক জরিপের প্রতিবেদনে এ তিক্ত সত্য ফুটে উঠেছে। সম্প্রতি দেশের দুর্যোগপ্রবণ রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলায় এ জরিপ চালানো হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত এ জরিপ প্রতিবেদন ‘দারিদ্র বিমোচনে দরিদ্র ব্যক্তিদের সম্পদ প্রদানে’র ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, হতদরিদ্র ব্যক্তিদের ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশই ঋণগ্রস্থ। এদের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ দেনাগ্রস্থ শুধু স্থানীয় মুদি দোকানগুলোর কাছে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ২৯ শতাংশ হতদরিদ্র চিকিৎসা বাবাদ খরচ করে ও ১৭ শতাংশ দৈনন্দিন খাবার কেনে। এছাড়া ক্ষুদ্রঋণের ১৩ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় মৃতের সৎকার, বিয়ে ও বিবাহ বিচ্ছেদের মতো পারিবারিক অনুষ্ঠান এবং জরুরি সংকট মোকাবেলায়। হতদরিদ্রের ঋণের উৎস সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬০ শতাংশ মানুষ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে ঋণ নেয়। দাদনের ঋণ নেয় ১০ শতাংশ। এছাড়া ১৪ শতাংশ গ্রামীণ ব্যাংক থেকে, ৭ শতাংশ ব্রাক থেকে, ১২ শতাংশ বিভিন্ন এনজিও থেকে ও মাত্র ১ শতাংশ সাধারণ ব্যাংক থেকে।
এন.জি.ও দের অর্থের যোগানদাতা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। পৃথিবীর সর্বত্র তাদের নেটওয়ার্ক সক্রিয়। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিকাশ, খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচার, ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ, নতুন মুৎসুদ্দী শ্রেণী তৈরী করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পুঁজি পাহারা দেয়া তাদের লক্ষ্য। বিগত ২৫ বছরে ঋণ বা সাহায্যের নামে এদেশে এসেছে ৫০হাজার কোটি টাকা, তার ৭৫ ভাগ অর্থাৎ ৩৭.৫০ কোটি টাকা তারাই নিয়ে গেছে, বাকি ১২.৫০ হাজার কোটি টাকা এ দেশে একটি লুম্পেন ধনিক শ্রেণী গঠনে খরছ হয়েছে। এনজিওবিষয়ক ব্যুরোতে তালিকাভুক্ত এনজিওর সংখ্যা বাংলাদেশে ২ হাজার ৩৭টি। চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত এনজিওবিষয়ক ব্যুরো প্রকল্প অনুমোদন করেছে ৩২৯টি। অর্থ অবমুক্ত হয়েছে ১ হাজার ৮১৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ফরহাদ মজহার বলেন, “ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্যবিমোচন করে না বরং সামন্তসমাজের ভূমিদাসের মতো এ যুগের মানুষকে গ্রামীণ ব্যাংক একধরনের ঋণদাসে পরিণত করছে। দারিদ্র্যবিমোচনের এই পথ অনুসরণ করার ফলে আমাদের উন্নতির কোনো দিশা আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার মধ্যেই সংখ্যালঘুর ধনী ও সংখ্যাগরিষ্ঠের গরিব হওয়ার প্রক্রিয়া নিহিত। এই গরিব করা ও গরিব রাখার ব্যবস্থা বহাল রেখে গরিবদের ঋণ দিয়ে ও উচ্চহারে সুদ নিয়ে কীভাবে গরিবি মোচন হবে? এই অস্বাভাবিক ও বিকৃত চিন্তাকেই আমরা সদলবলে লালন করে আসছি। অথচ এই আসল কথা না বলে এখন যার যার স্বার্থ অনুযায়ী কেউ ড. ইউনূসকে গালি দিচ্ছি আর কেউ তাঁকে দেবতার আসনে চিরদিন অধিষ্ঠিত রাখার মিথ্যা চেষ্টা করছি।”
স্বাধীনতার ৪০ বছরেও বাংলাদেশ দারিদ্র্যের অভিশাপ হতে মুক্তি পায়নি। এনজিও কার্যক্রমের সুফল কোথায়? সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৬৮ লাখ। এর মধ্যে ২ কোটি ৫০ লাখ অতি দরিদ্র। দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে বড় বাধা আমাদের সামর্থের সীমাবদ্ধতা ও পালাক্রমে ক্ষমতাসীনদের নজিরবিহীন দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটপাট।
কার্টেসিঃ ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন