অভিজ্ঞতার ঝুলি- ব্যাংকের খেলাপী ঋণ আদায়ের কৌশল
মোঃ জিল্লুর রহমানঃ আমি পেশায় একজন ব্যাংকার। আজ আমি পাঠকদের সাথে দুটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়তো পেশাগত জীবনে অন্যদের কাজে লাগতে পারে।
এক.
তখন আমি সবেমাত্র শিক্ষানবিস কর্মকর্তা এবং চাকুরির বয়সও এক দেড় বছর। বিনিয়োগ বিভাগে নতুন। ঢাকার একটি শাখায় কর্মরত এবং অন্যান্য কাজের সাথে আমাকে গৃহস্থালি সামগ্রী ক্রয়ের বিনিয়োগ আদায়ের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। একজন পুলিশ কনস্টবল ২০০৫ সালের দিকে তার ব্যক্তিগত জামানতের বিপরীতে মাত্র চল্লিশ হাজার টাকা বিনিয়োগ গ্রহণ করেছিল। যথারীতি মাসিক কিস্তিও নিয়মিত পরিশোধ করে আসছিল।
সর্বশেষ ব্যাংকের পাওনা যখন বার হাজার টাকা তখন তার মাথায় ভূত চাপে। তখন সে তার বাহিনী পুলিশ থেকে রাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়েনে নতুন পদায়ন হয়েছে এবং তার মধ্যে একটা ক্ষমতার বাহাদুরি চলে এসেছে। সে একদিন ব্যাংকে এসে ব্যাংকের টাকা মাফ করে দেওয়ার অনুরোধ করে। তাকে বুঝিয়ে বলি এটা সম্ভব নয় এবং এটা ব্যাংকের মাফ করার নীতিমালার মধ্যে পড়ে না। তাছাড়া, ব্যাংক কখনও আসল পাওনা মাফ করতে পারে না, কারণ এটা আমানতকারীদের জমানো টাকাই বিনিয়োগ (ঋণ) হিসাবে গ্রাহকদের প্রদান করে। তখন সে বলে এটা সে দিবে না এবং ব্যাংক যেন পারলে আদায় করে। আমি তাকে বললাম যেহেতু ব্যাংক একটা প্রতিষ্ঠান এবং সেটা আদায়ের জন্য সে সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু আপনি একজন ব্যক্তি এবং যেহেতু আপনি একটি শৃঙ্খলিত বাহিনীতে চাকুরি করেন, তাই আপনি এটা পরিশোধে বাধ্য। আপনি স্বেচ্ছায় ব্যাংকের টাকা পাওনা পরিশোধ না করলে ব্যাংক বাকা পথে তার পাওনা আদায় করবে। তখন আপনার একটা বড় ধরনের একটা ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তারপরও সে বললো আপনি পারলে টাকা আদায় করেন, ব্যাংক বাকি টাকা মাফ না করলে সে এটা দিবে না। সে এভাবে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে চলে যায়।
আরও দেখুন:
◾ বেসরকারি ব্যাংকের নতুন বেতন মার্চ-এপ্রিলেই কার্যকর হচ্ছে
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
বিষয়টি তার দুই সহকর্মী ও ব্যক্তিগত জামিনদারদের অবহিত করলাম। তারা বিষয়টি গ্রাহকের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর অনুরোধ করে। কিন্তু গ্রাহকের বদলির কারণে তারা তার সর্বশেষ কর্মস্থলের ঠিকানা দিতে পারেনি। তবে ব্যাংকের পাওনা আদায়ের বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিল। বিনিয়োগের নথিতে দেখলাম গ্রাহকের চাকুরির আইডি কার্ডের ফটোকপি রক্ষিত আছে। আমার জানা ছিল ঢাকা শহরে ৯৯৯ ফোন করে সহযোগিতা চাইলে পুলিশ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রেও আমি ৯৯৯ ফোন করে গ্রাহকের নাম ও আইডি কার্ডের নম্বর বলে তার সর্বশেষ কর্মস্থল ও তার নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তার তথ্য জানতে চাইলাম। তারা সাথে সাথে তার কর্মস্থল ও তার নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তার টেলিফোন নম্বর প্রদান করেন।
গ্রাহকের নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তার সাথে বিস্তারিত কথা বলে তার সহযোগিতা চাইলাম। তিনি জানালেন গ্রাহক বিদেশে শান্তিরক্ষার জন্য নির্বাচিত হয়েছে এবং তার অধীনে একটি ট্রেনিংয়ে আছে। এক মাসের মধ্যেই তার বিদেশের মিশনে যাওয়ার কথা। সে ব্যাংকের পাওনার সমর্থনে একটি চিঠি তার ফাক্সে পাঠানোর অনুরোধ করে। আমিও পাওনার সমর্থনে একটি তাগাদাপত্র লিখে তার ফাক্সে প্রেরণ করলাম এবং টেলিফোনে নিশ্চিত করলাম। ফাক্স পেয়ে তাকে ট্রেনিং ক্লাস থেকে ডেকে এনে সাথেসাথে এটি তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় এবং তাকে নির্দেশ দেয়া হয়, আগামী দিনের ক্লাসে অংশ নেওয়ার আগে যেন ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ করে ব্যাংক থেকে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে সে ক্লাসে অংশগ্রহণ করে। ব্যাংকের চিঠি পেয়ে সে হতচকিত হয়ে যায়!
