ব্যাংকিং খাতের উন্নতি প্রয়োজন সবার আগে
নিরঞ্জন রায়ঃ উন্নয়নশীল দেশের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য আরো একটি যুগান্তকারী অর্জন। দেশের মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই সব অর্জন সাধিত হয় এবং এই অভাবনীয় অর্জনের পেছনেও তাদের অবদান সবচেয়ে বেশি, তাই এই অর্জনের কৃতিত্বও দেশের জনগণের। তবে যাঁর যোগ্য নেতৃত্বের কারণে এই অসাধারণ সফলতা এসেছে তিনি হলেন স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের এলডিসি (স্বল্প উন্নত দেশ) থেকে উন্নয়নশীল দেশের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃত লাভের ঘটনাটি আরো স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই কারণে যে এই সফলতাটি এমন সময় এসেছে, যখন দেশবাসী বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছে।
উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে উন্নয়নের জন্য আমাদের দীর্ঘ ৫০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই ৫০ বছর সময়ের বিরাট একটি অংশ দেশ শাসন করেছে স্বৈরাচারী সরকার, বিশেষ করে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনের শাসকগোষ্ঠী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত করে দেশকে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত করার অপচেষ্টা না হলে এই অর্জন অনেক আগেই সম্ভব হতো। যাই হোক, অনেক উত্থান-পতন এবং প্রতিকূলতা কাটিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বিগত এক যুগ একটানা দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন বিধায় অনেক যুগান্তকারী এবং সাহসী উদ্যোগ একদিকে যেমন গ্রহণ করতে পেরেছেন, অন্যদিকে তেমনি সফল বাস্তবায়নও নিশ্চিত করেছেন, যার ফলাফল এসেছে দেশের এত বড় অর্থনৈতিক অর্জনের মধ্য দিয়ে।
একটি স্বাধীন দেশের জন্য ৫০ বছর মোটেই তেমন কোনো বড় সময় নয়। পৃথিবীর অনেক দেশ ৫০ বছরেরও অধিক সময় ধরে চেষ্টা করেও এই অর্জনের ধারেকাছে আসতে পারেনি। আমাদের আশপাশের অনেক দেশের দিকে তাকালেই দেখা যাবে যে আজ অর্থনৈতিকভাবে সেসব দেশ কোথায় এবং আমরা কোথায় এসেছি।
আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে, যেমন—কৃষি, রপ্তানি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন প্রভৃতি, কিন্তু পিছিয়ে গেছে দেশের ব্যাংকিং খাত। নানা অনিয়ম দেশের ব্যাংকিং খাতের ওপর জেঁকে বসেছে এবং সমস্যা জর্জরিত একটি খাতে পরিণত করেছে। বিগত দুই দশকে দেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেড়েছে অনেক; কিন্তু এই খাতের মান বজায় রক্ষা সম্ভব হয়নি। এমনকি এই খাতে একেবারেই নজর দেওয়া হয়নি। অথচ দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নতির পূর্বশর্ত হলো ভালো মানের ব্যাংকিং খাত। দেশের সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংককে দেশের অর্থনীতিতে রক্ত সঞ্চালনের সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। ভালো মানের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নতি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
দুর্বল ব্যাংকিং খাতের কারণে শক্তিশালী অর্থনীতিও যে দুর্বল হয়ে যেতে পারে, তার বড় প্রমাণ জার্মানি। ইউরোপের মধ্যে তো বটেই, এমনকি বিশ্বের মধ্যে জার্মানি ছিল খুবই শক্তিশালী অর্থনীতি, কারণ তাদের ছিল খুব উন্নতমানের ব্যাংক ব্যবস্থা। ডয়েচ ব্যাংক ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ এবং শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠান; অথচ সেই ব্যাংক আজ নানা অনিয়মের কারণে বেশ দুর্বল ব্যাংকে পরিণত হয়েছে এবং সর্বাত্মক সরকারি সহযোগিতা নিয়ে কোনো মতে টিকে থাকার চেষ্টায় লিপ্ত।
শুধু তা-ই নয়, সার্বিকভাবে জার্মানির ব্যাংকিং খাত খবু ভালো অবস্থায় নেই এবং এর প্রভাব পড়েছে দেশের সার্বিক অর্থনীতির ওপর। জার্মান অর্থনীতি এখনো সেভাবে মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পক্ষান্তরে আমেরিকা এখন নানা অনিয়মে এবং অব্যবস্থায় জর্জরিত কিন্তু তাদের শক্তিশালী ব্যাংকিং ব্যবস্থার কারণে এখনো তারা বিশ্বের সেরা অর্থনীতির মর্যাদা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি ভারতেও একটি মানসম্পন্ন ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু ছিল দীর্ঘদিন এবং এর সুফল তারা পেয়েছে ক্রমাগত অর্থনৈতিক উন্নতির মাধ্যমে।
কিন্তু বিগত কয়েক বছরে তাদের ব্যাংকিং খাতে নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে এবং এর ফলে এই খাত বেশ ঝাঁকুনি খেয়েছে। মহা ক্ষমতাধর কেন্দ্রীয় ব্যাংক, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া অসহায়ের মতো বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রত্যক্ষ করছে এবং ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে চললেও তারা কিছুই করতে পারছে না। সরকার অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেও, এমনকি এই খাতে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ দিয়েও এই খাতের সমস্যা খুব সহসা দূর করতে পারছে না। আজ ভারতের যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ধীরগতি তার অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম একটি বড় কারণ সেই দেশের ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা।
এসব উন্নত এবং উন্নয়নশীল বিভিন্ন দেশের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে যথাযথ শিক্ষা গ্রহণের এখনই উপযুক্ত সময়। আমাদের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নীত নিশ্চিত করার স্বার্থে এবং সদ্য স্বীকৃতি পাওয়া উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা শুধু ধরে রাখাই নয়, একে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিতে হলে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে এক শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর কোনো বিকল্প নেই। অনেকেই ভাবতে পারেন কাজটা অসম্ভব, কিন্তু মোটেই তা নয়। মাত্র কয়েকটি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব এবং সেই সঙ্গে দেশের ব্যাংকিং খাতের মান একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অধিকতর ক্ষমতা প্রদান এবং এই প্রতিষ্ঠানের অধিক স্বনির্ভরতা, ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের মাধ্যমে খারাপ ঋণ প্রদান বন্ধ করা, ক্রমান্বয়ে খেলাপি ঋণ সমস্যার সমাধান, ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা, যোগ্য ও উপযুক্ত ব্যাংকারদের মূল্যায়ন করে উপযুক্ত স্থানে নিয়োগদানের মতো বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে পারলেই আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত ঘুরে দাঁড়াবে এবং এখানে সুস্থ ধারার ব্যাংকিং নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া এই কাজটি সঠিকভাবে এবং যত্নসহকারে সম্পন্ন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী যদি নিজে এদিকে নজর দেন এবং এই খাতের বিরাজমান সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেন, তাহলে এটি খুব সহজেই সমাধান করা সম্ভব। যদিও এই দায়িত্বটি মোটেই প্রধানমন্ত্রীর নয়, বরং অর্থ মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু বাস্তব অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া দেশের ব্যাংকিং খাতে সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনা মোটেও সম্ভব নয়। দেশের বিদ্যুৎ খাত, পদ্মা সেতুসহ অসংখ্য মেগাপ্রকল্পের বাস্তবায়ন, সর্বশেষ মহামারি করোনা ব্যবস্থাপনা এবং এর ভ্যাকসিন প্রয়োগের মতো অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন প্রধানমন্ত্রীর একক নেতৃত্বে।
এ কারণেই ব্যাংকিং খাতে সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি উদ্যোগের এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এখনো দেশে অনেক অভিজ্ঞ ব্যাংকার এবং যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি আছেন, যাঁদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা যেতে পারে, যে কমিটি সরাসরি রিপোর্ট করবেন প্রধানমন্ত্রীকে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশনা অনুযায়ী এই খাতের সমস্যা দূর করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কাজ করবেন। আমাদের মনে রাখা উচিত যে এই খাতের সমস্যাগুলো জানা, প্রয়োজন শুধু এই সমস্যা সমাধানে কাজ করে যাওয়া।
লেখকঃ নিরঞ্জন রায়, ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা।