ই-কমার্স ব্যবসায় স্বচ্ছতা ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে
মো. জিল্লুর রহমানঃ সম্প্রতি ইভ্যালিসহ বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিশাল মূল্য হ্রাসের লোভনীয় অফার দিয়ে ভোক্তাদের কাছে সঠিক সময়ে পণ্য পৌঁছাতে দেরি করছিল বলে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা হচ্ছিল। ইভ্যালির লোভনীয় অফারে আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছিল। এর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ইভ্যালির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য একটি পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং বেশ কিছু গুরুতর অনিয়মিত দৃষ্টিগোচর হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় এবং এর আলোকে সম্প্রতি সরকার ই-কমার্স নীতিমালা জারি করে।
মূলত ইন্টারনেটের মাধ্যমে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে ই-কমার্স। অর্থাৎ ই-কমার্স হলো ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি যেমন ব্যক্তিগত কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, মোবাইল ফোন ইত্যাদি ব্যবহার করে ওয়েব ও ইলেক্ট্রনিক ডাটা আদান-প্রদানের মাধ্যমে সকল প্রকারের ভৌত এবং ডিজিটাল পণ্য ও সেবা ক্রয়-বিক্রয় করাকে বোঝায়। এটি মূলত অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনার একটি আধুনিক ডিজিটাল মাধ্যম, যা সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন, ব্যবসায়িক লেনদেন ও যোগাযোগ সহজীকরণ এবং সারাদেশে ব্যাপকহারে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে।
ইলেক্ট্রনিক প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে দেশে ২০০৬ সালে পণ্য বা সেবা ক্রয়-বিক্রয় বেসরকারিভাবে শুরু হয়। তখন অনলাইন বাণিজ্যের সরকারি অনুমোদন ছিল না। প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। পরবর্তী সময়ে ২০১০ সালে সরকার ব্যাংকের ই-কমার্স বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দেশে পুরোপুরিভাবে ই-কমার্স চালু হয়। এরপর থেকে এ খাতকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি।
তবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এই ব্যবসায় তরুণ উদ্যোগতাই বেশি। তরুণ উদ্যোগতা বেশি হওয়ার কারণ এই ব্যবসায় বিনিয়োগ কম, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কম সময়ে বেশি লাভবান হওয়া সম্ভাবনা। অন্যদিকে একটা ই-কমার্স ওয়েবসাইট তৈরি করতে খুব বেশি অর্থও লাগে না। কারণ বর্তমানে অনেক কম খরচে একটি ই-কমার্স ওয়েবসাইট তৈরি করা সম্ভব। বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা অনেক কম খরচে ই-কমার্স ওয়েবসাইট তৈরি করে থাকে। তাই খরচ ও সময় কম ব্যয় হওয়ায় এই ব্যবসার জন্য অনেকই এখন আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
ই-কমার্স ব্যবসার ভবিষ্যৎ আমাদের দেশে খুবই উজ্জল। কারণ বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আমাদেরকে অবশ্যই এ খাতের সমস্যা গুলো দূর করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল পণ্যই এখন অনলাইনের মাধ্যমে ক্রয় করা সম্ভব। অনলাইনের মাধ্যমে প্রতিদিন অনেক পরিমাণে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা আঙ্কটাড ১৩০টি দেশের ই-কমার্স খাত নিয়ে একটি নিরীক্ষা করে, তাতে দেখা যায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা একটি দেশের ই-কমার্স খাতের অবস্থান নির্ণয়ের প্রধান সূচক হিসেবে কাজ করে। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বৃদ্ধির হার ১৪%, তবে বিটিআরসি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী এহার ৩৯%। এতে প্রতীয়মান হচ্ছে দেশে ই-কমার্সের কর্মকান্ড দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি মাসে নতুন নতুন সাইটের আগমন ঘটছে। যদিও এ খাতের বর্তমান অবস্থা এবং ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে খুব একটা গবেষণা পরিচালিত হয়নি। তবে একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ই-কমার্স খাত ধীরে ধীরে উন্নতি করছে এবং এখাতে লেনদেন প্রতিবছর কমপক্ষে ১০% বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তবে ই-কমার্সের সংগঠন ই-ক্যাবের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ই-কমার্স বাড়ছে খুবই দ্রুত গতিতে। গত তিন বছর ধরে এই খাতের প্রবৃদ্ধি প্রায় ১০০ ভাগ। অর্থাৎ প্রতি বছর প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে এই খাত। বাংলাদেশে ই-কমার্সের এক নম্বর জায়গাটি চীনের আলিবাবার দখলে। বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আমাজনও। আমাদের দেশে ই-কমার্সের ক্রেতারা মূলত শহরকেন্দ্রিক। তন্মধ্যে ৮০% ক্রেতা ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের এবং এদের মধ্যে ৩৫% ঢাকার, ৩৯% চট্টগ্রামের এবং ১৫% গাজীপুরের অধিবাসী। অন্য দু’টি শহর হলো ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ এবং আরেকটি মেট্রোপলিটান শহর সিলেট। ৭৫% ই-কমার্স ব্যবহারকারীর বয়স ১৮-৩৪-এর মধ্যে।
এছাড়া, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজার উদ্যোক্তা ফেসবুক পেইজে ব্যবসা করছেন। তাদের মধ্যে ২০ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা সক্রিয়। সর্বশেষ তথ্যমতে- ২০১৯ সালে বাংলাদেশের ই-কমার্সের বাজার দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা চলতি বছর বেড়ে ২ হাজার ৭৭ মিলিয়ন ডলার হবে এবং আগামী ২০২৩ সালে বাজারের আকার হবে ৩ হাজার ৭৭ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে প্রায় ৭ হাজার ৫০০ প্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ই-কমার্সের সঙ্গে যুক্ত।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সারাদেশে যেহেতু ই-কমার্স এখনও পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তাই না চাইলেও কেনাকাটা করতে বাধ্য হয়ে ক্রেতাদের বাজারমুখী হতে হচ্ছে। তবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিল পরিশোধের ব্যাপার পুরোপুরিভাবে অনলাইনভিত্তিক হয়ে গেছে। যেমন বিদ্যুৎ, গ্যাসের বিল, সারাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের চাকরির বেতন ইত্যাদি পরিশোধ করা যাচ্ছে সম্পূর্ণ মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে। এতে করে মানুষের ভোগান্তি অনেক কমে গেছে এবং সেই সাথে মূল্যবান সময়ও নষ্ট হচ্ছে না। তাই অনেকেই ই-কমার্সের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
উন্নত দেশগুলোর সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার অংশ হয়ে উঠেছে ই-কমার্স ;তবে বাংলাদেশে ই-কমার্সের সম্ভাবনা কতোটা? তেমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে কেউ কেউ সংশয় করলেও প্রকৃত বাস্তবতা হলো, এদেশে ই-কমার্সের সম্ভাবনা অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত। আর তাতে নতুন মাত্রা আনয়ন করছে, করোনা ভাইরাস। এই ভাইরাস যে সারাবিশ্বের অর্থনীতিতে খুব খারাপ একটা প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে বা ফেলে দিয়েছে, এ বিষয়ে আমাদের কোন সন্দেহ নেই। তবে এর বিকল্প ভাল সমাধান হচ্ছে ই-কমার্সের বিকাশ ও প্রসার।
বতর্মানে দেশে যে ই-কমার্স সাইটগুলো রয়েছে, তাদের সবগুলোই বিশ্বস্ত নয়। কিছু প্রতিষ্ঠান সঠিক পণ্য, সঠিক সময়ে সরবরাহ, সঠিক দাম নিশ্চিত করে না ফলে ক্রেতারা প্রতারিত-বিড়ম্বিত হন বলে অভিযোগ উঠেছিল। এ কারণে ই-কমার্স ব্যবসা সুন্দর ও সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য ৪ জুলাই ২০২১ ডিজিটাল কমার্স ব্যবসা পরিচালনা নির্দেশিকা শিরোনামে একটি নির্দেশিকা জারি করেছে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ই-কমার্স ভিত্তিক অনলাইন কেনাকাটায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত ও গ্রাহক প্রতারণা এড়াতে ভোক্তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এ নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। উক্ত নীতিমালায় বলা হয়েছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে পণ্যের মজুদ আগে ঘোষণা করতে হবে এবং মজুদ থাকা সাপেক্ষে কেবলমাত্র পণ্য বিক্রির অগ্রীম অর্ডার নেয়া যাবে।
এছাড়া, কোনো পণ্যের অর্ডার নিলে গ্রাহক একই শহরের হলে পাঁচ দিন এবং ভিন্ন শহরের হলে পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে ডেলিভারি নিশ্চিত করার বিধান রাখা হয়েছে। পণ্য ডেলিভারির আগে বিক্রয়কারি টাকা পাবেন না, বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করতে হবে। নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে অনলাইন পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো বিক্রয়কারি প্রতিষ্ঠানের লটারি করার সুযোগ থাকবে না। সব ধরনের ডিজিটাল ওয়ালেট, গিফট কার্ড, ক্যাশ ভাউচার বা অন্য কোনো মাধ্যম, যা অর্থের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হবে, সেই সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে ব্যবসা করতে হবে। তাছাড়া, ই-কমার্স নীতিমালা ২০২১ এ ডিজিটাল কমার্সের মাধ্যমে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা নেটওয়ার্ক ব্যবসা পরিচালনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমে নেশাসামগ্রী, বিস্ফোরক দ্রব্য বা অন্য কোনো নিষিদ্ধ সামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে না। ডিজিটাল মাধ্যমে ওষুধ ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে।
একই সাথে ই-কমার্সের বিষয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিমালার আলোকে অনলাইনে কেনাকাটা বা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য মূল্য ও সেবা মাসুল পরিশোধের বিষয়ে সংশোধিত নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং তা সংশ্লিষ্ট সকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে মেনে চলার নির্দেশনা প্রদান করেছে।
আসলে ক্রমবিকাশমান বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার কারণে ই-কমার্সের মাধ্যমে কেনাকাটা করার জনপ্রিয়তা সারা বিশ্বেই দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। ঘরে বসে মাত্র কয়েক ক্লিকের মাধ্যমে পণ্য কেনার মজাই আলাদা। সময়ের সাথে সাথে যেমন মানুষের চাহিদার পরিবর্তন ঘটেছে তেমনি পরিবর্তন ঘটেছে বাজার চাহিদারও। বর্তমানে সরাসরি বাজারে না গিয়েই মানুষ অনলাইন মার্কেট থেকে পণ্য ক্রয় করছে। বাংলাদেশে আস্থার সংকটের কারণে অনলাইন থেকে পণ্য ক্রয় করার বিষয়টি এখনও পুরোপুরি চালু হয়নি। বাংলাদেশে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা এই সেবা চালু করেছে এবং নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান চাহিদার তুলনায় খুব কম। তাছাড়া, ভোক্তাদের কাছে তাদের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ ও অভিযোগ আছে। বর্তমান ই-কমার্স নীতিমালার আলোকে এ ব্যবসার প্রসার ও বিকাশের জন্য স্বচ্ছতা ও আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি।
লেখকঃ মো. জিল্লুর রহমান, ব্যাংকার ও কলামিস্ট।