ব্যাংকারের আত্মমর্যাদা রেখাঙ্কন
আত্মমর্যাদা মানুষের একটি বড় সম্পদ। মানুষ জ্ঞান-গরিমায় যত বড় হয়, তার আত্মমর্যাদাও সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে। ব্যক্তি পর্যায়ে যেমন আয়, শিক্ষা, সামাজিক স্তরের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি পেতে থাকে, তেমনি জাতীয় পর্যায়েও ওইসব চলকের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় মর্যাদা ও মূল্যবোধ বৃদ্ধি পায়। অনুন্নত দেশের একজন শ্রমিককে যেসব হীনকায় কাজে নিয়োগ করা যায়, উন্নত দেশের শ্রমিককে সেসব কাজে নিয়োগ করা যায় না। কারণ দুই দেশের শ্রমিকের মধ্যে আত্মমর্যাদায় অনেক তফাত আছে। পরনির্ভরশীল ও অনুন্নত অর্থনীতিতে জনগোষ্ঠীর মনমানসিকতাও গড়ে ওঠে হীন মর্যাদাসম্পন্নভাবে। অনুন্নয়নের জাঁতাকল থেকে বের হতে পারলে জনগোষ্ঠীর মনমানসিকতাও উন্নত হয়, আত্মমর্যাদাবোধও বৃদ্ধি পায়। এ আত্মমর্যাদাবোধ এমন একটি সম্পদ, যা একটি অমূল্য রতনের মতো।
টাই-স্যুট পরা সাহেব অফিসে যাওয়ার সময় জুতা পলিশওয়ালার কাছে গিয়ে জুতা পলিশ করালেন। সাহেব তার জুতা পায়ে ঢোকাতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু হাত না লাগালে জুতা পায়ে ঢুকছে না। তিনি হাত লাগানোর কষ্টটা নিজে না করে জুতা পলিশওয়ালাকে জুতাটা পায়ে ঢুকিয়ে দিতে বললেন। জুতা পলিশওয়ালা তা করতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। পলিশওয়ালা সাহেবকে জুতাটা পরিয়ে দিলেন না। কারণ ওই কাজটা করতে তার আত্মসম্মানবোধে আঘাত লাগে। শ্রমের বিনিময়ে উপার্জনে মর্যাদাবান সফল জীবন গড়া যায়, আত্মমর্যাদার বিনিময়ে নয়। জুতা পলিশওয়ালার আচরণই বলে দেয় দেশের আত্মমর্যাদার কতটুকু উত্তরণ ঘটেছে।
চিত্রকররা যখন একজন ভিক্ষুকের ছবি আঁকেন তখন দেখা যায়, যে লোকটার গায়ে অনেক তালিযুক্ত কিংবা ছেঁড়া কাপড় আছে, তিনিই ভিক্ষুক হিসেবে পরিচিত। যুগ পাল্টেছে। দেশের উন্নতি হয়েছে। উন্নয়নের ছবিটা সবখানে এসে পড়েছে। এমনকি ভিক্ষুকের গায়ে পর্যন্ত। তালিযুক্ত ভিক্ষুকের পোশাক এখন জাদুঘরেই দেখা মেলে। একসময় ভিক্ষুকরা পুরনো কাপড় চাইত পরার জন্য, যা ছেঁড়া হলেও চলত। কিন্তু এখন কোনো ভিক্ষুক পরিধানের জন্য পুরনো কাপড় ভিক্ষা চায় না। অর্থাৎ ভিক্ষুকরাও এখন ছেঁড়া কাপড় কিংবা ফেলনা কাপড় পরে না। ভিক্ষুক হলেই যে তার কোনো আত্মমর্যাদা নেই, তা তো নয়। দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ভিক্ষুকের আত্মমর্যাদাবোধেরও উন্নয়ন হয়েছে।
আশির দশকে বেসরকারি ব্যাংক বাজারে আসার পর বাংলাদেশে ব্যাংকিং সেবায় একটি নীরব বিপ্লব ঘটে যায়। চোখ ধাঁধানো ব্যাংক প্রাঙ্গণ, অতিশিক্ষিত স্মার্ট কর্মী, দ্রুততম সেবা এবং বৈচিত্র্যময় ডিপোজিট ও ক্রেডিট প্রডাক্ট নিয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলো জনগণকে তাক লাগিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রভূত স্বাক্ষর রাখে। ওই সময়ে এক ব্যবসায়ী বেসরকারি ব্যাংকের ম্যানেজারকে ফোনে বললেন, একটি বড় অংকের চেক জমা দেবেন তিনি। তাই চেকটি তার অফিস থেকে সংগ্রহ করার জন্য ব্যাংকের একজন অফিসার যেন তার অফিসে পাঠিয়ে দেন। ম্যানেজার সাহেব উত্তর দিলেন, ‘আমরা আপনাকে উত্তম সেবা নিশ্চিত করি, তার মানে এই নয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত একজন ছেলেকে তার আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে গ্রাহকদের সেবা দিতে হবে।’ ম্যানেজার সাহেব জানতে চাইলেন, ‘যে অনুরোধটা আমাকে করেছেন, সে অনুরোধটা কি একটি বিদেশী ব্যাংক কিংবা সরকারি ব্যাংকের ম্যানেজারকে করতে পারতেন?’ নিশ্চয়ই নয়? ম্যানেজার সাহেব তাকে পরামর্শ দিলেন চেকটি ব্যাংকে তার প্রতিনিধি মারফত পাঠিয়ে দিতে।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
বর্তমানে ব্যাংকিং সেবায় আরো গতি এসেছে। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকিং সেবায়ও এসেছে বহুমুখী উন্নতি। এরই সঙ্গে বেড়েছে ব্যাংকের সংখ্যা। তাই বেড়েছে আন্তঃব্যাংক প্রতিযোগিতা। আমানত সংগ্রহের প্রতিযোগিতা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় রূপ নেয়। এ অসুস্থতায় যেসব রোগের লক্ষণ ধরা পড়ে, তা পিলে চমকে যাওয়ার মতো। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সেবার নামে ব্যক্তি পূজা ও ব্যক্তি তোষণকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যেখানে আত্মমর্যাদার বালাই নেই, যা একজন জুতা পলিশওয়ালা কিংবা ভিক্ষুকও বিসর্জন দিতে পারে না। কিছু ক্ষেত্রে প্রতিভাত হয়েছে যে কিছু করপোরেট অফিসের আমানত পাওয়ার জন্য ওই অফিসের কর্তার মনোরঞ্জন করা যেন অপরিহার্য শর্ত হয়ে গেছে। বেশি রেট অফার করা তো আছেই, এর বাইরেও খুশির যা যা নমুনা প্রকাশ পায়, তাতে আত্মমর্যাদার শেষ বিন্দুটাকেও বিসর্জন দিতে হয়। কর্তার ব্যক্তিগত কাজ ও বাসার কাজগুলো করে দেয়ার জন্য একজন ব্যাংকারকে যখন ওই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নিয়োজিত করে, তখন সেবার নামে গ্রাহকদের কী দেয়া হচ্ছে, তা আমাদের ভাবিয়ে তোলে।
শুধু তা-ই নয়, এ কাজে নিয়োজিত অফিসারের মাধ্যমে যখন আশাতীত আমানত সংগৃহীত হয়, তখন ব্যাংকের সর্বোচ্চ মহল থেকে তাকে দেয়া হয় অস্বাভাবিক পুরস্কার ও অ্যাপ্রেসিয়েশন; যাতে অন্যরাও ওই অফিসারকে দেখে এসব কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। বেসরকারি ব্যাংকের জন্য তাই আত্মমর্যাদার সংজ্ঞাটিকে নতুনভাবে লেখা প্রয়োজন। যেমন এক পাওনাদার তার পাওনা টাকা অনেক চেষ্টার পরও আদায় করতে না পেরে একসময় রেগে গিয়ে দেনাদারকে জুতাপেটা করলে দেনাদার তার বন্ধু মহলে বলল, ‘আমাকে জুতাপেটা করেছে তো কী হয়েছে, অপমান তো করতে পারেনি!’ অপমানের সংজ্ঞাটি তার জন্য নিশ্চয়ই ভিন্ন।
ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন। |
বেসরকারি ব্যাংকের সেবাদানেও আত্মমর্যাদা হননকে কে কীভাবে সহ্য করছেন, তাও দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওসব অনৈতিক সেবা কারো কাছে অসম্ভব ব্যাপার আবার কারো কাছে একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপার। এতে গ্রাহকদের মাঝে ব্যাংকের সেবার সেরাটা কোন স্তরে গিয়ে পাওয়া যায়, তা বিরাট প্রশ্নবোধক হয়ে রয়ে গেছে। ব্যাংকের সেবার নামে ব্যাংকারদের আত্মসম্মানবোধকে বিসর্জন দেয়া কি নৈতিকতার স্তর তলানিতে পৌঁছে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন নয়!
জাতিসংঘ ঘোষিত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ধারা-২৩ (গ)-তে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘প্রত্যেক কর্মীর তার নিজের ও পরিবারে মানবিক মর্যাদা রক্ষার নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম এমন ন্যায্য ও অনুকূল পারিশ্রমিক এবং প্রয়োজনবোধে সেই সঙ্গে সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থাদি-সংবলিত লাভের অধিকার রয়েছে।’ মুনাফা ও আমানতের অস্বাভাবিক টার্গেটের চাপে পিষ্ট হয়ে শাখার কর্মকর্তারা ভুলে যান নৈতিকতার মানদণ্ড, শুদ্ধাচারের অপরিহার্যতা এবং আত্মমর্যাদার মূল্য। নিবন্ধটি আপনি পড়ছেন ব্যাংকিং নিউজ বিডি ডটকম-এ। আত্মমর্যাদাহীন পেশায় মেধাবী কর্মীদের আকর্ষণ করা যায় না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ব্যাংকিং পেশায় আকর্ষণ করার জন্য এটিকে আত্মমর্যাদাশীল পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার কোনো বিকল্প নেই।
প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য সেবার মান উন্নত করে গ্রাহকদের আকর্ষণ করা বাজার ব্যবস্থার মূলনীতি। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য অনৈতিক সেবা প্রদানের ইতিহাস নগণ্য নয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি যদি ব্যাংক হয়, সেক্ষেত্রে নৈতিকতার বিচ্যুতি সামান্যতম হলেও তা গর্হিত। কারণ ব্যাংক জনগণের আস্থার সর্বোচ্চ জায়গা। আস্থার ক্ষেত্রে আদালতের পরে কোনো প্রতিষ্ঠান যদি থাকে, সেটি হলো ব্যাংক। আর কেউ না হোক, যিনি অনৈতিক সুবিধা পাচ্ছেন, তার কাছে তো ওই ব্যাংকটির অবস্থান আত্মমর্যাদা, আত্মসম্মান ও ব্যক্তিত্ববোধের জায়গায় একেবারে তলানিতে।
বেসরকারি ব্যাংকের জন্মলগ্নে ব্যাংকারদের যে আত্মমর্যাদাবোধ ছিল, ব্যাংকের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্ম হওয়ার ফলে ব্যাংকারদের আত্মমর্যাদা কমতে থাকে। অর্থাৎ ব্যাংকের সংখ্যার বিপরীতে ব্যাংকারদের আত্মমর্যাদা রেখাটি ডানদিকে নিম্নগামী। এ অবস্থা থেকে যে করেই হোক ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ব্যাংকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও যাতে আন্তঃব্যাংক প্রতিযোগিতাটা অসুস্থ রূপ ধারণ না করে, তার নিশ্চয়তা বিধান অপরিহার্য। পরিপাটি ব্যক্তিত্বের অন্তরালে মর্যাদাহীন পেশা কাকের ময়ূরপুচ্ছ বলে উদাহরণ হয়ে যায়। তাই ব্যাংকারদের আত্মমর্যাদার স্থানে কোনোরূপ আপস কাম্য নয়।
লেখক: ড. এস.এম আবু জাকের