ব্যাংক কী কোনো চ্যারিটি?
আমরা তাত্বিকভাবে যতটুকু জানি, ব্যাংক পরের ধনে পোদ্দারী করা একটি মুনাফাভোগী প্রতিষ্ঠান। এখানে পরের ধন বলতে আমানতকারীদের আমানতকে বুঝায়। অর্থাৎ ব্যাংক তার আমানতকারীদের টাকাকে খাটিয়ে কিছু মুনাফা অর্জন করে, যার একটা অংশ আমানতকারীদের দিয়ে বাকী অংশ নিজেরা রাখে। এই অংশটুকুর জন্যই যুগযুগ ধরে ব্যাংকিং নামক এত বড় কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করে ব্যাংকগুলো। অর্থাৎ এটা-ই তাদের ব্যবসা।
তাহলে আমরা স্বাভাবিকভাবেই বলতে পারি ব্যাংকের যে পুঁজি তা মুলত জনগনের টাকা। এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নির্দেশে বা খামখেয়ালীপনায় যদি ব্যাংকিং ব্যবসা ক্ষতির সম্মুখিন হয় তা এ ব্যবসায়ের পুঁজির প্রকৃত মালিক আমানতকারীদেরই ক্ষতির মুখোমুখি হওয়া বই অন্য কিছু নয়।
অন্য আর দশটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মত ব্যাংকও যদি একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হয়েই থাকে, তবে অন্যদের ব্যবসায়ের সুবিধার জন্য ব্যাংকের পুঁজি এবং মুনাফাকে কেন ঝুঁকির মুখে ফেলবেন? হ্যাঁ, একথা সত্য যে- কেউ যদি বেশি মুনাফা করে তবে তার লাগাম টেনে ধরতে হবে। কারন বেশি মুনাফার সাথে অন্যকে শোষন করার বিষয়টি জড়িত থাকে। সেক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রনকারী প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই কিছু নীতি প্রনয়ণ করে তার লাগাম টেনে ধরা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাই বলে এমন সব নীতি প্রনয়ণ করা কী ঠিক যাতে করে ব্যাংক তথা ছোট ছোট আমানতকারীদের পুঁজি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে?
ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠক, ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন। |
এই যে, নানা সময়ে ঋণখেলাপীদের বিভিন্ন সুবিধা দেয়া, ঋণ-আমানতের সুদ কমানো, কখনো কখনো ঋণের সুদ মাফ করে দেয়া, ব্যাংক থেকে সরকারের অনিয়ন্ত্রিত ঋণ গ্রহন, বিভিন্ন ব্যাংকিং সেবার চার্জ কমানো, ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনে আইনের তোয়াক্কা না করা বা কারো কারো সুবিধামত আইন পরিবর্তন করা এবং ব্যাংকিং খাতে অনেক বড় ধরনের জালিয়াতির পরও শাস্তি না হওয়া। এসবতো ব্যাংকিং ব্যবসাটাকে ধীরে ধীরে খাদের কিনারে নিয়ে যাচ্ছে। এখনি যদি আমরা সচেতন না হই বা দায়িত্বশীল আচরন না করি তবে এ ব্যবসায়ের ধ্বংস অনিবার্য।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
আমাদের দায়িত্বশীলদের একথা স্মরন রাখতে হবে- অর্থনীতির রক্ত সঞ্চালন কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোই করে থাকে। তাই অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে অন্য আরো খাতের মত এই খাতকেও গুরুত্ব দিতে হবে। যেহেতু এর সাথে অর্থনীতির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক সেহেতু এই খাত অন্যদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়ার দাবিদার।
ব্যাংকের অন্য একটি গুরুত্বপুর্ণ দিক হল-কর্মসংস্থান। বর্তমানে এই ইন্ডাস্ট্রিতে প্রচুর লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতেও ব্যাংকের পরোক্ষ অবদান রয়েছে। দেশের হাজার হাজার পরিবার প্রত্যক্ষভাবে এ ইন্ডাস্ট্রির দান-পানি খেয়ে বেঁচে আছে। সুতরাং এ দিকটাও খেয়াল রাখা উচিত যে, আমাদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের যেকোন লাগামছাড়া কথাবার্তা বা সিদ্ধান্তের কারনে যদি ব্যাংকগুলো ক্ষতির মুখে পড়ে তাহলে অনেকেই চাকরি হারাবে। যেটা অবশ্য অর্থনীতির জন্য সুখকর হবে না।
আমাদের দেশে অনেক সেক্টর আছে যেখানে সরকার মাঝে মাঝেই ভুর্তুকি অথবা পণোদনা দিয়ে সেই সেক্টরকে টিকিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু ব্যাংকিং (প্রাইভেট) ই এমন একটা সেক্টর যারা নিজেদের আয় দিয়ে ব্যয় নির্বাহ করার সক্ষমতা বহন করে। ব্যাংকের এই সফলতা নষ্ট করার জন্য সংশ্লীষ্ট নিয়ন্ত্রকদের সাম্প্রতিক নির্দেশনাগুলোই যথেষ্ট।
এই যে নানা সময়ে ঋণ খেলাপীদের বিভিন্ন অযোক্তিক সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এতে তারা আরও উৎসাহিত হয়ে নতুন নতুন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য আবদার করছে। এতে করে ভালো ঋণ গ্রহীতারাও ঋণের টাকা পরিশোধে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। এসব কী ব্যাংক ব্যবসাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে না? ব্যাংকিং যেহেতু প্রকারান্তরে একটা ব্যবসা তাদের এ ব্যবসাকে কেন ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হচ্ছে? আমাদের মনে রাখতে হবে এ ব্যবসায়ের পুঁজি কিন্তু সাধারন আমানতকারীদের। যারা এদেশেরই সাধারণ মানুষ।
গত কিছু দিন আগে নয়-ছয়, নয়-ছয় করে ঋণ এবং আমানতের সুদ কমানো হল। ৯% ঋণ সুদহার কার্যকর করতে গিয়ে অধিকাংশ ব্যাংকের আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তার উপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী ২ মাসের সুদ স্থগিত করলে ব্যাংকগুলোর অবস্থা কী হবে সেটা বলা বাহুল্য।
করোনার প্রকোপ থেকে অন্য ব্যবসাকে রক্ষা করার জন্য ঋণের সুদ স্থগিতের সিদ্ধান্তটি বাস্তবমুখি কি না তা দেখতে হলে আমাদেরকে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কারন অন্যদের ব্যবসাকে টিকাতে গিয়ে ব্যাংক তার আস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। এক্ষেত্রে ব্যাংক যদি নিজেকে টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয় তবে তা অর্থনীতির জন্য হবে ভয়াবহ।
ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতারা সব সময় সুযোগের সন্ধানে থাকে। যেমনঃ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যখন ঋণের সুদ স্থগিতের নির্দেশনা দেয়া হল। তারা নিজে থেকে বুঝে নিল- ঋণের সুদ মাফ করে দেয়া হয়েছে। এবং এ নিয়ে তারা প্রতিনিয়ত তাদের কর্তিত সুদের টাকা যা নির্দেশনাটি দেয়ার আগেই কর্তন করা হয়েছিল, তা ফেরত দেয়ার জন্য ব্যাংকের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। মুলত কিছু মিডিয়াতে ভুল নিউজ প্রচারের কারনে ব্যাংককে মাঝে মাঝেই এধরনের অস্বস্তিতে পড়তে হয়।
আমরা জানি ব্যাংকের বাজার হচ্ছে সম্পূর্ন ইনফরমেশন সেনসিটিভ। এই ব্যবসাটা তথ্য প্রবাহের সাথে দোদুল্যমান। তাই এ সম্পর্কে যেকোন তথ্য প্রচার করার আগে আমাদের মিডিয়াগুলোকেও আরো সচেতন হওয়া উচিত। অনেক সময় টিভি স্ক্রলে ও প্রিন্ট মিডিয়ার হেডলাইনে যখন কয়েকটি শব্দ বা একটি বাক্যের মাধ্যমে তথ্যটি উপস্থাপন করা হয় তখন মানুষের কাছে ভুল নিউজটা-ই যায়। কারন এদেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো কোন একটি সংবাদ বিস্তারিত জানার প্রয়োজন মনে করে না। এখানে অবশ্য মিডিয়ার দোষ নেই। তবে তারা একটু সচেতনভাবে যদি পজেটিভ তথ্যগুলো দিয়ে হেডলাইন বা স্ক্রলটা করে সেটা সবার জন্য মঙ্গলজনক হয়।
আমাদের অর্থমন্তী মাঝে মাঝেই সরাসরি ব্যাংকরদের সুযোগ-সুবিধা কমানোর কথা বলে। আবার অন্যভাবেও বলে থাকে যে- ‘‘অপারেটিং কস্ট কমাতে হবে”। পাঠকের কাছে আমার একটি প্রশ্ন-‘‘ফলবতী গাছের পরিচর্চায় কখনো কী তার মালিক কৃপণতা প্রদর্শন করে?” পৃথিবীর সব মানুষই তার কর্মফলের সমান সুযোগ ভোগ করে। যে যার প্রতিষ্ঠানকে যতটুকু দিবে, সে ততটুকু পাবে। নিশ্চয়ই ব্যাংকাররাও তার প্রতিষ্ঠানকে যতটুকু ফল দেয় তাতটুকুই মালিকপক্ষ তাদেরকে দেয়। এরচেয়ে বেশি নয়।
আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রনালয়ের গত কয়েক বছরের সিদ্ধান্তগুলোর বেশিরভাগই ব্যাংকিং খাতকে ধ্বংস করার জন্য অগ্রনী ভুমিকা রেখে আসছে। এটা আমার নয়, দেশের প্রখ্যাত সব অর্থনীতিবিদদের মতামত। যা আমরা বিভিন্ন সময়ে মিডিয়ার ভুমিকায় জানতে সক্ষম হই। এ প্রেক্ষাপটেও সরকারই আবার সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে বেশি ঋণ গ্রহন করেছে ব্যাংক থেকে। সবকিছু দেখে আমার মনে প্রশ্ন জাগে-তাহলে কী ব্যাংক একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান? তাদের কাজ হল সাধারন মানুষ থেকে টাকা নিয়ে একটা সার্থবাদী ক্ষুদ্র গোষ্ঠিকে দান করা। পূর্বে উল্লেখিত- নানা সময়ে দান দক্ষিণার মত বিভিন্ন জনকে ঋণ বা সুদ বা চার্জ মাফ করে দেয়ার যে খড়গ ব্যাংকের উপর দিয়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা চালিয়ে আসছেন তা দেখেতো ব্যাংককে চ্যারিটি মনে হওয়া আমার ভুল নয়।
যে যত কথাই বলি, সব কথার মুল হচ্ছে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যেই ব্যাংকের আত্মপ্রকাশ। সুতরাং অন্য ব্যবসার মত ব্যাংককেও বৈধ ব্যবসা করার সুযোগ দিতে হবে। তাহলে কী ব্যাংকের ব্যবসায়ের প্রতি আরেকটু পজেটিভ দৃষ্টি দেয়া উচিত নয়?
লেখক: কামাল মাহতাব, ব্যাংকার
ব্যাংক, ব্যাংকার ও ব্যাংকিং বিষয়ক চলমান খবর বা সমসাময়িক বিষয়ে আপনার লেখা ও মতামত দেশের একমাত্র ব্যাংকিং নিউজ পোর্টালে প্রকাশ করতে সরাসরি আমাদেরকে ই-মেইল করুন- bankingnewsbd@gmail.com আমরা আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে তা প্রকাশ করব। |