ইসলামী অর্থনীতিতে ঋণ ব্যবস্থাপনা
ড. এম কবির হাসান ও মুফতি আব্দুল্লাহ মাসুমঃ প্রাথমিক কথা, ইসলাম মানুষের জীবনের সব সমস্যার সঠিক সমাধান ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে এসেছে। ইসলাম ছাড়া এ কল্যাণের দাবি ও তার সত্যতার দৃষ্টান্ত আর কোথাও নেই। সামগ্রিক ইসলামী জীবন ব্যবস্থার অন্যতম একটি বিভাগ হলো অর্থনীতি। জীবনের সব অঙ্গনে ইসলাম পরিপালন করা আবশ্যক। সে হিসেবে অর্থনীতিকেও ইসলাম থেকে বাইরে এসে চর্চা করার সুযোগ নেই।
আধুনিক অর্থনীতির চালিকাশক্তি হলো ব্যাংক ব্যবস্থা। কিন্তু এ ব্যাংক ব্যবস্থা সুদের মতো অভিশপ্ত অক্টোপাস দ্বারা আজ বেষ্টিত। যার ফলাফল প্রকাশ পাচ্ছে খেলাপি ঋণসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্য দিয়ে। এ প্রবন্ধে তাই আমরা আলোচনা করার প্রয়াস পেয়েছি, খেলাপি ঋণ সমস্যার প্রকৃত কারণ ও উত্তরণের উপায় নিয়ে। এরই মধ্যে নানা মহলে চলমান খেলাপি ঋণ থেকে উত্তরণের নানা উপায় ও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তবে আমাদের দৃষ্টিতে এসব পরামর্শ কেবল সাময়িক পেইন কিলার তুল্য। সমস্যার মূল সমাধান নয়।
বক্ষ্যমাণ গবেষণায় সমস্যার গভীরে দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। গবেষণায় এ সমস্যার মূলত তিনটি মৌলিক কারণ উদ্ঘাটন করা হয়েছে। যথা ক্রোনি ক্যাপিটালিজম, সুদ ও ঋণভিত্তিক অর্থনীতি। এরপর ইসলামী অর্থনীতির আলোকে এর সমাধান দেয়া হয়েছে। সুদকে পুরোপুরি বর্জন করা, ঋণভিত্তিক বিনিয়োগ পদ্ধতি থেকে বের হয়ে প্রকৃত ইকুইটিভিত্তিক বিনিয়োগচর্চায় অগ্রসর হওয়া—এ দুটির মাধ্যমেই মূলত সিংহভাগ ক্রোনি ক্যাপিটালিজম দূরীভূত হবে বলে আশা করি। পাশাপাশি চলমান ঘটে যাওয়া খেলাপি ঋণ থেকে উদ্ধারের জন্যও ‘ইসলামী অর্থনীতির ঋণ ব্যবস্থাপনা নীতির’ আলোকে স্পষ্ট সমাধান দেয়া হয়েছে। গবেষণায় খেলাপি ঋণ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যু তথা প্রভিশন, অবলোপন ইত্যাদির শরিয়াহ বিশ্লেষণও স্থান পেয়েছে, যা এ বিষয়ে একটি মাইলফলক রচনা করবে।
ইসলামী অর্থনীতির আলোকে খেলাপি ঋণ সমস্যার সমাধান বিষয়ে বাংলা ভাষায় এটিই প্রথম গবেষণা। আশা করি, প্রবন্ধটি খেলাপি ঋণ সম্পর্কে মৌলিক ধারণার পাশাপাশি শরিয়াহর আলোকে খেলাপি ঋণ মোকাবেলার স্থায়ী ও টেকসই পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক পথ দেখাবে ইনশা আল্লাহ। উল্লেখ্য, মূল গবেষণাটি ১০০ পৃষ্ঠার অধিক। পত্রিকার কলেবর বিবেচনা করে গবেষণার চম্বুকাংশ তুলে ধরা হলো। আজ প্রকাশ হলো এর প্রথম পর্ব।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
খেলাপি ঋণ ও সুদভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা
প্রচলিত খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতে এক বিষফোঁড়ায় রূপ নিয়েছে। এক দশক ধরে এ ফোঁড়া বিকট আকার ধারণ করে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন পত্রিকায় এ নিয়ে নানা লেখালেখি হচ্ছে। পর্যালোচনা হচ্ছে। খেলাপি ঋণ সৃষ্টির পেছনে কী কারণ ও উত্তরণের উপায় কী তাও আলোচনায় আসছে। কিছুদিন আগে একটি বেসরকারি সংস্থা তাদের গবেষণায় এর থেকে উত্তরণের নানা উপায়ও বাতলে দিয়েছে।
কিন্তু টেকসই ও স্থায়ী সমাধানের কথা কমই আলোচনা হচ্ছে। প্রচলিত খেলাপি ঋণ সৃষ্টির পেছনে মৌলিক কারণ ‘সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থা’। সুদ খেলাপি ঋণ তৈরির ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। এ পদ্ধতিতে ব্যাংক একটা পর্যায়ে অসহায় হয়ে পড়ে। তার কিছুই করার থাকে না।
সুদভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের সবচেয়ে বড় ভারসাম্যহীনতা হলো ব্যাংক সুদভিত্তিক ঋণ প্রদান করে সবসময় তার সুদসহ মূলের প্রাপ্তি চায়। ঋণগ্রহীতার অবস্থা ভালো, না খারাপ তা ব্যাংকের দেখার বিষয় নয়। মূল ব্যবসায় ব্যাংকের কোনো দখল থাকে না। কখনো এমন হয়, ঋণগ্রহীতা ঋণের অপব্যবহার করে, এতেও ব্যাংকের কিছু করার থাকে না।
এর ওপর আছে চড়া সুদ। সব মিলিয়ে ব্যাংকের প্রতি ঋণগ্রহীতা আগ্রাসী হয়ে ওঠে। মূলত এখান থেকেই খেলাপি হওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়। অন্যদিকে ঋণগ্রহীতা ব্যবসায় ভালো করলেও সে তার নির্ধারিত অংশই সুদ হিসেবে শোধ করছে। ব্যাংক এবং প্রকারান্তরে মূল পুঁজিদাতারা বঞ্চিত হয় বর্ধিত মুনাফা থেকে।
ভারসাম্যহীনতার গল্প এখানেই শেষ নয়; ঋণগ্রহীতা সুদ হিসেবে যা ব্যাংকে প্রদান করে, সেটি সাধারণ ভোক্তা থেকে মূল্য বাবদ উসুল করে নেয়। দিন শেষে, পুঁজিদাতা ব্যাংক থেকে যে সুদ লাভ করে, কখনো পণ্য ও সেবা ক্রয় বাবদ এর অধিক আদায় করতে হয়।
এর বিপরীতে আমরা যদি ইসলামী বিনিয়োগভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে তুলি, তাহলে এতে উপরোক্ত সমস্যা তৈরির সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ এতে ব্যাংক কোনো প্রকার ঋণ প্রদান করবে না। সরাসরি গ্রহীতাকে বিনিয়োগ প্রদান করবে। গ্রহীতার মূল ব্যবসায় সরাসরি অংশীদার হবে। পুরো ব্যবসায় ব্যাংক সরাসরি তদারকি ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
গ্রাহক চাইলেও যথেচ্ছা অর্থ ব্যয় করতে পারে না। পাশাপাশি সমুদয় মুনাফায় ব্যাংক অংশীদার হয়। ইচ্ছাকৃত খেলাপি হওয়ার সুযোগ এখানে নেই। গ্রহীতা তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম লুকানোর সুযোগ এখানে ক্ষীণ।
খেলাপি তার আর্থিক লোকসানের কথা বললেও মূল ব্যবসায় ও অ্যাসেটে ব্যাংকের আনুপাতিক দখল থাকে। এতে ব্যাংকের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। গ্রহীতারও আগ্রাসী হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ ব্যাংক তার সুখে যেমন সাথি, দুঃখেও সাথি হয়। লোকসান হলে ব্যাংকও সেটি আনুপাতিক হারে বহন করবে।
হ্যাঁ, একটি বিষয় থাকে, ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগগ্রহীতা ব্যবসায় ইচ্ছা করে লোকসান প্রদর্শন করবে। এতে ব্যাংকের লোকসান হবে। মূলত এ বিষয়টি সুদৃঢ় আইন প্রণয়নের মাধ্যমে রোধ করা সম্ভব। লোকসানের দাবি করলেই যে তা গ্রহণ করা হবে বিষয়টি এমন নয়; ইনভেস্টিগেশন সেল থাকবে। তদন্ত হবে।
প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকিং পুরোপুরি ইসলামী বিনিয়োগভিত্তিক নয়; তদুপরি তাদের খেলাপি ঋণ কনভেনশনাল ব্যাংকিংয়ের চেয়ে নগণ্য। সুতরাং পুরোপুরি সত্যিকার ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠা হলে খেলাপি ঋণ আরো কমবে বলে আশা করতে পারি।
সুতরাং আমাদের প্রস্তাবনা হলো খেলাপি ঋণসহ সার্বিক কল্যাণময়ী ও টেকসই ব্যাংকিং ও অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের ইসলামী অর্থনীতির দিকেই ফিরে যেতে হবে।
ইসলামী অর্থনীতিতে ঋণ ব্যবস্থাপনা নীতি
ইসলামী অর্থনীতির দৃষ্টিতে ঋণ একটি আপত্কালীন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এটি সর্বদা অনুমোদিত ও ব্যাপকভাবে লেনদেনের কোনো পদ্ধতি নয়। ঋণ মূলত একটি বিনিময়হীন সেবামূলক চুক্তি। ঋণের মাধ্যমে পরোপকার হয় এবং দাতা এর বিপরীতে আখেরাতের সওয়াব লাভ করে।
ঋণ হিসেবে প্রদত্ত সম্পদের সমপরিমাণ সম্পদ পুনরায় ফিরে পাওয়া ছাড়া ঋণদানের মাধ্যমে দাতার জন্য আর্থিক কোনো উপকার নিহিত নেই। এটি কোনো আর্নিং সোর্স নয়। বরং পরকালীন সওয়াবের আশা ও মানবতাপ্রীতি থেকে ঋণদাতা অন্যকে সহযোগিতা করে। ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতি রক্ষা এবং পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের এটি একটি অন্যতম উন্নত মাধ্যম। নিম্নে এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্তাকারে কিছু বিধান পেশ করা হলো:
ঋণ প্রদান চুক্তি মূলত একটি অনুদানমূলক চুক্তি। এটি বিনিময়মূলক চুক্তি নয়। আর্থিক বিনিয়োগ পদ্ধতিও নয়। এর একমাত্র উদ্দেশ্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। সুতরাং ঋণ প্রদান করে কোনো ধরনের বিনিময় গ্রহণ করা বৈধ নয়। চাই সেটি আর্থিক বিনিময় হোক কিংবা বৈষয়িক কোনো উপকার। ইসলামের দৃষ্টিতে ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত কোনো উপকার গ্রহণ করা সুদের অন্তর্ভুক্ত। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে— ‘যেসব ঋণ (ঋণ প্রদানের কারণে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি থেকে) কোনো ধরনের উপকার বয়ে নিয়ে আসে সেটা সুদ হবে।’—আল মাতালিবুল আলিয়া-১৪৮৪
সুতরাং প্রচলিত কনভেনশনাল ব্যাংকিং সেক্টরে সুদভিত্তিক ঋণ প্রদান পদ্ধতি স্পষ্ট রিবা বা সুদ। কোরআনুল কারিম কর্তৃক নিষিদ্ধ রিবার অন্তর্ভুক্ত। কোনোভাবেই তা অনুমোদিত নয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, প্রচলিত কনভেনশনাল ব্যাংকঋণকে বিনিময়মূলক ও বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। জড়িত হচ্ছে ভয়াবহ সুদের সঙ্গে।
রিবা বা সুদ ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ
ইসলামে রিবা বা সুদ কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। শিরকের পর ইসলামে সবচেয়ে ভয়াবহ অপরাধ রিবা। কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমীনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের বকেয়া যাহা আছে তাহা ছাড়িয়া দাও, যদি তোমরা মুমিন হও। যদি তোমরা না ছাড়ো, তবে আল্লাহ ও তাঁহার রাসূলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। কিন্তু যদি তোমরা তাওবা করো, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই। ইহাতে তোমরা অত্যাচার করিবে না এবং অত্যাচারিতও হইবে না।’ (সূরা বাকারা: ২৭৮-২৭৯)
সহিহ হাদিসে এসেছে, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদগ্রহীতা, সুদ প্রদানকারী, সুদের সাক্ষীদ্বয় ও সুদের লেখকদ্বয়কে অভিশম্পাত করেছেন।’ [জামে তিরমিযী, ১২০৬]
বলার অপেক্ষা রাখে না, ঋণের বিপরীতে শর্ত করে অতিরিক্ত আদান-প্রদান করা সুদের অন্তর্ভুক্ত। ইসলামী অর্থনীতিতে সুদ নিষিদ্ধ। কারণ তা অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। ধনী-গরিবে অস্বাভাবিক ব্যবধান তৈরি হয়। আন্তর্জাতিক দাতব্য ফেডারেশন ‘অক্সফাম’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘বিশ্বের দরিদ্রতম ৪৬০ কোটি মানুষের মোট সম্পদের চেয়েও বেশি সম্পদ রয়েছে মাত্র ২ হাজার ১৫৩ জন শীর্ষ ধনীর হাতে। দরিদ্র্য এ মানুষগুলো দুনিয়ার মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ৬০ শতাংশ।
অর্থাৎ পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর ৬০ ভাগ মানুষ দরিদ্রতম। তাদের সবার সমপরিমাণ সম্পদ মাত্র ২ হাজার ১৫৩ জন মানুষের হাতে বন্দি হয়ে আছে। এ দৃশ্য এখন প্রায় প্রতিটি দেশের। বাংলাদেশের চিত্রও অভিন্ন।
এ কারণেই পুঁজিবাদী সুদভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসার ব্যাকুলতা দেখা যাচ্ছে। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের’-এর বার্ষিক সম্মেলনে এর চেয়ারম্যান তার ভাষণে চলমান পুঁজিবাদ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, “Today we have reached a tipping point, which leaves us with only one choice: change or face the continued decline and misery.”
‘আজ আমরা এমন এক বিন্দুতে এসে পৌঁছেছি, যার পরে আমাদের জন্য অর্থ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া কোনো পথ নেই। নচেৎ ক্রমাগত অধঃপতনকে মেনে নেয়াই হবে আমাদের নিয়তি।’
আল্লামা তাকি উসমানী হাফিজাহুল্লাহ ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের’-এর ভাষণে ওই বক্তব্য উদ্ধৃত করে মন্তব্য করেছেন, যার সারকথা হলো— ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক পটপরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। তবে ঠিক কোন পথে পরিবর্তন হবে সেটা বিশ্বের মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়। আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সেই পথ হলো ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা’।
কর্জে হাসান ও প্রচলিত ক্ষুদ্র ঋণ
ঋণ সম্পূর্ণ একটি সহযোগিতামূলক চুক্তি। ঋণকে কেন্দ্র করে ব্যবসার চিন্তা গোড়াতেই গলদ। এতে সমাজে অর্থনৈতিক অনাচার ও জুলুম সৃষ্টি হয়। সম্পদে বৈষম্য দেখা দেয়। সর্বপ্রকার বিনিময়হীন মানসিকতা থেকে মুক্ত থেকে ঋণ প্রদান করাই ইসলামের নির্দেশনা। এভাবে বিনিময়হীন ঋণ প্রদান যখন কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে হয়ে থাকে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে অন্যকে সহযোগিতার নিয়তে হয়ে থাকে, তখন সেটি হয়ে ওঠে ‘উত্তম ঋণ’ যা ইসলামী অর্থনীতিতে ‘কর্জে হাসানা’ নামে পরিচিত।
কিন্তু আমাদের সমাজে ঋণ একটি ব্যবসায়িক মাধ্যম। এর উদ্দেশ্য থাকে ব্যবসা। সহযোগিতা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি নয়। দীর্ঘদিন বিধর্মীদের গভীর ষড়যন্ত্রে সমাজে আজ প্রতিষ্ঠিত। ঋণকেন্দ্রিক স্বার্থান্বেষী ব্যবসাকে এখন আর কেউ খারাপ চোখে দেখে না। একটি খারাপ কাজ যখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তখন তা সয়ে যায়।
আমাদের সমাজে ঋণ কেন্দ্রীয় ব্যবসার দুটি ধারা প্রচলিত। এক. ব্যাংককেন্দ্রিক ঋণ ব্যবসা। দুই. দরিদ্র শ্রেণীকেন্ন্দ্রিক ঋণ ব্যবসায়। আধুনিক ভাষায় একে ‘ক্ষুদ্র ঋণ’ বা ‘সোস্যাল বিজনেস’ বলে। শুধু বাংলাদেশে নয়; বিশ্বব্যাপী সুদের ভয়াল থাবায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অধিক।
২০০৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ দশমিক ২৯ বিলিয়ন। এর মধ্যে ৪০০ মিলিয়ন ভারতে এবং ১৭৩ মিলিয়ন চীনে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ৬৩ মিলিয়ন অর্থাৎ ৬ কোটি ৩০ লাখ। এর মধ্যে পল্লী অঞ্চলে ২৯ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।
ক্ষুদ্র ঋণের নামে ব্যবসার জন্য এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে বেছে নেয়া একটি গভীর ষড়যন্ত্র। বলা হবে, দারিদ্র্য বিমোচন করতে চাই। দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই। এর জন্য ‘ক্ষুদ্র ঋণ’ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা হবে। এর মাধ্যমে দরিদ্র শ্রেণীকে ঋণ দেয়া হবে। এতে তারা স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে। আদতে ‘ক্ষুদ্র ঋণের’ আড়ালে সুদের জাল বিস্তারই আসল উদ্দেশ্য। ব্যাংক যে হারে সুদ নেয়, এর থেকে কয়েক গুণ অধিক সুদ নেয়া হয় ক্ষুদ্র ঋণে।
বাংলাদেশের হতদরিদ্র মানুষ ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে এর ৬৭ শতাংশই ব্যয় করে অনুৎপাদনশীল খাতে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে কোনো ভূমিকাই রাখে না। এ ঋণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গ্রহণ করা হয় ব্যক্তিগত বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণের জন্য। যেমন চিকিৎসা, খাদ্য ইত্যাদি। এতে দেখা যায়, একসময় সেই ঋণ আদায় করতে না পেরে তা সুদে আসলে বৃদ্ধি হয়ে দরিদ্র মানুষটির জীবন নাভিশ্বাস হয়ে ওঠে। সুতরাং ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব নয়।
পত্রপত্রিকায় এমন ঘটনা কম নয়, ঋণ আদায় করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। বহু দরিদ্র মানুষের জীবন তছনছ হয় এই ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদে পড়ে। মাঝে মধ্যে কেউ এভাবে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে অন্যান্য সাপোর্টের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে উঠলে সেটি গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়।
কয়েক বছর আগে ডেনমার্কের সাংবাদিক টম হাইনমান কর্তৃক নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত ‘ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদ’ নামক প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে ‘ক্ষুদ্র ঋণ’ দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যর্থ এবং দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নে ক্ষুদ্র ঋণের ইতিবাচক ভূমিকা নেই।
বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘ক্ষুদ্র ঋণ দারিদ্র্য বিমোচন করে না; বরং সামন্তসমাজের ভূমিদাসের মতো এ যুগের মানুষকে এক ধরনের ঋণদাসে পরিণত করছে। দারিদ্র্য বিমোচনের এ পথ অনুসরণ করার ফলে আমাদের উন্নতির কোনো দিশা আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার মধ্যেই সংখ্যালঘুর ধনী ও সংখ্যাগরিষ্ঠের গরিব হওয়ার প্রক্রিয়া নিহিত। এ গরিব করা ও গরিব রাখার ব্যবস্থা বহাল রেখে গরিবদের ঋণ দিয়ে ও উচ্চহারে সুদ নিয়ে কীভাবে গরিবি মোচন হবে? এ অস্বাভাবিক ও বিকৃত চিন্তাকেই আমরা সদলবলে লালন করে আসছি।’
সুতরাং ঋণকেন্দ্রিক ব্যবসায় মানবতার কোনো কল্যাণ নেই। এতে বাহ্যিক চাকচিক্য আছে। তবে গভীর ক্ষত রয়েছে। সুতরাং ঋণকেন্দ্রিক সব ব্যবসায় ও ধান্ধার স্থান ইসলামে নেই। যদিও আমাদের দেশে কথিত সুদের ফেরিওয়ালারা এসব কথা শুনতে নারাজ।
লেখকঃ ড. এম কবির হাসান: অধ্যাপক, নিউ অরলিন্স বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র এবং মুফতি আব্দুল্লাহ মাসুম: সিএসএএ, অ্যাওফি, স্কলার।