অর্থনীতি

নিম্ন সুদহার নীতি আর উচ্চ সুদহার ঝুঁকির চক্রে ব্যাংক

ড. শহীদুল জাহীদঃ বাণিজ্যিক ব্যাংকিংয়ের প্রধানতম দুটি কাজ হচ্ছে আমানত গ্রহণ ও ঋণ প্রদান। আমানত গ্রহণের ওপর ব্যাংক সুদ প্রদান করে, যা ব্যাংকের জন্য তহবিল জোগান খরচ বা সুদ ব্যয়। অন্যদিকে ঋণ প্রদানের ওপর বাণিজ্যিক ব্যাংক সুদ অর্জন করে, যা তাদের জন্য সুদ আয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সুদ আয় হার এবং সুদ ব্যয় হারের পার্থক্যকে অর্থনীতির পরিভাষায় নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন বা স্প্রেড বলা হয়।

বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন বা স্প্রেড বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ চলকের নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন একই সঙ্গে ব্যাংকের কর্মদক্ষতা (পারফরম্যান্স) ও লাভজনকতা (প্রফিটাবিলিটি) পরিমাপক। নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন যখন কর্মদক্ষতা নির্দেশক, তখন মনে করা হয় যে ব্যাংকের নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন যত কম, সেই ব্যাংক তত বেশি কর্মদক্ষ। প্রকারান্তরে, লাভজনকতার দৃষ্টিকোণ থেকে ঠিক উল্টো ধারণা দেয় নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন। অর্থাৎ যে ব্যাংকের নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন বেশি, সেই ব্যাংক তত বেশি লাভজনক।

এক্ষেত্রে কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্মদক্ষতা, না লাভজনকতা—এ দুটির কোনটিকে তাদের ব্যাংক ব্যবসার উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করবে, তার ওপর নির্ভর করে। বিশদভাবে বলতে গেলে, কোনো ব্যাংক যদি কর্মদক্ষতাকে প্রাধান্য দেয়, তবে তারা তুলনামূলক কম ইন্টারেস্ট মার্জিন নিয়েও সন্তুষ্ট থাকতে পারে। অন্যদিকে ব্যাংক যদি লাভজনকতাকে প্রাধান্য দেয়, তবে উচ্চ নেট ইন্টারেস্ট বা সুদ মার্জিনকে ব্যবসার লক্ষ্য হিসেবে স্থির করবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অন্যান্য লাভজনক প্রতিষ্ঠানের মতোই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বলেই তাদেরও প্রধানতম উদ্দেশ্য থাকে যেকোনো মূল্যে লাভজনকতা অর্জন করা এবং তা ধরে রাখা। সেক্ষেত্রে ধরে নেয়া যায়, অন্য সবকিছু অপরিবর্তিত থাকলে উচ্চ নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর উচ্চ লাভজনকতা নিশ্চিত করতে পারে।

অন্যদিকে স্থিতিশীল নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সুদ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অন্যতম লক্ষ্য। ইন্টারেস্ট রেট রিস্ক বা সুদহারের ঝুঁকি বলতে বোঝায় কোনো কারণে বাজারে সুদহারের তারতম্য ঘটলে ব্যাংকের লাভজনকতা যদি হুমকির মুখে পড়ে, সেক্ষেত্রে সুদহার বৃদ্ধি বা হ্রাস উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাংকের লাভজনকতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দুই ধরনের ইন্টারেস্ট রেট রিস্কের কথা এখানে আলোচিত হতে পারে। এক. পুনর্মূল্যায়ন সুদহার ঝুঁকি এবং দুই, পুনর্বিনিয়োগ সুদহার ঝুঁকি। মূল্যায়ন ঝুঁকি অনুযায়ী বাজারে সুদহার বৃদ্ধি পেলে ব্যাংকের বিনিয়োগ পোর্টফোলিওর মূল্য পড়ে যাওয়াকে বোঝায়।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হতে পারে। ধরা যাক কোনো ব্যাংক ১০ শতাংশ স্থায়ী সুদে বিনিয়োগ করেছে। সে বন্ড বা বাণিজ্যিক ঋণ যা-ই হোক না কেন। কিন্তু বাজারে কিছুদিনের মধ্যেই সুদহার বেড়ে গেল এবং সমজাতীয় কোনো ব্যাংক সেই উচ্চ বাজার সুদে বিনিয়োগ করল। তখন প্রথমোক্ত ব্যাংকের সুদ আয়, প্রকারান্তরে লাভ শেষোক্ত ব্যাংকের তুলনায় কম হবে। আবার পুনর্বিনিয়োগ ঝুঁকি অনুযায়ী বাজারে সুদহার কমে যাওয়ার কারণে ব্যাংকের লাভজনকতা কমে যাওয়াকে নির্দেশ করে। এক্ষেত্রে বাজারে সুদহার পড়ে গেলে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান পূর্বাপর তুলনায় কম সুদহারে বিনিয়োগ এমনকি পুনর্বিনিয়োগ করতে বাধ্য হয়। সে রকম পরিস্থিতিতেও ব্যাংকের সামগ্রিক সুদ আয়ের পাশাপাশি মুনাফা কমে যেতে পারে।

ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন।

ব্যাংক ব্যবস্থাপকরা যেকোনো ধরনের সুদহার ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় খুবই সজাগ থাকেন। বলে রাখা ভালো, সুদহার ঝুঁকি ব্যাংকের মৌলিক ঝুঁকিগুলোর মধ্যে অন্যতম। সে কারণেই প্রায় প্রত্যেক বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও দক্ষ ঝুঁকি ব্যবস্থাপক নিয়োগ দিতে দেখা যায়। সুদহার ঝুঁকির ক্ষেত্রে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি ব্যবস্থাপকরা প্রথমে সুদ ঝুঁকি পরিমাপ করতে চেষ্টা করেন। নানা উপায়ে সুদহার ঝুঁকি পরিমাপের পরে তারা উপযুক্ত পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে ইন্টারেস্ট রেট রিস্ক বা সুদহার ঝুঁকি কমানোর ব্যবস্থা করেন।

বাণিজ্যিক ব্যাংক সুদহার ঝুঁকি কমাতে পারছে কিনা, তা দুটি উপায়ে বুঝতে পারা যায়। যথা সুদহার ঝুঁকি নিরসন পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যাংকের নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন বা স্প্রেড স্থিতিশীল বা অক্ষত আছে কিনা; দ্বিতীয়ত, প্রমিত পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে সুদহার ঝুঁকি কমেছে বা দূর হয়েছে, তা বোঝা যাবে যদি নেট ইকুইটি বা মালিক কর্তৃক সরবরাহকৃত মূলধন অটুট থাকে। বিস্তারিত আলোচনায় এটা প্রতীয়মান হয় যে অন্যান্য মান অপরিবর্তিত থাকলে নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন অথবা নেট ইকুইটি যদি অক্ষত বা অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে সেই ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদহার ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম।

বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সুদহার ঝুঁকি ক্রমে বাড়ছে। উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এক ডিজিটের সুদহার গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ বাণিজ্যিক ঋণের ওপর তারা সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদ আরোপ করবে, যেখানে তহবিল সংগ্রহের ক্ষেত্রে গড় সুদ ব্যয় হবে ৬ শতাংশ। ক্রেডিট কার্ডসহ অল্প কিছু ঋণের ওপর ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশের বেশি সুদ চার্জ করতে পারবে। বহুল আলোচিত এ ধরনের সুদ বাজারকে অনেকে ৯-৬ সুদহার বলেও আখ্যায়িত করেছেন।

যে নামেই আখ্যায়িত হোক না কেন, এ ধরনের ব্যবস্থাপনায় বাণিজ্যিক ব্যাংকের ন্যূনতম নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন বা স্প্রেড ৩ শতাংশ বা তার বেশি থাকার কথা। যেমন বাণিজ্যিক ঋণের ওপরে সুদ আয় ৯ শতাংশ এবং তহবিল জোগান ব্যয় সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ হলে নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন ৩ শতাংশ, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। অন্যদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংক যেহেতু ক্রেডিট কার্ডসহ কিছু ভোক্তা ঋণে কিছুটা উচ্চ সুদ আরোপ করার অধিকার রাখে, সেক্ষেত্রে তহবিল জোগান ব্যয় গড়ে ৬ শতাংশ হলেও নেট ইন্টারেস্ট মার্জিনের গড় ৩ শতাংশের ওপরে থাকার কথা।

উল্লেখ্য, নেট ইন্টারেস্ট মার্জিনের বৈশ্বিক গড় মান নিম্নমুখী হলেও বাংলাদেশের তুলনায় ঢের বেশি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের আন্তর্জাতিক আর্থিক পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১০ সালে নেট ইন্টারেস্ট মার্জিনের বৈশ্বিক গড় মান ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ আর ২০১৭ সালে তা কমে ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। ২০১৭ সালে বছরান্তে বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন ছিল ৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। আর ঠিক একই সময়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকে তা ছিল গড়ে ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

২০১৯ সালের আইএমএফের আইএফএস তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নেট ইন্টারেস্ট মার্জিনের গড় মান ২ দশমিক ৮ শতাংশ, যেখানে একই সময়ে বৈশ্বিক গড় নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যান্য ন্যায্যতায় দেখা যায়, ২০১৯ সালে উচ্চ আয়ের দেশগুলোয় নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন ছিল ৪ দশমিক ৯ শতাংশ, মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোয় ৬ দশমিক ৯ শতাংশ, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় তা ৬ দশমিক ২ শতাংশ। উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় ২০১৯ সালে নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন ছিল ৩ দশমিক ১ শতাংশ। উল্লিখিত যেকোনো পরিসংখ্যানের মানদণ্ডে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন অন্যদের তুলনায় যথেষ্ট পিছিয়ে।

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, এ দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন ক্রমহ্রাসমান। এক অংকের সুদহার তথা কথিত ৯-৬ সুদহার প্রচলন হওয়ার পরে এ দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন ক্রমে কমে যাচ্ছে। ২০২০ সালের এপ্রিলে সব ব্যাংকের গড় নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন ছিল ২ দশমিক ৯২ শতাংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের গড় ছিল যেখানে ২ দশমিক ৩১ শতাংশ, সেখানে বিদেশী ব্যাংকগুলোর গড় মান ছিল ৫ দশমিক ৩৭, আর দেশীয় ব্যক্তিমালিকানার ব্যাংকগুলোয় ২ দশমিক ৯১ শতাংশ। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, এ দেশে ২০২০ সালের অক্টোবর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর গড় নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন ২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, বিদেশী ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা ৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ এবং দেশীয় ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকগুয়োয় তা ২ দশমিক ৯৫ শতাংশ। তুলনামূলক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দেশীয় রাষ্ট্র বা ব্যক্তি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় নেট ইন্টারেস্ট মার্জিনের গড় মান ৩ শতাংশের কম হলেও বিদেশী মালিকানার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় তা ৩ শতাংশের চেয়ে যথেষ্ট বেশি।

এ দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নেট ইন্টারেস্ট মার্জিনের সামগ্রিক চিত্র বিশ্লেষণ যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। বিশেষত ব্যাংক ব্যবস্থাপক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কাছে তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এক অংকের সুদহার প্রবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক তফসিলি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য যথেষ্ট সুবিধাজনক পলিসি গ্রহণ করে। ব্যাংক রেট থেকে শুরু করে রেপো রেটের ক্ষেত্রেও ছাড় দেয়। যাতে এক অংকের সুদহার গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন তথা লাভজনকতা সংকুচিত না হয় বা অক্ষত থাকে।

অন্যদিকে সর্বসাধারণের সমান্তরাল বিনিয়োগ সুযোগ যেমন সরকারি বন্ড বা সঞ্চয়পত্রে সরকার বা ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষ সুদহার পরিবর্তন করে এবং কিছু ক্ষেত্রে কমিয়ে দেয়। স্বাভাবিকভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংক সে সুযোগে আমানতের সুদহারে বেশ সংকোচন করে। এক অংকের সুদহার নীতির বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ন্যূনতম নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন যাতে ৩ শতাংশ নিশ্চিত থাকে, তা ভেবে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ অনেক ক্ষেত্রেই নিষ্ক্রিয় বা উদার ভূমিকা পালন করে।

এখন প্রশ্ন হলো, নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের এত নিষ্ক্রিয় বা উদার ভূমিকার পরেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন পড়ে যাওয়ার কারণ বা কারণগুলো কী? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, সম্ভবত বহু কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের নেট ইন্টারেস্ট মার্জিনের সুরক্ষা দিতে পারছে না। অতি প্রতিযোগিতা একটি অন্যতম কারণ। মাত্রাতিরিক্ত প্রতিযোগিতার কারণে ব্যাংক হতে পারে ৯ শতাংশের কম সুদে বিনিয়োগ করতে বাধ্য হচ্ছে, অথবা ৬ শতাংশেরও বেশি সুদে তারা আমানত আকর্ষণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে তাদের নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন ৩ শতাংশের নিচে নেমে যাচ্ছে।

বর্তমান বছরটি যদিও ভিন্ন বাস্তবতায় আমাদের অতিবাহিত করতে হচ্ছে। করোনা মহামারীর কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতির সব ক্ষেত্রেই মন্দা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ মন্দা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বৈশ্বিক মহামন্দায় পরিগণিত হচ্ছে। করোনার অর্থনৈতিক প্রভাব মারাত্মক আকার ধারণ করবে এবং তা অন্যান্য খাতের ন্যায় ব্যাংকিং খাতেও নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে সন্দেহ নেই। এটি এক নতুন বাস্তবতা, আমাদের মেনে নিয়েই ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে।

কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে করোনার পাশাপাশি ৯-৬ সুদনীতির প্রভাবও মোকাবেলা করতে হবে। ৯-৬ সুদনীতির অন্যতম প্রভাব দেখা যাচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পুনর্বিনিয়োগ সুদ ঝুঁকির ক্ষেত্রে। এ দেশের ব্যাংকিং খাতে ইন্টারেস্ট রেট রিস্কের সামগ্রিক লক্ষণ বিদ্যমান। সেক্ষেত্রে মূল্যায়ন ঝুঁকির চেয়ে পুনর্বিনিয়োগ ঝুঁকির মাত্রা তুলনামূলক বেশি প্রতীয়মান হচ্ছে। আপাত মনে হচ্ছে, ব্যাংক ব্যবস্থাপকরা সুদহার ঝুঁকি নিরূপণ করতে সক্ষম হলেও সুদহার বা ইন্টারেস্ট রেট রিস্ক প্রশমন করতে পারছেন না। এর প্রামাণ্য উদাহরণ বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকিং খাতে বৈশ্বিক গড় মানের তুলনায় যথেষ্ট কমই নয়, ক্রমহ্রাসমান নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন। প্রশ্ন জাগে, নিম্ন সুদহার নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়েই ব্যাংকিং খাত উচ্চ সুদহার ঝুঁকিতে নয় তো?

লেখকঃ ড. শহীদুল জাহীদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button