এ.এস.এম. জসিম উদ্দিনঃ বিগত এক দশকে দেশের জিডিপি’র আকার বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় সাড়ে ৩ গুণ হলেও কর-জিডিপি অনুপাতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি। ২০২০-২১ করবর্ষে প্রায় ৫৬ লক্ষ টিআইএনধারী’র মধ্যে ৪৩ দশমিক ৪০ শতাংশ যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশের কিছু বেশি আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন। এটা পরিষ্কার যে, করযোগ্য আয় থাকা সত্ত্বেও সমাজের একটা বড় অংশ এখনো করজালের আওতায় আসেনি: যেখানে শতভাগ ব্যাংকার বর্তমানে করজালের আওতায় রয়েছেন।
ব্যাংকারদের করফাঁকির সুযোগ একেবারেই নেই; তবে সঠিক সময়ে সঠিক কর-পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে তারা তাদের করদায় নুন্যতম পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারেন। কিভাবে আয়কর রিটার্ন প্রস্তুত/ দাখিল করতে হয় তার সম্পর্কে বেশীরভাগ ব্যাংকারগণেরই স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে। তথাপিও যারা তৃতীয় পক্ষের সহায়তায় রিটার্ন দাখিল করে থাকেন আশা করি লিখাটি তাদেরকে নিজ থেকে রিটার্ন প্রস্তুত/ দাখিলে অনুপ্রাণিত করবে।
আয়কর কর্তৃপক্ষের নিকট একজন করদাতার বার্ষিক আয়, ব্যয়, দায় এবং সম্পদের তথ্যাবলী নির্ধারিত ফরমে উপস্থাপন করার মাধ্যমই হচ্ছে আয়কর রিটার্ন। যাদের করযোগ্য আয় রয়েছে বা আবশ্যিকভাবে রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে তাদেরকে প্রতিবছর ৩০শে নভেম্বরের (ছুটি থাকলে পরবর্তী কার্যদিবসের) মধ্যে রিটার্ন দাখিল করতে হয়। ১২ ডিজিটের ই-টিআইএন গ্রহণ করেছেন এমন সকলকেই রিটার্ন দাখিল করতে হয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশে ফিক্সড বেজ নেই এমন অনিবাসীকে এবং করযোগ্য আয় নেই এমন কেউ যদি জমি বিক্রয়ের বা ক্রেডিট কার্ড গ্রহণের জন্য ই-টিআইএন নিয়ে থাকেন তাহলে তাঁকে রিটার্ন দাখিল করতে হয় না।
সাধারণভাবে ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাগণের করমুক্ত আয়ের সীমা ৩.০০ লক্ষ টাকা। মহিলা বা ৬৫ বছরের বেশি বয়সের করদাতার করমুক্ত আয়ের সীমা ৩.৫০ লক্ষ টাকা প্রতিবন্ধী ব্যক্তি করদাতার ক্ষেত্রে যা ৪.৫০ লক্ষ টাকা এবং গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা করদাতার ক্ষেত্রে যা ৪.৭৫ লক্ষ টাকা। করযোগ্য আয় থাকলেই ঢাকা উত্তর/ ঢাকা দক্ষিণ/ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকার একজন করদাতার ন্যূনতম আয়কর হবে ৫,০০০ টাকা, অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন এলাকার করদাতার ক্ষেত্রে যা ৪,০০০ টাকা এবং অন্যান্য এলাকার করদাতার ক্ষেত্রে যা ৩,০০০ টাকা।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
অর্থ আইন–২১ অনুযায়ী করহারের তফসিল | |
মোট করযোগ্য আয় | করহার |
প্রথম ৩০০,০০০ টাকা পর্যন্ত | শূন্য |
পরবর্তী ১০০,০০০ টাকা পর্যন্ত | ৫% |
পরবর্তী ৩০০,০০০ টাকা পর্যন্ত | ১০% |
পরবর্তী ৪০০,০০০ টাকা পর্যন্ত | ১৫% |
পরবর্তী ৫০০,০০০ টাকা পর্যন্ত | ২০% |
অবশিষ্ট টাকার উপর | ২৫% |
ব্যক্তি বিশেষে করদাতার আয়ের খাতে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। একজন ব্যাংকার সাধারনত: বেতনখাতে- মূল বেতন, বাড়িভাড়া ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, মহার্ঘভাতা, উৎসব ভাতা, ছুটি ভাতা, বিশেষ ভাতা, বোনাস, ভবিষ্যৎ তহবিলে চাঁদা, যাতায়াত ভাতা, গ্র্যাচুইটি, সুপার এ্যানুয়েশন ফাণ্ড ইত্যাদি উপখাতে আয় করে থাকেন। এছাড়াও সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশ, শেয়ারে/ ডিবেঞ্চারে বিনিয়োগের লভ্যাংশ, ব্যাংক জমা হতে প্রাপ্ত মুনাফা/ সুদ, বীমা পলিসি হতে প্রাপ্ত বোনাস/ মুনাফা, দান, বাড়িভাড়া, জমি বিক্রি, শেয়ার বিক্রি হতেও আয়ের সুযোগ রয়েছে। নিয়োগকর্তার নিকট হতে যানবাহন সুবিধা পেলে তার জন্য ৬০,০০০ টাকা বা মূল বেতনের ৫ শতাংশের মধ্যে যেটা বেশি সেটাও মোট আয়ের সাথে অন্তর্ভুক্ত হয়।
করদায় হ্রাসের লক্ষ্যে করদাতাগণ সুনির্দিষ্ট কতিপয় খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে কর রেয়াতের সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। জীবন বীমা প্রিমিয়াম (পলিসিভ্যালুর সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ), স্বীকৃত ভবিষ্যৎ তহবিলে নিয়োগকর্তা এবং কর্মকর্তার চাঁদা, তফসিলি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ডিপিএস বাবদ বার্ষিক ৬০,০০০/- টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ, তালিকাভুক্ত কোম্পানীর শেয়ার, স্টক, মিউচ্যুয়াল ফাণ্ড এবং ডিবেঞ্চারে বিনিয়োগ, যাকাত তহবিলে দান সহ আরও বিভিন্ন খাতে (বিস্তারিত আয়কর পরিপত্র -২০২১ দেখুন) বিনিয়োগ বা দানের ক্ষেত্রে কররেয়াত পাওয়া যায়।
বিনিয়োগজনিত কর রেয়াতের পরিমান “করদাতার মোট আয়” এবং “রেয়াতের জন্য অনুমোদনযোগ্য অংক”- ২’টির উপরই নির্ভরশীল। আবার রেয়াতের জন্য অনুমোদনযোগ্য অংক নির্ধারিত হয়-
(১) নির্ধারিত খাতে করদাতার প্রকৃত বিনিয়োগ/ দান,
(২) করযোগ্য মোট আয়ের [কতিপয় খাত ব্যতীত] ২৫ শতাংশ এবং
(৩) ১ কোটি টাকা- এই ৩টি অংকের মধ্যে যেটি কম তার ভিত্তিতে। আর মোট করযোগ্য আয় ১৫.০০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হলে কর রেয়াতের পরিমাণ হবে অনুমোদনযোগ্য অংকের ১৫ শতাংশ এবং মোট আয় ১৫.০০ লক্ষ টাকার বেশি হলে কর রেয়াতের পরিমাণ হবে অনুমোদনযোগ্য অংকের ১০ শতাংশ বিনিয়োগের উপর কর রেয়াত পেতে অবশ্যই আয়বর্ষ শেষ হওয়ার পূর্বেই নির্দিষ্ট খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হয়।
করদাতার মোট আয় থেকে বিধি অনুযায়ী যতটুকু আয় সরাসরি বাদ দিয়ে করযোগ্য আয় নিরুপণ করা হয় ততটুকু আয় কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত আয়ের আওতাভুক্ত। কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত আয়কে করদাতার রিটার্নে উল্লেখ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। একজন চাকুরিজীবী বাড়িভাড়া ভাতা বাবদ প্রাপ্ত বার্ষিক আয় খাতে ৩.০০ লক্ষ টাকা বা মূল বেতনের ৫০ শতাংশ এ দু’য়ের মধ্যে যেটা কম সেটা, চিকিৎসা খাতে ১.২০ লক্ষ টাকা বা মূল বেতনের ১০ শতাংশ এ দু’য়ের মধ্যে যেটা কম সেটা এবং যাতায়াত ভাতা খাতে ৩০,০০০ টাকা পর্যন্ত সর্বোচ্চ কর অব্যাহতি পেতে পারেন।
