চেক প্রতারণা ও ডিজঅনারে করণীয়
মোশারফ হোসেনঃ বর্তমান সময়ে ব্যাংকিং সেবার অনেক অল্টারনেটিভ ডেলিভারি চ্যানেল (এডিসি) উদ্ভাবনের ফলে অর্থ জমা, উত্তোলন কিংবা ট্রান্সফার- সব ক্ষেত্রেই একাধিক বিকল্প পদ্ধতি চালু হয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে চেকের বিকল্প হিসেবে কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধার মাধ্যমে টাকা উত্তোলন ও ট্রান্সফার হচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে। এজেন্ট আউটলেটগুলোতে এবং কিছু ব্যাংকের শাখা পর্যায়েও চেক এবং কার্ড ছাড়াও আঙ্গুলের ছাপ দিয়েই বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে অর্থ উত্তোলন এখন অহর্নিশ হচ্ছে।
তবে এত বিকল্পের পরও কি আমরা নিত্যদিনের ব্যাংকিংয়ে চেকের ব্যবহার থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি বা পারব কি? কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়ত বের হয়ে আসা গেছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখনো চেকের কোনো বিকল্প নেই। ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে চেক যেভাবে প্রমাণযোগ্য দলিল হিসেবে কাজ করে, তা চেকের অন্য কোনো বিকল্প মাধ্যমের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত ধার-দেনায়, ব্যবসায়িক লেনদেন বিশেষ করে বাকিতে পণ্য ক্রয়ে (ক্রেডিট পারচেজ), ব্যাংক ঋণ উত্তোলনে এখনো চেক অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত একটি মাধ্যম। বর্তমানে ব্যাংক গ্যারান্টির (সিকিউরিটি গ্যারান্টি) বিকল্প হিসেবেও কাজ করছে জামানতের চেক।
আরও দেখুন:
◾ চেক এর পক্ষ সমূহ কি?
ডিলারদের কাছ থেকে শুধু জামানতের চেক জমা রেখে কোটি কোটি টাকা বাকিতে পণ্য বিক্রি করছে বড় বড় ব্যবসায়িক কোম্পানিগুলো। ব্যক্তি পর্যায়েও বিভিন্ন লেনদেনের দলিল ও নিশ্চয়তা হিসাবে কাজ করছে এই চেক। নেগোসিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাক্ট, ১৮৮১ বলে প্রাপ্য প্রতিকারের ভরসাতেই ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী মহলে চেক লেনদেনের একটি দলিল হিসাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তবে চেকদাতা ও চেকগ্রহীতা উভয়ের অজ্ঞতা ও অসতর্কতার জন্য উভয়কেই পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। আবার কখনো কখনো চেকদাতার ইচ্ছাকৃত প্রতারণার জন্যও হয়রানির শিকার হন চেকের গ্রহীতা বা প্রাপক।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
ত্রুটিপূর্ণ ও প্রতারণাপূর্ণ চেক পরিশোধে বা কালেকশনে ব্যাংক অস্বীকৃতি জানায়, অর্থ্যাৎ পরিশোধের জন্য উপস্থাপিত চেক ব্যাংক কর্তৃক প্রত্যাখ্যান বা ডিজঅনার করা হয়। চেকদাতার সুনাম ক্ষুন্ন হয়, চেকগ্রহীতা পাওনা আদায়ে বা অর্থ উত্তোলনে অসমর্থ হন। অনেক ক্ষেত্রে চেকগ্রহীতার আইনি প্রতিকারও বাধাগ্রস্থ হয়। আবার চেক জালিয়াতির কারণে চেকদাতারও মাথায় হাত পড়ে কখনও কখনও। তাই চেক বিষয়ে সর্ব মহলেই সচেতনতা ও জানার প্রয়োজন আছে বৈকি।
চেকদাতার সতর্কতাঃ
আপনার হিসাবে পর্যাপ্ত ব্যালেন্স আছে, তথাপি চেকটি যদি যথাযথভাবে ইস্যু করা (ড্র করা) না হয়, তাহলে এই চেক দিয়ে ব্যাংক হতে কোনো অর্থ উত্তোলন সম্ভব হবে না। তাই চেক ইস্যু করার সময় চেকদাতা হিসেবে আপনাকে কিছু সাধারণ বিষয় মাথায় রেখে চেক ইস্যু করতে হবে। যেমন-
এক. চেকের তারিখ সঠিকভাবে লিখুন। চেকের তারিখ বলতে চেক ইস্যুর তারিখ বুঝায়। তবে প্র্যাক্টিস হচ্ছে, যেদিন ব্যাংকে চেকটি উপস্থাপন করবেন, চেকের গায়ে সেই দিনের তারিখটিই লিখবেন। চেকের গায়ে উল্লিখিত তারিখ হতে পরবর্তী সর্বোচ্চ ৬ মাসের মধ্যেই চেকটি নগদায়ন করতে হবে। তারিখ লিখার জন্য দিন, মাস, বছরের জন্য নির্ধারিত আটটি বক্স যথাযথভাবে পূরণ করবেন।
দুই. প্রাপক বা চেকের গ্রহীতার (ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান) পূর্ণ নাম সঠিকভাবে লিখুন। আংশিক নাম বা ডাকনাম লিখবেন না
তিন. টাকার পরিমাণ কথায় ও অংকে স্পষ্ট ও অভিন্নভাবে লিখুন।
চার. চেকের অপব্যবহার রোধে অংকে ও কথায় লেখা টাকার পরিমাণের আগে, পরে ও মাঝখানে কোনো অতিরিক্ত ফাঁকা জায়গা রাখবেন না। অংকে লেখা টাকার পর “ /- ” চিহ্ন এবং কথায় লেখা টাকার পর “মাত্র” লিখে পরবর্তী ফাঁকা অংশগুলো যথাসম্ভব আনুভূমিক দাগ টেনে ভরে দিন। প্রাপকের নাম লেখার ক্ষেত্রেও একই সতর্কতা অবলম্বন করবেন।
পাঁচ. নগদ উত্তোলন পরিহার করতে এবং একমাত্র প্রাপকের হিসাবেই চেকের অর্থ জমা নিশ্চিত করতে তথা আপনার ইস্যুকৃত চেকের অধিকতর নিরাপত্তার স্বার্থে যথাসম্ভব প্রাপকের নামের সাথে তাঁর হিসাব নম্বরটি (সম্পূর্ণ নম্বর) উল্লেখ করুন এবং চেকের ‘অর বিয়ারার’ শব্দদ্বয় দাগ টেনে কেটে (স্ট্রাইক আউট) দিন এবং চেকের বাম পাশের টপ কর্নারে আড়াআড়িভাবে ‘অ্যাকাউন্ট পেইয়ি’ ক্রসিং দিন। চেকের পিছনে নির্ধারিত স্থানে প্রাপকের নাম, হিসাব নম্বর লিখে নিচে আপনি স্বাক্ষর করে এনডোর্স করে দিন। এতে করে চেকটির নগদ উত্তোলন রহিত হবে এবং চেকটি কেবল প্রাপকের (চেকে উল্লিখিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান) ব্যাংক একাউন্টেই জমা করা সম্ভব হবে।
ছয়. চেকে কোনো অল্টারেশন (কাটাকাটি বা ওভাররাইটিং) থাকলে তা প্রত্যাখ্যাত হবে। যদি কোনো কাটিকাটি বা ওভাররাইটিং হয়েই যায়, তাহলে তা চেকদাতার (ড্রয়ার) পূর্ণ স্বাক্ষরে নিশ্চিত করতে হবে। অবশ্যই চেকে ঘষামাজা বা ফ্লুয়িড জাতীয় কিছু ব্যবহার করা যাবে না।
সাত. চেক উপস্থাপনের তারিখে আপনার হিসাবে চেকটি অনার করার মত পর্যাপ্ত ব্যালেন্স নিশ্চিত করুন।
আট. আপনার ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী মিনিমাম ব্যালেন্স রেখে তারপর চেক ইস্যু করুন।
নয়. ইস্যুকৃত চেকের পেমেন্ট অথারাইজ করতে চেকের ডানপাশে নিচের দিকে এমআইসিআর অংশের উপরিভাগে নির্দিষ্ট স্থানে স্বাক্ষর করবেন এবং স্বাক্ষর ব্যাংকে সংরক্ষিত নমুনা স্বাক্ষরের (স্যাম্পল সিগনেচার) সাথে মিল রেখে করবেন।
দশ. আন্তঃব্যাংক বা আন্তঃশাখা চেক পরিশোধের জন্য আপনার ব্যাংকে ‘পজিটিভ পে’ নির্দেশনা প্রদান করুন এবং আপনার কনফারমেশন সাপেক্ষে চেক পরিশোধের স্বার্থে ব্যাংকে প্রদত্ত আপনার সেলফোন নম্বরটি সর্বদা সচল রাখুন।
এগার. নিজের কলম দিয়ে এবং অমুছনীয় কাল কালির বলপয়েন্ট পেন দিয়ে চেক লিখবেন। একইভাবে পেন্সিল, জেলপেন বা অন্য রঙিন কালি (নীল, সবুজ, লাল ইত্যাদি) বর্জন করবেন। বর্তমানে কেও কেও চেকের ডিটেইলস হাতে না লিখে প্রিন্ট করেও চেক ইস্যু করে। চেকের গ্রহীতা বা অন্য কারোর (সুপরিচিত নয় এমন কেও) কলম দিয়ে চেক লিখলে বা অন্য কাওকে দিয়ে চেক লিখালে ব্যবহৃত কলমটি ‘ফ্রডস্টার পেন (যে কলমের কালি মুছনীয়)’ হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ফলে বড় ধরনের জালিয়াতির স্বীকার হতে পারেন আপনি। কারণ এক্ষেত্রে সতর্ক না থাকলে প্রাপকের নাম ও টাকার পরিমাণ বদলে গিয়ে আপনার হিসাবের অর্থ উধাও হতে পারে আপনার অজান্তেই। এই ভয়ে বড় অংকের চেকের ক্ষেত্রে প্রাপক ও টাকার অংশগুলোর ওপর কেও কেও সেলোটেপ (স্বচ্ছ স্কচ টেপ) পেস্ট করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে আমাদের দেশে এই প্র্যাক্টিসটি প্রচলিত নয়, কারণ চেকের গায়ে ব্যাংকারও স্বাক্ষর করার পাশাপাশি একাধিক সীল ব্যবহার করে থাকে যা সেলোটেপের ওপর সম্ভব নয়।
বার. চেকের আংশিক উত্তোলন সম্ভব নয়।
তের. এক চেকে একাধিক গ্রহীতা কর্তৃক উত্তোলন বা একাধিক হিসাবে ট্রান্সফার সম্ভব (যেমন- বেতন, বোনাস, ফি ইত্যাদি পরিশোধের ক্ষেত্রে)। তবে এক্ষেত্রে চেকদাতা কর্তৃক এনডোর্সমেন্ট বাঞ্ছনীয়। তবে নগদ উত্তোলনে এমন চেক ইস্যু করবেন না।
চৌদ্দ. একই চেকে আংশিক নগদ উত্তোলন, আংশিক ট্রান্সফার সম্ভব নয়।
পনের. ডিডি বা পে-অর্ডার ক্রয়ের ক্ষেত্রে চেকের প্রাপকের ঘরে “ইউরসেল্ফ ফর ডিডি/পে-অর্ডার” লিখবেন।
ষোল. কোনো ব্ল্যাংক চেক ইস্যু করবেন না। যদি ইস্যু করতেই হয় তাহলে প্রাপকের নাম ও টাকার ঘরগুলো যেন অন্তত ফাঁকা না থাকে। অথবা নিতান্ত প্রয়োজনে যদি টাকার অংক উল্লেখ না-ই করেন, তবে চেকের গায়ে ঈপ্সিত টাকার সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিয়ে লিখে দিতে পারেন “নট ওভার……টাকা”।
সতের. চেকে অগ্রিম স্বাক্ষর করে রাখবেন না, যথাসম্ভব যখন ব্যাংকে উপস্থাপন করবেন তখনই স্বাক্ষর করবেন।
আঠার. দেনা বা দায় পরিশোধের পর জামানতের চেক ফেরত নিতে ভুলবেন না।
ঊনিশ. আপনার হিসাবের সকল জমা-উত্তোলনের রেকর্ড সংরক্ষণ করুন এবং ব্যাংক স্ট্যাটমেন্টের সাথে নিয়মিত ট্যালি করে মিলিয়ে নিবেন। আপনার মোবাইলে লেনদেনের এসএমএস নোটিফিকেশনগুলোতে চোখ রাখবেন। কোনো অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক লেনদেন প্রতীয়মান হলে তাৎক্ষণিকভাবে আপনার ব্যাংককে অবহিত করুন।
বিশ. জাল-জালিয়াতি রোধে আপনার চেক বইটি যথাসময়ে (আবেদনের ১০ দিনের মধ্যেই) আপনার ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করুন। চেক বই আপনি নিজে সংগ্রহ করবেন। বিশেষ প্রয়োজনে আপনার চেক বই গ্রহণের জন্য অন্য কোনো বাহক প্রেরণ করলে তার নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর উল্লেখপূর্বক তাঁর স্বাক্ষর সত্যায়িত করে ব্যাংকে অথারাইজেশন লেটার প্রদান করতে হবে।
একুশ. কোনো চেক বা সম্পূর্ণ চেক বই হারিয়ে গেলে বা চুরি হলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাংককে অবগত করুন। থানায় জিডি এন্ট্রি করিয়ে তার সত্যায়িত কপিসহ ব্যাংকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এবং নতুন চেকবই প্রদানের জন্য লিখিত আবেদন করুন।
বাইশ. কোনো চেক বাতিল (কেনসেল) করতে চাইলে চেকের গায়ে, টাকার অংকে, স্বাক্ষরে, চেক নম্বরে ও এমআইসিআর অংশের কোডগুলোতে একাধিক ক্রস চিহ্ন (×) একে দিন অথবা আড়াআড়িভাবে দুইটি সমান্তরাল দাগ টেনে মাঝে ‘বাতিল/কেনসেলড’ লিখে দিন অথবা চেকটি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ধ্বংস করে ফেলুন। চেক বাতিল বা ধ্বংসের তথ্য নিজে সংরক্ষণ করবেন এবং আপনার ব্যাংককেও অবগত করবেন।
তেইশ. নতুন চেক বইয়ের জন্য বর্তমান চেক বই নিঃশেষ হওয়ার আগেই চেকের শেষাংশে সংযুক্ত চেক রিকুইজিশন বা চেক রিকুয়েস্ট স্লিপের মাধ্যমে আবেদন করুন। ইন্টারনেট ব্যাংকিং অপশন অথবা ব্যাংকের মোবাইল অ্যাপ (যদি থাকে) ব্যবহার করেও আবেদন করতে পারেন।
চব্বিশ. চেক হয়ত ইংরেজি ভাষায় প্রিন্টেড হতে পারে। তবে আপনি চাইলে বাংলা অথবা ইংরেজি যেকোনো ভাষায় চেক লিখতে পারেন। কিন্তু উভয় ভাষার মিশ্রণ ঘটালে চেকটি প্রত্যাখ্যাত হতে পারে।
পঁচিশ. কোনো চেকের পেমেন্ট যৌক্তিক কোনো কারণে (যেমন- পাওনাদারের পাওনা ইতোমধ্যে নগদে বা অন্য কোনোভাবে হয়ত পরিশোধ করে ফেলেছেন অথবা কোনো চেক হারিয়ে গেলে বা চুরি হলে) স্টপ করাতে চাইলে আপনার হিসাব নম্বর, সংশ্লিষ্ট চেকের নম্বর, পেমেন্ট স্টপ করার কারণ উল্লেখপূর্বক আপনার ব্যাংকে লিখিত আবেদন করুন।
ছাব্বিশ. চেক গ্রহণকালে চেকের পাতা সংখ্যা গুনে-বুঝে নিবেন এবং প্রতিবার চেক ইস্যুর পরও চেক লিফের ব্যালেন্সিং করবেন।
সাতাশ. নিয়মিত লেনদেন করে হিসাবটি অপারেটিভ রাখুন আটাশ. মনে রাখবেন, চেক কেবল এক টুকরো কাগজ নয়। ইহা একটি লিগ্যাল ডকুমেন্ট যা চেকদাতা এবং চেকগ্রহীতার লেনদেনের একটি আইনি চুক্তি। চেক অনেকটাই নগদ অর্থের সামিল এবং ইহার ডিজঅনার ও জালিয়াতিপূর্ণ ব্যবহার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই আপনার চেকের নিরাপদ ও সযত্ন হেফাজত (আন্ডার লক এন্ড কি) করুন এবং নিশ্চিত করুন- আপনার চেকটি যেন কোনোভাবেই রংহ্যান্ডেড না হয়।
চেকগ্রহীতার সতর্কতাঃ
বর্তমানে মুদ্রিত এমআইসিআর চেক ইস্যু করে ব্যাংক। তাই আগে থেকে চেকে বেশ কিছু তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবেই গ্রাহক পেয়ে যান, যেমন- ব্যাংক ও শাখার নাম, হিসাবের নাম ও নম্বর, শাখার রাউটিং নম্বর, চেক নম্বর। তাই কোনো চেক গ্রহণ করার আগে উপরিউল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়াও আরও যেসব বিষয়গুলো মিলিয়ে নিবেন তা হচ্ছে-
এক. প্রথমেই দেখে নিবেন চেকের চারটি এপারেন্ট টেনর (তারিখ, প্রাপক, টাকার পরিমাণ, স্বাক্ষর) যথাযথভাবে লিখা আছে কিনা?
দুই. চেকের নিচের অংশে এমআইসিআর কোড ব্যান্ডে যেন কোনো ভাঁজ, সীল, স্ট্যাপল, পিন, পেস্ট, ঘষা-মাজা (টেম্পারিং), লেখা, দাগ টানা ইত্যাদি না করা হয়। তাহলে চেকটি ইলেকট্রনিক্যালি ইনভেলিড হয়ে যাবে।
তিন. জামানতের চেকের ক্ষেত্রে আপনার দায়িত্ব হচ্ছে, চেকে চেকদাতার স্বাক্ষরটি তাঁর নমুনাস্বাক্ষরের সাথে মিল আছে কিনা তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে গিয়ে যাচাই করা। তা না হলে ভবিষ্যতে চেক প্রেজেন্ট করলে হয়ত দেখবেন, চেকদাতার হিসাবে ব্যালান্স আছে কিন্তু স্বাক্ষর অমিলের কারণে আপনি চেকটি ভাঙ্গাতে পারছেন না, কারণ চেকদাতা ইচ্ছা করেই প্রতারণার উদ্দেশ্য ভিন্ন বা গড়মিল স্বাক্ষর প্রদান করেছেন। হিসাবটি চালু আছে কিনা, ইস্যুকৃত চেকটি একাউন্টহোল্ডার কর্তৃক স্টপ বা লস্ট বা স্টুলেন মার্ক করা কিনা তা-ও জেনে নিবেন।
চার. প্রতিষ্ঠানের হিসাব হলে স্বাক্ষরের সাথে সীলযুক্ত আছে কিনা তা দেখে নিবেন।
পাঁচ. যদি আপনি ‘একাউন্ট পেইয়ি’ চেক গ্রহণ করেন, তাহলে খেয়াল রাখবেন- চেকে আপনার নামের বানানটি যেন আপনার ব্যাংক হিসাবের নামের সাথে মিল থাকে। আপনার যদি কোনো ব্যাংক একাউন্ট না থেকে থাকে, তাহলে চেকে আপনার নামটি আপনার এনআইডির সাথে হুবহু মিল রেখে লিখাবেন এবং চেকটি উপস্থাপনের সময় আপনার এনআইডির কপি সংযুক্ত করবেন।
ছয়. চেক যথাসম্ভব চেকদাতাকে দিয়েই লিখাবেন এবং আপনার সামনেই স্বাক্ষর করাবেন। এতে করে চেকদাতা পরবর্তীতে ‘এই চেক সে দেয়নি’ বা ‘স্বাক্ষর সে করেনি’ মর্মে অস্বীকার করার সাহস পাবে না। তাছাড়া আপনার অনুপস্থিতিতে সে অন্য কাউকে দিয়ে (যেমন ছেলে, স্ত্রী, কর্মচারী) চেক স্বাক্ষর করিয়ে নিজের স্বাক্ষর বলে চালিয়ে দিতে পারে এবং পরে আদালতে ‘এই স্বাক্ষর তাঁর নিজের নয়’ বলে স্বীকারোক্তি দিয়ে আপনার বিরুদ্ধেই চুরি, প্রতারণা বা চেক জালিয়াতির মামলা ঠুকে দিতে পারে।
সাত. এছাড়াও খেয়াল করবেন- চেকে চেকদাতার টাইপকৃত নাম আছে কিনা। তা-নাহলে দেখা যাবে চাতুর্যের সাথে প্রতারণার উদ্দেশ্যে চেকদাতা অন্যের চেকে (যেমন স্ত্রীর বা অন্য কারোর চেকে) নিজে স্বাক্ষর করে আপনাকে দিয়ে দিবে, যে চেক দিয়ে আপনি কখনোই টাকা উত্তোলন বা আদায় করতে পারবেন না, উল্টো নিজেই ফেসে যেতে পারেন।
আট. নগদ গ্রহণের জন্য ক্যাশ কাউন্টারে চেকের সাথে সংযুক্ত টোকেনটি জমা করুন। বিয়ারার চেকের ক্ষেত্রে এই টোকেনের মাধ্যমেই ক্যাশ পেয়িং কর্মকর্তা আপনাকে চেকের প্রকৃত বাহক হিসাবে সনাক্ত করবে।
নয়. চেকের অর্থ গ্রহণকালে চেকের পিছনে নামের পূর্ণ স্বাক্ষর করুন (আপনি নিজেই যদি চেকের ড্রয়ার হন, তাহলে ব্যাংকে সংরক্ষিত নমুনা স্বাক্ষর অনুসারে স্বাক্ষর করবেন)।
দশ. চেকদাতার মৃত্যু, মানসিক বৈকল্য ও দেউলিয়াত্বে কিংবা আদালতের গার্নিশি অর্ডার থাকলে চেকদাতার হিসাবের কোনো চেক নগদায়ন করতে পারবেন না। তাছাড়া নিয়মিত লেনদেনের অভাবে চেকদাতার হিসাবটি ইনঅপারেটিভ হয়ে গেলেও ওই হিসাবের কোনো চেক নগদায়ন করা যাবে না। তাই যথাশীঘ্র চেকের পেমেন্ট গ্রহণ করবেন।
এগার. চেকটি যেন মিউটিলেটেড (স্যাঁতস্যাঁতে, ভাঁজপড়া, মেটে, জোড়াতালি দেওয়া, ঘষা-মাজা করা, কালি বা রঙ-মাখা) না হয়।
বার. প্রাপক বা এনডোর্সি হিসেবে আপনার অধিকার সীমিত বা বারিত করে এমন কোনো এনডোর্সমেন্ট আছে কিনা দেখে নিবেন।
তের. কোনো চেকের জেনুইটি নিয়ে সন্দেহ হলে নিকটস্থ ব্যাংক শাখায় চেক সনাক্তকারী মেশিনে যাচাই করে নিবেন।
চৌদ্দ. চেক মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগে ব্যাংকে উপস্থাপন করুন।
পনের. ব্যাংকের বিজনেস আওয়ারে (সকাল ১০ টা হতে বিকাল ৪ টা) চেক প্রেজেন্ট করুন। তবে অনলাইন বা ব্যাচ-এর চেক হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই উপস্থাপন করতে হবে।
ষোল. আপনি যদি চেকের নগদ উত্তোলন করতে চান এবং নগদ প্রদানকারী শাখার গ্রাহক না হয়ে থাকেন, তবে চেকের সাথে আপনার এনআইডির কপি ও মোবাইল নম্বর সংযুক্ত করবেন।
সতের. চেকটি আপনার হিসাবে জমা করাতে চাইলে নির্দিষ্ট জমা স্লিপে আপনার হিসাব ও চেকের তথ্যাদি, নাম, মোবাইল নম্বর উল্লেখপূর্বক জমাস্লিপটি স্বাক্ষর করে চেকসহ জমা করুন এবং জমা রশিদের কার্বন কপি বা ডুপ্লিকেট গ্রহণ করুন। ড্রয়ার যদি ইতোমধ্যে চেকে এনডোর্স না করে থাকেন, তাহলে জমার আগে চেকের পিছনে নির্ধারিত স্থানে প্রাপকের নাম (আপনার হিসাবের নাম), হিসাব নম্বর লিখে নিচে আপনি স্বাক্ষর করে এনডোর্স করে দিন।
আঠার. অনেকেই চেক ভেঙ্গে বা কয়েক ভাঁজে ভাঁজ করে পকেটে বা মানিব্যাগে রাখেন। এমনটা কখনই করবেন না।
ঊনিশ. চেকটি যদি অন্য কোনো ব্যাংকের বা একই ব্যাংকের ভিন্ন কোনো শাখার হয়ে থাকে, তবে ব্যাংক নির্দিষ্ট হারে কালেকশন চার্জ আদায় করবে। আর এই চেক কোনো কারণে ডিজঅনার হলেও ডিজঅনার চার্জ আদায় করা হবে আপনার কাছ থেকেই।
কত দিনের মধ্যে চেক উপস্থাপন বা ডিজঅনার করাবেনঃ
চেক গ্রহীতাকে মনে রাখতে হবে, চেকে উল্লিখিত তারিখে অথবা উল্লিখিত তারিখ হতে পরবর্তী ছয় মাসের (অথবা চেকে উল্লিখিত মেয়াদের মধ্যে যেটি কম) মধ্যেই পরিশোধকারী ব্যাংকে চেকটি নগদায়নের জন্য উপস্থাপন করতে হবে। চেকে উল্লিখিত তারিখের আগে চেক উপস্থাপন করলে এই চেক পরিশোধকারী ব্যাংক ‘পোস্ট ডেটেড চেক বা অগ্রিম তারিখযুক্ত চেক’ বলে প্রত্যাখ্যান করবে। অন্যদিকে চেকের মেয়াদ ছয় মাস (অথবা চেকে উল্লিখিত মেয়াদের মধ্যে যেটি কম) অতিবাহিত হয়ে গেলে ব্যাংক চেকটিকে ‘স্ট্যাল চেক বা মেয়াদোত্তীর্ণ চেক’ বলে প্রত্যাখ্যান করবে। উভয়ক্ষেত্রেই চেকগ্রহীতা ১৩৮ ধারায় কোনো আইনি প্রতিকার পাবে না।
শুধু কি ‘তহবিল অপর্যাপ্ততা’ই‘ চেক ডিজঅনার’ এবং শাস্তিযোগ্যঃ
নেগোসিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাক্ট, ১৮৮১ এর ১৩৮ থেকে ১৪১ ধারাগুলো চেক ডিজঅনারের অপরাধ ও শাস্তির বিধান সম্পর্কিত। তবে অপরাধ এবং শাস্তি ১৩৮ ধারাতেই নির্ধারিত হয়। অনেকেই মনে করেন, শুধু ‘তহবিল অপর্যাপ্ততা’ই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে তহবিল অপর্যাপ্ততার কারণে চেক ডিজঅনার না হয়ে আমলযোগ্য অন্য কোনো কারণে, যা চেক দাতার প্রতারণাপূর্ণ মনোভাব প্রমাণ করে, ডিজঅনার হলেও এ ধারার অপরাধ হবে। কারণ পর্যাপ্ত তহবিল থাকার পরও একটি চেক অন্য একাধিক কারণে ডিজঅনার হতে পারে যেখানে ড্রয়ারকে দোষী সাব্যস্ত করার যৌক্তিক কারণ থাকে। যেমন- ‘রিফার টু ড্রয়ার’, ‘সিগনেচার ডিফারস’, ‘সিগনেচার ইনকমপ্লিট’, ‘পেমেন্ট স্টপড বাই ড্রয়ার’, ‘একাউন্ট ক্লোজড’, ‘এডভাইস নট রিসিভড’ ইত্যাদি।
স্বয়ংক্রিয় স্বাক্ষরযুক্ত চেকঃ
স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রিন্টেড বা রাবার স্ট্যাম্পের ইমপ্রেসড স্বাক্ষরযুক্ত চেকের প্রতিকার বিষয়ে আইনে কিছু বলা নেই। তথাপি বর্তমানে অনেক কর্পোরেট চেকে সিগনেটরির স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রিন্টেড বা ইম্প্রেসড স্বাক্ষর থাকে। কারণ, কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের ব্যস্ত প্রধানের পক্ষে হয়ত দিনে ১০০টি চেকে স্বাক্ষর করা সম্ভব নয়। এসব ক্ষেত্রে কোম্পানী স্বয়ংক্রিয় স্বাক্ষরযুক্ত চেক ইস্যু করে থাকে। তবে এসব চেক গ্রহণকালে চেকদাতা প্রতিষ্ঠানের ধরন, সুনাম, আর্থিক ভিত্তি, চেক পরিশোধের অতীত রেকর্ড ইত্যাতি বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
চেক উপস্থাপনকারী পেয়িং ব্যাংকের ওয়াক-ইন কাস্টমার হলে চেক ডিজঅনার করা যাবে কিঃ
চেক যদি ক্রসড চেক না হয় তাহলে চেক উপস্থাপনকারীকে হিসাবধারী গ্রাহক হওয়া নিষ্প্রয়োজন। তবে চেক ডিজঅনারের পরিণতি বিবেচনায় এক্ষেত্রে চেক উপস্থাপনকারীর পরিচিতি জ্ঞাত হওয়া উচিত। তাই ওয়াক-ইন কাস্টমার (হিসাবধারী নয় এমন গ্রাহক) কর্তৃক উপস্থাপিত চেক ডিজঅনার করতে ব্যাংক চেকের বাহক বা প্রেজেন্টারের এনআইডি গ্রহণ, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর সংরক্ষণ করে, যাতে করে আদালত ব্যাংককে স্বাক্ষী হিসেবে তলব করলে বা প্রতিবেদন দাখিল করতে বললে ব্যাংক যেন তখন চেকের বাহক সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করতে পারে। ডিজঅনার করার পর ডিজঅনারকৃত চেক ও ডিজঅনার মেমোর ফটোকপি ব্যাংক সংগ্রহে রেখে মূল চেক ও ডিজঅনার মেমো চেকের বাহক বা প্রেজেন্টারকে প্রদান করে ডিজঅনার রেজিস্টারে তার প্রাপ্তিস্বীকারমূলক স্বাক্ষর রাখবে।
প্রাপকের ঘরে ‘ক্যাশ’ বা ‘সেল্ফ’ লেখা চেকে মামলা করা যাবে কিঃ
এক্ষেত্রে চেক উপস্থাপনকারী চেকদাতা নিজেই হলে কোনো অপরাধ সংঘটিত হবে না। তবে চেকের ধারক যদি চেকদাতার পাওনাদার হয় বা যথানিয়মে ধারক হয় তাহলে ১৩৮ ধারায় বিচার্য হবে। তবে এক্ষেত্রে মামলা দুর্বল হওয়ার অনেক উপাদান থেকে যাবে এবং এক্ষেত্রে ধারক কর্তৃক আদালতকে বুঝাতে এবং প্রমাণ করতে সমর্থ হতে হবে যে সে-ই চেকের যথানিয়মে ধারক।
কে মামলা করবেঃ
যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে (প্রাপক, এনডোর্সি, যথানিয়মে ধারক) চেক দেওয়া হয়েছে সে ব্যক্তি বা তার পাওয়ার অব অ্যাটর্নি হোল্ডার, প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা প্রতিনিধিই মামলা করতে পারবে।
কতবার ডিজঅনার করাবেনঃ
অনেকেই মনে করেন মামলা করার জন্য চেকটি তিনবার ডিজঅনার করাতে হয়। এ ধারণাটি আইনসম্মত নয়। একবার ডিজঅনার হলেই মামলা করা যাবে।
আইনি নোটিস ও মামলাঃ
ডিজঅনার হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে চেকের ড্রয়ারকে (চেকদাতা) চেক ডিজঅনার হওয়ার বিষয়টি জানিয়ে ৩০ দিনের সময় দিয়ে চেকে উল্লিখিত অংকের টাকা প্রদানের দাবি জানিয়ে নির্ধারিত নিয়মে একজন আইনজীবীর মাধ্যমে আইনি নোটিস প্রদান করতে হবে। চেকের প্রাপক বা যথানিয়মে ধারক নিজেও উক্ত নোটিস প্রদান করতে পারেন। তবে আইনজীবীর মাধ্যমে করাই ভালো। কোনোভাবেই নোটিস প্রেরণ না করে সরাসরি মামলা করা যাবে না। চেক প্রদানকারী নোটিস প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে চেকের প্রাপক বরাবরে চেকে উল্লিখিত অংকের টাকা পরিশোধ ব্যর্থ হলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যেই মামলা করতে হবে। তিন পদ্ধতিতে নোটিস দেওয়া যাবে-
এক. চেক ইস্যুকারীকে সরাসরি নোটিস প্রদান করে। তবে এক্ষেত্রে নোটিসের অনুলিপিতে প্রাপ্তি স্বীকারস্বরুপ নোটিসগ্রহীতা চেকদাতার স্বাক্ষর রাখতে হবে।
দুই. নিয়মিত বাসস্থানের ঠিকানায় অথবা বাংলাদেশের যে স্থানে সর্বশেষ বসবাস করেছেন বা ব্যবসা করেছেন সেই ঠিকানায় রেজিস্টার্ড এডি ডাকযোগে।
তিন. বহুল প্রচারিত যেকোনো একটি জাতীয় দৈনিক বাংলা পত্রিকায় নোটিস প্রকাশ করে।
ডিজঅনারকারী ব্যাংক নির্ধারণঃ
১৮৮১ সালে করা আইন দিয়ে বর্তমান সময়ে চেক ডিজঅনার করতে কালেক্টিং ব্যাংকার ও পেয়িং ব্যাংকারের ঠেলাঠেলির কারণে কখনও কখনও সমস্যায় পড়তে হয় গ্রাহককে। কারণ তৎকালীন সময়ে বা কয়েক বছর আগের ব্যাংকিং ব্যবস্থার কথাও যদি বিবেচনা করি, তাহলে দেখতে পাই, আগের দিনে একটি চেকের পেমেন্ট নিতে চেকের প্রাপককে চেকদাতার শাখায় গিয়ে তারপর চেকটির নগদ পেমেন্ট নিতে হত, অথবা প্রাপক তার নিজের ব্যাংকের (চেকদাতার ব্যাংকের একই বা ভিন্ন কোনো শাখা যেখানে প্রাপকের একাউন্ট আছে, অথবা অন্য কোনো ব্যাংকের শাখা যেখানে প্রাপকের একাউন্ট আছে) মাধ্যমে নিজের হিসাবে কালেকশন করিয়ে নিতেন। বর্তমানেও এ পদ্ধতিগুলো চালু আছে। তবে এর পাশাপাশি চেক পরিশোধ পদ্ধতিতে অনেক যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে– যোগ হয়েছে অনলাইন, ব্যাচ এর মত একাধিক নতুন, দ্রুততর ও প্রযুক্তিনির্ভর পদ্ধতি।
অনলাইন ব্যাংকিংয়ের ফলে এক শাখার চেক একই ব্যাংকের অন্য শাখা থেকে ক্যাশ করা যাচ্ছে। ব্যাচের মাধ্যমে এক ব্যাংকের চেক অন্য ব্যাংকের মাধ্যমে কালেকশন হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনেই। তবে সমস্যা দেখা দিচ্ছে নতুন এসব পদ্ধতিতে চেক ডিজঅনার করা নিয়ে। যেমন –
এক. একই ব্যাংকের অন্য কোনো শাখা হতে অনলাইনে উত্তোলন করতে গেলে ডিজঅনারকারী শাখা নির্ধারণ।
দুই. ভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ওবিসি বা ব্যাচের মাধ্যমে কালেকশনের উদ্দেশ্য জমাকৃত চেক ডিজঅনার হলে, ডিজঅনারকারী ব্যাংক হিসাবে গ্রাহককে ডিজঅনার মেমো কে দিবে?
মামলার স্থানীয় অধিক্ষেত্র এবং স্বাক্ষী হিসেবে আদালত কী পেয়িং ব্যাংকারকে তলব করবে নাকি কালেক্টিং ব্যাংকারকে তলব করবেঃ
ধরি, জনাব মির্জা আসাদুল্লাহ গালিব একটি চেকের গ্রহীতা। জনাব মির্জা আসাদুল্লাহ গালিব-এর (চেক গ্রহীতা) ব্যাংক একাউন্ট ন্যাশনাল ব্যাংকের কিশোরগঞ্জ শাখায়। অন্যদিকে চেকদাতার একাউন্ট হচ্ছে প্রাইম ব্যাংকের রাজশাহী শাখায়। এখন প্রাইম ব্যাংকের চেকটি ন্যাশনাল ব্যাংক কিশোরগঞ্জ শাখা (কালেক্টিং ব্যাংক) তার গ্রাহক জনাব মির্জা আসাদুল্লাহ গালিব-এর হিসাবে জমা করার উদ্দেশ্যে BACH এর মাধ্যমে উপস্থাপন করার পর প্রাইম ব্যাংক রাজশাহী শাখা চেকটি তহবিল অপর্যাপ্ততার কারণে ডিজঅনার করলে মামলার স্থানীয় অধিক্ষেত্র কোনটি হবে– কিশোরগঞ্জ নাকি রাজশাহী? এক্ষেত্রে যে ব্যাংকে চেকটি পরিশোধের জন্য উপস্থাপন (প্রেজেন্ট) করা হয়েছে, সেই ব্যাংক (পেয়িং বা পরিশোধকারী ব্যাংক) যে আদালতের স্থানীয় অধিক্ষেত্রে অবস্থিত সেই আদালতে মামলাটি দায়ের করতে হবে। উপরিউল্লিখিত ক্ষেত্রে চেকটি পরিশোধকারী ব্যাংক, অর্থাৎ প্রাইম ব্যাংকের রাজশাহী শাখা যে আদালতের স্থানীয় অধিক্ষেত্রে অবস্থিত সেই আদালতে মামলাটি দায়ের করতে হবে। অন্যদিকে প্রাথমিকভাবে স্বাক্ষী হিসেবে আদালত পেয়িং ব্যাংকারকেই তলব করবেন।
আমলী আদালত ও বিচারিক আদালতঃ
এই মামলা নালিশি মামলা বা সিআর মামলা হিসেবে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করতে হবে। মামলা করার সময় আদালতে মূল চেক, ডিজঅনারের রসিদ, আইনি নোটিশ বা বিজ্ঞপ্তির কপি, পোস্টাল রসিদ, প্রাপ্তি রসিদ প্রদর্শন করতে হবে। এসবের ফটোকপি ফিরিস্তি আকারে মামলার আবেদনের সঙ্গে দাখিল করতে হবে। তবে মামলার বিচার/নিষ্পত্তি হবে দায়রা জজের আদালতে।
শাস্তিঃ
চেক ইস্যুকারী ব্যক্তির অপরাধ প্রমাণিত হলে আদালত তাঁকে এক বছরের কারাদন্ড অথবা চেকে বর্ণিত অর্থের তিনগুণ পর্যন্ত অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করতে পারেন।
দেওয়ানী আদালতে মামলাঃ
যদি বিচারক এনআই আ্যাক্টের ১৩৮(১) উপধারা মোতাবেক দন্ড প্রদান করেন তথাপিও চেকের গ্রহীতা বা ধারক চেকে বর্ণিত সম্পূর্ণ বা আংশিক অনাদায়ী টাকা আদায়ের জন্য দেওয়ানি আদালতে মোকদ্দমা (মানি স্যুট) করতে পারবেন। তবে চেকের গ্রহীতা বা ধারক চাইলে এনআই আ্যক্টে মামলা চলাকালীন সময়ে বা এনআই আ্যাক্টে মামলা করার আগে-পরেও মানি স্যুট করা যাবে। কারণ দুই আদালতের মামলাই স্বতন্ত্রভাবে পাশাপাশি চলতে পারে। তবে সর্বশেষ ডিজঅনারের তারিখ থেকে ৩ বৎসরের মধ্যে মানি স্যুট করতে হবে।
আপীলঃ
ধারা ১৩৮ এর উপধারা-(১) এ প্রদত্ত দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপীলের সুযোগ আছে। তবে আপীল করার পূর্বশর্ত হচ্ছে, চেকে বর্ণিত টাকার কমপক্ষে ৫০ শতাংশ টাকা যে আদালত দণ্ড প্রদান করেছেন সেই আদালতে জমা দিতে হবে চেক ইস্যুকারীকে ।
এনআই আ্যাক্টে মামলা করতে না পারলেঃ
নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্টের ১৩৮ ধারার বিধানমতে যথাসময়ে অথবা যথানিয়মে মামলা দায়ের করতে না পারলে দণ্ডবিধির ৪০৬ এবং ৪২০ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে কিংবা থানায় ফৌজদারী মামলা দায়ের করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে টাকা ফেরত পাওয়ার সুযোগ নেই। দোষী সাব্যস্ত হলে সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে।
লেখকঃ মোশারফ হোসেন, ব্যাংকার