অর্থনীতিইসলামী অর্থনীতি

অর্থনৈতিক লেনদেনে ধোঁকা ও প্রতারণা

অর্থনৈতিক লেনদেনে সুদ বর্জন করা অপরিহার্য। মহান আল্লাহ সুদকে হারাম ঘোষণা করেছেন এবং ব্যবসায়কে বৈধ করেছেন। সুরা আল-বাকারার ২৭৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন: ‘অথচ আল্লাহ বেচাকেনাকে বৈধ করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।’ সুদমুক্ত লেনদেন ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিংয়ের মূল কাজ। সুদের পাশাপাশি লেনদেনকে গারার বা প্রতারণা থেকে মুক্ত রাখতে হবে। কেননা এটিও হারাম।

গারার (ধোঁকা) বা অনিশ্চয়তার উপাদানসমূহ
‘গারার’ বা ধোঁকা বলতে অনিশ্চয়তা বা প্রতারণার উপাদানকে বোঝানো হয়। ধোঁকা হচ্ছে প্রবঞ্চনার উপাদান। বিনিময়ের আবশ্যকীয় উপাদান সম্পর্কে অজ্ঞতাহেতু কোনো এক পক্ষ বা উভয় পক্ষরই প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এটা হতে পারে মালামাল বা মালামালের মূল্য সম্পর্কে অজ্ঞতা অথবা মালের ভুল বিবরণ।

গারার বা ধোঁকার বিক্রয় নিষিদ্ধ হওয়া সম্পর্কে অনেক হাদিস রয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘নবী করিম (সা.) নুড়ি নিক্ষেপের মাধ্যমে বিক্রয় বা অনিশ্চয়তা সম্পৃক্ত বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছেন।’ (মুসলিম, আহমদ ও আবু দাউদ)

আইনজ্ঞগণের মতে, কোনো চুক্তিতে উভয় পক্ষের পূর্ণ সম্মতি ও সন্তোষ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই গারার বা ধোঁকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পরিপূর্ণ সম্মতি ছাড়া কোনো চুক্তি বৈধ হতে পারে না। আর পূর্ণ সম্মতির জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত নিশ্চয়তা ও স্বচ্ছতা, পূর্ণ জ্ঞান ও গোপনীয়তামুক্ত অবস্থা।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

সরাসরি গারারের উদাহরণ হলো, আকাশের পাখি, পানিতে থাকা মাছ, ডুবুরির ধরা জিনিস, মায়ের পেটে থাকা জন্মের জন্য অপেক্ষমাণ বাচ্চা ইত্যাদির বিক্রি করা।

ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন।

আল-বাজি আল-আন্দালুসি বলেন, গারার বিক্রয় বলতে সেই ধরনের বিক্রয়কে বোঝায়, যেখানে ধোঁকা মুখ্য উপাদান হিসেবে বিদ্যমান থাকে। এ ধরনের বিক্রয় সর্বসম্মতভাবে নিষিদ্ধ। গারার দুই ভাগে বিভক্ত। যথা:

গারার ইয়াসির (গৌণ গারার বা ধোঁকা):
গৌণ গারার বা ধোঁকা ক্ষমাযোগ্য এবং তা বিক্রয় চুক্তিকে ত্রুটিপূর্ণ গণ্য করে না। যে ধোঁকা চুক্তির মৌলিক উপাদানের (আরকান) প্রয়োজনীয়তার ওপর যেমন—সম্পদ, মূল্য চুক্তির ভাষা প্রভৃতি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে না সেটি গারার ইয়াসির বা গৌণ ধোঁকা (গারার)।

গারার ফাহিশা (মুখ্য ধোঁকা):
যে ধোঁকার ফলে চুক্তি বাতিল হয়, তাকে মুখ্য ধোঁকা বলে। সাধারণভাবে মুখ্য ধোঁকা হলো—
ক. এমন অনিশ্চয়তা, যা এত গুরুত্বপূর্ণ যে তা অগ্রহণযোগ্য।
খ. এমনই অস্পষ্ট যে তা পরিমাপযোগ্য নয়। এমন ধোঁকার কিছু উদাহরণ নিম্নে উল্লেখ করা হলো—

চুক্তির ক্ষেত্রে ধোঁকা:
এটা এক ধরনের লিখিত চুক্তি, যেখানে ধোঁকার বিদ্যমানতা বোধগম্য এবং তা নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে:

