গল্প ও কবিতাব্যাংকার

জীবন তরঙ্গ: শিক্ষক থেকে ব্যাংকার হওয়ার গল্প-১

নূরুল ইসলাম খলিফাঃ ছাত্র জীবনে রচনা লিখতে হতো ‘জীবনের লক্ষ্য’ বা এইম ইন লাইফ। কতবার যে লিখেছি ডাক্তার হবো কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হবো কিন্তু কখনও ব্যাংকার হবো এমন কথা লিখেছি এমনটা মোটেই মনে করতে পারছি না। কেননা ব্যাংকিং যে একটা পেশা এমনটা জানাই ছিল না। তা ছাড়া আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যা, তাতে পরীক্ষায় পাশ করার জন্য রচনা লেখা; এর সাথে বাস্তব কোনো সম্পর্ক ছিল না। এখনও আমাদের শিক্ষার্থীদের হয়তো এধরনের রচনা লিখতে হয়, কিন্তু বাস্তবের সাথে কতটুকুন মিল আছে আমার জানা নেই।

মজার ব্যাপার ছিল, মানবিক বিভাগে পড়ছি আর জীবনে ডাক্তার হবো এমন কথাও লিখেছি! তার মানে লেখার জন্য লেখা। আসলে কি হতে চেয়েছি তা নিজেই জানতাম না। আমাদের কাছে তখন পড়াশুনার একটাই উদ্দেশ্য জানা ছিল আর তা হচ্ছে একটা চাকুরী করা-সেটি যেখানেই হোক। এটি গ্রাম বাংলার কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা প্রায় সবারই লক্ষ্য ছিল বললে খুব বেশি অতিরিক্ত বলা হবে না। ব্যতিক্রম ছিল হয়তো যারা একটু শিক্ষিত ও স্বচ্ছল পরিবারে বেড়ে উঠেছে তাদের মধ্যে।

আমার এ গল্প কোনো বিশেষ গল্প নয়। বাংলাদেশের আর দশজন সাধারণ মানুষের গল্পই। অনেকের সাথেই হয়তো মিলে যাবে। তারপরেও কিছু বৈচিত্র, কিছু নাটকীয়তা অবশ্যই আছে। এই গল্প বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, জীবনের পাতায় পাতায় করুণাময়ের সীমাহীন দয়া ও রহমতে সিক্ত আমি। পেছনের দিকে তাকালে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাই! প্রতিটি মুহুর্তেই আমি আমার মহান প্রতিপালকের স্নেহের দৃষ্টির সামনে রয়েছি। “হে নবী! আমার বান্দারা তোমাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে? বলে দাও আমি তাদের অতি নিকটে। তারা ডাকলে আমি তাদের ডাক শুনি এবং সাড়া দেই।” কুরআন মাজীদের এই অমীয় বাণী এমন প্রত্যক্ষ ভাবে আমার জীবনের নানা সময় প্রকাশ পেয়েছে যা বর্ণনাতীত! জীবনের এই লগনে এসে শুধুই ফরিয়াদ করি, ‘রাব্বুল আলামীন! তোমার একটি দানের শোকর আদায় করাও আমার পক্ষে সম্ভব না।

অতএব, আমার হিসাব সহজ করে দাও! আমার প্রতি তোমার রহমত ও বারাকাত অব্যাহত রাখো, বাড়িয়ে দাও কমিয়ে দিও না! আমাকে তোমার ক্ষমাপ্রাপ্ত বান্দাহদের মধ্যে শামিল কর, মহা সংকটের দিনে আমাকে লাঞ্চিত ও অপমানিত করোনা প্রভু আমার!’ যখন সরিকল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের আচরণে ব্যথিত হয়ে বিকল্প কিছু চাইছিলাম, সেই মুহুর্তেই প্রাইমারী স্কুলের দরজা খুলে গেল। যখন বছর তিনেক পরে মনটা ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে উঠলো তখনই ব্যাংকের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

সুদের চাকুরীর বিষয়ে যখন ভীতি এবং উদ্বেগ শুরু হলো এবং ভাল বিকল্পের চিন্তা করছিলাম, ইসলামী ব্যাংকের দ্বার খুলে গেল। ত্রিশ বছর একটানা একটি আনন্দময় পরিবেশে (একটি দিনের জন্যও খারাপ লাগেনি) কাজ করে শেষ মুহুর্তে যখন কারো কারোর কর্তৃত্ববাদী আচরণে ত্যক্ত বিরক্ত এবং ঘরে ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলাম তখনই আল আরাফাহ থেকে ডাক আসলো যেখানে শেষ দিনটি পর্যন্ত ছিল অপরিসীম মানসিক প্রশান্তি, সম্মান ও মর্যাদা। কী ভাবে আমি আমার প্রতিপালকের শোকর আদায় করবো?

