ইসলামী ব্যাংকিংবিশেষ কলাম

ইসলামি ব্যাংকিংয়ের জন্য স্বতন্ত্র আইন কতটা প্রাসঙ্গিক

মো. জিল্লুর রহমানঃ ইসলামি ব্যাংকিং বিশ্বব্যাপী দ্রুত সম্প্রসারণের ফলে মানুষের মধ্যে ব্যাপক চাহিদা, আগ্রহ ও আস্থা সৃষ্টি করেছে এবং ইসলামি ব্যাংকিং বাংলাদেশেও একটি শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থা শক্তিশালী অর্জন অক্ষুণ্ণ রেখেছে এবং এই ব্যবস্থাটি এখন বাংলাদেশের পুরো ব্যাংকিং শিল্পের ২৭ শতাংশেরও বেশি বাজারের অংশীদার। তবে ইসলামি ব্যাংকিংয়ে প্রসার বাড়লেও দেশে এখন পর্যন্ত ইসলামি ব্যাংকিং পরিচালনার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই। ১৯৮৩ সাল থেকে দেশে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের কার্যক্রম চললেও ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক নামমাত্র একটি গাইডলাইন তৈরি করে দেয়।

ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থার উদ্দেশ্যগত ও পদ্ধতিগত পার্থক্য রয়েছে। ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হচ্ছে সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও কল্যাণ। ফলে সামগ্রিকভাবে বড় শিল্প বা ব্যবসার পাশাপাশি এসএমই খাত ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সহজে বিনিয়োগ সুবিধা পাচ্ছেন। ইসলামী ব্যাংকে লাভ-লোকসান অংশীদার ভিত্তিতে আমানত হিসেবে পরিচালিত হয়। ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ কার্যক্রম শরিয়াহ্সম্মত নীতি অনুসরণ করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের ইসলামিক ব্যাংকিং সেলের এক সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, দেশি-বিদেশি মিলে দেশে মোট তফসিলি ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকের সংখ্যা ১০টি, আগে যা ছিল আটটি। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক নতুন করে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তর হয়েছে। এর বাইরে আটটি প্রচলিত ব্যাংকের ১৯টি ইসলামি ব্যাংকিং শাখা এবং ১১টি ব্যাংকের ১৭৮টি ব্যাংকিং উইন্ডো রয়েছে। সব মিলে দেশে মোট ব্যাংকের ১০ হাজার ৭৬৭টি শাখার মধ্যে ইসলামি ব্যাংকিং শাখা রয়েছে এক হাজার ৫৫৮টি, যা মোট শাখার ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিকে দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১২ লাখ ৯৮ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা এবং এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৫৭ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা, যা মোট ব্যাংক খাতের সাড়ে ২৭ শতাংশ। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে এটি ছিল সাড়ে ২৫ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানতের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে পৌনে ১০ শতাংশ। একই সময়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। মোট ১১ লাখ ৬৩ হাজার ২৬ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ ছিল তিন লাখ ২২ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা, যা মোট ব্যাংক খাতের ২৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে এটি ছিল ২৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০০৯ সালে একটি ইসলামি ব্যাংকিং নীতিমালা করে। এখন এ ব্যবস্থার পূর্ণ বিকাশের জন্য পৃথক আইন প্রয়োজন। কেননা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা ইসলামি ব্যাংকিং আইনের বিকল্প হিসেবে অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর নয়। ইসলামি ব্যাংকিং আইন হলে প্রকৃতপক্ষে শরিয়াহ্ পরিপালন করে ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না। দেশে শরিয়াহ্ বিষয়গুলো দেখার জন্য সব ইসলামী ব্যাংকে আলাদা শরিয়াহ্ কমিটি আছে। এছাড়া সব ইসলামী ব্যাংকের জন্য সেন্ট্রাল শরিয়াহ্ বোর্ড আছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকে পৃথক ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডো থাকলেও কোনো ইসলামি ব্যাংকিং বিভাগ নেই।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

বাংলাদেশে ব্যাংক কোম্পানি পরিচালনার জন্য ১৯৯১ সালে ব্যাংক-কোম্পানি আইন পাস করা হয়। এই আইনের মধ্যে শরিয়াহ্র রেফারেন্স দেয়া হয়েছে বিভিন্ন ধারায়। কিন্তু দেশে ইসলামি ব্যাংকিং আইন নামে কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই। দেশের পুঁজিবাজারে ইসলামী ব্যাংক কীভাবে অংশ নেবে সে বিষয়ে এবং ইসলামী সুকুক বন্ড সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন সার্কুলারে বলা আছে। এসব বাজার দিনকে দিন প্রসারিত ও বিকশিত হচ্ছে এবং এসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন আইনি জটিলতা দূর করার জন্য সুনির্দিষ্ট আইন থাকা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৯ সালে একটা গাইডলাইন তৈরি করেছে এবং সেখান থেকে রেফারেন্স নিয়েই ইসলামী ব্যাংক পরিচালনা করা হয়। দেশের ইসলামি ব্যাংকিং দেখাশোনা ও পর্যবেক্ষণ করার জন্য বাংলাদেশে ব্যাংকের একটি ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডো রয়েছে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের যে গাইডলাইন রয়েছে, তা অনুসরণ করে ইসলামিক ব্যাংকের কার্যক্রম দেখভাল ও তদারকি করে।

ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দেশের বিশাল পরিসরের ইসলামি ব্যাংকিং সুচারুভাবে দেখাশোনা ও পর্যবেক্ষণ করার জন্য ইসলামি ব্যাংকিং গাইডলাইনই যথেষ্ট নয়, এর জন্য সুনির্দিষ্ট আইন থাকা দরকার। ‘অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে’ ব্যাংকগুলোর নীতি নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংকিং রেগুলেশন অ্যান্ড পলিসি ডিপার্টমেন্ট’ রয়েছে। কিন্তু তারা ইসলামী ব্যাংকগুলোর শরিয়াহ্-সংক্রান্ত বিষয়গুলোর কোনো দিকনির্দেশনা দেয় না এবং এর জন্য যে শরিয়াহ্ বিশেষজ্ঞ দরকার, তাও তাদের নেই। অনেকের অভিমত ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য যে গাইডলাইন রয়েছে, সেটা সংসদে পাস হওয়া কোন সুনির্দিষ্ট আইন নয়। তাদের মতে, ইসলামী ব্যাংকগুলো মূলত কিছুটা শরিয়াহ্ভিত্তিক এবং কিছুটা গাইডলাইন থেকে নিয়ম-নীতি নিয়ে মিশ্রভাবে ব্যাংক পরিচালনা করছে। এজন্য ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য একটা কার্যকর ও সুনির্দিষ্ট আইন দরকার, যাতে করে কোনো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি তৈরি হলে সেই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যায়।

ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য বিভিন্ন নীতিমালা আছে এটা সত্য, কিন্তু যেটা দরকার সেটা হলো আইন। কারণ প্রত্যেকটি আইনের একটি নিজস্ব স্বকীয়তা আছে, নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যবোধ আছে এবং এটি আইন-আদালতসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সব জায়গায় গ্রহণযোগ্য। আইন সব নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক এবং এর বিধানগুলো অমান্য বা মানতে অস্বীকার করলে শাস্তি ভোগ করতে হয়। কিন্তু গাইডলাইনের ক্ষেত্রে তা বাধ্যতামূলক নয়। প্রত্যেকটি ইসলামী ব্যাংকের নিজস্ব শরিয়াহ্ কাউন্সিল আছে বটে, কিন্তু তাদের অভিন্ন কার্যপরিধি নির্ধারণের জন্যও আইনি কাঠামো দরকার। তাছাড়া ইদানীং ইসলামি ব্যাংকিংয়ের বিভিন্ন সেবার নামে ডিস্টরশন বা বিকৃতি ঘটছে বলে নানা মহলে আলোচিত হচ্ছে।

ইচ্ছাকৃতভাবে যদি কোনো ব্যাংক ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ডিস্টরশন বা বিকৃতি ঘটায় সেটার শাস্তি কী, তা আইনি কাঠামো দ্বারা সংজ্ঞায়িত হওয়া দরকার। তাছাড়া যদি কোনো ধরনের সমস্যা হয়, কিংবা অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন কোন আইনের অধীনে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে? যদি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের নির্দেশ না থাকে, তাহলে সেখানে একটা সমস্যা হতে পারে। যারা গ্রাহক তারা একটা আস্থার ভিত্তিতে শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকে যাচ্ছে, প্রচলিত ব্যাংকের চেয়ে এই ব্যাংকে তারা বেশি আস্থা পাচ্ছে বলেই তারা যাচ্ছে। কিন্তু আসলে সেটার যদি শক্ত আইনগত ভিত্তি না থাকে, তাহলে তো কোনো সমস্যা হলে গ্রাহকরাই সমস্যায় পড়ে যাবে। তখন বিশাল আস্থার সংকট তৈরি হবে এবং তার প্রভাব পুরো ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ওপর বর্তাবে।

ইরান ইসলামী আর্থিক ব্যবস্থার অন্যতম পথিকৃৎ। ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে শাহ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার মাত্র চার বছর পর ১৯৮৩ সালে ইসলামী বিপ্লবী সরকার সুদমুক্ত ব্যাংকিং আইনটি পাস করে, যা স্থানীয় ব্যাংকগুলিকে শরিয়াহ্ভিত্তিক পণ্যের মাধ্যমে তাদের ব্যবসা পুনর্র্নির্মাণ করতে বাধ্য করেছিল। প্রায় ৪০ বছর সময় ধরে ইরানি ব্যাংকিং শিল্প পুরোপুরি শরিয়াহ্ আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রয়েছে। এটি এখন পর্যন্ত বিশ্বের বৃহত্তম ইসলামি ব্যাংকিংয়ের কেন্দ্র এবং এর অভিজ্ঞতা বিশ্ব ইসলামী সম্প্রদায়ের মধ্যে অনন্য উদাহরণ। অন্যদিকে মালয়েশিয়ায় শরিয়াহ্ভিত্তিক ও কনভেনশনাল দুটি ব্যাংকিং ব্যবস্থাই চালু আছে। শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংক পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে ১৯৮৩ সালে ইসলামি ব্যাংকিং আইন এবং ১৯৮৪ সালে ইসলামী ইন্স্যুরেন্স আইন প্রণয়ন করা হয়। চাহিদা ও সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে ইসলামি ব্যাংকিং আইন পরিমার্জন ও সংশোধন করে ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস নামে নতুন আইন তৈরি করা হয়।

পাকিস্তানে ১৯৮১ সালের ১ জুলাই এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে সব ব্যাংকে সুদবিহীনভাবে লাভ-ক্ষতির ভিত্তিতে আমানত সংগ্রহের নির্দেশ দেয়া হয়। একই সময় ১৯৬২ সালের ব্যাংকিং কোম্পানিজ অর্ডিন্যান্স সংশোধন করে সুদবিহীন সংগৃহীত আমানতকে বিনিয়োগ করার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া ইসলামী আর্থিক ব্যবস্থাকে সুসংগঠিত করার জন্য ১৯৮০ সালেই আরও কিছু আইনকে সংশোধন ও পরিমার্জিত করে যুগোপযোগী করা হয়। অন্যদিকে সৌদি আরবে সৌদি আরাবিয়া মনিটারি এজেন্সি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা পালন করে, যা সে দেশের ১৯৩১ সালের এক রাজকীয় ফরমান বলে গঠিত হয় এবং তা বিভিন্ন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধন করা হয়। সৌদি আরবে সমস্ত ব্যাংকিং কার্যক্রমে শরিয়াহ্ভিত্তিক পরিচালিত হওয়ার নিয়ম থাকলেও কিছু বিচ্যুতি লক্ষ্য করা যায় এবং সেসব বিষয় দেখাশোনা ও আদালতে যাওয়ার আগে সৌদি আরাবিয়া মনিটারি এজেন্সির অধীন ব্যাংকিং ডিসপিউটস সেটেলমেন্ট কমিটি সমাধান করে থাকে।

যুক্তরাজ্যে ইসলামিক ফিন্যান্স পরিচালিত প্রাথমিক আইন ‘ফিন্যান্স অ্যাক্ট ২০০৫’-এর সংশোধিত হিসেবে ‘ফিন্যান্স অ্যাক্ট ২০০৭’ প্রণীত হয়েছে। ‘ফিন্যান্স অ্যাক্ট ২০০৫’ ইসলামিক ফিন্যান্স লেনদেনকে বিকল্প অর্থ ব্যবস্থারূপে চিহ্নিত করে এবং ইসলামী ফিন্যান্স ইন্সট্র–মেন্টগুলো কাজ করার ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত সরল পদ্ধতি গ্রহণ করে প্রচলিত আইনি পরিবেশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো আইনি কাঠামো নেই। তবে ১৯৯৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে খুচরা ইসলামিক ফিন্যান্স সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যখন মুদ্রার নিয়ন্ত্রকের অফিস (ওসিসি) গৃহঋণের জন্য ইজারাহ কাঠামোকে অনুমোদন দিয়েছিল, কারণ এটি প্রচলিত সুরক্ষিত রিয়েল এস্টেট ঋণদানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও কার্যকর।

জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংক চালু হওয়ার এক বছর আগে ‘ইসলামি ব্যাংকিং আইন’ চালু করেছিল থাইল্যান্ড। অথচ বাংলাদেশে প্রায় ৩৮ বছর ধরে ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে এলেও এখন পর্যন্ত এ-সংক্রান্ত আইন চালু করা যায়নি। তবে ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য জারিকৃত ২০০৯ সালের বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইনটি ২০১১ সালে সংশোধন করা হয়। ২০১১ সালে সংসদের অর্থবিষয়ক স্থায়ী কমিটির কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি খসড়া আইন চূড়ান্ত করে জমা দিয়েছিল। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে এখনও তা আলোর মুখ দেখেনি। তবে ২০১৬ সালের ১৬ জুন হোটেল সোনারগাঁওয়ে ইসলামিক ব্যাংকস কনসালটেটিভ ফোরাম (আইবিসিএফ) আয়োজিত ‘ইসলামিক ব্যাংকিং’ শীর্ষক এক সেমিনারে বর্তমান অর্থমন্ত্রী দেশের ইসলামী শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকগুলোর বিকাশের জন্য একটি স্বতন্ত্র ইসলামিক ব্যাংকিং আইন তৈরির আশ্বাস দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, অনেক আগে আইবিসিএফ ইসলামিক ব্যাংকিং আইন করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিল। তবে বিভিন্ন কারণে তা সম্ভব হয়নি। সরকার মালয়েশিয়ার ইসলামিক ব্যাংকিং আইনের আলোকে দেশের ইসলামী শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকগুলোর বিকাশের জন্য ইসলামিক ব্যাংকিং আইন করার চিন্তা করছে।

একেক দেশে ইসলামি ব্যাংকিং একেকভাবে বেড়ে উঠেছে। ইরান, পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় এটি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিকশিত হয়েছে। তারা শুরুতেই আইন করেছে। অথচ একই সময়ে বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং শুরু করলেও আজও আইন করেনি। মালয়েশিয়ার ব্যাংক খাতের মোট ৩০ শতাংশ, আর বাংলাদেশে ২৭ শতাংশ ইসলামি ব্যাংকিং। শরিয়াহ্র কথা হলো, তোমরা ব্যবসা করো, কিন্তু সুদে অর্থ লেনদেন কর না। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে ইসলামি ব্যাংকিংয়ে নিজেদের যুক্ত রেখেছেন। বহু মানুষ শরিয়াহ্র ভিত্তিতে অর্থনৈতিক জীবন চালাতে চান। সে কারণেই এখানে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের প্রসার ঘটছে। মানুষের বিশ্বাস, এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ গ্রাহকই মুসলিম। মালয়েশিয়ায় উল্টো ৭৫ শতাংশ গ্রাহকই অমুসলিম। কারণ তারা দেখেছেন, এখানে স্বচ্ছতা আছে, আস্থা আছে, কিন্তু কোনো অনিয়ম নেই।

মুসলিম দেশগুলোয় ইসলামিক ব্যাংকের ব্যাপক চাহিদা আছে। কোরআনের নিয়ম মেনে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেনদেন করতে চান, তারা সাধারণত ইসলামিক ব্যাংকগুলোতে লেনদেন করেন। ব্যাংকিং করতে গেলে কিছু সুবিধা অসুবিধা সামনে চলে আসে। আইন থাকলে সেগুলো সহজে সমাধান করা যায়। পৃথক আইনের অনুপস্থিতিতে যে ইসলামী ব্যাংকগুলো সুবিধা পেয়েছে এমন নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই তারা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে। প্রতিটি ইসলামী ব্যাংকেই দেশের শীর্ষ উলামা, ইসলামী গবেষক, অর্থনীতিবিদ ও চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে নিজস্ব শরিয়াহ্ সুপারভাইজারি কমিটি রয়েছে, যাদের সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে শরিয়াহর আলোকে ইসলামী ব্যাংকগুলো পরিচালিত হচ্ছে।

আরও দেখুন:
ইসলামী ব্যাংকিং এর ইতিহাস
ইসলামী ব্যাংকিং কি এবং কেন?
ব্যাংকিং এ শরীয়াহ: প্রসঙ্গ বিনিয়োগ

বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ইসলামী ব্যাংকগুলোর সেন্ট্রাল শরিয়াহ্ বোর্ডও এ ক্ষেত্রে কাজ করছে। কিন্তু দেশে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ক্রমবর্ধমান মার্কেট শেয়ার বা বাজার হিস্যা বিবেচনায় পৃথক আইন ও পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা এখন জরুরি। এটি এমন একটি ব্যবস্থা, যা অপ্রচলিত ঋণ হ্রাস করে, ফটকা ব্যবসাকে নিরুৎসাহিত করে এবং সমাজের কল্যাণকে উৎসাহ দেয়, সম্পদ এবং ইক্যুইটিভিত্তিক আর্থিক পরিষেবা সরবরাহ করে। তার পরও ইসলামি ব্যাংকিং দেশে ও বিদেশে আরও টেকসইভাবে পরিচালনার জন্য স্বল্পমেয়াদি অর্থ বাজারের সমর্থনের পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট ইসলামি ব্যাংকিং আইন এখন সময়ের দাবি।

লেখকঃ মো. জিল্লুর রহমান, ব্যাংকার ও ফ্রিল্যান্স লেখক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button