ক. একের মধ্যে দুই বিক্রয়:
একই চুক্তির মধ্যে দুই বিক্রয় হয়, যখন এর মধ্যে একটি সম্পাদনের ক্ষেত্রে বিক্রেতার বক্তব্য—‘আমি বস্তুটি ১০০ টাকায় নগদে বিক্রয় করলাম এবং ১১০ টাকায় এক মাস পর’ এবং ক্রেতা বলল, ‘আমি রাজি’। তবে ক্রেতা কোন প্রস্তাবটি গ্রহণ করলেন তা নির্ধারণ না করেই চুক্তি সম্পন্ন হলো। এখানে গারার বিদ্যমান। কেননা বিক্রয়মূল্য চূড়ান্ত না করেই চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। প্রকৃত বিক্রয়মূল্য ১০০ টাকা নাকি ১১০ টাকা সেটা নিশ্চিত নয়।

খ. স্থগিত বিক্রয় (মুয়াল্লাক):
স্থগিত বিক্রয় হয় অন্য একটি অনিশ্চিত ঘটনার ভিত্তিতে নির্ধারণকৃত শর্তের ওপর। এরূপ বিক্রয়ের একটি উদাহরণ হলো, যখন কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তিকে বলে, আমি তোমার কাছে এই খনিজজাত দ্রব্যসামগ্রী এক হাজার টাকায় বিক্রি করব, যদি মি. অমুক তার বাড়িটি এক লাখ টাকায় আমার কাছে বিক্রি করেন এবং অন্য ব্যক্তি বলেন, ‘আমি রাজি’। বেশির ভাগ আইনজ্ঞের মতে এরূপ চুক্তি অকার্যকর ও বাতিল বলে গণ্য হবে।

চুক্তির উদ্দেশ্যের মধ্যে গারার বা ধোঁকা:
চুক্তির উদ্দেশ্যের মধ্যে গারার বলতে বিনিয়োগকৃত দ্রব্যের ব্যাপার, অর্থাৎ বিক্রয় চুক্তিতে বিক্রীত বস্তু ও সেটার মূল্য সম্পর্কিত কোনো গারার অন্তর্ভুক্ত থাকাকে বোঝায়।

নিম্নে উল্লিখিত অবস্থা ও প্রেক্ষাপটে চুক্তির বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ধোঁকা বিদ্যমান থাকে—
ক. কোনো বস্তুর বিক্রয়ের সময় যখন তা বিদ্যমান থাকে না বা কোনো পক্ষের তা দখলে নেই এবং ভবিষ্যতে দখলের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা রয়েছে। যেমন—উড়ন্ত পাখি বিক্রয়, না ধরা মাছ, ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো বা এখনো জন্ম নেয়নি এমন পশু।
খ. এমন বস্তুর বিক্রয়, যার মালিকানা নির্ধারিত নয় বা অসম্পূর্ণ মালিকানা বিদ্যমান, বা এমন কিছু যা মালিকানা ছাড়া কারো দখলে রয়েছে। বর্ণিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে গারার নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ ঝুঁকি বা অনিশ্চয়তা, যা মাল চুক্তির বিষয়বস্তু সরবরাহ তথা চুক্তি নিষ্পত্তির ব্যাপারে সন্দেহের উদ্রেক করে।

অসম্পূর্ণ ও গলদপূর্ণ তথ্য:
তথ্য ইসলামী বিধান অনুযায়ী সম্পাদিত চুক্তির কেন্দ্রবিন্দু। চুক্তির পক্ষগণকে প্রাসঙ্গিক তথ্য পর্যাপ্ত ও নির্ভুলভাবে প্রদান করতে হবে, যাতে সম্ভাব্য ফলাফল যুক্তিসংগতভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। অপর্যাপ্ত ও গলদপূর্ণ তথ্য ধোঁকা বা গারারের উৎস। প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভূমিকার কারণে যেকোনো পক্ষের তথ্যের অভাব হতে পারে অথবা হতে পারে অনিশ্চিত কোনো অবস্থায় পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে চুক্তি সম্পাদন। উভয় ক্ষেত্রেই এরূপ চুক্তি নিষিদ্ধের পর্যায়ে পড়বে।

জ্ঞানের অভাব জাহল বা অজ্ঞতা হতে পারে মূল্য বা বস্তু সম্পর্কে, মূল্য বা বস্তুর গুণগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে, প্রার্থিত মূল্য বা মালের পরিমাপ সম্পর্কে অথবা ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের মেয়াদ সম্পর্কে।

চুক্তির আবদ্ধ পক্ষগণকে তথ্যের অভাবজনিত ক্ষতি থেকে সুরক্ষা প্রদানের প্রতি ইসলাম গুরুত্ব আরোপ করে। দুর্বল পক্ষকে সুরক্ষা প্রদান সম্পর্কে অনেক হাদিস রয়েছে। এমন হাদিসও আছে, যেখানে তথ্য বঞ্চিত হলে ওই পক্ষ চুক্তি সম্পাদনের পরও তা বাতিলের সুযোগ পায়।

লেখকঃ ড. মুহাম্মাদ মোহন মিয়া, কো-অর্ডিনেটর, ইসলামী ব্যাংকিং কনভারশন প্রজেক্ট, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button