এইচএসসি পরীক্ষা পাশের পরে তদানীন্তন সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতভাগ পাশের কেরামতিসহ একটা বিশ্রি ধরনের অরাজকতা দেখে আর লেখা পড়া করবো না সিদ্ধান্ত নিয়ে বাড়ি বসে বেকার জীবনের রসাস্বাদন করছি ।কী করবো না করবো তাই ভাবছি। বলা যায় ঘটনাচক্রে শিক্ষকতা শুরু করলাম ১৯৭৩ সালের ৭ জুন। যে স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে বের হয়েছিলাম আমার নিজের সেই প্রিয় শিক্ষাঙ্গনেই। বাড়ি থেকে ডেকে নিলেন তদানীন্তন প্রধান শিক্ষক, কিছু দিন তাকে একটু সাহায্য করতে। বলা প্রয়োজন যে, আমি ছাত্র থাকা অবস্থায় যিনি প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিনি ইতোমধ্যে ইনতিকাল করেছেন। অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ বলা যায় প্রায় সবাই তখন কর্মরত। সেই সব সম্মানিত ও প্রিয় শিক্ষকমন্ডলীর আমি সহকর্মী হলাম। ক্লাসে পড়াতাম ভাল, শিক্ষকগণ ভাল বাসতেন আমাকে। শিক্ষকতাকে দারুন ভাবে ভালবেসে ফেললাম।

সিদ্ধান্ত নিলাম শিক্ষকতাই করবো অন্য কিছু আর দরকার নেই। পায়ে চপ্পল, পাজামা-পাঞ্জাবী পরা সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ যৌবনে পা রাখা এক গ্রাম্য যুবক এমন একটি পেশার মধ্যে এক ধরনের রোমান্টিকতা খুঁজে পেলাম। কিন্তু জীবনের নাটাই যে জীবন মরনের মালিকের হাতে সেটি তখন অতটা উপলব্ধি করতে সক্ষম ছিলাম না যতটা আজকে বুঝতে পারি। বিশ্ব নিয়ন্তা একটা নিয়তি ঠিক করে রেখেছেন যা অতিক্রম করার সাধ্য কারোর নেই। মানুষের কাজ হচ্ছে বুদ্ধি বিবেচনা কাজে লাগিয়ে শুধু চেষ্টা করে যাওয়া। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মানুষের মালিকের হাতে। আল কুরআনের সুরা ইউসুফ পড়ার পর এ বিষয়ে আমার প্রত্যয় বেড়েছে। তাই তো তাঁর ভাইয়েরা যখন তাঁকে কুপে ফেলে দিল, বিশ্ব নিয়ন্তা বোধ হয় অলক্ষ্যে হেসেছিলেন এই বলে যে, তোমরা তো তাকে মিশরের বাদশাহ হওয়ার সিঁড়ির প্রথম ধাপে রেখে গেলে।

দেড় শ’ টাকা মাইনের মাষ্টারীতে আমি তখন মগ্ন। টাকা পয়সার চেয়েও পেশাটিকে দারুন উপভোগ করছিলাম। ইতোমধ্যে মাইনে বেড়ে দু’শো পঁচিশ এ দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আপনজনেরা বিষয়টি অত খুশীর সাথে নিলেন না। সাময়িক ভাবে মেনে নিলেও স্থায়ীভাবে আমি একজন স্কুল শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন বেছে নিব এটি যেন একটি অসঙ্গত চিন্তা তাদের কাছে। এক কথায় আমার মাথা ঠিক আছে কিনা এমনটাই প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ালো। সমাজের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, ‘যার নাই কোনো গতি, সে করে পন্ডিতি বা হোমিওপ্যাথি।’ যদিও দুটোর ব্যাপারেই আমার ছিল ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। হোমিও প্যাথির বিষয়ে আমার বরাবরই একটা উচ্চ ধারনা ছিল এবং এখনও আছে। এটি একটি চমৎকার শাস্ত্র যা মানব কল্যাণে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। ব্যক্তি জীবনে আমি নিজে এর কল্যাণের দিকটি প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করেছি সময়ান্তরে সে গল্প করা যাবে।

