ডিজিটাল মুদ্রার আগমন ও ভবিষ্যতের আর্থিক খাত
ড. মিরাজ আহমেদঃ চারদিকে যখন এত এত ডিজিটাল রব রব, তাহলে টাকা কী দোষ করল? একটা সময় ছিল পণ্য বিনিময় প্রথা আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনের আবহে এল বর্তমান প্রচলিত টাকার নোট! সেই টাকার নোট বদলে এখন আবার এল ডিজিটাল টাকা! আসুন কিছুটা ধারণা লাভ করি কী এই ডিজিটাল টাকা!
ডিজিটাল টাকার আগে একটু ভেবে নিই বর্তমান প্রচলিত নোট ব্যবস্থায় কী কী সমস্যা বিদ্যমান? কিছু সমস্যা তো আছেই। যেমন অনেক বছর ব্যবহার হলে পুরনো হয়ে ছিঁড়ে যায়, হারিয়ে গেলে বা পানিতে ভিজে, আগুনে পুড়ে নষ্ট হলে আর কাজে লাগে না। চুরি-ডাকাতি ছিনতাইয়ের ভয় তো আছেই! আবার টাকা প্রিন্ট করা যেমন পরিবেশবান্ধব নয়, আবার অনেক সময়সাপেক্ষ আর জনবলেরও প্রয়োজন! সরকার যদি মার্কেটে আরো টাকা আনতে চায় কিংবা টাকা উঠিয়ে ফেলতে চায়, সেটাও অনেক সময়সাপেক্ষ আর জটিল ব্যাপার (ভারতের মোদির ক্ষেত্রে যেমন হয়েছিল)। আবার বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে এসব নোট টাকার ব্যবহারও কিছুটা ঝামেলার! এ সবকিছুর সীমাবদ্ধতা অনেকাংশে কমিয়ে দেবে এ ডিজিটাল টাকার ব্যবহার! যেহেতু সর্বপ্রথম চীনে এ ব্যবস্থা চালু হলো, তাই আমরা এখানে চীনের ডিজিটাল ইউয়ান (চীনের মুদ্রা) নিয়েই আলোচনা করব!
ডিজিটাল ইউয়ান (চীনের মুদ্রার নাম ইউয়ান বা আরএমবি) হলো এক কথায় চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বর্তমান প্রচলিত ক্যাশ টাকা বদলে ডিজিটাল টাকায় রূপান্তর! সহজ ভাষায়, বর্তমান নোট টাকার মতো কেনাকাটা, লেনদেন, অদলবদল সবকিছুই করা যাবে কিন্তু ছোঁয়া যাবে না! অনেকেই হয়তো জানেন, প্রযুক্তির এ যুগে এমনিতেই বর্তমানে চীনে প্রিন্ট টাকার ব্যবহার অনেক কম! টাকার নোটের ব্যবহার এতটাই কম যে আপনার হাতে যদি একটি স্মার্টফোন থাকে তাহলে দিন, সপ্তাহ, মাস চালানোর জন্য ব্যাংক কিংবা এটিএম বুথে যাওয়া লাগে না! উইচ্যাট ও আলিপে নামে দুটি অ্যাপস দিয়ে বেশির ভাগ মানুষ প্রায় সব ধরনের লেনদেন করে! ২ টাকার বাস ভাড়া থেকে শুরু করে ১০ লাখ টাকার গাড়ি পর্যন্ত কিনতে পারবেন এ দুটি অ্যাপসের মাধ্যমে যদি আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যুক্ত করা থাকে। প্রশ্ন হলো, বর্তমানে যদি মানুষ নোট টাকা ব্যবহার না করে তাহলে আবার ডিজিটাল টাকার কী দরকার?
আরও দেখুন:
◾ ফিনটেক কী এবং কেন?
◾ ফিনটেক এবং ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যৎ
◾ আগামীর ডিজিটাল ব্যাংকিং কেমন হবে
◾ আধুনিক ব্যাংকিং ও ভবিষ্যৎ চাহিদা
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
প্রথম কারণ হলো, ‘নিয়ন্ত্রণ’। প্রথমেই ধারণা করা যায়, বর্তমান ব্যবস্থায় অনেক নামে-বেনামে টাকা-পয়সার লেনদেন হয়; কিন্তু ডিজিটাল সিস্টেমে আইনসিদ্ধ না হলে সেসব লেনদেন সহজেই চিহ্নিত করা যাবে! দ্বিতীয়ত, আলিপে আর উইচ্যাট দুটিই ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, সেখানে সরকার হয়তো প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা না-ও করতে পারে। আরো অনেক সুবিধার মধ্যে আছে যেমন যখন খুশি তখন সরকার দেশের বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়াতে কিংবা কমাতে পারবে। আবার আরেকটি বড় সুবিধা হলো, যারা খুব হতদরিদ্র, দুর্গম এলাকায় থাকে, যেখানে ব্যাংক সুবিধা নেই, প্রতিবন্ধী কিংবা চলাফেরায় অক্ষম—এ জনগোষ্ঠীকে অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার এক বিশাল সুযোগ।
এদিকে কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ ধারণা করেন, চীন তাদের নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ান বা ‘আরএমবি’-কে আন্তর্জাতিককরণ করতে যাচ্ছে। বর্তমানে চীন তার বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক ব্যবসা (আমদানি-রফতানি) আমেরিকান ডলারের মাধ্যমে করে। ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে চীন তার ব্যবসায়িক সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে নিজস্ব মুদ্রায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করার যে চিন্তাভাবনা করছে, অনেকেই মনে করছেন যে সে পথে এগোনোর জন্য এ ডিজিটাল টাকার আগমন একটি বিশাল পদক্ষেপ। যদিও চীন সরকারের এখনই ডিজিটাল মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক করার প্রতি খুব বেশি আগ্রহ নেই। আপাতত তার মনোযোগ হচ্ছে দেশীয় বাজারে দেশীয় ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থা চালুকরণ।
কীভাবে কাজ করবে এ ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থা?
এসব নিয়ে কৌতূহলী সবার মনে দুটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—
১. কীভাবে সরকার এ ডিজিটাল টাকার বণ্টন করবে;
২. মানুষই-বা কীভাবে সেটা খরচ কিংবা ব্যবহার করবে?
চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, বণ্টন ব্যবস্থা দুটি স্তরে হতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রথমে কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলোকে টাকা দেবে, তারপর কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলো সেই টাকা তাদের কাস্টমার কিংবা জনগণের হাতে তুলে দেবে। কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলো তাদের নিজস্ব অ্যাপসের মাধ্যমে কিংবা তাদের নিজস্ব কোনো পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে সে টাকা জনগণের কাছে পৌঁছে দেবে। যদিও এটা এখনো খুব স্পষ্ট নয় জনগণ কীভাবে এসব টাকা ব্যবহার করবে, তবে ধারণা করা হচ্ছে কুইক রেসপন্স বা কিউআর কোডের সাহায্যে মানুষ যেকোনো পেমেন্ট বা কোনো লেনদেন করতে পারবে। যদি কোনো গ্রাহকের কোনো ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট না থাকে? সেক্ষেত্রে ধারণা করা হচ্ছে তার মোবাইল নাম্বারের সাহায্যে একটি ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট থাকবে (কিছুটা আমাদের বিকাশ, নগদের মতো), সেই ডিজিটাল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে যে কেউ যেকোনো লেনদেন সম্পন্ন করতে পারবে। ব্যাপারটা চীনের অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছুটা সহজ হলেও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ব্যবহারের সময় আরো অনেক জটিলতার মুখোমুখি হতে হবে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
ডিজিটাল টাকা কি বিটকয়েনের মতো হবে?
