ক্রেডিট কার্ড ভয়াবহ এক খরচাস্ত্র
টাকার প্রাচুর্য এবং টাকার প্রভূত অভাব মানুষকে যতটা প্রভাবিত করতে পারে, তার সুখ-শান্তি-অসুখ-বিসুখে যতটা প্রভাব ফেলতে পারে, অন্য কোনো বস্তুগত জিনিস ততটা প্রভাবিত করতে পারে না। তাই টাকার শৃঙ্খলা একটা অত্যাবশ্যকীয় বিষয়।
দুই দশক আগের কথা। আমার এক বন্ধু তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছে। ওখানে আবার একটু পড়াশোনা করে চাকরি নেয় একটা আইটি কোম্পানিতে। বেশ দক্ষ আর চৌকস হবার কারণে তার পারফরম্যান্স খুব ভালো হলো; ফলস্বরূপ বেড়ে গেল বেতন।
ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন। |
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, বেতন বাড়ার কিছুদিন পর থেকে তার চলতে কষ্ট হতে লাগল। কারণ সে বেতন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাসা পরিবর্তন করেছিল। খাবার দাবার পোশাক এসবেও খানিকটা পরিবর্তন হলো। বন্ধু-বান্ধব সার্কেলে এলো কিছু সংযোজন বিয়োজন।
তার চলতে কষ্ট হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ, সে কোন ফাঁকে যে তার ক্রেডিট কার্ডের বর্ধিত সীমা শেষ করে ফেলেছিল, সেটা খেয়াল করেনি। হাতে টাকা নেই, ক্রেডিট কার্ডের সীমা শেষ, এখন কী করা? তার ছিল একাধিক ক্রেডিট কার্ড। সবগুলোর একই অবস্থা হলো। কারণ, আয় যে পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, অনেক সময় খরচের বৃদ্ধি তার চেয়ে বেশি হয়। তাছাড়া, আবার ভবিষ্যতে আয় বাড়বে- এই প্রত্যাশাতেও বর্তমানের খরচ বেড়ে যায় অনেকের। বিপত্তি ঘটে তখন, যখন আয়ের বৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যায় খরচের বৃদ্ধি। আর যদি হাতে থাকে অত্যাধুনিক খরচাস্ত্র ক্রেডিট কার্ড, তাহলে তো কথা-ই নেই। খরচ বাড়ানোর অনুষঙ্গটি সঙ্গেই আছে। আমার বন্ধুটির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। বাংলাদেশি হলেও সে পশ্চিমা ধাঁচের ভোগবাদে প্রভাবিত হয়েছিল।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
প্রসঙ্গত বলতে চাই, পশ্চিমা বিশ্ব আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে সব বিষয়ে অনেক এগিয়ে- এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তারা নিয়ম-কানুন, টেকনোলজি, অস্ত্র-গোলাবারুদ ও ভোগ-বিলাসে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তাদের মাথাপিছু আয় আমাদের চেয়ে অনেকগুণ বেশি। আমরা যেখানে মৌলিক চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাই, সেখানে তারা বসবাস করছে ভোগের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। মৌলিক চাহিদা তাদের মিটে গেছে অনেক আগে।
তবে আরেকটা বিষয়ে তারা অনেক এগিয়ে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের তুলনায়। তা হচ্ছে, তাদের অধিকাংশ পরিবার ভবিষ্যতের দুই-তিন বা তারও বেশি বছরের সম্ভাব্য আয়কে খরচ করে ফেলেছে, তাও আবার সুদে। কীভাবে? এই প্রশ্ন আসতে পারে। কানাডা বা আমেরিকার কোনো কোনো পরিবারে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা ৯ থেকে ১২টা। যখন তাদের ক্রেডিট কার্ডের লিমিট বাড়ে, তখন তারা পার্টির আয়োজন করে। উল্লেখ্য, আমার বন্ধুটিও ক্রেডিট কার্ডের সীমা বাড়ার পর বন্ধুদের আপ্যায়ন করেছিল।
এখন আমাদের দেশেও পাশ্চাত্যের দেখাদেখি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে ক্রেডিট কার্ড ও কনজুমার লোন দিয়ে ভবিষ্যৎ-আয়কে বর্তমানে খরচ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে, মানুষের ভোগস্পৃহাকে উসকে দিচ্ছে। যখন কেউ নগদ টাকা দিয়ে বাজার করে, তখন কেনাকাটার মধ্যে একটা নিয়ন্ত্রণ থাকে; সে বুঝতে ও অনুভব করতে পারে- কী পরিমাণ খরচ তার হচ্ছে, কত টাকা তার পকেট থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।
এখানে একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারও কাজ করে। বিল পরিশোধ করার সময় একটা খোঁচা তার মনে লাগে, আহ, এত টাকা খরচ হয়ে গেল! কিন্তু ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কিছু কেনাকাটা করলে ঐ মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারটা ঘটে না। একটা স্বাক্ষর করলে সব চুকে যায়। কিন্তু ঝামেলা বাঁধে তখন, যখন পরিশোধের সময় এসে পড়ে। প্রতিমাসে সর্বনিম্ন পেমেন্ট করলে এক জীবনে শেষ হওয়ার কথা নয়। আজীবন ঋণের জালে বন্দি হওয়ার একটা ভালো ক্ষেত্র!
পশ্চিমা দেশগুলোতে এখন প্লাস্টিক কার্ড ব্যবহার করতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তারা এখান মেনে নিচ্ছে, ঋণ করে ভোগ বাড়ালে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে বাধ্য। এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকার ৩৮.১ শতাংশ পরিবারের ক্রেডিট কার্ডের ঋণ আছে। তাদের গড় ঋণ ৫ হাজার ৭০০ ডলার। আর যেসব পরিবারের নিট সম্পদ শূন্য বা ঋণাত্মক, তাদের গড় ক্রেডিট কার্ড ঋণ ১০ হাজার ৩০৮ ডলার। আমেরিকানদের মোট কনজুমার লোনের বকেয়া ৩.৯ ট্রিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে কানাডিয়ানরা বছরে ৩০ হাজার কোটি ডলার খরচ করে ক্রেডিট কার্ডে। গড়ে একজন কানাডিয়ানের ক্রেডিট কার্ডের বকেয়া ৮ হাজার ৬০০ ডলার, যা ভারতীয়দের মাথাপিছু আয়ের পাঁচ গুণেরও বেশি। তাদের যেসব ক্রেডিট কার্ড চালু রয়েছে, সেগুলোর বিপরীতে বার্ষিক খরচ হয় গড়ে ৯ হাজার ৭০০ ডলার। বর্তমানে তাদের সচল ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা ৩১০ লাখেরও বেশি, যার মধ্যে ৩০ শতাংশ কার্ড হোল্ডার সঠিক সময়ে কার্ডের বকেয়া পরিশোধ করেন না; অর্থাৎ, তাদের নিয়মিত সুদসহ বকেয়া পরিশোধের সঙ্গে সঙ্গে পেনাল সুদ পরিশোধ করতে হয়। যারা ক্রেডিট কার্ড বিক্রি করেন, তাদের প্রিয় এবং প্রিমিয়াম গ্রাহক হচ্ছেন তারা- যারা সঠিক সময়ে দেনা পরিশোধ না করে বরং দু-পাঁচদিন পরে করেন।
ক্রেডিট কার্ডের ঋণে অভ্যস্ততা একটা পরিবারকে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে নিপতিত করতে পারে। বলা হয়, যারা ক্রেডিট কার্ডের চক্করে পড়েন, তারা এই দুষ্টচক্র থেকে প্রবল মনবল ছাড়া বের হয়ে আসতে পারেন না।
ছোট একটা হিসাব দেই ক্রেডিট কার্ডের বিষয়ে, তাহলে বিষয়টার ঋণাত্মক দিকটা একটু আঁচ করা যাবে। ধরুন, যদি কোনো ব্যক্তি ক্রেডিট কার্ড চার্জ করে ব্যাংক বা এটিএম থেকে ৫ হাজার টাকা ক্যাশ তোলে, সুদ যদি হয় বাৎসরিক ২৪ শতাংশ, সে যদি মাসিক সর্বনিম্ন বকেয়াটা পরিশোধ করে নিয়মিতভাবে- ধরুন ১০০ টাকা (২ শতাংশ), তাহলে তার ক্রেডিট কার্ডের দেনা পরিশোধ করতে সময় লাগবে অন্তত ৩০ বছর। এই ৩০ বছরে সে ৫ হাজার টাকায় সুদ দেবে ৩৬ হাজার ১০০ টাকা; অর্থাৎ ঋণের ৭.২২ গুণ।
ক্রেডিট কার্ডের ঋণ একবার যাকে স্পর্শ করেছে, সেই ‘স্বর্গীয়’ স্পর্শ থেকে মুক্তি পাওয়া তার পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব! সময় এমনভাবে সামনের দিকে যাচ্ছে, ক্রেডিট কার্ড ছাড়া চলা হয়তো কঠিন হয়ে যাবে। তাই এর ব্যবহারে সতর্ক না হতে পারলে আমরা ঋণের আবর্তে ঘুরপাক খাব; নিজেরা ঋণগ্রস্ত থাকব। অর্থাৎ, নিজে কষ্ট করে আয় করে ক্রেডিট কার্ড বিক্রেতাদের ধনী করব।
অতি খরুচে স্বভাব পরিহার করা এবং সেজন্য খরচকে, খরচের খাতকে চিহ্নিত করা খুবই জরুরি। জীবন হচ্ছে অনেক বিকল্প পছন্দের সমাহার; যার যেটা পছন্দ, সে সেটা নেবে। যার যে পথ পছন্দ, সে সেই পথে পরিভ্রমণ করবে। তবে বোধকরি সবাই একমত হবেন, টাকার প্রাচুর্য এবং টাকার প্রভূত অভাব মানুষকে যতটা প্রভাবিত করতে পারে, তার সুখ-শান্তি-অসুখ-বিসুখে যতটা প্রভাব ফেলতে পারে, অন্য কোনো বস্তুগত জিনিস ততটা প্রভাবিত করতে পারে না। তাই টাকার শৃঙ্খলা একটা অত্যাবশ্যকীয় বিষয়।
অনেকের ধারণা, ধনী সবাই হতে পারে না, তাদের মধ্যে ধনী হওয়ার যোগ্যতা নেই। এই কথাটার মধ্যে অসারতা বিদ্যমান। সবাই হয়তো একজীবনে তাদের নিজের মতো করে ধনী হতে পারে না; কিন্তু নিজের অর্জিত টাকার যথোপযুক্ত ব্যবস্থাপনা করে, সঠিক পথে বিনিয়োগ করে, আর্থিক জ্ঞানের মাধ্যমে নিজের টাকাকে ঝুঁকিমুক্ত করে এবং নিজের সঞ্চিত টাকাকে সম্পদে রূপান্তরিত করে যে কেউ সম্পদশালী বা ওয়েলদি হয়ে ওঠতে পারে সহজে।
তার জন্য কিছু নিয়ম মানতে হয়। নিজের লোভ ও ভয় নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। নিজের ভোগস্পৃহা দমন করতে হয়। নিজের আয়-ব্যয়ের মধ্যে একটা সমন্বয় সাধন করতে হয়। সম্পদ ও দায় কী- বুঝতে হয়। সর্বোপরি নিজের সাধ্যের মধ্যে চলতে হয়। সঞ্চয়ী মানসিকতা গড়ে তুলতে হয়।
কোনো কাজই কঠিন নয়, যদি তাকে আমরা সহজ হিসাবে গ্রহণ করতে পারি। মন আমাদের খুব অমূল্য এক সম্পদ। এই মনকে নিয়ন্ত্রণ করে সময় ও উদ্যোগকে কাজে লাগিয়ে জীবন ও সম্পদমুখী হতে হয়। তবেই জীবনকে দারিদ্রের দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত করা যায়।
পরিশেষে, ছোট্ট একটা গল্প দিয়ে শেষ করব। আমার ব্যক্তিগতভাবে তিনটা ক্রেডিট কার্ড ছিল। দেখেছি স্বপ্ন বা অ্যাগোরা বা অন্য কোনো সুপার শপে ঢুকলে জিনিসপত্র কেনা যেন আর শেষ হতো না। তাছাড়া, একটা কিছু কিনতে গিয়ে কিনে ফেলতাম তিন-চারটা জিনিস। প্রতি মাসে দিতাম শুধু সর্বনিম্ন পেমেন্ট। একসময় দেখলাম, ক্রেডিট কার্ডের ঋণের বোঝা এত ভারি হয়ে গেছে, আয়ের একটা বড় অংশ চলে যায় ঋণের টাকার একটা অংশ শোধ করতে। দেখা গেল, যতই শোধ করি না কেন, ঋণের পরিমাণ যেন কমে না!
এক রাতে খুব চিন্তা করলাম। পরের দিন সকালে একটা কাঁচি নিলাম হাতে। একে একে কেটে ফেললাম দুটি ক্রেডিট কার্ড। ডেবিট কার্ডও কেটে ফেললাম। বাকি থাকল একটা ক্রেডিট কার্ড। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, আমার ভোগস্পৃহা বা কেনাকাটার ইচ্ছা কমতে শুরু করেছে।
এখন আমার একটা মাত্র ক্রেডিট কার্ড। সেটাও অনেকদিন হাতে নিই না। পারলে, অল্প করে হলেও ঋণ শোধ করি। যে দুটো কার্ড নষ্ট করলাম, তাদের ঋণ শোধ করলাম প্রথমে; পরে যেটা এখন আছে, সেটার ওপর কাজ শুরু।
আমার মনে হয়, স্বল্প আয়ের লোকজনের উচিত যতদূর সম্ভব ক্রেডিট কার্ড নামক ঐ শক্তিশালী খরচাস্ত্র থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখা। আপনি যদি ঋণমুক্ত হতে পারেন, তাহলে আপনার শান্তির ঘুমের হন্তারক হওয়ার জন্য বিশেষ কেউ আর থাকবে না।
করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের সবার হাতের অবস্থা যে কতটা খারাপ, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। তবে খরচের ব্যাপারে যত্নবান না হলে সামনে সমূহ বিপদ। খরচ করতে সবার ভালো লাগে, কিন্তু ঋণ শোধ করতে গেলেই যত বিপত্তি। তাই খরচের ব্যাপারে যত্নবান হোন।
লেখকঃ সাইফুল হোসেন, কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল। [প্রকাশিত এই লেখাটি লেখকের একান্তই নিজস্ব। ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখা ও মতামতের জন্য ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ দায়ী নয়।]