আমার পাঠকগণ হয়তো ইতোমধ্যে বিরক্ত হয়ে উঠেছেন এত লম্বা কিসসা কেন শুরু করেছি ভেবে। কিন্তু আমি আগেই বলেছি এ গল্প কিছুটা লম্বা হবে বিষয়টি পরিস্কার করার জন্য। শিক্ষকতা পেশাকে আমাদের সমাজে শুধুমাত্র আর্থিক মানদন্ডে বিচার করা হয় এবং এদিক থেকে শিক্ষকগণ সর্বদাই পিছিয়ে আছেন। কিন্তু খুব অল্প বেতনে প্রায় সাড়ে চার বছর হাই স্কুলে শিক্ষকতা করে আমি যে মানসিক তৃপ্তি পেয়েছি তা তুলনাহীন। ব্যাংকিং জীবনের শেষ তিন বছর এবং মাঝে দেড় বছরের মত আমি ছিলাম পুরোদস্তর শিক্ষক। দীর্ঘ কর্মজীবনে সব সময়ই সুযোগ পেলে শিক্ষকের ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করেছি। আসলে শিক্ষকতা আমার রক্ত মাংসে জড়িয়ে আছে সারা জীবন। তাই এ দু’টো পেশা সম্পর্কে প্রচলিত প্রবাদটি আমি সঠিক বলে কখনও ভাবি না।

তারপরও আমাকে শিক্ষকতা ছেড়ে দিতে হলো। এর পেছনে পারিবারিক, সামাজিক এবং মনস্তাত্বিক কারন বিদ্যমান ছিল যা উপেক্ষা করার মত অবস্থা আমার ছিল না। প্রথমত: আমরা উঠে এসেছি নিম্ন মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবার থেকে। অপেক্ষাকৃত মেধাবী ছাত্র হিসেবে আমার এ্যাকাডেমিক রেজাল্ট ভাল ছিল। পড়াশুনা করবোনা এমনটা সিদ্ধান্ত নিলেও পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে গ্রাজুয়েশান কমপ্লিট করেছি। সে বছর পাশের হার ছিল তের এবং বরিশাল বিএম কলেজ কেন্দ্রে দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করার দু’জনের আমি ছিলাম একজন। সুতরাং পরিবারের স্বাভাবিক প্রত্যাশা ছিল একটা ভাল চাকুরী করবো এবং পরিবারকে সাপোর্ট দেব।

তখনকার সময়ের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন প্রত্যাশা কোনো অযৌক্তিক ছিল না। পরিবারে খানিকটা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ আসবে এবং এর মাধ্যম হিসেবে চাকুরীকেই একমাত্র অবলম্বন মনে করা হতো। আমার পরিবারে আমিই বড় সন্তান। নয় ভাই বোনের সবাই তখন স্কুল কলেজে পড়াশুনা করছে। সংসারের উপার্জনাক্ষম একমাত্র বাবা যার আয়ের উৎস হচ্ছে কৃষিকাজ। যে বছর ফসল ভাল হতো মোটের উপর চলে যেত টানাটানির মধ্যে। কিন্তু অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদিজনিত কারনে যে বছর ফসল ভাল হতোনা সে বছর বেশ কষ্ট হতো বাবার জন্য।

এমন একটি পরিবারের মেধাবী সন্তান হিসেবে শিক্ষকতায় পড়ে থাকা মানে একধরনের ভ্রান্তি বিলাস এমনটাই মনে করতে লাগলেন আপন জনেরা। এই সময়ে সরকারী প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ হওয়ার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলো। আমার এক ফুফাতো ভাই যিনি বিএবিএড করে নিকটস্থ এক হাই স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন তিনি আমাকেও আবেদন করতে চাপ সৃষ্ঠি করলেন। তিনি নিজে তো আবেদন করলেনই, আমার আবেদনটিও তিনি নিজের হাতে সংশ্লিষ্ট অফিসে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে আমাকে আবেদন করতে বললেন। আমার অনীহা দেখে নসীহত করলেন, ‘আরে সাহেব! প্রেস্টিজ দিয়ে কি জীবন চলে? প্রাইমারী স্কুলের চাকুরী সরকারী চাকুরী। এখন ক’টাকা বেতন পাও? ওখানে মাস গেলে বেতন এবং সাড়ে তিন শ’ থেকে চার শ’ টাকা পাওয়া যায়।’ তাকে আমি কিভাবে বুঝাবো যে আমি প্রেস্টিজের জন্য নয়, আমার ভাল লাগার জন্যই হাই স্কুলের শিক্ষকতা ছাড়তে চাচ্ছি না।

শেষ পর্যন্ত আবেদন করলাম বলা যায় করতে বাধ্য হলাম। ভাবলাম সবাই যখন চায়, আবেদন করেই ফেলি। আবেদন করলেই তো আর চাকুরী হয়ে যাবে না, আর চাকুরী হলে তখন সবাইকে এক রকম বুঝিয়ে সুঝিয়ে ম্যানেজ করে নিব। প্রাইমারী স্কুলে অবশ্যই চাকুরী করবো না। মৌখিক পরীক্ষা দিলাম অনেকটা তাচ্ছিল্য করে। আমি নিশ্চিৎ ছিলাম যে, যেভাবে আমি ইন্টারভিউ বোর্ডের মেম্বারদেরকে পাল্টা প্রশ্ন করেছি, তাতে চাকুরী হওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু এখানেও আমি আমার তাকদিরকে দেখতে পেলাম। ইতোমধ্যে স্কুলের প্রধান শিক্ষক যাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতাম এখনও তার জন্য দোয়া করি এবং যিনি আমাকে বাড়ি থেকে ডেকে এনেছিলেন, তিনি আমার সাথে এমন একটি প্রতারনামুলক আচরণ করলেন যা তার মত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের যায় না। তিনি ছিলেন আমার কাছে এক টাওয়ারিং ব্যক্তিত্ব এবং বলা যায় আমার আইডল।

আমি মানসিক ভাবে খুব দু:খ পেলাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম তার সাথে আর এক ছাদের নীচে কাজ করা সম্ভব নয়। একটা বিকল্পের সন্ধান করছিলাম, ঠিক এই সময়েই প্রাইমারী স্কুলের নিয়োগ পত্র এসে হাজির। যেখানে কোনোভাবেই চাকুরী করবো না, সেটাই তখন আমার কাছে আল্লাহর মূর্তিমান রহমত হিসেবে মনে হলো। তখনকার জাতীয় বেতন কাঠামোর ৮ম গ্রেডের সরকারী চাকুরী কোনোভাবেই ফেলনা নয় আমার অভিভাবকদের কাছে। তারা মন্দের ভাল হিসেবে গ্রহন করলেন অন্তত সরকারী চাকুরী তো! আর আমার অবস্থা ছিল যে ভাবেই হোক এখান থেকে সরতে হবে।

প্রায় সাড়ে চার বছরেরও বেশি সময় হাই স্কুলে কাজ করে শতভাগ অনিচ্ছায় আমি যোগ দিলাম প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হিসেবে। অনিচ্ছার কারনটি ছিল অনেকটাই মনস্তাত্বিক। এত ছোট বাচ্চাদের আমি কি পড়াবো যেখানে আমি দশম শ্রেণির অর্থনীতি এবং বাংলা সাহিত্য পড়াই। অষ্টম শ্রেণির ইংরেজী পড়ানো মাষ্টার আমি এই দুধের শিশুদের কি পড়াবো? বাবার দিকটা চেয়ে আমি মানাতে চেষ্টা করলাম। যদিও বাবা কখনও মুখে বলেননি যে, তাকে টাকা দিয়ে পরিবারে সাপোর্ট দিতে হবে। কিন্তু অন্যান্য আত্মীয় স্বজনেরা আমাকে প্রায়ই একথা বুঝাতেন। আমি নিজেও বিষয়টি বুঝতাম, বাবাকে আরও একটু সাপোর্ট দেয়া দরকার সেটা বুঝার মত মন এবং বোধ আমার ছিল। কিন্তু হাই স্কুলের শিক্ষকতা কোনো ভাবেই ছাড়তে ইচ্ছ করছিল না। এজন্য আমি সকাল বিকাল দু’বার ছাত্র ছাত্রীদের প্রাইভেট পড়াতাম। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না। অনেকটা কুইনিন গেলার মত ১৯৭৭ সালের ৩১ অক্টোবর মেহেন্দিগঞ্জ থানার চাঁদপুর ইউনিয়নের কাশীপুর হাই স্কুলে যোগ দিলাম যা বাড়ি থেকে অনেক দূরে।

প্রাইমারী স্কুলে চাকুরী করার বিষয়ে আমার এই অনীহা পুরোটাই মনস্তাত্বিক। এখানে বড় ছোট কোনো বিষয় নয়; অথবা টাকা পয়সা কম বেশিরও কোনো বিষয় নয়। কেননা ছোটদের পড়ানোর যে যোগ্যতা এটা আমার ছিল না। আবার যেনতেন করে ক্লাসে সময় কাটানো আমার কাছে অনৈতিক মনে হতো। বিগত সাড়ে চার বছর আমি ছাত্র ছাত্রীদের সামনে যে ইথিক্যাল বিষয়গুলো তুলে ধরতাম সে বিষয়টি এখানে ছিল না। ক্লাসে মনোনিবেশ না করতে পেরে অবশেষে আমি শিক্ষক সমিতির সাথে জড়িয়ে পড়লাম। ১৯৭৯ সালে নির্বাচন করে বাবুগঞ্জ থানা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলাম। এর পরে আর স্কুলে আমার উপস্থিতি খুব কমই ছিল। আমার কর্মক্ষেত্র হয়ে উঠলো থানা শিক্ষা অফিস। শিক্ষকদের জন্য কিছু করা যায় কিনা সেটা হয়ে উঠলো আমার কর্মসূচী। কিছু পরিবর্তন আনতে সক্ষম হলাম।

কিন্তু গতানুগতিকতার উর্দ্ধে উঠতে যে সাহস ও মন দরকার, দেখলাম সেটা করতে শিক্ষকগণ রাজী হচ্ছেন না। তারা একটা ষ্ট্যটাসকে বজায় রাখতেই বেশি আগ্রহী। স্কুলে যাওয়া, মাসের মাইনেটা পাওয়া এটুকুনই যথেষ্ট। টিইও বা অন্য অফিসে কি হলো, বেতন পেতে কেন ঘাটে ঘাটে টাকা দিতে হবে- এসব নিয়ে তারা ভাবতে মোটেই রাজী না। কেউ উগ্যোগ নিক তাও তাদের পসন্দ নয়, যদি টিইও অফিস আবার বিগড়ে যায় এসব জুজুর ভয়ে তারা অস্থির থাকতো।

সর্বোপরি সমিতির কাজ কর্মে স্বচ্ছতার বেশ অভাব ছিল যেটি নিয়ে আমার সভাপতির সাথে একটা দূরত্ব তৈরী হয়ে গেল। তিনি যেহেতু আমার বেশ গুরুজন এবং বহু বছর ধরে এই দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন, তাই তার সাথে ঝগড়ায় যেতেও মন সায় দিচ্ছিল না। তখন একটা বিকল্প খুঁজতে শুরু করলাম। ক্লাসে এসেও একসাথে দু’টো ক্লাস নিলে প্রচন্ড মাথাব্যাথা করতো। ফলে আমার প্রভুর কাছে আবার ফরিয়াদ একটা ভাল বিকল্প দাও মা’বুদ! (অসমাপ্ত)

লেখকঃ নূরুল ইসলাম খলিফা, সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ও সাবেক প্রিন্সিপাল, ট্রেইনিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড।

আরও দেখুন:
ব্যাংকাররাই ব্যাংকারদের ক্ষতি করছে
ব্যাংকারদের লেন‌দেন সময় ও টা‌র্গেট ক‌মা‌নো উচিত
ব্যাংকার হতে চান? আরেকবার ভাবুন
একজন ব্যাংকারের যে সকল গুণাবলী থাকা জরুরী
ব্যাংকারদের দেরিতে অফিস ত্যাগ সিস্টেম নাকি অদক্ষতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button