ব্যাংকিং প্রফেশনাল এক্সাম (BPE)

ব্যাংকিং ডিপ্লোমা যুগোপযোগী হোক

ড. লিপন মুস্তাফিজঃ ব্যাংকিং ডিপ্লোমা যুগোপযোগী হোক – বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকিং সেবার অবদান অনস্বীকার্য। একইভাবে কর্মসংস্থানেও ব্যাংকিং খাতের অবদান কোনো অংশেই কম না। বর্তমানে আমাদের দেশে ছয়টি সরকারি, তেতাল্লিশটি বেসরকারি, দশটি বেসরকারি ইসলামি, নয়টি বিদেশি, তিনটি বিশেষায়িত এবং পাঁচটি নন-শিডিউল ব্যাংক আছে। সব মিলিয়ে মোট ৭৬টি ব্যাংক বাংলাদেশে কাজ করছে। আমরা আনুমানিকভাবে বলতে পারি প্রায় ২ লাখ জনবল নিয়ে ব্যাংক খাত কাজ করছে। এ গবেষণায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানিকে তিনি যুক্ত করেননি।

কর্মসংস্থানের তাগিদে এই খাতে নিয়োজিতরা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নানান বিষয়ে পড়াশোনা করে ডিগ্রি অর্জন করেছে। এই খাত এমন একটি খাত যেখানে শুধু বাণিজ্য বিভাগ নয়, মানবিক, আইন, বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরাও কাজ করে। এই খাতে চাকরির জন্য যেন সবাই আবেদন করতে পারে এমন একটা নির্দেশনা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও দেওয়া আছে। ব্যাংকিং খাত তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর হওয়ার কারণে এখানে কম্পিউটার সায়েন্সের গ্র্যাজুয়েটদেরও কাজের সুযোগ আছে। মেকানিক্যাল ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এমনকি ডাক্তারদের কাজ করার সুযোগও আছে এই খাতে। সুতরাং ব্যাংকিং খাত এমন একটা খাত যেখানে প্রায় সব ডিসিপ্লিন থেকে পাস করা গ্রাজুয়েটদের কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে।

ডিপার্টমেন্টাল বা বিভাগীয় পরীক্ষা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সব পেশায় কম-বেশি থাকে, যা সেই পেশার পদোন্নতিতে ভূমিকা রাখে। পদোন্নতির জন্য কিছু বৈশিষ্ট্য ঠিক করা হয় যার বিপরীতে একটা নম্বর থাকে (সাধারণত ১০০ নম্বর) যার ভিত্তিতে এক পদ থেকে আরেক পদে একজন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সে বৈশিষ্ট্যের একটা হলো পেশাগত যোগ্যতা। একইভাবে ব্যাংকিং খাতে পদোন্নতির জন্যও পেশাগত যোগ্যতার বিপরীতে একটা নম্বর থাকে। যা মূলত ব্যাংকিং ডিপ্লোমা নামে পরিচিত। এই ব্যাংকিং ডিপ্লোমা আসলে কী এবং কেন? ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই কয়েকজন ব্যাংকার এবং অন্য পেশাদাররা একটা সভা করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন যে বাংলাদেশে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি পেশাদার সংস্থা হিসেবে ইনস্টিটিউট অফ ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। ফলে ‘দি ইনস্টিটিউট অফ ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (আইবিবি) ১৯৭৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে ‘সমিতি নিবন্ধন আইন ১৮৬০’-এর অধীন একটি সমিতি হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছিল।

আরও দেখুন:
ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষায় পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