না, ডিজিটাল টাকা বিটকয়েনের মতো কিংবা অন্য যেসব ক্রিপ্টোকারেন্সি রয়েছে, সেগুলোর মতো হবে না। এর প্রধান কারণ হলো লিগ্যাল স্ট্যাটাস কিংবা আইনসিদ্ধতা। অনেক দেশে বিটকয়েন কিংবা অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সির বৈধতা নেই (বাংলাদেশেও অবৈধ)। উপরন্তু, ডিজিটাল টাকার ব্যবহার, লেনদেনের ক্ষেত্রে একটি সেন্ট্রাল অথরিটি থাকবে বা গভর্নিং বডি (সেন্ট্রাল ব্যাংক) থাকবে, যেটা বিটকয়েনের ক্ষেত্রে আমরা দেখি না। এদিক থেকে বিবেচনা করলে ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েন থেকে অনেকটাই নিরাপদ। মুদ্রাস্ফীতি কিংবা অন্য যেকোনো কারণে ডিজিটাল টাকার ব্যবহার সীমিত কিংবা বর্ধিত করা যাবে, বিটকয়েনের ক্ষেত্রে কিন্তু সে সুযোগ নেই। আবার বিটকয়েন হলো ব্লকচেইন টেকনোলজির ওপর ভিত্তি করে নির্মিত, কিন্তু ডিজিটাল টাকার ভিতটা এখনো খুব পরিষ্কার নয়।
বাস্তবতা কী বলে?
ডিজিটাল টাকার আগমন আসলে কতটা বাস্তব—এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি পাওয়া যায়। অনেকেই ধারণা করছেন, এ ব্যবস্থায় জনগণের সার্বিক লেনদেনের প্রতি সরকারের নজরদারি কিংবা ক্ষমতা আরো অনেক বেড়ে যাবে। সেক্ষেত্রে অনেক বড় বড় বিদেশী বিনিয়োগকারী হয়তো অস্বস্তিতে পড়বেন এবং বিনিয়োগ কমিয়ে দেবেন। আমাদের দেশে যেমন এখন কালো টাকা সাদা করে অর্থনীতিতে অবদানের সুযোগ আছে, এমনটা হয়তো আর থাকবে না। শুধু বিদেশী বিনিয়োগকারীরা নন, এমনকি দেশের জনগণও তাদের বিলাসী জীবন এমনকি দৈনন্দিন খরচ অনেকটা কাটছাঁট করে ফেলবে। এতে দেশের অর্থনীতির ওপর একটা প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে। এদিক বিবেচনা করলে কিছুটা ব্যাকফুটে এ ডিজিটাল ব্যবস্থা।
এ অবস্থায় চীন কিন্তু পরীক্ষামূলকভাবে এ ডিজিটাল টাকার ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। গত বছর এপ্রিলে সরকার চারটি বড় শহরে কয়েক মিলিয়ন টাকা জনগণের মাঝে ফ্রি বিতরণ করে। অনেকেই সেই টাকা মোবাইলের সাহায্যে গ্রহণ করে এবং লেনদেনও করে। অন্যদিকে আবার এ ডিজিটাল টাকার আন্তর্জাতিকীকরণও অনেক অনেক দূরের পথ। বর্তমানে মাত্র ৪ শতাংশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয় ইউয়ান দিয়ে। যদিও রাশিয়া, ইরান, ভেনিজুয়েলা, কিউবা ইত্যাদি দেশ পাশ্চাত্যের পেমেন্ট গেটওয়ে ডলার বাদ দিয়ে চীনের সঙ্গে এই ইউয়ান দিয়ে বাণিজ্য শুরু করেছে। আরো অনেক জটিল সমীকরণের মাঝে বর্তমান ডিজিটাল টাকার বাস্তবতা নিহিত। চোখ বন্ধ করে যেমন অনেকেই সেটা গ্রহণ করতে পারছে না, আবার সরকারও এটার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব আশাবাদী। আপাতত এটাই বাস্তবতা।
লেখকঃ ড. মিরাজ আহমেদ, সহযোগী অধ্যাপক, গুয়াংডং ইউনিভার্সিটি অব ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিকস।