বড় হচ্ছে ইসলামি ব্যাংকিং, ঝুঁকছে অন্যরাও
দেশে ক্রমে বাড়ছে ইসলামি অর্থব্যবস্থা। এরই মাঝে বেশ কয়েকটি ব্যাংক সুদের হিসাব-নিকাশ ছেড়ে আগাগোড়া ইসলামি ব্যবস্থা চালু করেছে। এতে সামগ্রিকভাবে দেশে ইসলামি অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, অর্থনীতিতে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের অবদান বাড়ছে। সরকারও এ অর্থব্যবস্থায় সায় দিচ্ছে। এরই মধ্যে দেশে প্রথমবারের মতো শরিয়াহভিত্তিক সুকুক বন্ড চালু করেছে সরকার। এই বন্ডে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছে ইসলামি ধারার ব্যাংকের পাশাপাশি কনভেনশনাল (প্রচলিত) ব্যাংকগুলোও। এরই মধ্যে এ বন্ড ছেড়ে চার হাজার কোটি টাকা তুলেছে সরকার। সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক এ বন্ড বিক্রি করছে।
প্রসঙ্গত, দেশের প্রথম শরিয়াহ বন্ড সুকুকের নিলাম গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হয়। নিলামে ৩৯টি আবেদন জমা পড়ে। আনুপাতিক হারে সবাই বন্ড পায়। ৪ হাজার কোটি টাকার বন্ডের জন্য আবেদন পড়ে ১৫ হাজার ১৫৩ কোটি ১০ লাখ টাকার। এর মধ্যে কনভেনশনাল ব্যাংকগুলো সুকুক বন্ডের ৬৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ ইউনিট কিনে নিয়েছে। অর্থাৎ প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো শরিয়াহভিত্তিক এই বন্ডে বিনিয়োগ করেছে ৩ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। ১ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ইসলামি ধারায় পরিচালিত ব্যাংক ও কনভেনশনাল ব্যাংকের ইসলামি ব্যাংকিং ইউনিটগুলো।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, মানুষ এখন শরিয়াহভিত্তিক অর্থব্যবস্থার দিকে বেশি ঝুঁকছে। কনভেনশনাল কয়েকটি ব্যাংকও ইসলামি ধারায় ফিরছে। এ কারণেই মূলত সুকুক বন্ড চালু করেছে সরকার।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, এই বন্ড পেতে সোনালী ব্যাংক দুই হাজার কোটি টাকার আবেদন করে। কিন্তু পেয়েছে ৫২৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকার। ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) ও রূপালী ব্যাংক দেড় হাজার কোটি টাকা করে, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ও ব্যাংক এশিয়া ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা করে, অগ্রণী ব্যাংক ১ হাজার কোটি টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ৭০০ কোটি টাকা, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ৬৫০ কোটি টাকা, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ৬০০ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ও জনতা ব্যাংক ৫০০ কোটি টাকার আবেদন করে। এর বাইরে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৩৫০ কোটি, এক্সিম ব্যাংক ১০০ কোটি ও ইউনিয়ন ব্যাংক ১০০ কোটি টাকার আবেদন করে। প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো তাদের ইসলামি ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমেও আবেদন করে। এর বাইরে দুই ব্যাংকের দুজন গ্রাহক বিনিয়োগ করেছেন ২ কোটি ৬৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
এদিকে স্ট্যান্ডার্ড ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক নতুন বছরে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকিং সেবা চালু করছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৩১ ডিসেম্বর পৃথক দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, নতুন বছরের জানুয়ারি থেকে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংককে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ধারায় ব্যাংকে রূপান্তর করা হলো। আর এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে ‘গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড’ করা হলো। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ছিল প্রবাসীদের উদ্যোগে গঠিত একটি ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকটি এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে।
দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ১৯৯৯ সালের ৩ জুন কার্যক্রম শুরু করে। সারা দেশে ব্যাংকটির রয়েছে ১৩৮টি শাখা। গ্রাহক প্রায় ৭ লাখ। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ ছিল ১৫ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। গত বছরের শুরুতে পুরোপুরি ইসলামি ধারার ব্যাংকে রূপান্তরিত হওয়ার অনুমতি পায় এনআরবি গ্লোবাল ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।
এ ছাড়া কনভেনশনাল বা সাধারণ ব্যাংকিং করা যমুনা ব্যাংকও ইসলামি ব্যাংকিংয়ে রূপান্তর হওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি পেয়েছে। ব্যাংক তিনটি পুরোপুরি ইসলামি ধারার কার্যক্রম শুরু করলে দেশে ইসলামি ধারার ব্যাংকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১১টিতে। ইসলামি ব্যাংকিং চালু করতে ১০টির বেশি আবেদনপত্র বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রয়েছে। বাকি কনভেনশনাল ব্যাংকগুলোও ইসলামি ব্যাংকিংয়ের প্রতি গুরুত্ব বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানত ও বিনিয়োগের দিক থেকে এক চতুর্থাংশই ইসলামি ব্যাংকিংয়ে দখলে।
অনেকেই বলছেন, মুসলিম প্রধান দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের অনেক মানুষ সুদের সঙ্গে যুক্ত হতে চান না। ফলে আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রে ইসলামি ব্যাংকগুলোর টার্গেট দ্রুত পূরণ হয়। আবার এদের মাধ্যমে রেমিট্যান্সও আসে বেশি। তাই এদের দেখাদেখি এখন কনভেনশনাল ব্যাংকগুলোও তাদের ইসলামি ব্যাংকিং ইউনিটে জনশক্তি বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, সারাদেশে গত বছরের জুন পর্যন্ত সব ব্যাংকের মোট শাখা ছিল ১০ হাজার ৫৮৮টি। এর মধ্যে ইসলামি ব্যাংকিং শাখা এক হাজার ৪৪৮টি। দেশে যে রেমিট্যান্স আসে তার ২৭ শতাংশের বেশি আসে এসব ব্যাংকের মাধ্যমে। যেখানে কাজ করছেন ৩৬ হাজার ৫৮২ জন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, একদিকে গ্রাহকরা এখন ইসলামি ব্যাংকিং বেশি পছন্দ করছে। অন্যদিকে কনভেশনাল ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রতিযোগিতাও বেশি। যারা ওই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না তারা ইসলামি ব্যাংকের দিকে যাচ্ছে। আবার অনেক গ্রাহক সরকারি ব্যাংকেও ইসলামি ব্যাংকিং চান। সে কারণে আমরাও এদিকে মনযোগ দিচ্ছি। আমাদের ব্যাংকেরও ইসলামিক উইন্ডোতে সেবার মান বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিনি উল্লেখ করেন, প্রত্যেকটা ব্যাংক এখন ইসলামি উইন্ডোর দিকে মনযোগ দিচ্ছে। ইসলামি ব্যাংকের ব্যবসাও ভালো হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, কনভেনশনাল ব্যাংকে আমানতে সুদ নির্ধারিত। কিন্তু ইসলামি শাখা ও ইসলামি উইন্ডোরগুলোর সুদ নির্ধারিত নয়। প্রচলিত ব্যাংকগুলো নির্ধারিত সুদের চেয়ে বেশি লাভ দিতে পারে না, কিন্তু ইসলামি ব্যাংকগুলো চাইলে বেশি লাভ দিতে পারে।
দেশের এখন পর্যন্ত ৮টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংক হলো—ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, আল-আরাফাহ ইসলামি ব্যাংক লিমিটেড, ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামি ব্যাংক লিমিটেড, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড, শাহজালাল ইসলামি ব্যাংক লিমিটেড, এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট ব্যাংক অব বাংলাদেশ লিমিটেড (এক্সিম), সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংক লিমিটেড ও ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড। গত বছরের জুন পর্যন্ত দেশে পুরোদমে ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছে ৮টি ব্যাংক। এ ছাড়া ৯টি প্রচলিত ব্যাংকের ১৯টি শাখা এবং ১২টি প্রচলিত ব্যাংকের ১৫৫ উইন্ডোর মাধ্যমে ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম চলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, পূর্ণাঙ্গ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর চেয়েও ভালো ব্যবসা করছে কনভেনশনাল (প্রচলিত) ব্যাংকের ইসলামি উইন্ডো ও শাখাগুলো। এসব উইন্ডো ও শাখায় অন্য ব্যাংকের তুলনায় আমানত সংগ্রহের হার বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। কর্মকর্তাও বেড়েছে অন্য ব্যাংকের দ্বিগুণের চেয়ে বেশি।
গত বছরের জুন পর্যন্ত কনভেনশনাল ব্যাংকের ইসলামি উইন্ডোর সংখ্যা ছিল ১৫৫টি। আগের বছরের একই সময়ে এই ব্যাংকগুলোর উইন্ডোর সংখ্যা ছিল মাত্র ৪১টি। একইভাবে গত বছরের জুন পর্যন্ত কনভেনশনাল ব্যাংকের ইসলামি উইন্ডোগুলোতে কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিল ৪৭৩ জন। আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৯৯ জন।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গত বছরের জুন পর্যন্ত যেখানে ইসলামি ধারার ব্যাংকের ১৪ শতাংশ হারে আমানত বেড়েছে, সেখানে কনভেনশনাল ব্যাংকের ইসলামি শাখাগুলোতে আমানত বেড়েছে ২৬ দশমকি ১৭ শতাংশ। গত বছরের জুন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোতে আমানত বেড়েছে ১৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, ইসলামি ব্যাংকিং করছে এমন ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের পরিমাণ ২ লাখ ৯১ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। এক বছর আগে ছিল ২ লাখ ৫৩ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ইসলামি ব্যাংকিংয়ে আমানত বেড়েছে ১৫ শতাংশ। অবশ্য জুন পর্যন্ত দেশের পুরো ব্যাংক খাতে মোট আমানতের স্থিতি ছিল ১১ লাখ ৮০ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক (এপ্রিল-জুন) প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের জুন পর্যন্ত পুরো ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণ ছিল ১১ লাখ ৬৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে দুই লাখ ৭৫ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা।
যেসব কনভেনশনাল ব্যাংকের ইসলামি শাখা রয়েছে- সিটি ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, ব্যাংক আল-ফালাহ ও এইচএসবিসি।
এর বাইরে ইসলামি উইন্ডো রয়েছে এমন ব্যাংকগুলো হলো- সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, মিডল্যান্ড, এনআরবি গ্লোবাল, এনআরবিসি, মার্কেন্টাইল ব্যাংক।