ইসলামী ব্যাংকগুলো ঋণ দেয় না বরং পণ্য বিক্রি করে
কাউন্টারে টাকা উত্তোলন, টাকা জমা দেওয়া, রেমিট্যান্স নেওয়া, বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল জমা দেওয়া, একাউন্ট খোলাসহ বেশ কিছু সেবার ধরন দেখে অনেকেই প্রচলিত ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে গুলিয়ে ফেলেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব নিয়ম মেনে চললেও নীতি ও পরিচালন পদ্ধতিতে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে দুই ধারার ব্যাংকের। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণের নিয়ম একেবারেই আলাদা।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, ‘ঐতিহ্যগতভাবে ইসলামী ব্যাংক শরিয়াহ মেনে তার গ্রাহকদের কাছে পণ্য বিক্রি করে। গ্রাহক ব্যাংকে এলে তাকে সরাসরি টাকা দেওয়া হয় না। পণ্য কেনার জন্য ব্যাংক টাকা দেয় সরবরাহকারীকে। সেই পণ্য লাভে ব্যাংক বিক্রি করে গ্রাহকের কাছে। গ্রাহক সেই পণ্যের দাম কিস্তিতে পরিশোধ করেন।’
তিনি আরও জানান, ‘এই পদ্ধতি শুধু ইসলামী ব্যাংকিংয়ে নয়, পুরো অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাই মুরাবাহা তথা ক্রয়-বিক্রয় নামের এ পদ্ধতির কারণে বিনিয়োগ ভিন্ন খাতে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। কিন্তু প্রচলিত ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বা নগদ টাকা পেলে সেটা ভিন্ন খাতে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।’
যেভাবে পণ্য বিক্রি করে ইসলামী ব্যাংকগুলো
ইসলামী ব্যাংকিং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রচলিত ব্যাংকগুলোর মতো ইসলামী ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহ করে ঋণ বিতরণ করে না। একইভাবে সুদের হিসাবও করে না। মূলত ইসলামী ব্যাংকগুলো গ্রাহকের চাহিদানুযায়ী পণ্য বিক্রি করে। অর্থাৎ ইসলামী ব্যাংকগুলোকে দোকানের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী পরিচালিত এই দোকানগুলো পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে অর্থায়নকারীর কাজ করে। বাই মুরাবাহা পদ্ধতিতে ব্যাংক পণ্য ক্রয় করে গ্রাহকের কাছে তা বিক্রি করে। এখানে ব্যাংক প্রথমে হয় ক্রেতা, পরে হয় বিক্রেতা। কাজটি আবার তিন স্তরে সম্পন্ন হয়।
এক— গ্রাহক ব্যাংকের কাছে নির্ধারিত পণ্য ক্রয়ের জন্য আসে এবং এ বিষয়ে ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করে।
দুই— ব্যাংক গ্রাহকের জন্য নিজে পণ্য ক্রয় করে এবং পণ্যটাকে নিজের মালিকানায় এনে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে।
তিন— ব্যাংক পণ্যের ক্রয়মূল্যের সঙ্গে নিজের খরচ ও মুনাফা যোগ করে গ্রাহকের কাছে মোট বিক্রয়মূল্য ঘোষণা করে এবং পণ্য হস্তান্তর করে। এরপর গ্রাহক নির্দিষ্ট মেয়াদের ভেতর মূল্য পরিশোধ করে।
যেমন- ‘ধরুন কোনও গ্রাহক বাড়ি তৈরির প্রয়োজনে ১০ লাখ টাকার সিমেন্ট কিনবেন। এ জন্য তার ঋণের দরকার। ইসলামী ব্যাংক তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে তাকে ১০ লাখ টাকার সিমেন্ট কিনে দিতে পারে। এক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক যে কোনও সিমেন্ট কোম্পানি অথবা গ্রাহকের পছন্দের কোম্পানিকে ১০ লাখ টাকা দেবে। এরপর ব্যাংক সিমেন্ট কোম্পানির কাছ থেকে সিমেন্ট বুঝে নেবে এবং গ্রাহকের কাছে ১১ লাখ টাকার (আনুমানিক লাভসহ) বিনিময়ে নির্দিষ্ট মেয়াদে পরিশোধের শর্তসাপেক্ষে সিমেন্ট বিক্রি করবে। ওই গ্রাহক যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সিমেন্টের মূল্য ব্যাংককে পরিশোধ করতে না পারেন, তবুও কোনও অতিরিক্ত সুদ আরোপ করা হবে না। তবে ব্যাংক কারণ অনুসন্ধান করে ওই গ্রাহকের গাফিলতি পেলে জরিমানা আদায় বা আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবে। ওই অর্থ শরিয়াহর দৃষ্টিকোণ হতে সন্দেহজনক হওয়ায় এটি ব্যাংকের আয়ের হিসাবেও আসবে না। এ টাকা চলে যাবে জনকল্যাণমূলক তহবিলে।
সুদি ব্যাংক যা করে
একইভাবে সুদি ব্যাংকের মাধ্যমে কোনও গ্রাহক সিসি লোনের সাহায্যে ১০ লাখ টাকার সিমেন্ট কিনতে পারবেন। আবার ইচ্ছে করলে ১০ লাখ টাকায় বিদেশ ভ্রমণ করতেও পারেন। এমনকি অবৈধ কোনও কাজেও বিনিয়োগ করতে পারেন। ব্যাংক এক্ষেত্রে কিছু না বললেও গ্রাহক সময়মতো ঋণ পরিশোধ না করলেই সুদসহ জরিমানা বাড়তে থাকবে। তথা ব্যাংকের আয় বাড়তে থাকে।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে বিনিয়োগ নেওয়া একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, স্থানীয় দোকানদার, যেমন উৎপাদক অথবা পাইকারি ব্যবসায়ী বা কখনও আমদানিকারকদের কাছ থেকে পণ্য কিনে তারপর খুচরা বিক্রি করে ব্যাংকটি। এই কেনাবেচা করতে কোনও দোকানদারকে যেমন গ্রাহকের কাছ থেকে সুদ নিতে হয় না, একইভাবে ইসলামী ব্যাংকেরও তার গ্রাহকের কাছ থেকে সুদ নিতে হয় না। এই ক্রয়-বিক্রয়ে শরিয়াহ নিয়ম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুসরণ করা হয়।
বাকিতেও পণ্য দেয় ইসলামী ব্যাংক
ক্রয়-বিক্রয়ের আরেক নাম বাই মুয়াজ্জল। বাই মুয়াজ্জল অনেকটা বাই মুরাবাহার মতোই। তবে পার্থক্য হলো এ পদ্ধতিতে ব্যাংক গ্রাহককে পণ্যের ক্রয়মূল্য জানায় না এবং গ্রাহক ব্যাংকের নির্ধারিত মূল্য বাকিতে পরিশোধ করে। বাই মুরাবাহা নগদে বা বাকিতে হতে পারে এবং এখানে গ্রাহক ব্যাংকের মুনাফা সম্পর্কে জ্ঞাত থাকে। কিন্তু বাই মুয়াজ্জল মানেই বাকি হতে হবে এবং ব্যাংকের মুনাফা কত হবে, তা গ্রাহক জানবেন না।
রফতানিতে অগ্রিম অর্ডার
ক্রয়-বিক্রয়ের আরেক নাম বাই সালাম তথা অগ্রিম ক্রয় পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ব্যাংক গ্রাহকের কাছে পণ্য ক্রয়ের জন্য অগ্রিম মূল্য দেয়। একজন কৃষককে ব্যাংক এক হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে বললো পাঁচ মাস পর দুই মণ আলু ব্যাংককে দিতে হবে। এক্ষেত্রে আলুর পরিমাণ ও গুণাগুণ স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে। এসব উল্লেখ না থাকলে বাই সালামের মাধ্যমে লেনদেন বৈধ হবে না।
পণ্য রফতানিতে ইসলামী ব্যাংকগুলো বাই সালাম অনুসরণ করে। যেমন, কোনও গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক ৫০ লাখ টাকার মোট ১০ হাজার পিস টি-শার্ট আগামী তিন মাসের মধ্যে রফতানির অর্ডার নিলো। এখন ব্যাংক ওই গার্মেন্টস কারখানাকে ওই অর্ডারের জন্য অগ্রিম ৪৯ লাখ টাকা পরিশোধ করে বললো পণ্য তিন মাসের মধ্যে সরবরাহ করতে হবে। অর্থাৎ এখানে ব্যাংক অগ্রিম ৪৯ লাখ টাকার টি-শার্ট কিনে এক লাখ টাকা মুনাফা করলো।
বাই ইসতিসনা (অর্ডারের ভিত্তিতে ক্রয়)
বাই ইসতিসনা মানে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কোনও জিনিস নির্মাণ বা উৎপাদন করে দেওয়ার জন্য কোনও দক্ষ ও অভিজ্ঞ শ্রমিকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া। অর্থাৎ ভবিষ্যতে নির্ধারিত কোনও সময়ে বা কিস্তিতে সম্মত মূল্য পরিশোধের শর্তে ক্রেতার আদেশে নির্দিষ্ট পণ্য তৈরি করে বিক্রি করাকে বাই ইসতিসনা বলে। এই লেনদেনে পণ্য অস্তিত্ব লাভ করার আগেই বিক্রি করা হয়। এক্ষেত্রে পণ্যের দাম অগ্রিম/এককালীন/কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য।
উৎপাদন ব্যয় নির্বাহের জন্য পণ্যের মূল্য অগ্রিম পরিশোধ করা যায়। উৎপাদন শুরু হলে চুক্তি বাতিল করা যায় না। পণ্য কোথায়, কীভাবে, কার খরচে সরবরাহ হবে, তা চুক্তিতে উল্লেখ থাকতে হবে। কোনও পক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করলে দায়ী পক্ষের ওপর নির্দিষ্ট জরিমানা আরোপ করা যাবে— এমন শর্ত চুক্তিতে রাখা যায়।
আবাসিক ভবন নির্মাণে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাই ইসতিসনা প্রচলিত পদ্ধতি। যদি কোনও গ্রাহক একখণ্ড জমির মালিক হন এবং বাড়ি নির্মাণে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন, তাহলে ব্যাংক বা বিনিয়োগদাতা ইসতিসনার ভিত্তিতে বিনিয়োগ করতে পারে।
হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিল্ক
এ পদ্ধতিতে ব্যাংক ও বিনিয়োগ নেওয়া গ্রাহক উভয়ই যৌথভাবে সম্পদের মালিকানা অর্জন করে। এরপর ব্যাংকের অংশ গ্রাহককে ভাড়া দেওয়া হয় এবং একইসঙ্গে গ্রাহক ব্যাংকের অংশ কিস্তিতে ক্রয় করবে।
গ্রাহক ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকের মালিকানা কমতে থাকে এবং গ্রাহকের মালিকানা বাড়তে থাকে। ফলে ভাড়ার পরিমাণও কমতে থাকে। একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের পর গ্রাহক সম্পূর্ণ সম্পদের মালিক হয়।
আরও দেখুন:
◾ ইসলামী ব্যাংকগুলো কি ঘুরিয়ে সুদ খায়?
যেমন, একটি নির্মাণাধীন ফ্ল্যাটের জন্য গ্রাহক ৪০ লাখ টাকা এবং ইসলামী ব্যাংক ৬০ লাখ টাকা ব্যয় করলো। তাহলে ব্যাংক ওই বাড়ির ৬০ শতাংশের মালিক। এখন ব্যাংক তার অংশের জন্য মাসিক ভাড়া নির্ধারণ করলো ১০ হাজার টাকা। গ্রাহক ৬০ লাখ টাকা পরিশোধ করলে বাড়ির পুরো মালিকানা পাবেন।