দুর্নীতির মূলোৎপাটনই হোক টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি
মোঃ জিল্লুর রহমানঃ বর্তমানে টেকসই উন্নয়ন এবং দুর্নীতি একথা গুলো মানুষের মুখে মুখে খুবই প্রচলিত। একটির সাথে আরেকটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কেননা, টেকসই উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে যেটি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা হলাে দুর্নীতি। নৈতিকভাবে উন্নত, সৎ, বিবেকবান মানুষ যে পদেই থাকুন কেন, তিনি সমাজ ও জাতির বড় সম্পদ। তাকে দিয়ে উপকার না হলেও অন্তত কারও ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে না। অপরদিকে নৈতিকতা বিবর্জিত ব্যক্তি যতই উচ্চ আসনে অবস্থান করুক না কেন, তিনি মােটেও শ্রদ্ধার পাত্র নন। পদমর্যাদার কারণে তাকে হয়তাে মানুষ সামনে কিছু বলে না কিন্তু পেছনে অন্তর থেকে ঘৃণা করে। তার দ্বারা উপকারের চেয়ে দেশ ও জাতির ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি।
আভিধানিক অর্থে দুর্নীতি হলো নীতিবিরুদ্ধ, কুনীতি, অসদাচরণ, অসৎ উপায় অবলম্বন, অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন, নীতি-বিরুদ্ধ আচরণ ইত্যাদি। আর প্রতিরোধ অর্থ হচ্ছে-নিরোধ, নিবারণ, বাধাদান, প্রতিবন্ধকতা, আটক, ব্যাঘাত। আভিধানিক অর্থে শব্দটি অত্যন্ত ছোটো হলেও এর অর্থ ব্যাপক। দুর্নীতিকে নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞায় আবদ্ধ করা যায় না। দুর্নীতি এমন এক ধরনের অপরাধ, যার সঙ্গে ক্ষমতার অপব্যবহার, সুযোগ সুবিধার অপব্যবহার যুক্ত। সাধারণ কথায় দায়িত্বে অবহেলা, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ উৎকোচ গ্রহণ বা মহল বিশেষের অশুভ স্বার্থ হাসিল করাকে দুর্নীতি বোঝায়।
আরও দেখুন:
◾ ব্যাংকের এন্ট্রি লেভেলে বেতন-ভাতা সংক্রান্ত নতুন সার্কুলার জারি
অন্যদিকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) হলো ভবিষ্যত আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত একগুচ্ছ লক্ষ্যমাত্রা। সহজ কথায় টেকসই উন্নয়ন বলতে ঐ ধরনের উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ডকে বুঝায় যার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাও নিশ্চিত হয়, দীর্ঘস্থায়ী হিসেবে টিকে থাকে আবার প্রকৃতি এবং আমাদের ইকোসিস্টেমেও কোন ক্ষতিকর প্রভাব না পড়ে৷ জাতিসংঘ লক্ষ্যগুলো প্রণয়ন করেছে এবং “টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা” হিসেবে লক্ষ্যগুলোকে প্রচার করেছে। এসব লক্ষ্য সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে প্রতিস্থাপন করেছে, যা ২০১৫ সালের শেষ নাগাদ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মেয়াদ ২০১৬ থেকে ২০৩০ সাল। এতে মোট ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা ও ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা হলো- দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধা মুক্তি, সুস্বাস্থ্য, মানসম্মত শিক্ষা, লিঙ্গ সমতা, সুপেয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, নবায়নযোগ্য ও ব্যয়সাধ্য জ্বালানী, কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি, উদ্ভাবন ও উন্নত অবকাঠামো, দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় বৈষম্য হ্রাস, টেকসই নগর ও সম্প্রদায়, সম্পদের দায়ীত্বপূর্ণ ব্যবহার, জলবায়ু বিষয়ে পদক্ষেপ, টেকসই মহাসাগর, ভূমির টেকসই ব্যবহার, শান্তি, ন্যায়বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য অংশীদারিত্ব৷
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
বার্লিন ভিত্তিক দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা “ট্রান্সপারেনসি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)” পরিচালিত দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান হতাশাজনক। সম্প্রতি টিআই বিশ্বজুড়ে দুর্নীতির ধারণাসূচক বা করাপশন পারসেপশনস ইনডেক্স (সিপিআই) ২০২১ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। উক্ত রিপোর্টে দুর্নীতির বিশ্বজনীন ধারণাসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এক ধাপ উন্নতি হয়েছে। মোট ১৮০টি দেশের তথ্য নিয়ে সংস্থাটি সিপিআই ২০২১ প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে এবং দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে একমাত্র আফগানিস্তানই বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। সূচক অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ভুটান, দেশটির স্কোর ৬৮। উক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় নিচের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম এবং ২০২০ সালে যা ছিল ১২তম। ১৩তম অবস্থানে আরও রয়েছে মাদাগাস্কার ও মোজাম্বিক। এবার বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭তম রয়েছে। তবে গত চার বছর ধরে ১০০ এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২৬।
টিআইবি’র মতে, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের দুর্নীতির পেছনের অন্যতম একটি কারণ হলো, বাস্তবে উচ্চ শ্রেণির দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকার যথাযথ বাস্তবায়ন না করা। সূচক অনুযায়ী, সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। দেশ তিনটির স্কোর ৮৮। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত আফ্রিকান দেশ দক্ষিণ সুদান, দেশটির স্কোর ১১ এবং ১৩ স্কোর পেয়ে যৌথভাবে তালিকার দ্বিতীয় সর্বনিম্ন সিরিয়া ও সোমালিয়া এবং ১৪ স্কোর পেয়ে তৃতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে ভেনেজুয়েলা। উল্লেখ্য, টিআই’র দুর্নীতির ধারণা সূচকে ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ছিল তালিকার এক নম্বরে!
অর্থনীতিবিদদের মতে, টেকসই উন্নয়ন ও দুর্নীতি পরস্পর নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। একটি দেশ যখন দরিদ্র অবস্থা থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে ধাবিত হয়, তখন সে দেশে ব্যাপক দুর্নীতি দেখা দিতে পারে। দুর্নীতি অনেকটাই উন্নয়নের সহযাত্রী। অর্থাৎ একটি দেশ বা জনপদ যখন উন্নয়নের ধারায় ধাবিত হয় তখন সেখানে নানা পর্যায়ে দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে এবং প্রশ্নাতীত রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে, তাহলে দুর্নীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা সম্ভব।
বিশ্বে কোনো দেশই দুর্নীতিকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পারেনি। উন্নত দেশগুলোতে দুর্নীতি আছে তবে তা সীমিত বা সহনীয় পর্যায়ে।তাই দুর্নীতি সেসব দেশের প্রধান সমস্যা নয়। তবে একটি সমাজে কোনোভাবেই ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতির বিস্তার সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। দ্রুত উন্নয়ন এবং ব্যাপক দুর্নীতিও কাম্য হতে পারে না।অতি দরিদ্র কোনো দেশ যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের মহাসড়কে ধাবিত হয় তখন সেখানে অবধারিতভাবে দুর্নীতির বিস্তার ঘটে।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তা এক কথায় বিস্ময়কর। বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ধারাবাহিক ৭ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। ২০১৯ সালে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বড়ো ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে। তখন বাংলাদেশ হবে ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। সামাজিক নানা সূচকে বাংলাদেশ নিকট-প্রতিবেশী অনেক দেশকে অতিক্রম করে গেছে।
তবে বহুল আলোচিত রূপপুরের বালিশ কাণ্ড, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কেলেঙ্কারি, ক্যাসিনো কান্ড, দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ কাজে রডের পরিবর্তে বাঁশ, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, জনতা ব্যাংকের অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট ও থারমেক্স গ্রুপের দুর্নীতি, সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের অর্থ লোপাট ইত্যাদি সাম্প্রতিক বছরগুলোর আলোচিত-সমালোচিত দুর্নীতির ঘটনা। এসব ঘটনা ও কেলেঙ্কারি আমাদের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য বড় ক্ষত এবং দুর্নীতি প্রতিরোধের বিশাল হুমকি ও চ্যালেঞ্জ।
টিআইবি’র মতে, বাংলাদেশের দুর্নীতির সম্ভাব্য কারণগুলো হলো- দুর্নীতির বিরুদ্ধে অঙ্গীকার এবং এর বাস্তবায়নের মিল না থাকা; উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও আমলাদের দুর্নীতি চিহ্নিত না করা; সরকার ও রাজনৈতিক দল সহ উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে না পারা; আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে ঋণ খেলাপি ও জালিয়াতি বৃদ্ধি পাওয়া; ভূমি-নদী-খালবিল দখল, টেন্ডার ও নিয়োগে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ না কমা; অবৈধ অর্থের লেনদেন বন্ধ না হওয়া; দুর্বল জবাবদিহিতা; দুদকের কার্যকারিতা ও স্বাধীনতার অভাব; দায়মুক্তি ও দুর্বল আইনের শাসন। অর্থাৎ দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং এই অপরাধে সবার জন্য আইন সমান, সেই ধারণা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া এবং গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের ক্ষেত্র সংকুচিত করা।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো দুর্নীতির বিষবৃক্ষ মূলোৎপাটন করে ফেলা। বর্তমান বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে বইছে দুর্নীতির কালো অধ্যায়, সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কালো থাবার প্রভাবে আচ্ছন্ন প্রতিটি নাগরিকের জীবন। সর্বনাশা এই ব্যাধি দেশকে আজ হুমকির সম্মুখীন করেছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ নীতি, শিল্প বাণিজ্য, ব্যবসাসহ সকল ক্ষেত্রেই চলছে দুর্নীতির তাণ্ডব লীলা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে দুর্নীতিই আজকের বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের প্রধান বাধা। দুর্নীতি যে কোনো দেশেরই উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক সাম্য ও গণতন্ত্রের জন্যও হুমকি। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দুর্নীতি রয়েছে। এই দুর্নীতির ব্যাপকতা, প্রকৃতি, মাত্রা, ক্ষেত্র এবং কৌশল ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘুষ দুর্নীতির চাপে পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
দুর্নীতিই টেকসই উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় ও প্রতিবন্ধক। এই দুর্নীতিই ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক সাম্য ও গণতন্ত্রের হুমকি। উন্নয়নের এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এর বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। দুর্নীতির বিষবৃক্ষ সকল স্তর থেকে উপড়ে ফেলতে হবে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বদরবারে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে সুষমভাবে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আঞ্চলিকতা বা অন্য কোনো বিভাজনকে ন্যূনতম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য- দুর্নীতিই আজকের বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান বাধা হিসেবে সামনে চলে আসছে। টেকসই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে জিরো টলারেন্স নীতির মাধ্যমে দুর্নীতির বিষবৃক্ষ সমূলে উচ্ছেদ করতে হবে।
মোঃ জিল্লুর রহমান, ব্যাংক কর্মকর্তা ও ফ্রিল্যান্স লেখক।