তাছাড়াও তিনি ২.৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত অনুমোদিত গ্র্যাচুইটি, স্বীকৃত প্রভিডেন্ড ফাণ্ড/ সুপার এ্যানুয়েশন ফাণ্ড হতে প্রাপ্ত অর্থ, স্বীকৃত ভবিষ্যৎ তহবিলে অর্জিত সুদ (মুল বেতনের এক-তৃতীয়াংশ বা ১৪.৫০ শতাংশ এর মধ্যে যেটি কম), ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত মিউচ্যুয়াল ফাণ্ড বা ইউনিট ফাণ্ড হতে প্রাপ্ত আয়, স্টক এক্সচেঞ্চে তালিকাভুক্ত কোন কোম্পানি হতে প্রাপ্ত ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত নগদ লভ্যাংশ, করমুক্ত বলে ঘোষণাকৃত নিরাপত্তা জামানতের সুদ, শেয়ার বিক্রয় হতে অর্জিত মূলধনজাতীয় আয়, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট হতে প্রাপ্ত সম্মানী বা ভাতা, আইনি প্রক্রিয় অনুসরণ করে বাংলাদেশে আনীত বাংলাদেশী নাগরিকের দেশের বাইরে উপার্জিত নিজস্ব আয় ইত্যাদি খাতে কর অব্যাহতি পেয়ে থাকেন।
লক্ষনীয় যে সর্বশেষ নিরুপিত আয় ৬.০০ লক্ষ টাকার বেশি হলে করদাতাকে সমান ৪ কিস্তিতে অগ্রিম আয়কর প্রদান করতে হয়। ২০২১-২২ করবর্ষ হতে রিটার্নের সাথে ৫.০০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত প্রদেয় আয়কর বাবদ পে-অর্ডার, ব্যাংক চেক, ডিডি ইত্যাদি গৃহিত হবে না, যা শুধু এ চালান বা ই-পেমেন্ট এর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে। ৪.০০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় থাকলে জীবন যাত্রার ব্যয় বিবরণী (আইটি ১০ বিবি) এবং ৪০.০০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত মোট সম্পদ বা গাড়ির মালিক বা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বাড়ী/ ফ্ল্যাট এর মালিক হলে করদাতার সম্পদ বিবরণী (আইটি ১০ বি) জমা দেয়া আবশ্যক।
রিটার্ন প্রস্তুতের পূর্বে করদাতাকে অবশ্যই আয়বর্ষে হ্রাস-বৃদ্ধি হয়েছে এমন সকল উৎসের আয়, বিনিয়োগ, দায় ও সম্পদ সংক্রান্ত প্রমাণাদি সংগ্রহ করতে হয় যা রিটার্লের সাথে যেমন দাখিল করতে হয় তেমনি রিটার্ন প্রস্তুতেও প্রয়োজন হয়ে থাকে। আয়কর নির্ধারণের ক্ষেত্রে, প্রথম ধাপে খাত অনুযায়ী মোট আয় হতে কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত আয় বাদ দিয়ে করযোগ্য আয় বের করতে হয় এবং তার উপর তফসিল অনুযায়ী মোট আয়কর নির্ধারণ করতে হয়।
আরও দেখুন:
◾ টিন সার্টিফিকেট কেন প্রয়োজন হয়?
◾ করযোগ্য আয় বের করবেন যেভাবে
বিনিয়োগ সমূহের তালিকা প্রস্তুতকরণ, রেয়াতযোগ্য বিনিয়োগ অংক ও কররেয়াত নির্ধারণ করা হচ্ছে তার পরের ধাপ। এরপর মোট আয়কর থেকে কর রেয়াতের পরিমান বাদ দিয়ে নীট করদায় নির্ণয় করা হয়। নীট করদায় হতে উৎস কর, অগ্রিম কর, অতিরিক্ত কর সমন্বয় ইত্যাদি বাদ দিলে রিটানের সাথে প্রদেয় করের পরিমান জানা যায়। আসুন সময়মত রিটান দাখিল করি, জরিমানা পরিহার করি।
লেখকঃ এ.এস.এম. জসিম উদ্দিন এসএভিপি, ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড।