নীরবে-নিভৃতে
আজ ঘুমিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই একটা স্বপ্ন দেখি। স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। আমার খানিকটা দূরে কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে সবুজ হ্যান্ডলুম কটন কাপড়ের উপর কৃষ্ণচূড়া ফুলের রক্তিম লাল পাইপিনের নকশায় কাজ করা থ্রি-পিছ, সাদা রঙের প্লাজু। দুধে আলতা এক পায়ে নূপুর অন্য পা খালি। কেউ একজন ক্লাসরুম থেকে নাম ধরে ডাকছে মেয়েটাকে। সাড়া দেয়না মেয়েটা। আমি সানগ্লাসের ফাঁক দিয়ে মন ভরে দেখছি তাকে। অবশ্য যত দূর মনে পড়ে পুরো স্কুল লাইফে আমি কখনও সানগ্লাস পড়িনি। আর মেয়েটাকেও স্কুল ড্রেস ছাড়া এরকম ক্যাজুয়াল ড্রেসে দেখেছি বলে মনে পড়ছেনা। অথচ স্বপ্নে তাই-ই দেখলাম। বড়ই অদ্ভুত স্বপ্ন। ঘুম ভাঙ্গার পর মেয়েটার নামটা মনে করার চেষ্টা করি। একসময় স্পষ্ট মনে পড়ে মেয়েটাকে। আজ এতটা বছর পর মেয়েটা কে স্বপ্নে দেখার কারনটা খুঁজে পাচ্ছিনা না। ভাবছি এটা কি শুধুই বিভ্রম নাকি ব্যাকরণিক কোন গন্ডগোল?
ঘুমটা ভেঙে গেলো। ইদানীং আমার সঙ্গে এই কাজটা বেশি হচ্ছে। প্রথম প্রথম ভাবতাম তাড়াতাড়ি ঘুমোতে আসি তো,তাই হয়তো এই সময়ে ঘুম ভেঙে যায়। তাই দু’দিন ধরে একটু দেরী করে ঘুমোতে যাই। রাত জেগে টুকটাক লেখালেখি করি, সিনেমা দেখি। তবু সেই একই সময়ে ঘুম ভেঙে যায়। ব্যাপারটা রহস্যজনক! প্রচন্ড পিপাসা ধরেছে। বিছানা ছেড়ে গলা ভিজিয়ে নিলাম। ফ্যানের বাতাসটা গায়ে লাগছে। রেগুলেটরটা নষ্ট হয়ে গেছে। একটা নতুন রেগুলেটর এনে লাগাতে হবে। প্রতিদিন বাইরে যাবার সময় মনে করে বের হই। অফিসে কাজের চাপে ভুলে যাই আনতে। রাতগুলো ইদানীং কেমন জানি টেস্ট পেপারের মতো দীর্ঘ মনে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। ঘুম আসছে না। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। কোথায় যেন পড়েছিলাম বৃষ্টির সাথে নাকি মানুষের অতীত স্মৃতির বেশ যোগসাজশ রয়েছে। বৃষ্টির ফোটায় ফোটায় অতীতরা নাকি ভেসে আসে। এটা একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার। অনেক কিছুই মনে পড়ছে আজ। হাইস্কুল জীবনের কথা বেশি মনে পড়ছে।
প্রাইমারী স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে হাইস্কুল জীবনে পদার্পন করতে যাচ্ছি তখন। নতুন স্কুল, নতুন স্যার, নতুন বন্ধু এসব নিয়ে বেশ রোমাঞ্চিত ছিলাম। প্রথম দিন আসাদ মামার সাথে যোগেন্দ্র চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে যাই। মামার পূর্ব পরিচিত মোজাম্মেল হক স্যারের সাথেই আমার প্রথম পরিচয় হয়। স্যার আমাকে ভর্তির ফর্মটা হাতে দিয়ে ক্লাসে যেতে বললেন। আমি অতি সুবোধ বালকের মত ক্লাসে গেলাম। কাঁচাপাকা টিনশেডের ক্লাস রুমটার মেঝে ছিল মাটির। মেয়েরা বসত বামদিকের সারিতে আর ছেলেরা ডানদিকের। ক্লাসরুমটা কানায় কানায় পূর্ন। ক্লাস টিচার ইসলাম উদ্দিন স্যার।
স্যারের অনুমতি নিয়ে ক্লাসে ঢুকতেই হুচট খেলাম। ক্লাসের সবাই আমায় দেখে রীতিমত হট্রগোলে মেতে উঠল। পরে কারনটা জানতে পেরে নিজেরই খুব লজ্জা লাগছিল। সব ছেলেদের পরনে ছিল শার্ট প্যান্ট। আমার গায়ে শার্ট থাকলেও পড়নে প্যান্টের বদলে ছিল টেট্টন কাপড়ের একটা হাফপ্যান্ট, হাফপ্যান্ট পড়ার কারনে বের হয়ে থাকা আমার লম্বা লম্বা পা দেখে ক্লাসের সব ক’টা ছেলেমেয়ে একসঙ্গে হেসে উঠল। সবচে উচ্চস্বরে যে ছেলেটি হেসেছে, পরে অবশ্য সেই-ই আমার সবচে ভাল বন্ধুতে পরিনত হয়েছিল। লজ্জায় সেদিন আর ক্লাস না করেই বাড়ি চলে আসি। মনে আছে আসাদ মামাই আমার ভর্তির ফর্মের সবকিছু ফিলআপ করে দিয়েছিলেন। জাহাজে চাকুরির দরুন বাবা খুব একটা সময় পেতেন না বাড়ি আসার। ফর্মের নিচের অংশে অভিভাবকের স্বাক্ষরের ঘরে বাবার নামটাও সেবার মামাই লিখে দিয়েছিলেন।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন। |
পরদিন যথারীতি ফুলপ্যান্ট আর শার্ট পড়েই স্কুলে যাই। তাজুল স্যারের কাছে ফর্মটা জমা দিতেই হাজিরা খাতায় আমার রোল নম্বর পড়লো ৮৯। ফার্স্ট আওয়ারে দেখি নতুন এক স্যারকে। বেশ সুদর্শন, টল ফিগার, আপাদমস্তক দেখতে খুবই স্মার্ট। রোল কলিং এর পর স্যার নিজের পরিচয় দিলেন। মোহাম্মদ আব্দুল মোত্তালিব। আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক। স্যার নিয়মিত ক্লাস নেন না। মাঝে মধ্যে কোন স্যার না আসলে তিনি সেই ক্লাস প্রক্সি দেন। হেড টিচার হওয়ার কারণে মিটিং ফিটিং নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় স্যারকে। আর আমরা যেহেতু সবে মাত্র ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলাম, হাইস্কুলের নতুন ছাত্র হিসবে স্কুলের আদব কায়দা নিয়ম কানুন ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের জ্ঞান দিতেই স্যারের এই ক্লাস। স্যার বিভিন্ন প্রাইমারি স্কুল থেকে আসা রোল নং ১ এর ছাত্রদের দাঁড় করালেন। রাধানগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফার্স্টবয় হিসেবে সেদিন আমিও দাঁড়িয়েছিলাম। স্যারের কথা বলার ভঙ্গি, পড়ানোর স্টাইল, স্মার্টনেস দেখে বড়ই ভাল লাগছিল সেদিন। মনে মনে ঠিকও করে ফেলি বড় হয়ে শিক্ষক হব, ঠিক মোত্তালিব স্যারের মত বড় মাপের শিক্ষক।
সিক্স থেকে সেভেন উঠব। বার্ষিক পরীক্ষা এসে গেছে। বাড়িতে বাড়িতে পড়াশোনার ধুম। পড়াশোনায় বরাবরই বেশ ভাল ছিলাম বিধায় পরীক্ষা নিয়ে তেমন ভীতি ছিলনা আমার। যাই হোক ইংরেজী ছাড়া বাকী সব বিষয়েই আমার পরীক্ষা বেশ ভাল হলো। ইংরেজি পরীক্ষার দিন কি যেন একটা কারনে পরীক্ষার হলে ঢুকতে আমার আধা ঘন্টা দেরি হয়েছিল। ফল বের হলে আমি স্কুলের সমস্ত শিক্ষকদের স্তম্ভিত করে প্রথম হয়ে যাই। বাবাকে চিঠি লিখে জানালাম আমি হাইস্কুলেও প্রথম হয়েছি। সেই-ই যে প্রথম হলাম। স্কুল জীবনে কেউ আর আমার ফার্স্টবয়ের শিরোপার দখল নিতে পারেনি।
সেবার স্কুলের রেকর্ড ভেঙ্গে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ক্লাস এইটে উঠি। সেজন্যে অবশ্য হেড স্যার পিটি প্যারেডে সবার সামনে আমার হাতে একটা পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন। একশত টাকার প্রাইজবন্ড। ইসলাম উদ্দিন স্যারকে আমি খুব পছন্দ করি। শুধু আমি একা না। স্কুলের প্রায় সব ছাত্রই পছন্দ করে। অথচ তিনি এই স্কুলের সবচেয়ে রাগি স্যার। বেত ছাড়া স্যারকে কখনও ক্লাসে ডুকতে দেখেনি কেউ। পিটি প্যারেড শুরু হলে ছাত্রদের সারির মাঝখান দিয়ে বেত হাতে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াতেন স্যার। স্কুল জীবনে একবার মাত্র মার খেয়েছিলাম। আর সেটাও এই স্যারের হাতেই। পিটি প্যারেডে অন্যসবার সাথে তাল মেলাতে না পারার অপরাধে।
সেদিন দৃষ্টিপটে এক তরুণীকে আবিস্কার করলাম। দেখতে ছিল ভারী মিষ্টি। মেয়েটার চোখ দুটো ছিল সবচেয়ে সুন্দর। যাকে বলে হরিণ চোখা। খোঁজ নিয়ে পরে জানতে পারি সে আমাদের দুই ব্যাচ জুনিয়র। তারপর কদিন ধরে আমার কি যেন একটা হলো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা। ক্লাসে আমি স্যারদের দিকেও তাকাই না। বোর্ডে কী লেখা হচ্ছে তাও পড়তে চেষ্টা করি না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি রাজকন্যার দিকে। সত্যিকার রাজকন্যা নয়। এলোমেলো করে আমার অংক খাতায় বলপয়েন্টের আঁকা রাজকন্যার দিকে। প্রায়ই আমার বই-খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় রাজকন্যার নামে একটা সংকেত লেখা থাকত। পড়ালেখায় খুবই সিরিয়াস আর উৎসুক টাইপের একটা ফ্রেন্ড ছিল আমার। আমায় খুব ফলো করত। আমার নোটস, টেস্টপেপার ইত্যাদি নিয়ে খুব ঘাটাঘাটি করত। যদিও আমি কখনো কাউকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভাবিনি। একদিন খেয়াল করলাম আমার লেখা ওই সংকেত টার দিকে ও বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে; হয়তবা সংকেতটার নাড়ীনক্ষত্র উদ্ধারে ব্যস্ত বন্ধু আমার। কতটুকুন উদ্ধার করতে পেরেছিল সেদিন তা জানিনা।
কৈশোরের ফ্রেমেবন্দী গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেল অথবা বর্ষায় আকাশে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রোদ্দুর কিংবা মেঘকালো চোখের ভাষা, রং তুলিতে আঁকা অবসর বিকেল; রাজকন্যার নামে আরও কত কী আঁকি আনমনে! সত্যিকারের রাজকন্যার সাথে অবশ্য কোনদিন কথা হয়নি আমার। আমার এই অস্বাভাবিক আচরণ কোনদিন রাজকন্যার চোখে পড়ল কি না তাও জানি না। না পড়ারই কথা। জীবনতরী সর্বদা একদিকে প্রবাহিত হয় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের বাঁকও পরিবর্তিত হয়। ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখ বদলায়, ঘড়িটাও সময় বদলিয়ে দিনটাকে এগিয়ে নিয়ে যায়; একসময় রাজকন্যা চ্যাপ্টার টা গাদা গাদা টেস্ট পেপারের নিচে চাপা পড়ে যায়।
সেদিনের স্বনীল স্বপ্নগুলো কেবল প্রহসনের মতোই বুকের মধ্যিখানে বেজে উঠে। গভীর রাতের নীরবতায় যেন পরিস্থিতির রহস্যময়তা এক চিলতে বাড়ে। কৈশোরে ফিরে যাই। বৃত্তের বাইরে এসে টুকরো কিছু বাক্যে ঘুম আর স্বপ্নের মাঝখানে অদৃশ্য দেয়াল ভুলে নীরবে-নিভৃতে খুঁজি ফিরি হারিয়ে যাওয়া কৈশোরের সেই সকাল, সেই বিকেল, বৃষ্টি ভেজা দুপুর, অলস মেঘ রোদ্দুর, স্বপ্ন গানে যদিও কখনো আসবেনা জানি ফিরে আমার গল্পের রানী হয়ে।
লেখকঃ ফয়সুল আলম, ব্যাংকার ও তরুণ লেখক। [প্রকাশিত এই লেখাটি লেখকের একান্তই নিজস্ব। ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখা ও মতামতের জন্য ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ দায়ী নয়।]