ব্যষ্টিক অর্থনীতি ও সামষ্টিক অর্থনীতির পার্থক্যসমূহ
ব্যষ্টিক অর্থনীতি ও সামষ্টিক অর্থনীতির পার্থক্যসমূহ – ব্যক্তি ও সমাজ জীবন কিভাবে তাদের অসীম অভাবকে সসীম সম্পদ দ্বারা পূরণের প্রচেষ্টা চালায় এ নিয়ে যে বিষয়টি আলোচনা করে তা হলো অর্থনীতি। আধুনিক অর্থশাস্ত্রের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হচ্ছে ব্যষ্টিক অর্থনীতি ও সামষ্টিক অর্থনীতি। সংজ্ঞা ও বিষয়বস্তু এবং বিশ্লেষণ পদ্ধতির দিক হতে বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতির মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে।
ব্যষ্টিক ও সমষ্টিক অর্থনীতির পার্থক্য (Difference between Micro and Macro economics):
অর্থনৈতিক বিষয়গুলো ব্যষ্টিক (Micro) এবং সমষ্টিক (Macro) এ দুটি ধারায় প্রবাহিত। ব্যষ্টিক ও সমষ্টিক অর্থনীতি সমান্তরাল ধারায় প্রবাহিত। ব্যষ্টিক ও সমষ্টিক অর্থনীতি একে অন্যের সহযোগী হিসাবে পরিগণিত। অর্থনীতির প্রতিটি বিশেষ অংশের পৃথক আলোচনা ব্যষ্টিক অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তের অর্থনীতির সামগ্রিক ক্রিয়া সমষ্টিক অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত। নিম্নে ব্যষ্টিক অর্থনীতি এবং সামষ্টিক অর্থনীতির পার্থক্য আলোচনা করা হলো-
আরও দেখুন:
◾ সামষ্টিক অর্থনীতি বলতে কী বোঝায়?
১) সংজ্ঞাগত পার্থক্য (Definitional difference):
ব্যষ্টিক অর্থনীতি ও সমষ্টিক অর্থনীতির মধ্যে সংজ্ঞাগত পার্থক্য রয়েছে। ব্যষ্টিক বা Micro শব্দের অর্থ হল ক্ষুদ্র। ব্যষ্টিক অর্থনীতি বিস্তৃত ক্ষেত্রের খন্ডখন্ড অংশ নিয়ে আলোচনা করে। অপরদিকে, সমষ্টিক বা Macro শব্দের অর্থ হল বৃহৎ বা বিশাল, যা অর্থনীতির বিস্তৃত বা বিশাল ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করে।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
২) বিষয়বস্তু ভিত্তিক পার্থক্য (Differences based on content):
ব্যষ্টিক অর্থনীতি অর্থব্যবস্থার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে আলোচনা করে। এ কারণে ব্যষ্টিক অর্থনীতির পরিধি বা বিষয়বস্তু ক্ষুদ্র ও আংশিক। কিন্তু সামষ্টিক অর্থনীতিতে অর্থব্যবস্থার সামগ্রিক দিক নিয়ে। আলোচনা করা হয়। ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির পরিধি বা বিষয়বস্তু অপেক্ষাকৃত ব্যাপক ও বিস্তৃত।
৩) ব্যক্তি একক ও সামগ্রিক প্রেক্ষিত (Individual unit and total observed):
ব্যষ্টিক অর্থনীতি ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক এককের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক পর্যালোচনা স্থান পায়। যেমন-একজন ভোক্তার সর্বোচ্চ উপযোগ প্রাপ্তি, একটি ফার্মের সর্বোচ্চ ও দাম নির্ধারণী বিষয় ইত্যাদি একক আলোচনা ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে আলোচিত হয়। পক্ষান্তরে, সামষ্টিক অর্থনীতিতে একটি দেশের মোট আয়, নিয়োগ, বিনিয়োগ, সঞ্চয় ও সামগ্রিক দামস্তরের আলোচনা স্থান পায়।
৪) স্থির চলক ও পরিবর্তনযোগ্য চলক (Constant and changeable variables):
ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতির বিষয়গুলো চলক হিসাবেও বিবেচিত হয়। সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে চলক স্থির, তা ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে পরিবর্তনযোগ্য চলক হিসাবে গণ্য হয়। পক্ষান্তরে, ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে যে চলক স্থির তা সামষ্টিক অর্থনীতিতে পরিবর্তনযোগ্য চলক হিসাবে পরিগণিত হয়। তাই ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে যখন মোট উৎপাদন, আয়, নিয়োগ ও দামস্তর নিয়ে আলোচনা করা হয়, তখন ব্যষ্টিক উপাদান হিসাবে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আয়ের বণ্টন স্থির ধরা হয়। অন্যদিকে, ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে যখন আলোচিত হয় তখন সামষ্টিক উপাদান মোট উৎপাদন, আয়, বিনিয়োগ ইত্যাদি স্থির ধরা হয়।
৫) পদ্ধতিগত পার্থক্য (Systematic differences):
সাধারণত ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে ধরে নেওয়া হয় মোট উপাদান এবং সাধারণ মূল্য স্তর প্রদত্ত। এর ভিত্তিতে কোন পণ্যের উৎপাদন ও মূল্য কিভাবে নির্ধারিত হয়, তা ব্যষ্টিক অর্থনীতি ব্যাখ্যা করে। অন্যদিকে সামষ্টিক অর্থনীতিতে দ্রব্যের কটন ও আপেক্ষিক মূল্য স্থির ধরা হয়। এক্ষেত্রে মোট উৎপাদন ও সাধারণ মূল্যকে চলক হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এদের নির্ধারণ ব্যাখ্যা করা হয়।
৬) “আংশিক ভারসাম্য” এবং “প্রায়-সামগ্রিক ভারসাম্য” (“Partial Equilibrium” and “quasi general equilibrium”):
ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে আংশিক ভারসাম্য বিশ্লেষণ অধিক ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের অর্থনীতিতে ব্যক্তি, ফার্ম বা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকান্ড ব্যাখ্যার জন্য আংশিক ভারসাম্য পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পক্ষান্তরে, সামষ্টিক অর্থনীতিতে আপাতদৃষ্টে সামগ্রিক ভারসাম্য ব্যবহৃত হয় বলে অনুমান করা হলেও প্রকৃতপক্ষে সামষ্টিক অর্থনীতিতে প্রায় সামগ্রিক ভারসাম্য ব্যবহৃত হয়।
৭) অনুমানগত দিক (Assumptional-side):
কোনো কোনো বিষয় সামষ্টিক অর্থনীতিতে আলোচনা করার সময় ব্যষ্টিক আলোচনায় ন্যায় পূর্বে নির্ধারিত আছে বলে অনুমান করা হয়। পক্ষান্তরে, কোনো কোনো বিষয় ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে আলোচনা করার সময় সামষ্টিক আলোচনায় পূর্বে নির্ধারিত আছে বলে অনুমান করা হয়। উদাহরণস্বরূপ মূল্যের কথা বলা যায়। ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে আপেক্ষিক মূল্য কিভাবে নির্ধারণ করা যায় তার সমাধানে সামগ্রিক মূল্য ‘Overall price’ প্রদত্ত বলে ধরে নেয়া হয়। অন্যদিকে সামষ্টিক অর্থনীতিতে যখন সামগ্রিক মূল্য নির্ধারণের বিষয় বিবেচনা করা হয়, তখন আপেক্ষিক মূল্য দেয়া আছে বলে ধরে নেয়া হয়।
৮) বিভিন্ন অংশের সম্পর্ক (Relationship of different parts):
ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক ঘটনাসমূহ পৃথক পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করা হয় বলে তাদের মধ্যে কোন যোগসূত্র থাকে না। কিন্তু সামষ্টিক অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক ঘটনাসমূহ সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। এ কারণে সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিভিন্ন বিষয় পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
৯) বাজারগত সম্পর্ক (Market Relation):
ব্যষ্টিক অর্থনীতি একটি বাজার সম্পর্কে আলোচনা করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক বাজারের সাথে অন্য বাজারের সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা করে। কিন্তু সামষ্টিক অর্থনীতিতে নির্দিষ্ট কোনো বাজারের সাথে সামগ্রিক অর্থনীতির সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে।
১০) অর্থনীতির চিত্র (Figure of economy):
ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে অর্থব্যবস্থার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ আলোচনা করা হয়। ফলে ব্যষ্টিক অর্থনীতির আলোচনায় দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আংশিক বা খণ্ড চিত্র পাওয়া যায়। অন্যদিকে সামষ্টিক অর্থনীতিতে অর্থব্যবস্থার সামগ্রিক বিশ্লেষণ করা হয়। সুতরাং সামষ্টিক অর্থনীতির আলোচনায় দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়।
আরও দেখুন:
◾ ব্যষ্টিক অর্থনীতি বলতে কী বোঝায়?
উপরোক্ত আলোচনা আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বিশ্লেষণ পদ্ধতি ও বিষয়বস্তুর দৃষ্টিকোণ হতে বিচার করলে ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। তবে ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতির মধ্যে কোন মৌলিক বিরোধ নেই। অর্থনীতিবিদ পল এ স্যামুয়েলসনের মতে, “সত্যিকার অর্থে ব্যাষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতির মধ্যে কোন বিরোধ নেই। উভয়ই একান্তভাবে অপরিহার্য।” সুতরাং বলা যায়, ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতি পরস্পরের প্রতিযোগী নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক।