জীবন তরঙ্গ: এইচআরডি খুব পিচ্ছিল জায়গা!
নুরুল ইসলাম খলিফাঃ ২০০৪ সালের জুলাই মাসের চার তারিখে আমি ব্যাংকের মানব সম্পদ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিলাম। এখানে আসাটাও আমার চিন্তা ভাবনা বা আশা আকাঙ্খার একেবারেই বিপরীত মুখী ঘটনা। ক্যারিয়ারে সবারই একটি আশা থাকে; থাকে সামনের দিকে যাওযার একটা স্বপ্ন এবং সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের একটা কল্পচিত্রও মনে মনে আঁকা থাকে। কিন্তু আমার এই কল্পচিত্রের মাঝে এইচ আর নামক স্টেশনটি একেবারেই ছিল না এবং কখনও মনের কোনে উঁকিও দেয়নি যে এইচ আর এ কাজ করবো। ঘটনাটি আমার জন্য যেমন আকস্মিক ছিল; তেমনি ছিল অভাবিত। সেই কাহিনীটি শেয়ার করার আগে একজন সহকর্মীর একটি মন্তব্য শেয়ার করা প্রয়োজন মনে করছি।
২০০৩ সালে আমরা ১২ জন ভাইস প্রেসিডেন্ট, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে পদোন্নতি পাই। আমি কেবলমাত্র মানব সম্পদ ডিভিশনের প্রধান হিসেবে যোগ দিয়েছি। এখানে উল্লেখ্য যে, আমাদের এই বারো জনের মধ্যে আমিই প্রথম জোনাল হেড হিসেবে পোষ্টিং পাই এবং হেড অফিসে আমিই প্রথম একটি ডিভিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পাই। অন্যরা বেশির ভাগই শাখা প্রধান এবং কেউ কেউ হেড অফিসে ডিপার্টমেন্ট প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এমনই একজন ডিপার্টমেন্টাল হেড, আমার সহকর্মী নামাজের পরে আমাকে বললেন, ‘খলিফা ভাই, এইচ আরডি কিন্তু খুবই পিচ্ছিল জায়গা। আপনি এসেছেন তো, একটু সাবধানে থাকবেন।’ আমি বিষয়টি সহজ ভাবেই নিলাম এবং ভাবলাম, তিনি একজন শুভার্থী ভাই হিসেবে কথাটা বলেছেন, কেননা এই জায়গাটা পিচ্ছিল হোক বা না হোক কিছুটা সংবেদনশীল তো বটেই। কিন্তু তিনি পরপর তিন দিন আমাকে একই কথা বললেন। আমি ভাবলাম এখন একটু কথা বলতে হয়, নয়তো একই কথা আরও কতদিন শুনতে হয় কে জানে? বললাম, ‘ভাই, আমি এইচআরডি তে আসি নাই এবং আসতে চাইও নাই। আমাকে আনা হয়েছে এবং আমি মনে করি যিনি আমাকে এখানে এনেছেন, আমার সেই সর্বশক্তিমান মালিকের উপরই আমি ভরসা করি। আপনারাও আমাকে সহযোগিতা করবেন এবং আশা করি পিচ্ছিল হলেও পথ চলতে সমস্যা হবে না।
আরও দেখুন:
◾ ইসলামী ব্যাংকিং: তিন দশকে যেভাবে বুঝেছি
২০০৪ সালের ২ জানুয়ারী আমি খুলনা জোন প্রধান হিসেবে যোগ দেই। এর পূর্বে কুষ্টিয়া শাখার দায়িত্বে ছিলাম একটানা প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর। তখন খুলনা জোনের আওতায় একুশটি শাখা। কিন্তু জোনের ভৌগোলিক আয়তন ছিল অনেক বড়। বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙা, যশোর, মেহেরপুর জেলায় অবস্থিত শাখা সমুহ এই জোনের আওতায় ছিল। ফলে জোন প্রধানকে ব্যাপক সফর করতে হতো। আমি সবগুলো শাখায় মাত্র একবারই রুটিন পরিদর্শন শেষ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। মাগুরাতে একটা শাখা খোলা হবে, জায়গা সিলেকশান করার জন্য হেড অফিসের চিঠি পেলাম এবং যথারীতি মাগুরা শহরে একটি বাড়ি প্রাথমিক ভাবে নির্বাচিত করলাম। খুলনাতে প্রধান নির্বাহী আবদুর রকীব সাহেবের একটি ভিজিট ছিল। আমাকে তিনি বললেন যে, রাতে ফরিদপুর থাকবেন এবং সেখান থেকে ভোরেই তিনি খুলনা রওয়ানা দিবেন। পথে প্রস্তাবিত মাগুরা শাখার ভবনটি দেখবেন। ফলে আমি খুলনা থেকে ফজর পড়েই রওয়ানা দিলাম এবং মাগুরাতে এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্টকে রিসিভ করলাম। প্রস্তাবিত বাড়িটি দেখে তিনি সন্তষ্ট হলেন। মাগুরা থেকে খুলনা আসার পথে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, খুলনাতে বাসায় কে কে আছে? মেয়েকে ভর্তি করিয়েছি কিনা, ছেলে হলে থাকে না বাসায় থাকে ইত্যাদি। উল্লেখ্য, কেবলমাত্র কুষ্টিয়া থেকে এসে খুলনায় সেটেল্ড হয়েছি। সেঝ মেয়েটাকে বয়রা সরকারী মহিলা কলেজে ভর্ত্তি করেছি। ছোট মেয়েটাকে একটা মাদ্রাসায় ভর্ত্তি করেছি। বড় ছেলে তখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগের ছাত্র। সে মেস থেকে বাসায় শিফট হলো।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
রকীব সাহেবের কথায় আমার একটু সন্দেহ হলো যে, এত কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন? বললাম, স্যার! এত তথ্য জিজ্ঞেস করছেন কেন কোনো সমস্যা? তিনি একটু দ্বিধা মিশ্রিত কন্ঠে বললেন, ‘না সমস্যা নেই; তবে আপনাকে নিয়ে একটু ভিন্ন চিন্তা হচ্ছে।’ ‘কি চিন্তা হচ্ছে?’ জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকালাম আমি। উনি বললেন, আপনাকে হেড অফিসে নেয়ার চিন্তা হচ্ছে।’ পরে তিনি বিস্তারিত বললেন যে আমাকে হেড অফিসের মানব সম্পদ বিভাগের প্রধান হিসেবে বদলী করার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। আমি খানিকটা বিস্মিত হলাম এই ভেবে যে, মাত্র ছ’মাসও হলো না আমাকে এখানে জোন প্রধান হিসেবে বদলী করা হয়েছে, এখনই আবার কেন হেড অফিসে নিতে হবে? কিন্তু ম্যানেজমেন্ট চাইলে কিছু করার নেই। বললাম, ‘স্যার! বদলীর বিষয়ে আমার কখনও কিছু বলার নেই, কিন্তু যখন আমাকে কুষ্টিয়া থেকে খুলনা জোন প্রধান করে দেয়া হয়, তখনই আমি অনুরোধ করেছিলাম হেড অফিসে নিতে। এখন বাসা বাড়ি নিয়েছি, ছেলেটি হল ছেড়ে বাসায় এলো, মেয়েদেরকে ভর্তি করিয়েছি; বেশ কষ্ট হবে আমার।’ উনি বললেন, তখন সবাই আপনাকে খুলনা জোনে দেয়ার পক্ষে ছিল; এখন সবাই আপনাকে হেড অফিসে নিতে চায়, একটু কষ্ট হলেও কী আর করবেন। আসেন হেড অফিসে একত্রে কাজ করবো, আপনার ভাল লাগবে।
অবশেষে ২০০৪ সালের ৪ জুলাই, যোগ দিলাম হেড অফিসে এইচআর প্রধান হিসেবে এবং এর এগারো বছর পরে হেড অফিস থেকে অবসরে চলে এলাম। মাঝখানে মাত্র বছর খানেকের মত ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন; এর পরে আবার হেড অফিসে। আমি যোগ দেয়ার পরে একদিন ব্যাংকের তদানীন্তন চীফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) মরহুম হাবীবুর রহমান ভুঁইয়া আমাকে বললেন, ‘খলিফা ভাই! আপনাকে স্বাগতম! আপনার পোষ্টিং অর্ডার হওয়ার আগ থেকেই আমি জানতাম যে আপনি আসছেন এখানে। ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান জনাব নাজির আহমদ সাহেব বলছিলেন যে, এইচআরএ একজন হৃদয়বান মানুষ দরকার। আর আপনাকে উনি সেই ভাবেই দেখেন।’ বললাম, ‘আমার হৃদয় আছে কিনা সেটিই তো খুঁজে দেখিনি। তার পরেও যখন এসে পড়েছি, সকলের দোয়া চাই যেন কমপক্ষে হৃদয়হীন না হই।’
এইচ আর প্রধান হিসেবে আমি চার বছরের কিছু বেশি ছিলাম। দু’টো কাজ করার চেষ্টা করেছি আমি আমার রুটিন জবের বাইরে।
প্রথমত: এটি কোনো নিষিদ্ধ এলাকা নয়; এমন একটি ধারণা দিতে চেয়েছি জনশক্তির কাছে। এখানের সহকর্মীদের বলেছি, আমাদের এখানে কিছু গোপনীয় বিষয় আছে সন্দেহ নেই কিন্তু সেটির জন্য গোটা এইচআরডিকে নিষিদ্ধ এরিয়া বানানো দরকার নেই। এইচআর হবে জনশক্তিবান্ধব। শাখার যেমন গ্রাহক সেবা আছে, এইচ আরডির গ্রাহক হলো প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এবং তাদের সেবা দেয়া নিশ্চিত করতে হবে এইচআরডি কে। যে ডিপার্টমেন্ট গোপনীয় বিষয়গুলো দেখে তারা গোপনীয়তা বজায় রাখবে কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এখানে কেউ কিছু জানতে আসলেই তার সাথে রাফ এ্যান্ড টাফ হতে হবে।
দ্বিতীয়ত: আমার চেম্বার সকলের জন্য ওপেন করে দিয়েছিলাম। যে কেউ দেখা করতে আসলে আমি কখনই তাকে ফিরিয়ে দেই নি। একজন ম্যাসেঞ্জারও উত্তর বঙ্গের কোনো শাখা থেকে বিনা নোটিশে এসে আমার সাথে দেখা করতে চাইলে তাকে বঞ্চিত করিনি। অতি ব্যস্ত সময় যখন আমাকে বলা হয়েছে স্যার! একজন সিকিউরিটি গার্ড এসেছে রংপুর থেকে, আপনার সাথে কথা বলতে চায়। মাঝে মধ্যে বিরক্তি এসেছে, কিন্তু সাথে সাথে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে গেছে। মনে মনে চিন্তা করেছি, একজন কর্মী আমার সাথে দেখা করতে এসেছে, তার কথা না শুনলে যদি আল্লাহ তায়ালা আমাকে কৈফিয়ত তলব করেন যে, তোমাকে একটি দায়িত্ব দিয়েছিলাম, কিন্তু তুমি তোমারই মত একজন কর্মীর কথা শুনার মত সময় পাও নি; আজকে তোমার কথা আমি শুনবো কেন? সকলের সমস্যা হয়তো সমাধান করতে পারিনি; কিন্তু শুনেছি সবার কথাই। যতটুকু আমার এখতিয়ারে ছিল, যতটুকুতে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের কোনো ক্ষতি হয়নি, ততটুকু করতে আমি কখনও কার্পণ্য করিনি। তার পরেও ভুলত্রুটি হয়েই যেতে পারে। তবে চেষ্টা করেছি রাগ অনুরাগের বশবর্তী হয়ে কিছু না করতে।
আলহামদুলিল্লাহ! এইচআরডি আমার কাছে পিচ্ছিল মনে হয়নি, তবে সংবেদনশীল তো বটেই। শত শত নিয়োগ পত্রে সই করেছি তখন কিন্তু বেশ ভাল লেগেছে যে, একটি পরিবারের মুখে হাসি ফুটবে। আবার যখন কারো ডিসমিসাল লেটারে সই করেছি, তখন ভীষন কষ্ট লেগেছে। কত কান্না, অশ্রু আর দীর্ঘশ্বাসের সাক্ষী হতে হয়েছে! এসব ক্ষেত্রে সাধারণত এইচআর প্রধানের তেমন কিছু করার থাকে না। প্রতিষ্ঠানের নীতিমালার আওতায়ই তাকে কাজ করতে হয়। চার বছরেরও বেশি সময় এখানে থাকার পর কর্তৃপক্ষ আমার সম্মতি নিয়েই আমাকে কর্পোরেট বিনিয়োগ বিভাগের প্রধান হিসেবে বদলী করেছেন।
লেখকঃ নুরুল ইসলাম খলিফা, সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ও সাবেক প্রিন্সিপাল, ট্রেইনিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড।