এসএমই ঋণ সম্প্রসারণে বাধাসমূহ
মোশারফ হোসেনঃ নানা আয় উৎসারী কর্মকাণ্ড ও উদ্যোগ নিয়েই এসএমই খাত। তাই এ খাতকে এমপ্লয়মেন্ট জেনারেটিং মেশিনও বলা হয়। ব্যাংকিং খাতকে যদি দেশের অর্থনীতির প্রাণ বলা যায়, তাহলে এসএমই খাত হবে অর্থনীতির প্রাণভোমরা। এসএমই খাত শক্তিশালী হওয়া মানে তা দেশের প্রবৃদ্ধিশীল অর্থনীতিরই পরিচায়ক। শরীরের জন্য যেমন অক্সিজেন, ঠিক তেমনি ব্যবসার জন্য পুঁজি। এসএমই খাতের এ পুঁজির জোগান কয়েকভাবেই হতে পারে— নিজস্ব তহবিল, ব্যক্তিপর্যায়ে ধার ও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণসহায়তা। ক্রেডিট ওরিয়েন্টেড (বাকিতে বিক্রয়) ব্যবসায়িক পদ্ধতি ও রীতির কারণে এবং ক্রেতা ধরে রাখার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার স্বার্থে সাধারণ একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকেও আজকাল লাখ লাখ টাকা বাকিতে বিক্রি করতে হয়।
পাশাপাশি ক্রেতাসাধারণের বাড়তি ও নিত্যনতুন চাহিদা পূরণ, বাজার সম্প্রসারণ, বাড়তি উৎপাদন খরচ মেটানো, অগ্রিম ডিও ক্রয় ইত্যাদি কারণে প্রয়োজন হয় বাড়তি পুঁজির। ফলে নিজস্ব পুঁজি দিয়েই যে ব্যবসার শুরু, তা একসময় আর সেই পুঁজিতে চলে না; দ্বারস্থ হতে হয় ব্যাংকঋণের। তাই এ খাতে ব্যাংকঋণের প্রবাহ যত অবাধ, খাতটির উন্নয়নও ততটাই গতিশীল। বাংলাদেশ ব্যাংক, এসএমই ফাউন্ডেশন ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এ খাতের উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক একে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং এসএমই ঋণ নীতিমালা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১০ সালে আলাদা এসএমই বিভাগ (বর্তমানে এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস বিভাগ) চালু করে। প্রধান কার্যালয় ও শাখা অফিসগুলোয় এসএমই মনিটরিং সেল গঠন করে। এরই ধারাবাহিকতায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এসএমই ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। এসএমই অর্থায়নসংক্রান্ত সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি মাস্টার সার্কুলার এসএমইএসপিডি সার্কুলার নং-১-এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে এ মর্মে নির্দেশনাও দিয়েছে যে, তাদের সার্বিক ঋণ ও অগ্রিমের কমপক্ষে ২০ শতাংশ দিতে হবে এসএমই খাতে এবং পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে এ হার অন্যূন ৩০ শতাংশে উন্নীত করতেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের ব্যক্তিগত গ্যারান্টিকে জামানত হিসেবে বিবেচনা করে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সহায়ক জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের নির্দেশনাও প্রদান করেছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যোগ্য উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা দেয়া হচ্ছে। প্রতিটি ব্যাংক শাখায় আলাদা ‘এসএমই ডেডিকেটেড ডেস্ক’ ও “উইমেনস এন্ট্রাপ্রেনিউর’স ডেডিকেটেড ডেস্ক/হেল্প ডেস্ক” স্থাপন, প্রধান কার্যালয়ে আলাদা ‘এসএমই বিভাগ’ চালু এবং ‘এসএমই ফোকাল পার্সন’ নির্ধারণ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে এ খাতে ঋণ বিতরণে উৎসাহী করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আরো বলা হয়েছে যে, এসএমই খাতে ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সফলতাকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নতুন শাখা খোলার ক্ষেত্রে অন্যতম ইতিবাচক মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
এসএমই খাতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট যৌথভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। অন্যদিকে এসএমই ফাউন্ডেশন প্রতি বছরই স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে এসএমই মেলার আয়োজন করছে। শ্রেষ্ঠ পুরুষ ও নারী এসএমই উদ্যোক্তাদের বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনটি ক্যাটাগরিতে ছয়টি জাতীয় পুরস্কার প্রদান করছে। এসএমই উদ্যোক্তা সৃষ্টি, উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য দেশব্যাপী এসএমই উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এসএমই খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ ও নজরদারির কারণে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে।
ব্যাংকগুলোও তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের প্রয়োজনে ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা পরিপালনে এ খাতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। ব্যাংকগুলো এসএমই উদ্যোক্তাদের আকর্ষণ করতে নানা ঋণ পণ্য বাজারজাত করছে, ক্ষেত্রবিশেষে যোগ্য ও সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তাদের রেয়াতি সুদে ঋণ প্রদান করছে। নিয়মিত গ্রাহক/এসএমই উদ্যোক্তা সমাবেশ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায় প্রকাশ্যে এসএমই উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদান করছে। ব্যবসায় বিশেষ সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের (এসএমই) সেরা উদ্যোক্তাকে ‘সৃজনশীল উদ্যোক্তা পুরস্কার’, ‘নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার’, ‘আস্থা পুরস্কার’ ইত্যাদি নামে পুরস্কার দিয়ে উৎসাহ প্রদান করছে। তথাপি গ্রাহক ও ব্যাংকপর্যায়ে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার জন্য এ খাতের ঋণ সম্প্রসারণ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না।
আরও দেখুন:
◾ ব্যাংক লোনের ১০টি বৈশিষ্ট্য
◾ এসএমই (SME) কী? এসএমই এর গুরুত্ব
◾ ঋণ বা লোন বা বিনিয়োগ ডকুমেন্টেশন
◾ ক্রেডিট রেটিং কি? ক্রেডিট রেটিং এর সুবিধা সমুহ
গ্রাহক পর্যায়ে
১. ব্যক্তি নামে ব্যবসা: অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী প্রাতিষ্ঠানিক নামে ব্যবসা না করে ব্যক্তি নামে ব্যবসা করেন। ফলে এসব ব্যবসায়ীর ব্যবসায়িক আয়-ব্যয় ও ব্যক্তিগত আয়-ব্যয় হিসাব করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এসব ব্যবসায়ীর কোনো ব্যবসায়িক ট্রেড লাইসেন্সও থাকে না।
২. নগদ লেনদেন (অপর্যাপ্ত ব্যাংক লেনদেন): অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরই ব্যাংক হিসাব থাকে না। আর থাকলেও ব্যবসার নামে হিসাব না থেকে ব্যক্তি নামে হিসাব থাকে। ফলে এসব ব্যক্তিক হিসাবের লেনদেন ব্যবসায়িক লেনদেন হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা হারায়। ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহারের পরিবর্তে নগদ লেনদেনেই তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাছাড়া নিজের ব্যাংক হিসাববহির্ভূত লেনদেনের রেকর্ড যেমন— সাপ্লায়ারদের হিসাবে অনলাইন জমার রশিদ, ক্রয়/বিক্রয় মেমো/রশিদ, চালান ইত্যাদি সংরক্ষণ করেন না। আবার যাদের ব্যাংক হিসাব আছে, তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন পর্যাপ্ত লেনদেন করেন না। ফলে আর্থিক বিবরণীতে উল্লেখ করা বার্ষিক বিক্রয়ের পরিমাণ ব্যাংক হিসাবের লেনদেনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং দুর্বল লেনদেনের কারণে আর্থিক বিবরণীতে উল্লেখ করা বার্ষিক বিক্রয়ের পরিমাণ ব্যাংকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারায়। গ্রাহকের হিসাব এক ব্যাংকে কিন্তু গ্রাহকের ব্যবসায়িক সাপ্লায়ারের হিসাব আরেক ব্যাংকে, অর্থাৎ আন্তঃব্যাংক লেনদেনের সুবিধা না থাকার কারণেও লেনদেন অপর্যাপ্ত হয়।
৩. হিসাব সংরক্ষণ না করা: ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা তাদের দৈনিক ক্রয়/বিক্রয় বহি, দেনাদার ও পাওনাদারের তালিকা, মজুদ পণ্যের তালিকা ইত্যাদি সংরক্ষণ করেন না। ব্যবসার আয় থেকেই হিসাব ছাড়া পারিবারিক ব্যয় নির্বাহ করেন। ফলে বার্ষিক লাভ-ক্ষতির বিষয়েও নিশ্চিত হতে পারেন না। এ কারণে ব্যাংকারের পক্ষে চোখের দেখায় ও গ্রাহকের কথায় বিশ্বাস করে ব্যবসার সঠিক চিত্র নির্ণয় করা দুরূহ হয়ে পড়ে।
৪. একই ব্যবসার একাধিক/বিভিন্ন নাম: কিছু অসচেতন ব্যবসায়ী ব্যাংকে হিসাব সংরক্ষণ করেন এক নামে আর সাপ্লায়ারের সঙ্গে লেনদেন করেন ভিন্ন নামে। যেমন— মত্স্য খাদ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স খায়রুল ফিশ ফিড’-কে ঋণ দিতে গিয়ে দেখা যায়, তার সাপ্লায়ারের সঙ্গে সব লেনদেন হচ্ছে ‘মেসার্স খায়রুল পোলট্রি’ নামে। জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘আগে আমার পোলট্রি ফিডের ব্যবসা ছিল, পরে ব্যবসা পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু কোম্পানির (সাপ্লায়ার প্রতিষ্ঠান, যে পোলট্রি ফিড ও ফিশ ফিড দুটো পণ্যই উৎপাদন করে) সঙ্গে আগের নামেই ব্যবসা করছি।’ আরেক ব্যবসায়ীকে ঋণ দেয়া হয়েছে ‘মেসার্স রহিম এন্টারপ্রাইজ’ নামে। দোকানে এ নামে সাইনবোর্ডও ছিল কিন্তু ঋণ নেয়ার কয়েক মাস পরেই দোকানের নাম ও সাইনবোর্ড বদলে হয়ে গেল ‘মেসার্স রহিম এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড ইলেকট্রনিক’!
৫. ঋণগ্রহীতাদের শিক্ষা ও ব্যাংকিং জ্ঞানের অভাব: কিস্তিভিত্তিক টার্ম লোনের ক্ষেত্রে কিস্তি পরিশোধের শর্তে বলা থাকে মাসের প্রথম ১০ তারিখের মধ্যে কিস্তি পরিশোধ করতে। কারণ ব্যাংক রিডিউসিং মেথড পদ্ধতিতে সুদ আদায় করে। আর তাই ঋণ চুক্তিতে বলা হয় যে, শেষ কিস্তি পরিশোধের পরও যদি কোনো ঋণ স্থিতি অবশিষ্ট থাকে, তাহলে তা শেষ কিস্তির সঙ্গেই একসঙ্গে পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু অনেকে যারা মাসের শেষ দিন অর্থাৎ ৩০ বা ৩১ তারিখে কিস্তি পরিশোধ করেন, তার মোট পরিশোধিত টাকা মাসের ১ তারিখে কিস্তি পরিশোধ করা গ্রাহকের চেয়ে একটু বেশিই হবে। ফলে বিলম্বে কিস্তি পরিশোধ করা গ্রাহকের শেষ কিস্তিটা নিয়মিত কিস্তির চেয়ে কিছুটা বেশি হয়, যা বোঝাতে গিয়ে ব্যাংকারকে ঘাম ঝরাতে হয়। আবার কেউ কেউ ঋণ নেয়ার আগে যথাসময়ে কিস্তি পরিশোধ করার অঙ্গীকার করেও ব্যাংক নির্ধারিত সময়ে কিস্তি পরিশোধ করেন না এবং এক মাসের কিস্তি আরেক মাসে পরিশোধ করেন। ফলে এসব ঋণগ্রহীতা পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে দ্বিতীয় কোনো ঋণ সুবিধা পান না।
৬. অসন্তোষজনক স্টক: চলতি ঋণ দেয়ার সময় ব্যাংকগুলো এ মর্মে শর্তারোপ করে যে, ঋণগ্রহীতাকে ৫০ শতাংশ মার্জিন (কমবেশি হতে পারে) নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ ব্যবসার মোট ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের (চলতি মূলধন) অর্ধেক দেবে ব্যাংক আর বাকি অর্ধেক (৫০%) দেবেন ঋণগ্রহীতা নিজে। ১ কোটি টাকা ঋণ নেয়া ব্যবসার চলতি ঋণ নবায়ন করতে গিয়ে দেখা যায়, দোকান ও গুদাম মিলে ৩০ লাখ টাকারও স্টক নেই। বাকিতে বিক্রয় (দেনাদার) হিসেবে পাওয়া গেল ২৫ লাখ। ধরে নিলাম এ স্টক ও বাকিতে বিক্রয়ের সবটাই ব্যাংকঋণের টাকায়, তাহলে ব্যাংকের বাকি ৪৫ লাখ টাকা গেল কই? ঋণগ্রহীতার নিজের অংশীদারিত্বের বাকি ১ কোটি টাকাইবা কই? কেউ আবার একেক সিজনে একেক পণ্যের ব্যবসা করেন। ঋণ দেয়া হয়েছে পেঁয়াজ ব্যবসার জন্য কিন্তু ঋণ নবায়নের সময় স্টক ভিজিট করতে গিয়ে পাওয়া গেল পাটের স্টক! অনেকে আবার সাপ্লায়ারের কাছ থেকে পণ্য কিনে নিয়ে এসে স্টক গুদামজাত না করে সরাসরি তার রিটেইলার বা কাস্টমারদের দোকানে পৌঁছে দেন। ফলে ব্যাংকের চাহিদামতো স্টক দেখাতে ব্যর্থ হন।
৭. অভিজ্ঞতার অভাব: ব্যাংকগুলো সাধারণত কোনো ব্যবসা শুরু করার জন্য ঋণ দেয় না। দু-তিন বছরের আর্থিক ইতিহাস থাকলেই কেবল ব্যাংক একটি ব্যবসাকে ঋণ দেয়ার জন্য বিবেচনায় নেয়। কিন্তু অভিজ্ঞতা প্রমাণের সপক্ষে দু-তিন বছরের ট্রেড লাইসেন্স অনেকেই দেখাতে পারেন না। ফলে ঋণ সুবিধাও পান না।
৮. অসঙ্গত অ্যাকাউন্টিং প্র্যাকটিস: আয়কর ফাঁকি দেয়ার জন্য অনেক ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসার অডিটেড লাভ-ক্ষতি বিবরণীতে ও ব্যালান্স শিটে কিংবা আয়কর রিটার্নে আয় ও সম্পদের পরিমাণ সত্যিকারের চেয়ে কম প্রদর্শন করেন। ফলে ঋণ নিতে গিয়ে তারা ব্যাংকারের কাছে তাদের যে আয় ও সম্পদের হিসাব দেন, তাদের অডিটেড আর্থিক বিবরণী/আয়কর রিটার্নের সঙ্গে তা মেলে না। ফলে অসঙ্গত অথবা অপর্যাপ্ত আয় ও সম্পদের কারণে কাঙ্ক্ষিত ঋণ সুবিধাটি প্রদান করা ব্যাংকারের জন্য দুরূহ হয়ে পড়ে। যেমন— ২ কোটি টাকা ঋণের জন্য আবেদন করা প্রতিষ্ঠিত এক ব্যবসায়ীর আয়কর প্রত্যয়নপত্রে বার্ষিক করযোগ্য আয় দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং নিট সম্পদ দেখানো হয়েছে ৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা!
৯. ঋণের নিয়মাচারে অনীহা: রডের কারবারি এক সিসি (হাইপো) ঋণগ্রহীতা নতুন একটি ময়দার মিল করবেন। তাই তিনি ময়দা মিলের মেশিনারি ক্রয় করতে বর্তমান রড ব্যবসার জন্য অনুমোদিত সিসি ঋণের সীমা বাড়িয়ে দিতে বললেন। ব্যাংকার বললেন, ‘ময়দার মিল করার জন্য টার্ম লোন নিতে হবে এবং রডের লোনের টাকা ময়দা মিলে ব্যবহার করা যাবে না। তাছাড়া সিকিউরিটি কভারেজ বাড়াতে হবে। আরো সিকিউরিটি দিতে হবে।’ কিন্তু গ্রাহকের দাবি, ‘বর্তমান সিকিউরিটি দিয়েই ঋণের সীমা বাড়িয়ে দিতে হবে। উপরন্তু, সুদের হারও কমিয়ে দিতে হবে নতুবা অন্য ব্যাংকে চলে যাব।’
১০. ব্র্যান্ডিংয়ের অভাব: ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বিশেষ করে কটেজ ও মাইক্রো খাতের ব্যবসায়ীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ট্রেড লাইসেন্স থাকলেও প্রতিষ্ঠানের নামের কোনো সাইনবোর্ড থাকে না। ফলে ঋণ অনুমোদনকারী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দোকান/ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ছবি পাঠালে তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কিনা— এ মর্মে সন্দেহ তৈরি হয়।
১১. ব্যাংকের চাহিদাকে ঝামেলা মনে করা: ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যই হলো, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ঋণ ও অর্থায়নের ব্যবস্থা করা। আমাদের দেশে একটি প্রচলিত ধ্যান-ধারণা বিদ্যমান রয়েছে যে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ঋণপ্রাপ্তিতে সহায়তার পরিবর্তে অহেতুক জটিলতার সৃষ্টি করে। উদ্যোক্তা হিসেবে শিল্প-কারখানা পরিচালনার জন্য যেমন নিয়মনীতি অনুসরণ করতে হয়, তেমনি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পদ্ধতিগতভাবে নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। ঋণ প্রদানের জন্য ব্যাংকারকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও তার ব্যাংকের সিআরএম, ক্রেডিট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েনস, আইন ও আদায় বিভাগের নিয়মনীতি ও সার্কুলার পরিপালন করেই একটি ঋণপ্রস্তাব করতে হয়। অনেক সময় উদ্যোক্তারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাস্তব জ্ঞান ও ব্যাংকের নিয়মকানুন সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে অহেতুক অসুবিধার সম্মুখীন হন।
১২. প্রস্তুতি ছাড়া ঋণের আবেদন করা কিন্তু দ্রুততম সময়ে ঋণপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা চাওয়া: অনেক গ্রাহক আছেন, যাদের ঋণ লাগবে কিন্তু তা তাত্ক্ষণিক। অর্থাৎ তারা ঋণ প্রক্রিয়াকরণ, মঞ্জুর ও অর্থ ছাড় করা পর্যন্ত স্বাভাবিক সময়টুকুও দিতে রাজি থাকেন না। উল্টো প্রস্তাব পাঠানোর আগেই কত টাকা দিতে পারবে, কতদিনের মধ্যে দিতে পারবে— এ মর্মে ব্যাংকারের কাছ থেকে অগ্রিম নিশ্চয়তা চান। কিন্তু ঋণপ্রস্তাব তৈরি করতে গিয়ে দেখা যায়, ট্রেড লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ, আয়কর সনদ হালনাগাদ করা হয়নি, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি, ঋণের বকেয়া সুদ (চলতি ঋণের ক্ষেত্রে) পরিশোধ করা হয়নি ইত্যাদি। ফলে গ্রাহকের প্রত্যাশিত সময়ে ঋণপ্রাপ্তি বিঘ্নিত হয়।
১৩. জামানতের অভাব: অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে, এসএমই ঋণ সম্প্রসারণের সবচেয়ে বড় যে প্রতিবন্ধক তা হলো, সহায়ক জামানতের অভাব। কারণ ব্যাংক বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা না পেলে বিনিয়োগ করবে না— এটা অত্যন্ত সহজ সমীকরণ। কারণ ব্যাংক নিজের টাকায় ব্যবসা করে না, করে আমানতকারীদের অর্থ দিয়ে। উদ্যোক্তার নিজের নামে জমিজমা কিংবা সম্পত্তি না থাকার কারণে তার নেটওয়ার্থ কম/দুর্বল হয়। অন্যদিকে ঋণের বিপরীতে উদ্যোক্তার নিজের মূল্যবান কিছু ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ না থাকলে নিজের উদ্যোগের প্রতি প্রত্যাশিত আগ্রহ থাকে না এবং ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে তাড়না কিছুটা হলেও কম পরিলক্ষিত হয়। বিনিয়োগের আগে এসব অনিশ্চয়তার কারণে এবং পর্যাপ্ত জামানত নিয়ে অগ্রিম প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারলে ব্যাংক এসব উদ্যোগে বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে।
১৪. ত্রুটিপূর্ণ কিংবা অসম্পূর্ণ সহায়ক জামানত: ত্রুটিপূর্ণ কিংবা অসম্পূর্ণ সহায়ক জামানত যেমন— বর্তমান মালিকের নামে খারিজা খতিয়ান না থাকা, পূর্ববর্তী মালিকদের নামের বায়া দলিল ও খতিয়ানগুলো না থাকার কারণে ঋণপ্রাপ্তি বিলম্বিত হয়। কারণ এসব দালিলিক গ্যাপের কারণে বন্ধকি সম্পত্তির আইনি মতামত নেয়া সম্ভব হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতারা এসব কাগজপত্র জোগাড় করে দেয়াকে ঝামেলা ও হয়রানি মনে করেন। কেউ কেউ ঋণ নেয়ার সিদ্ধান্ত থেকেই পিছু হটেন, তবু এসব কাগজপত্র জোগাড় করে দিতে সম্মত হন না। অন্যদিকে বন্ধকি সম্পত্তি ব্যাংকে বন্ধক থাকা অবস্থাতেই বন্ধকদাতা কর্তৃক বন্ধকি সম্পত্তি আংশিক বা সম্পূর্ণ হস্তান্তর করে দেয়ারও অনেক ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সালে সিসি লোন দেয়া হয়েছিল ২৫ শতাংশ জমি বন্ধক নিয়ে। ২০১৭ সালে ঋণ নবায়নকালে হালনাগাদ খাজনা রশিদ নিয়ে দেখা যায়, জমির পরিমাণ ২০ শতাংশ!
বন্ধকদাতা ঋণগ্রহীতাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘হজে যাওয়ার আগে স্ত্রীকে ৫ শতাংশ জমি হেবা করে দিয়ে দিয়েছি।’ ফলে ব্যাংকারকে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়, সময়মতো নবায়ন প্রস্তাব পাঠাতে পারেন না। ব্যাংকার তখন ট্রান্সফার করে দেয়া ৫ শতাংশের কাভারেজ হিসেবে আরো জমি দেয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু বন্ধকদাতার পক্ষে নতুন জমি দেয়া সম্ভব হয় না। আবার তফসিলে পরিবর্তনের কারণে নতুন করে আইনি মতামত নেয়া, রিডেম্পশান ও রিভোকেশন দলিল সম্পাদন করে নতুন করে বন্ধকি ও আমমোক্তারনামা দলিল সম্পাদন করতে হয়, যা করতে ঋণগ্রহীতার ঘোর আপত্তি। অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে বলতে শোনা যায়, ‘অবশিষ্ট ২০ শতাংশ দিয়েই অন্য ব্যাংক দ্বিগুণ লিমিট দিতে রাজি আছে। ২০ শতাংশ দিয়েই নতুন করে রেজিস্ট্রেশন না করে যদি পারেন লোন নবায়ন করুন, নইলে কাগজপত্র দিয়ে দেন, অন্য ব্যাংকে চলে যাই।’ বণ্টননামা দলিল সম্পাদন ব্যতিরেকে যৌথ সম্পত্তির একক অংশ বন্ধক দিয়ে অনেকে ঋণ নিতে চান।
কিন্তু এক্ষেত্রে বন্ধকদাতার দখল কোনো রেজিস্টার্ড দলিল দ্বারা প্রমাণিত না হওয়ার কারণে ব্যাংক ঋণ দিতে পারে না। প্রস্তাবিত সম্পত্তির তফসিলে দাগে কিংবা খতিয়ানে ভুল একটা নিয়মিত সমস্যা। এসব বিরোধপূর্ণ কিংবা অনিষ্কণ্টক সম্পত্তি ব্যাংক সহায়ক জামানত হিসেবে নিতে আগ্রহী নয়। আবার অনেক সময় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বন্ধকি জমির মালিকানা এক দাগে, আর দখল আরেক দাগে। কিংবা ব্যাংককে দেখানো হচ্ছে এক জমি কিন্তু বন্ধক দেয়া হচ্ছে আরেক জমি। ফলে ব্যাংক এসব ত্রুটিপূর্ণ জমিজমা জামানত হিসেবে নিতে পারে না। আর নিলেও ভবিষ্যতে জটিলতা সৃষ্টি হয়।
১৫. নিশ্চয়তা বা গ্যারান্টির অভাব: ব্যাংক সাধারণত জামানতসহ ঋণ প্রদানকেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। কারণ ঋণগ্রহীতা ব্যবসা গুটিয়ে ফেললে কিংবা ঋণ পরিশোধে অসমর্থ হলে জামানত/বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি করে ঋণ আদায়ের সুযোগ থাকে। কিন্তু যেসব ঋণে কোনো সহায়ক জামানত থাকে না, ওইসব ঋণ প্রদানের জন্য ব্যাংক চায় ঋণগ্রহীতার পাশাপাশি তৃতীয় কারো গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতা এবং এসব ঋণের গ্যারান্টরদের কাছে গ্যারান্টি ধারণাটাই স্পষ্ট নয়; তারা মনে করেন, গ্যারান্টি মানে নিছক সুপারিশ এবং ঋণপ্রস্তাবে একটা সই পর্যন্তই গ্যারান্টরের দায়িত্ব শেষ।
যখনই গ্যারান্টরের সঠিক দায়দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত করা হয় কিংবা নেটওয়ার্থ হিসাব করার জন্য গ্যারান্টরের সম্পদ ও দায় সম্পর্কে জানতে চেয়ে গ্যারান্টরের মালিকানাধীন স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ও তফসিল নিশ্চিত হওয়ার জন্য তার মালিকানাধীন জমিজমার দলিল কিংবা খারিজের ফটোকপি চাওয়া হয়, অমনি গ্যারান্টিদাতা গ্যারান্টি প্রদানে ঘোর আপত্তি প্রকাশ করেন। কেউ যদি সত্যিকার অর্থেই কোনো একটা ঋণের গ্যারান্টর হতে চান, তাহলে অবশ্যই তাকে সংশ্লিষ্ট ঋণের দায়দায়িত্ব নেয়ার আর্থিক সামর্থ্য (আয় ও সম্পদ) ও সদিচ্ছা দুটোই থাকতে হবে। কিন্তু এসব ক্ষুদ্রঋণের জামিনদাতাদের অনেকেরই আর্থিক সামর্থ্য থাকলেও সদিচ্ছার বড়ই অভাব। ফলে নামকাওয়াস্তের এসব গ্যারান্টি ব্যাংক নিতে পারে না; আর নিলেও এসব জামিনদারের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে সহযোগিতামূলক আচরণ পাওয়া যায় না।
১৬. তৃতীয় পক্ষ বন্ধকদাতা: সিসি ঋণ চলমান থাকাবস্থায় তৃতীয় পক্ষ বন্ধকদাতা/আমমোক্তারদাতার মৃত্যু হলে ঋণটি চলমান রাখা কিংবা নবায়ন করা সম্ভব হয় না, যদি না বন্ধকি সম্পত্তির পরবর্তী ওয়ারিশরা নতুন করে আবার বন্ধকি/আমমোক্তারনামা দলিল সম্পাদন করেন এবং পার্সোনাল গ্যারান্টি দেন।
১৭. উত্তরাধিকারের অভাব: একক মালিকানাধীন ব্যবসার ক্ষেত্রে ব্যবসার হাল ধরার জন্য কোনো অভিজ্ঞ Ready Succession না থাকলে ঋণগ্রহীতার হঠাৎ মৃত্যু হলে কিংবা দুর্ঘটনাজনিত কারণে অক্ষম হয়ে গেলে ব্যবসা হালছাড়া হয়ে পড়ে এবং ঋণ আদায় সম্ভাবনা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
১৮. নামের ভিন্নতা: অনেক ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতার জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম একটা তো ট্রেড লাইসেন্সে বা টিআইএন সনদে কিংবা টাইটেল ডিড বা খারিজে নাম আরেকটা। নামের ভিন্নতা শুধু ঋণগ্রহীতারই থাকে এমন নয়। স্ত্রী, মা-বাবা, জামিনদাতা, বন্ধকদাতাদের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়। যেমন ঋণগ্রহীতার পরিচয়পত্রে তার নাম ‘মো. ওছমান গণি সোহেল’ কিন্তু তার স্ত্রীর আইডিতে স্বামীর নাম ‘সোহেল’। বায়া দলিলের মালিকদের নামেও ভুল ও ভিন্নতা থাকে। ফলে মালিকানাস্বত্বের চেইন (ধারাবাহিকতা) টানা দুরূহ হয়ে পড়ে।
১৯. ব্যবসা নিজে করেন কিন্তু ট্রেড লাইসেন্স স্ত্রীর নামে: কেউ কেউ ব্যাংকঋণের সুদ রেয়াত পাওয়ার জন্য স্ত্রীকে ব্যবসার মালিক হিসেবে দেখান। অর্থাৎ ব্যবসার মালিক তিনি নিজে কিন্তু ট্রেড লাইসেন্সে মালিক হিসেবে দেখানো হয় তার স্ত্রীকে। উদ্দেশ্য হলো, স্ত্রীর নামে নারী উদ্যোক্তা লোন করিয়ে সুদ রেয়াত পাওয়া। কিন্তু এসব নামসর্বস্ব নারী উদ্যোক্তাকে ব্যাংক ঋণ দিতে পারে না।
২০. অসম প্রতিযোগিতা: বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পেরে না ওঠার কারণে অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নিজেদের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারেন না বা দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে পারেন না। ফলে ব্যাংকও এসব দুর্বল ব্যবসাকে ঋণ দিতে সাহস পায় না। বাংলাদেশে পোলট্রি খামারিদের এবং এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অবস্থা বর্তমানে অনেকটাই এমন।
২১. ঋণ পরিশোধকে গৌণ মনে করা: ঋণগ্রহীতার যদি কোনো কারণে আর্থিক সংকট চলে, তখন তিনি ব্যাংকের সুদ বা কিস্তি পরিশোধকে অগ্রাধিকার না দিয়ে অন্যান্য ব্যবসায়িক ও পারিবারিক প্রয়োজনগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ ঋণ পরিশোধকে মৌলিক প্রয়োজনের পরে স্থান দেয়া হয়। ফলে ঋণ পরিশোধের বিষয়টি একসময় তার কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে এবং এর ফলে ঋণটি অনিয়মিত হয়ে পড়ে। ব্যাংক অনিয়মিত কোনো ঋণগ্রহীতাকে দ্বিতীয়বার ঋণ দেয়ার আগে শতবার ভাবে।
২২. ঋণ-তথ্য গোপন করা এবং একাধিক ঋণ গ্রহণ করা: ঋণগ্রহীতা ঋণ গ্রহণের সময় ঋণদাতা ব্যাংক বরাবর লিখিত অঙ্গীকারনামায় অন্য কোনো ব্যাংকে/আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দায়দেনা নেই মর্মে অঙ্গীকার করেন এবং ঋণদাতা ব্যাংকের অনুমতি ব্যতিরেকে ভবিষ্যতে অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করবেন না মর্মেও প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। কিন্তু এসব অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ঋণদাতা ব্যাংকের অজ্ঞাতে একই ব্যবসার জন্য অন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আবারো ঋণ গ্রহণ করেন। ঋণ নবায়নকালে (চলতি ঋণের ক্ষেত্রে) সিআইবি রিপোর্টে এসব অনুমোদনবহির্ভূত দায়দেনার কারণে চলমান ঋণটি নবায়ন করতে ব্যাংক অস্বীকৃতি জানাতে পারে। আর নবায়ন করলেও দ্বিতীয় ঋণটির অনুমোদন চিটি, ঋণ হিসাবের বিবরণী ইত্যাদি অন্য ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করে প্রধান কার্যালয়কে অবগত করতে যথেষ্টই কালক্ষেপণ হয় এবং ঋণটি চলমান রাখার অনুমোদন পাস করিয়ে নিতে শাখাকে অনেক বেগ পেতে হয়।
২৩. শ্রেণীকৃত সিআইবি রিপোর্ট: ঋণের আবেদনকালে ঋণগ্রহীতাকে জিজ্ঞেস করা হয়, তার অন্য কোথাও দায়দেনা আছে কিনা। অনেকে এসব তথ্য গোপন করেন। কেউ জ্ঞাতসারে ইচ্ছাকৃতভাবে করেন, কেউ আবার না বুঝে করেন। সিআইবি রিপোর্ট ক্লিন এলে হয়তো সমস্যা নেই। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, সিআইবি রিপোর্টে নিজের নামে কোনো ঋণ না থাকলেও কোনো এক সময় নিজের কোনো ব্যবসায়িক বন্ধুর বা পরিচিত জনের ঋণের গ্যারান্টর হয়েছিলেন, যে ঋণটি মূল ঋণগ্রহীতা পরিশোধ না করার কারণে খেলাপি হয়ে গেছে এবং গ্যারান্টর হিসেবে ভাবী এ গ্রাহকের সিআইবিতেও তার স্ট্যাটাস খেলাপি, অর্থাত ঋণ প্রাপ্তিযোগ্যতা হারায়।
২৪. ভাড়া দোকানে ব্যবসা: ভাড়া দোকানে ব্যবসা করার একটা সমস্যা হলো, ব্যবসা যদি উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নতি করে, তাহলে পজেশনের মালিক নিজেই তখন ভাড়াটে ব্যবসায়ীকে হটিয়ে ব্যবসা করতে চান। ফলে বর্তমান ভাড়াটে উদ্যোক্তার ব্যবসায়িক ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ে কিংবা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। আর তখন ব্যাংকের বিনিয়োগও মুখ থুবড়ে পড়ে এবং আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তাছাড়া দোকান মালিকের কাছ থেকে লেটার অব ডিসক্লেইমার না নিতে পারার কারণেও ভাড়াটে ব্যবসায়ী ঋণ সুবিধা নিতে পারেন না।
২৫. ফান্ড ডাইভার্সন: ঋণের অননুমোদিত ব্যবহারের কারণেই অধিকাংশ ঋণী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে না এবং ব্যাংকের বিনিয়োগকৃত টাকাও ফেরত আসে না। ঋণগ্রহীতা ফান্ড ডাইভার্ট করে ঋণের টাকা অন্যত্র বিনিয়োগ করেন। ঋণ দেয়া হয়েছে হয়তো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য চালের ব্যবসার জন্য কিন্তু বিনিয়োগ করা হচ্ছে আয় নিরুত্সাহী ক্যাপিটাল ব্লকিং খাত যেমন— জমি/ফ্ল্যাট বা বিলাস দ্রব্য কেনার কাজে। ফলে মূল যে ব্যবসার জন্য ঋণ দেয়া হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে অসুস্থ হতে থাকে। কারণ ব্যাংকের সুদ পরিশোধ করার মতো আয় তিনি জেনারেট করতে পারেন না এবং যে খাতে ফান্ড ডাইভার্ট করা হয়েছে, সে খাতও অনুত্পাদনশীল বলে একপর্যায়ে ঋণটি মন্দ ঋণে পরিণত হয়।
২৬. জামানতের অতিমূল্য দাবি করা এবং সেই অনুপাতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ঋণসীমার আবেদন করা: ব্যাংকিং জ্ঞানের অভাবে কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রতারণামূলক মনোভাবসম্পন্ন কিছু গ্রাহক আছেন, যারা ব্যাংকের চোখে ধুলা দিয়ে বন্ধকি সম্পত্তির অতিমূল্য দাবি করেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক প্রয়োজন বা সক্ষমতা গোপন করে বন্ধকি জমির দামের অনুপাতিক হারে ঋণসীমা দাবি করেন।
২৭. স্ত্রী ও সহজামিনদাতাদেরকে ব্যাংকে নিয়ে আসতে অনীহা: সিসি (চলতি) ঋণের ক্ষেত্রে ঋণ নবায়নের সময় জামিনদাত্রী স্ত্রী কিংবা তৃতীয় পক্ষ বন্ধকদাতাদের নতুন করে পার্সোনাল গ্যারান্টি নিতে হয়। এ বিষয়টি অনেকেই ভালো চোখে দেখেন না, বিশেষ করে প্রতিবার ঋণ নবায়নের ক্ষেত্রে স্ত্রীকে ব্যাংকে নিয়ে আসাটা অনেকেই সমর্থন করেন না, সেটা ধর্মীয় ও সামাজিক— দুই কারণেই হতে পারে। কেউ কেউ আছেন, যারা ঋণ নিতে চান কিন্তু বউ যেন জানতে না পারে এ শর্তে। ঋণ নবায়নের সময় হয়েছে কিন্তু তৃতীয় পক্ষ বন্ধকদাতা দেশের বাইরে চলে গেছেন— এমন ঘটনাও ঘটে। ব্যাংকারকে তখন ভীষণ পীড়ায় পড়তে হয়।
২৮. ব্যবসায় ও বন্ধকি সম্পত্তিতে দায়বদ্ধতার সাইনবোর্ড সাঁটাতে অনীহা: স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক নিয়ে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক বন্ধকি সম্পত্তিতে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় দায়বদ্ধতার সাইনবোর্ড নিশ্চিত করার শর্ত দিয়ে থাকে। এ শর্তটি পরিপালনে প্রায় সব উদ্যোক্তাই আপত্তি জানান। কারণ তারা মনে করেন যে, তাদের দায়বদ্ধতার স্ট্যাটাস প্রকাশ পেলে তারা সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হবেন। তাই ঋণের টাকা হাতে চলে আসার পরই তারা এসব সাইনবোর্ড খুলে বা সরিয়ে ফেলেন। ফলে ঋণ-পরবর্তী সময়ে কিংবা চলতি ঋণ নবায়নের উদ্দেশ্যে সাইট ভিজিট করতে গিয়ে ব্যবসায় কিংবা বন্ধকি সম্পত্তির কোনোটাতেই দায়বদ্ধতার সাইনবোর্ডের অস্তিত্ব খোঁজে পাওয়া যায় না।
ব্যাংক পর্যায়ে
১. খেলাপি ঋণ: খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংকিং খাতকে অক্টোপাসের মতো গিলে খাচ্ছে। খেলাপি ঋণ ব্যাংকের ঋণ বিতরণের বল্গায় লাগাম টেনে ধরে। যেসব খাতে আদায় কম, ব্যাংক ওইসব খাতে বারবার বিনিয়োগ করতে অনাগ্রহী হয়। পাশাপাশি যেসব শাখার খেলাপি ঋণ বেশি, ওইসব শাখার নতুন কোনো ঋণ অনুমোদনের বিপক্ষে প্রধান কার্যালয়কে শক্ত অবস্থান নিতেও দেখা যায়।
২. সব দায় ম্যানেজারের: কোনো এসএমই ঋণ খেলাপি হলে ঋণ মঞ্জুরিকালীন ম্যানেজারের কোনো অনিয়ম বা গাফিলতি আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হয়। অন্যদিকে কোনো ম্যানেজারের ব্যাংক সুইচকালেও তার আমলে দেয়া কোনো ঋণ খেলাপি থাকলে ম্যানেজারের ব্যাংক সুইচে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করা হয়, মানসিকভাবে চাপে রাখা হয়, রিলিজ দিতে বিলম্ব করা হয়, রিলিজ নেয়ার শর্ত হিসেবে অনিয়মিত ঋণগুলোকে নিয়মিত করতে বলা হয়। অনেক সময় ম্যানেজারদের রিটায়ারমেন্ট বেনিফিটও (সার্ভিস বেনিফিট) আটকে দেয়া হয় কিংবা কর্তন করা হয়। এসব বিষয় ম্যানেজারদের এসএমই ঋণ প্রদানে অনাগ্রহী করে তোলে। অন্যদিকে অনেক ম্যানেজার ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে ঝুঁকি ও দায় এড়িয়ে চলার জন্য ঋণ দেয়া থেকে বিরত থাকতে চান কিংবা ‘ধীরে চলো’ নীতি অনুসরণ করেন। ফলে ওই শাখার এসএমই ঋণের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি হয় না।
৩. বিজনেস ডেলিগেশনের অভাব: শাখাপর্যায়ে ম্যানেজারদের বিজনেস ডেলিগেশন না থাকাটাও এসএমই ঋণ সম্প্রসারণের অন্তরায়। ম্যানেজারদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে শাখাপর্যায়ে অনেক ম্যানেজারের এসএমই ঋণ দেয়ার কোনো ডেলিগেশন নেই বা থাকলেও তা খুবই সীমিত। ফলে ওইসব শাখার ১ লাখ টাকার এসএমই ঋণপ্রস্তাবও অনুমোদনের জন্য প্রধান কার্যালয়ের সিআরএম ডিভিশনে পাঠাতে হয়। ফলে ঋণ মঞ্জুরি প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ হয়ে যায়।
৪. দীর্ঘ ঋণপ্রস্তাব: দীর্ঘ ঋণপ্রস্তাব ফরম্যাট কিংবা তথ্যের বাহুল্য বা একই তথ্য বারবার দিতে গিয়ে, যেমন— ঋণগ্রহীতার আবেদনের একই তথ্য আবারো ঋণপ্রস্তাবে ও অফিস নোটে উল্লেখ করতে গিয়ে ঋণপ্রস্তাবটিকে দীর্ঘ করে ফেলা হয়। ফলে প্রস্তাব তৈরিতে কালক্ষেপণ হয়। ঋণপ্রস্তাবে তথ্যের বাহুল্য না ঘটিয়ে এবং অযাচিত তথ্য না দিয়ে মৌলিক তথ্যাদি দিয়ে তা তৈরি করলে অনেক সময় বাঁচবে এবং দ্রুততম সময়ে ঋণ মঞ্জুর করা সম্ভব হবে।
৫. উচ্চ সুদহার ও রকমারি ব্যাংকিং চার্জ: উচ্চমাত্রার সুদহারের কারণে অনেক ব্যবসায়ী এসএমই ঋণ গ্রহণ করে প্রত্যাশিত ব্যবসায়িক সাফল্য পান না। বাংলাদেশ ব্যাংক ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে সুদের চক্রবৃদ্ধি হিসাব করতে বললেও অনেক ব্যাংক এখনো তা মাসিক ভিত্তিতে করে। ফলে কার্যকর সুদহার ঘোষিত হারের চেয়ে আরো বেশি হয়ে যায়। অন্যদিকে সুদবহির্ভূত খরচ যেমন— ঋণ আবেদন ফি, প্রক্রিয়াকরণ ফি, ডকুমেন্টেশন ফি, মনিটরিং ফি, আইনজীবীর ফি, সার্ভেয়ার/জামানত মূল্যায়নকারীর ফি, অডিট কোম্পানির ফি, রেটিং ফি, স্ট্যাম্প খরচ, দলিল রেজিস্ট্রেশন খরচ, ইন্স্যুরেন্স খরচ, রিস্ক ফান্ড, কমিটমেন্ট চার্জ, আর্লি সেটলমেন্ট ফি, সার্ভিস চার্জ, ভ্যাট, বার্ষিক এক্সাইজ ডিউটি ইত্যাদি ঋণের সুদের হারকে আরো ২-৩ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়।
৬. কাগজপত্র আদায়ে কড়াকড়ি: টাইটেল ডিডের (দলিলের) সত্যায়িত কপি গ্রহণ না করা, খতিয়ান বা বায়া দলিলের খসড়া কপি/ফটোকপি গ্রহণ না করা, সিএস খতিয়ান থেকে মালিকানার ধারাবাহিকতা নির্ণয় করা, কোনো বায়া দলিলের গ্যাপ অ্যালাউ না করা, সরকারি বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার সনদ যেমন— পোলট্রি ফার্মিংয়ের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র এবং জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট নেয়া ইত্যাদি দালিলিক কড়াকড়ি উদ্যোক্তাদের ঋণগ্রহণে দুশ্চিন্তায় ফেলে এবং নিরুত্সাহিত করে।
৭. ঋণ বিশ্লেষণ ও প্রস্তাব তৈরিতে ব্যাংকারের অদক্ষতা ও কাঠামোগত দিকনির্দেশনার অভাব: বিভিন্ন ব্যবসার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল অ্যাসেস করাটা অনেক ব্যাংকারই পারেন না। অনেক ব্যাংকারের ট্রেডিং ব্যবসায় ফিন্যান্স করার অভিজ্ঞতা থাকলেও উত্পাদন খাতে ঋণ দেয়ার অভিজ্ঞতা নেই। ফলে তিনি জানেন না কীভাবে সাধারণ একটি পোলট্রি ফার্ম কিংবা একটি ফিশারি প্রজেক্ট, একটি রাইস মিল বা ফ্লাওয়ার মিল, একটি সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি কিংবা পেপার মিলের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল অ্যাসেস করতে হয়। ঠিক একইভাবে ব্যাংকও তাদের কর্মকর্তাদের এসব বিষয়ে আগে থেকেই কাঠামোগত (কীভাবে বিভিন্ন প্রজেক্ট প্রোফাইল তৈরি করতে হয়, বিভিন্ন ব্যবসার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল অ্যাসেসমেন্ট করতে হয় ইত্যাদি) জ্ঞান প্রদানে মনোযোগী নয়। ফলে এসব খাতের ঋণগ্রহীতাকে অনভিজ্ঞ বা অদক্ষ ব্যাংকারের কারণে বিলম্বিত ঋণ সুবিধা কিংবা প্রয়োজনের কম ঋণ পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
৮. ঋণ মঞ্জুরি কর্তৃপক্ষের (শাখা/সিআরএম/ক্রেডিট কমিটি/ইসি কমিটি) ঋণ মঞ্জুরিতে দীর্ঘসূত্রতা: ঋণ মঞ্জুরি প্রক্রিয়া দ্রুত ও সহজীকরণার্থে দলিলাদি সম্পাদনে যথাসম্ভব স্বল্প আনুষ্ঠানিকতা অনুসরণ করার জন্য এবং পূর্ণ ঋণ আবেদনপ্রাপ্তির পর সর্বোচ্চ ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সিদ্ধান্ত প্রদানের নীতি গ্রহণ করার জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা দেয়া থাকলেও প্রধান কার্যালয়ে নিয়মিত বা স্বল্প বিরতিতে ক্রেডিট কমিটি কিংবা এক্সিকিউটিভ কমিটির মিটিং না হওয়ার কারণে যথাসময়ে ঋণ মঞ্জুর ও অর্থ ছাড় করা সম্ভব হয় না। এসব কারণে বড় ঋণগুলো মঞ্জুর হতে ক্ষেত্রবিশেষে তিন থেকে চার মাস লেগে যায়। ঋণ মঞ্জুর হতে হতে সিআইবির রিপোর্টের মেয়াদ পর্যন্ত চলে যায়।
৯. লোকবলের অভাব: পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবে অনেক যোগ্য উদ্যোক্তাকেও ঋণ দেয়ার আশ্বাস দেয়া সম্ভব হয় না। একটি ঋণপ্রস্তাব যথাসময়ে প্রস্তুত করা এবং প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো সম্ভব হয় না। ঠিক একইভাবে প্রধান কার্যালয়ও লোকবল সংকটের কারণে প্রস্তাবটি যথাসময়ে রিভিউ করতে পারে না। অনেক সময় দেখা যায়, শাখা থেকে ঋণপ্রস্তাব পাঠানোর এক থেকে দেড় মাস পর প্রধান কার্যালয় থেকে ফার্স্ট কোয়েরি আসে। কোয়েরি মিট-আপ করতে শাখার আরো ৭ থেকে ১০ দিন চলে যায়। ফলে ঋণটি প্রধান কার্যালয় থেকে ছাড় পেতে প্রায় দেড় থেকে দুই মাস চলে যায়। লোকবলের অভাবে ঋণ মঞ্জুরি পরবর্তীতে যথাসময়ে ডকুমেন্টেশন, অর্থ ছাড়, মনিটরিং, নবায়ন ও আদায় প্রক্রিয়াও বিঘ্নিত হয়।
১০. অসম্পূর্ণ ঋণপ্রস্তাব প্রেরণ: শাখা থেকে অসম্পূর্ণ ঋণপ্রস্তাব প্রেরণ, অর্থাত্ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংযোজন না করে কিংবা প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত না দিয়েই দায়সারা গোছের ঋণপ্রস্তাব পাঠানোর কারণে প্রধান কার্যালয় এসব ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন করতে পারে না। আর অনুমোদন করলেও এসব প্রস্তাবের বিপরীতে প্রয়োজনীয় কোয়েরি মিট-আপ করতে অনেক কালক্ষেপণ হয়ে যায়।
১১. দীর্ঘ ডকুমেন্টেশন প্রক্রিয়া: ঋণ মঞ্জুর হলেই ঋণগ্রহীতা টাকা পেয়ে যান না। তাকে যথাযথ ডকুমেন্টেশন সম্পাদন করেই ঋণের অর্থ ছাড় করাতে হয়। কিন্তু বন্ধকি ঋণের ক্ষেত্রে প্রতিবার ঋণসীমা বাড়লেই বন্ধকি দলিল সম্পাদন এসএমই ঋণের সম্প্রসারণের অন্তরায়। অন্যদিকে কিছু ব্যতিক্রমী ঋণ ডকুমেন্ট প্রস্তুত করতে গিয়ে ছোট শাখাপর্যায়ের কর্মকর্তারা হিমশিম খান। যেমন— টেকওভার, সিন্ডিকেশন ইত্যাদি ঋণের ক্ষেত্রে কিছু ভিন্নধর্মী ডকুমেন্ট প্রস্তুত করতে হয়, যা শাখাপর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা অনভিজ্ঞতার কারণে প্রস্তুত করতে পারেন না। অন্যদিকে শাখার আইনজীবীরাও ব্যতিক্রমী এসব দলিল কিংবা অঙ্গীকারনামা প্রস্তুত করতে অক্ষমতা বা অদক্ষতা প্রকাশ করেন এবং উল্টো ব্যাংকারেরই সহায়তা চান। প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিভিশনও নমুনা ডকুমেন্ট সরবরাহ কিংবা প্রয়োজনীয় নির্দেশনা না দিতে পারার কারণে ডকুমেন্টেশন প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত হয়।
১২. প্রয়োজনের তুলনায় কম ঋণ প্রদান: গ্রাহক কর্তৃক প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঋণ চাওয়াটা একটা সংস্কৃতি হয়ে যাওয়ার কারণে এবং শাখাপর্যায়ে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল অ্যাসেসমেন্টে ভুল বা অদক্ষতার কারণে প্রধান কার্যালয় কর্তৃক প্রস্তাবিত ঋণসীমার চেয়ে কম ঋণ মঞ্জুর করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এতে যোগ্য উদ্যোক্তারা অনেক সময় প্রাপ্য ঋণসীমা পান না।
১৩. সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের অসহযোগিতা: বন্ধকি সম্পত্তির সঠিকতা যাচাইয়ে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের অসহযোগিতা, যেমন— সাব-রেজিস্ট্রি অফিস প্রদত্ত নির্দায়ী সনদে স্বাক্ষর প্রদান করতে সাব-রেজিস্ট্রারদের অনীহার কারণে তথাকথিত তল্লাশকারকরা বিনা তল্লাশিতে নির্দায়ী সনদ প্রদান করে, যা ব্যাংকের ঋণ ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় এবং ব্যাংকারকে ঋণদানে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়।
১৪. ব্যাংকারদের দুর্নীতি: শাখা ব্যবস্থাপক ও ঋণ অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের মন জয় করতে অনেক সময় প্রস্তাবিত ঋণগ্রহীতাকে অর্থ ঢালতে হয়। নিয়মের কড়াকড়ি, কাগজপত্রের বাধ্যবাধকতা, উচ্চসুদের পাশাপাশি এসব সুদবহির্ভূত অদৃশ্য খরচ এসএমই গ্রাহকদের কস্ট অব ফান্ড বাড়িয়ে দেয় এবং ঋণগ্রহণে অনাগ্রহী করে তোলে।
১৫. সীমার অতিরিক্ত এডি রেশিও: প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো তার আমানতের ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করতে পারে। ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর জন্য যা ৯০ শতাংশ। কিন্তু এডি রেশিও এ সীমা লঙ্ঘন করলে বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ঋণ প্রদানের বল্গায় লাগাম টেনে ধরে।
উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ব্যাংকের চাহিদা ও এসএমই উদ্যোক্তাদের জোগানের ফারাকের জন্যই এসব ব্যবসা বা উদ্যোগ প্রয়োজনীয় ঋণ সুবিধা পায় না। তাই উদ্যোক্তা ও ব্যাংকারদের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। ব্যাংক ও এসএমই উদ্যোক্তা উভয়কেই উভয়ের প্রয়োজন বুঝতে হবে। উদ্যোক্তাদেরও মানতে হবে যে, ব্যাংক কেবল সম্ভাবনাময় ও প্রতিশ্রুতিশীল একটা উদ্যোগেই বিনিয়োগ করে। আর একটা উদ্যোগ যে সম্ভাবনাময় তা প্রমাণ বা প্রতীয়মান করার জন্য কিছু সংখ্যাগত ও গুণগত বিষয় বিশ্লেষণ করেই তা নির্ণয় করতে হয়।
এসব সংখ্যাগত ও গুণগত বিশ্লেষণকে উদ্দেশ্য করেই ব্যাংক তার চাহিদা তৈরি করে। পাশাপাশি কিছু আইনি বাধ্যবাধকতা তো আছেই। ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতা করে ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে, ক্ষেত্রবিশেষে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংকের ভালো এসএমই গ্রাহকদের নিয়ে কাড়াকাড়ি করে। এ কাড়াকাড়ির মধ্যেও যদি আপনি ঋণ না পান, তাহলে অবশ্যই বুঝতে হবে ঋণপ্রাপ্তিতে আপনার কিংবা আপনার উদ্যোগের কোনো না কোনো অযোগ্যতা নিশ্চয় আছে।
আপনার ব্যবসা বুঝুন এবং ব্যবসায়িক প্রয়োজনে কিছুটা ব্যাংকিংও শিখুন। আপনার নিরাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। আপনার জন্যই ব্যাংক। আপনি না থাকলে ব্যাংকও থাকবে না। পরস্পর পরস্পরের ব্যবসায়িক অংশীদার। ধরুন, আপনাকে ঋণ দেয়ার জন্য ১০টি ব্যাংক আপনার পেছন পেছন ঘুরছে। তাহলে কার কাছ থেকে আপনি ঋণটা নেবেন? স্বাভাবিকভাবেই যে ব্যাংক আপনার চাহিদা মতো ঋণের পরিমাণ দিতে পারবে, সুদের হার সবার চেয়ে কম চার্জ করবে, গ্রেস পিরিয়ড একটু বেশি দেবে, সর্বোপরি আপনার ব্যাংকিংকে সহজতর করে দেবে, তাকেই আপনি বেছে নেবেন। ঠিক তেমনি ব্যাংকও ভালো উদ্যোক্তা খোঁজে।
যে ব্যালান্স শিট, আয় বিবরণী আপনার তৈরি করে দেয়ার কথা, তা আপনার হয়ে আপনার ব্যাংকারই তৈরি করে দিচ্ছেন। আপনার বায়া দলিল নেই, খতিয়ান নেই? আপনার ব্যাংকারই আপনার জন্য তা জোগাড় করে দিচ্ছেন। একজন ভালো উদ্যোক্তা সবসময় যেকোনো ব্যাংকের ব্যবসায়িক টার্গেট। তাই নিজেকে সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তাতে রূপান্তর করুন, যাতে কোনো একজন উদ্যোক্তা যদি ব্যাংকঋণ পান, তিনি যেন আপনিই হন।
ব্যাংক কখনই জামানতসর্বস্ব ঋণ দেয় না। ব্যাংকের মুখ্য চাহিদা হচ্ছে— একটি ভালো উদ্যোগ, প্রত্যয়ী একজন উদ্যোক্তা এবং ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ব্যাংকিং লেনদেন। জামানত ব্যাংকের গৌণ চাহিদা। ভালো উদ্যোগকে ব্যাংক জামানতের অতিরিক্ত এবং জামানত ছাড়াও ঋণ প্রদান করে। অন্যদিকে ব্যাংককেও উদ্যোক্তাবান্ধব ঋণনীতি ও ঋণপণ্য তৈরি করতে হবে। উদ্যোক্তাদের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে উত্সাহিত করতে হবে।
ব্যাংকের ওয়েবসাইট, ফ্যান-পেজ, মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে এসএমই প্রডাক্ট তালিকা, নীতিমালা, আবেদন পদ্ধতি, প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের তালিকা ডিসপ্লের ব্যবস্থা করতে হবে। এসএমই ব্যাংকিং ও এসএমই অর্থায়ন একটি নতুন ধারণা, যা ব্যাংকার ও উদ্যোক্তাদের কাছে সুপরিচিত নয়। সুতরাং ব্যাংক কর্মকর্তাদের এসএমই ব্যাংকিং বিষয়ে সচেতন ও দক্ষ করে তোলার জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঋণ প্রদানে সরকার ব্যাংকগুলোকে গ্যারান্টি না দিলেও অনাদায়ী ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে যথাযথ আইনি সহযোগিতা প্রদান করলে এ দেশের কোনো যোগ্য উদ্যোক্তা ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন না।
লেখক: মোশারফ হোসেন, ব্যাংকার।