অর্থনীতিবিশেষ কলাম

মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি ও অর্থনীতি

মো. কামরুজ্জামানঃ হঠাৎ করেই জানতে পারলাম বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২২২৭ ডলার থেকে বেড়ে ২৫৫৪ ডলার হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এটা ভালো খবর। একটি দেশের জাতীয় আয় (এক বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের আর্থিক মূল্য) বৃদ্ধি পেলে মাথাপিছু আয় বাড়ে। গত এক দশকে আমাদের দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৩৬৬ ডলার (১৫৮ শতাংশ), যা যেকোনো বিচারে যথেষ্ট ভালো অর্জন।

তবে এবারের হিসাবটা একটু ভিন্ন। হঠাৎ করে ৩২৭ ডলারের এই উল্লম্ফন ঘটেছে মূলত ভিত্তি বছর পরিবর্তনের কারণে। সাধারণত প্রতি দশ বছর পর পর এই ভিত্তি বছর পরিবর্তন হয়। এর আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০০৫-০৬ সালকে ভিত্তি বছর ধরে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছিল ২২২৭ ডলার। এখন নতুন ভিত্তি বছর ২০১৫-১৬ ধরে সেই হিসাব পাঁড়িয়েছে ২৫৫৪ ডলার। সুতরাং অনুমান করা যাচ্ছে, এ পর্যায়ে জাতীয় আয় কেবল গাণিতিকভাবে বেড়েছে, প্রকৃত অর্থে বাড়েনি।

আরও দেখুন:
অর্থ ব্যবস্থাপনার পাঁচ পরামর্শ
ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ জরুরি

মাথাপিছু আয় একটি দেশের উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক (development indicator) হিসেবে বিবেচিত হয়। ২০২০ সালের হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মাথাপিছু আয়ের দেশগুলো হলো লুক্সেমবার্গ (১১৬,৯২১ ডলার), সুইজারল্যান্ড (৮৬,৮৪৯ ডলার), আয়ারল্যান্ড (৮৩,৮৫০ ডলার), নরওয়ে (৬৭,১৭৬ ডলার) এবং যুক্তরাষ্ট্র (৬৩.৪১৬ ডলার)। অন্যদিকে নিম্ন মাথাপিছু আয়ের দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে মোজাম্বিক (৪৫০ ডলার), মালয় (৪০৭ ডলার), সোমালিয়া (৩২৭ ডলার), দক্ষিণ সুদান (২৯৬ ডলার), এবং বুরুন্ডি (২৫৪ ডলার)। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয়ের দেশ মালদ্বীপ (৭৪৫৬ ডলার) আর সবচেয়ে কম মাথাপিছু আয়ের দেশ আফগানিস্তান (৫০৮ ডলার)। বড় খবর হলো, আমরা অনেক আগেই পাকিস্তানকে এবং সম্প্রতি ভারতকে মাথাপিছু আয়ে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

তবে উন্নয়নের পরিমাপক হিসেবে মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা রয়েছে। মাথাপিছু আয় মূলত গড় আয়ের একটি ধারণা দেয়। কোনো দেশের মোট জাতীয় আয়কে সেই দেশের মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে মাথাপিছু আয় পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে দেশের কিছু মানুষের আয় যদি ব্যাপক হারে বাড়ে তবে অন্যদের আয় কমলেও গড় আয় বৃদ্ধি পেতে পারে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে ২০১৮ সালে মিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ছিল (ডলারের হিসেবে) ১৩৩৩৯ জন যা ২০২১ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২১৩৯৯ জন। অর্থাৎ, মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে দেশে মিলিয়নিয়ারের সংখ্যা বেড়েছে ৮০০০। অন্যদিকে দেশে গরিব মানুষের সংখ্যাও কিন্তু বেড়েছে। বিআইডিএসের গবেষণা মতে দারিদ্র্যসীমার নিচের জনসংখ্যা (population below the poverty line) ২০১৯ সালে ২০.৫ % থেকে বেড়ে ২০২১ সালে দাড়িয়েছে ২৫.৮৭%। তার মানে গত দুই বছরে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের গড় আয় না বেড়ে বরং কমেছে। আর এর পেছনে মূল কারণ ছিল দীর্ঘমেয়াদি করোনার ভয়ানক অভিঘাত।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একদিকে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, অন্যদিকে জন্যসংখ্যার বড় একটি অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে, এটা কীভাবে সম্ভব? আসলে এর মানে দাঁড়াচ্ছে, জাতীয় আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষের আয় বৈষম্যও বেড়েছে। অর্থাৎ আয় বৃদ্ধির গুণগত মান বাড়েনি। অন্যভাবে বলা যায়, মাথাপিছু আয় বাড়লেও মানুষের সার্বিক জীবনযাত্রার মান তেমনটি বাড়েনি।

কোনো দেশের আয় বৈষম্য কেমন, তা মাপার সুন্দর একটি ব্যবস্থা রয়েছে, যার নাম গিনি কোয়েফিশিয়েন্ট। গিনি কোয়েফিশিয়েন্টের মান থেকে ১-এর মধ্যে থাকে। এই মান শূন্যের যত কাছাকাছি হবে, তত আয় সমতা (income equality) আর এক এর যত কাছাকাছি হবে তত আয়ের অসমতা (income inequality) নির্দেশ করে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আয় বৈষম্য রয়েছে আফ্রিকান দেশগুলোতে, যেগুলোর মধ্যে আবার নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা সবার শীর্ষে (০.৬৩)। আর সবচেয়ে কম আয় বৈষম্য রয়েছে ইউরোপের দেশগুলোতে। যেমন স্লোভেনিয়া (২৪), চেক রিপাবলিক (০.২৫) স্লোভাকিয়া (০.২৫), বেলারুশ (০.২৫), ইউক্রেন (০.২৬), নরওয়ে (০.২৭) ইত্যাদি।

২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে গিনি সূচকের মান ০.৩২। বাংলাদেশের আয় বৈষম্যের চিত্র চীন, ভারত, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ভালো। একমাত্র মালদ্বীপের অবস্থা আমাদের থেকে ভালো (০.৩১)। তবে বাংলাদেশে গিনি কোয়েফিশিয়েন্টের মান ২০১৬ সালে ০.৩২ থেকে ২০১৮ তে এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ০.৩৯ এবং দীর্ঘমেয়াদি মহামারীর কারণে দারিদ্র্যের হার যেভাবে বেড়েছে, তাতে করে ২০২১-এ এসে এই মান যে আরও বেড়ে গেছে তা নিশ্চিত করে বলা যায়।

তবে, আয় বৃদ্ধির গুণগত মান যাই-ই হোক, দীর্ঘমেয়াদে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির একটা গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, জিডিপি বাড়লে জাতীয় আয় বাড়বে, আর জাতীয় আয় বাড়লে তার সুফল ধীরে ধীরে দেশের সকল স্তরের মানুষের কাছে পৌছে যাবে। অর্থনীতির ভাষায় একে চুইয়ে পড়ার প্রভাব (trickle down effect) বলে। একটি দেশের আর্থ সামাজিক অবকাঠামো যত উন্নত হবে, দেশের সার্বিক জাতীয় আয় বৃদ্ধির প্রভাবে সাধারণ মানুষের তত বেশি উপকার হবে।

পরিশেষে, জাতীয় আয় বাড়লে মানুষের সুখ সমৃদ্ধি বাড়ে কি না, সেটা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। আমেরিকার মানুষ যে সবচেয়ে সুখী মানুষ তা বলার যেমন উপায় নেই, তেমনি মোজাম্বিকের মানুষ যে সবচেয়ে অসুখী, তাও সঠিক নেই। আসল কথা হলো, মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি থেকে সর্বোচ্চ সুফল পেতে হলে সম্পদের সুষম বণ্টন (equal distribution of wealth) নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সামাজিক ও ভৌত অবকাঠামোগুলোর যথাযথ মাত্রায় উন্নয়ন হলে উন্নয়নের সুফল সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। এতে উন্নয়ন যেমন টেকসই হবে তেমনি মানুষের সুখ সমৃদ্ধিও বাড়বে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায়। তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট

লেখকঃ মো. কামরুজ্জামান, ব্যাংকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button