এর মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রাথমিকভাবে প্রশিক্ষণ, পরীক্ষা এবং পেশাদার উন্নয়ন কর্মসূচির একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পেশাদারভাবে যোগ্য ব্যাংকারদের বিকাশ করা; বিভিন্ন ব্যাংকিং সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের দক্ষতা পরীক্ষা করার জন্য পরীক্ষার আয়োজন এবং পরিচালনা করা। পরীক্ষায় সফল প্রার্থীদের সার্টিফিকেট, স্মারকলিপি এবং ডিপ্লোমা পুরস্কার প্রদান। প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত সহায়তা পরিষেবা যেমন কোচিং ক্লাসের আয়োজন, প্রশিক্ষণ প্রদান এবং পাঠ্য বই/ পড়ার উপকরণ সরবরাহ করা ইত্যাদি; জার্নাল, নিউজলেটার প্রকাশের মাধ্যমে এবং কথোপকথন, বক্তৃতা, সেমিনার ইত্যাদির আয়োজনের মাধ্যমে ব্যাংকিং এবং আর্থিক পরিষেবা সম্পর্কে জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া। পরীক্ষার্থীদের জন্য দক্ষ লাইব্রেরি সংগঠিত ও পরিচালনা করা। ‘আইবিবি’ ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষা পরিচালনা করে। JAIBB (জুনিয়র অ্যাসোসিয়েট অফ দ্য ইনস্টিটিউট অফ ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ) এবং DAIBB (ডিপ্লোমাড অ্যাসোসিয়েট অফ দ্য ইনস্টিটিউট অফ ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ) পরীক্ষা সাধারণত বছরে দুবার অনুষ্ঠিত হয়।

তবে এই পরীক্ষা নিয়ে আছে নানান অভিযোগ, খোদ রাজধানীসহ জেলা শহরে এই পরীক্ষাগুলোতে একটা সময় বই দেখে লিখে পাস করার প্রবণতা অনেক বেশি ছিল। হালে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকিতে সেটা এখন অনেকাংশে কমেছে। ফলে এই পরীক্ষার মান নিয়ে একটা প্রশ্ন এখনো রয়ে গেছে। আছে পদ্ধতি নিয়েও, অনেকেই অর্থনীতিতে অনার্সসহ মাস্টার্স করে তিন থেকে চার বার পরীক্ষা দিয়েও পাস করতে পারছে না অর্থনীতিতে, আবার কেউ কেউ অ্যাকাউন্টিংয়ের ছাত্র হয়েও সেটাই পাস করতে পারছে না। অনেকেই চার বা পাঁচ বছর ধরে পার্ট-১ শেষ করেছেন, অনেকেই পার্ট-২ পাস করতে করতে ডিজিএম বা জিএম হয়েছেন। এর বিপরীত চিত্রও আছে। অনেকেই একবারে পাস করেছেন। বছরে দুইবার রেজিস্ট্রেশন করতে হয় এই পরীক্ষার জন্য, এর জন্য প্রতিবার ১৫০০ টাকা ফি জমা দিতে হয়। এই ডিপ্লোমা কোর্স ১৯৭৩ সালে যখন চালু করা হয়, তখন সাধারণ ডিগ্রি বা এইচএসসি পাস করেও ব্যাংকে কাজ করা যেত। তখনকার জন্য এই ডিপ্লোমা কোর্স অনেক অর্থবহ ছিল। কারণ তখন সদ্য স্বাধীন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাংকিং নিয়ে আলাদা কোনো ডিগ্রির সুযোগ ছিল না।

কিন্তু বর্তমানে ব্যাংক সম্পর্কিত অনেক উচ্চতর ডিগ্রি প্রদানের ফলে অনেকেই ব্যাংকে প্রবেশের আগেই ব্যাংক সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা নিয়ে চাকরি করছে। এই যুগে এই ডিপ্লোমার প্রয়োজনীয়তা আছে কি না তা নিয়ে কথা বলেছি ছয়টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের সঙ্গে। তন্মধ্যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশবিদ্যালয় এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিভাগের অনেক শিক্ষক মনে করেন, এই পরীক্ষার সিলেবাস ও পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন দরকার। আবার অনেকেই মনে করেন যদি ব্যাংকিং ডিপ্লোমার সিলেবাসের কোনো বিষয় যদি কেউ অনার্স বা মাস্টার্সে পড়ে আসে তবে সেক্ষেত্রে ঐ বিষয়গুলো বাদ দিয়ে বাকি বিষয়গুলো পরীক্ষার মাধ্যমে পাস করলেও যেন তাকে ডিপ্লোমা দেওয়া হয় এমন ব্যবস্থা থাকা উচিত। আবার কেউ কেউ বলেছেন, বাংলা, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, রসায়ন এই ধরনের বিষয়ের ডিগ্রিধারীদের অর্থাৎ ফিন্যান্স বা অর্থনীতি বা বিজনেস-এর কোনো বিষয়ে ডিগ্রি নেই এমন ব্যক্তিদের জন্য এই ডিপ্লোমা পাস করাটা বাঞ্ছনীয়।

দেশের সরকারি ব্যাংকের পদোন্নতির প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, এই ডিপ্লোমার জন্য ৬ নম্বর বরাদ্দ আছে, (বাংলাদেশ ব্যাংকসহ) ফলে যারা নকল করে পাস করেছেন তারা এই নম্বর পেয়ে পদোন্নতিতে অনেক এগিয়ে থাকেন। তবে এই কোর্সের গুরুত্ব বোঝাতে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে এই কোর্সে নম্বর প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১৩ অক্টোবর ২০২০ সালে তাদের বিআরপিডি সার্কুলার নং-১৮তে বলেছে যে, ‘ব্যাংকে কর্মরত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নীতিমালায় ব্যাংকিং ডিপ্লোমা, (১ম ও ২য় পর্ব) অফিসার ও সমমানের পদ থেকে মহাব্যবস্থাপক ও সমমানের (প্রধান নির্বাহীর অব্যবহিত নিচের এক স্তর ছাড়া অন্য সব কর্মকর্তা, যে নামেই অভিহিত হোক না কেন) পদ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত মোট নম্বরের মধ্যে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা, ১ম পর্ব ও ব্যাংকিং ডিপ্লোমা, ২য় পর্ব পরীক্ষার জন্য একটি নির্দিষ্ট নম্বর বরাদ্দ রাখতে হবে।

ব্যাংকিং ডিপ্লোমা, ২য় পর্ব পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত নম্বর কোনোভাবেই ১ম পর্ব-এর জন্য নির্ধারিত নম্বরের চেয়ে কম হতে পারবে না। অর্থাৎ এখানে ইচ্ছে করলে কম নম্বর নির্ধারণ করার সুযোগ ছিল। আবার সেই সার্কুলারে বলা আছে কারও নিয়োগ যদি টেকনিক্যাল পদ (আইটি কর্মকর্তা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইন কর্মকর্তা ইত্যাদি) এবং ক্যাশ হয়ে থাকে তবে সেক্ষেত্রে এই শর্ত শিথিল করা যাবে। উল্লেখ্য, এ সংক্রান্ত নীতিমালা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ৪৫ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ ব্যাংক এ নির্দেশনা জারি করেছে। ফলে সময় এসেছে এই ডিপ্লোমা পরীক্ষার নম্বর বণ্টন নিয়ে নতুন করে ভাববার।

সুতরাং, ব্যাংকিং ডিপ্লোমার ১ম এবং ২য় পর্ব-এর জন্য বরাদ্দ ৬ নম্বর কমিয়ে কম্পিউটার বা একটা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে বেশি নম্বর দিলে ভালো হবে বলে আমার ধারণা। কেননা ব্যাংকিং খাতে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি অনায়াসে বলতে পারি যে আমাদের এই দুই ক্ষেত্রে বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকে দুর্বলতা আছে। আবার ব্যাংকিং ডিপ্লোমার পাশাপাশি অন্যান্য কোর্সে নম্বর দেওয়া যেতে পারে যেমন ‘সিডিসিএস’, ‘সিএফএ’ ইত্যাদি। যেহেতু সব ব্যাংকের নিজস্ব ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এবং রিচার্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগ আছে যেহেতু ডক্টরেটধারীদেরও পদোন্নতির ক্ষেত্রে একটা নম্বর দেওয়া যেতে পারে। ব্যাংকের বোর্ডের কোম্পানি সেক্রেটারি হওয়ার জন্য এক ধরনের সার্টিফিকেট অর্জন করতে হয়। সে সনদকেও ডিপ্লোমার পাশাপাশি নম্বর দিয়ে উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে।

পরিশেষে বলা যায় যে, ব্যাংকিং ডিপ্লোমার জন্য নতুন করে চিন্তা ভাবনার সুযোগ এখনো আছে। এতে করে বারবার পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত কর্মকর্তারা পরীক্ষা আতঙ্কে না ভুগে তাদের কাজে মনোনিবেশ করতে পারবে। বছরে দুইবার করে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য সময়, অর্থ ব্যয় করতে হবে না। ব্যাংকিং ডিপ্লোমা হোক যুগোপযোগী চিন্তাধারার, হোক এটা নিয়ে আলোচনা।

লেখকঃ ড. লিপন মুস্তাফিজ, ব্যাংকার ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button