পরদিন সকালে এসে দেখি সে আমার টেবিলের সামনে বসা এবং তার হাতে ব্যাংকের চিঠি। আমি অফিসে আসার আগেই সে হাজির। তাকে দেখে আমার বুঝতে আর কিছুই বাকী ছিল না। সে বললো স্যার আপনি আমার একটা ক্ষতি করে ফেললেন। আমি বললাম, দেখুন সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না। আপনি তো বলেছিলেন, ব্যাংক যদি পারে তবে যেন টাকা আদায় করে। ব্যাংক তো আপনার কোন ক্ষতি করেনি, বরং সে শুধু তার পাওয়া আদায়ের যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছে। আপনি কোন উপায়ন্তর না পেয়ে ব্যাংকের পাওনা পরিশোধে বাধ্য হয়েছেন এবং এটা আপনার মতো লোকজনের জন্য একটা বিশাল শিক্ষা! ছোট চাকুরি করে বেশি দাপট দেখাতে নেই, এটা আপনার জানা উচিৎ। সে লজ্জায় কোন কথা না বাড়িয়ে ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ করে একটা ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট নিয়ে চলে গেল। আমি পরে তার বসকে টেলিফোনে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানালাম।
দুই.
আমি বরিশাল চকবাজার শাখায় যোগদান করে শাখার হাল হকিকত অর্থ্যাৎ নতুন বিনিয়োগ, আমানত, মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা, পুরাতন খেলাপি বিনিয়োগ আদায় ইত্যাদি বিষয় জানার চেষ্টা করছি। এ শাখার খেলাপি বিনিয়োগ (ঋণ) আদায়ের ব্যবস্থা তখন বেশ নাজুক। বেশ কিছু বিনিয়োগ দীর্ঘদিন ধরে আদায় হচ্ছে না। চিঠিপত্র লেখা, ফোন করা, বাসা বাড়িতে হানা দিয়ে বিনিয়োগ আদায়ের চেষ্টা অব্যাহত আছে। খেলাপি বিনিয়োগ গ্রাহকদের নথি নাড়াচাড়া করতে গিয়ে একটি নথিতে চোখ আটকে গেল। লক্ষ্য করলাম চিঠি লিখতে লিখতে নথি বেশ মোটা হয়ে গেছে। বিনিয়োগটির আদায় প্রায় শতভাগ অনিশ্চিত।
নথি ঘেটে দেখলাম গ্রাহক পেশায় একজন জেল রক্ষী। সেই ২০১১ সালে গৃহস্থালি সামগ্রী ক্রয়ের জন্য ব্যক্তিগত জামানতের বিপরীতে মাত্র ষাট হাজার টাকা বিনিয়োগ গ্রহণ করেছেন। ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক ব্যাংকের একটি পয়সাও পরিশোধ করেন নি। সর্বসাকুল্যে তার কাছে পাওনা জরিমানা ও অন্যান্য খরচসহ দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। বিনিয়োগ গ্রহণের কিছুদিন পরই তিনি বরিশাল থেকে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যায় এবং তারপর থেকে তার বরিশালের অফিসের ঠিকানায় বহুবার চিঠিপত্র প্রেরণ করা হয়েছে। তার অফিসে চিঠিপত্র অফিসিয়ালি গ্রহণের প্রমাণও আছে কিন্তু এটি আদায়ের বিষয়ে কিংবা পরিশোধের জন্য তার অফিসের পক্ষ থেকে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বিনিয়োগের বাকী দুজন জামিনদারও তারই সহকর্মী এবং তারাও বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছে। নথিতে রক্ষিত তাদের মোবাইল নম্বরও সচল নেই। এমনকি বিনিয়োগটি আদায়ের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগেও চিঠি প্রেরণের রেকর্ড আছে। আসলে সরকারি অফিস বলে কথা! কার খবর কে রাখে, সরকারি অনেক অফিসে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে নথি নিতে পয়সা খরচ করতে হয়, অন্যথায় নথিতে ময়লার স্তুপে ঢেকে গেলেও কারও খবর কেউ রাখে না।
বিনিয়োগটি আদায়ের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসার মোটামুটি আশা ছেড়ে দিয়েছে যেখানে আট নয় বছরে একটি টাকাও আদায় হয়নি। গ্রাহককে সনাক্ত করা যাচ্ছে না, সর্বশেষ সে কোথায় কর্মরত আছে। অবশ্য এর একটি কারণও ছিল। তার অফিসে যত চিঠিপত্র প্রেরণ করা হয়েছে, তাতে তার নাম ও পদবি উল্লেখ করা হলেও তার অফিসিয়াল আইডি নম্বর উল্লেখ করা হয়নি। আমার শাখার সংশ্লিষ্ট অফিসারের সহায়তায় তার নথি ঘেটে তার অফিসের একটি আইডি কার্ডের ফটোকপি খুঁজে পাই। তখন বিনিয়োগটি আদায়ের বিষয়ে একটু আশার আলো দেখতে পাই।
অনেকেরই একটা বিষয় হয়তো জানা আছে, বর্তমানে সকল সরকারি বেসরকারি অফিসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের নাম, পদবি, টেলিফোন ও মোবাইল নম্বর ইত্যাদি তথ্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ইন্টারনেটের ওয়েবসাইটে দেয়া থাকে। সুবিধাভোগীরা যেন ইচ্ছে করলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সহযোগিতা নিতে পারে। তাদের তথ্য গুগলে সার্চ দিলে খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। অনেক সরকারি অফিসের সামনে সিটিজেন চার্টারও টানানো আছে। সেসব অফিসে সরকারি সেবা নিতে নিয়মানুযায়ী কতটাকা ফি নির্ধারণ করা আছে, সেটাও সিটিজেন চার্টারে উল্লেখ থাকে। এক্ষেত্রে আমি লক্ষ্য করেছি, সরকারি অফিস আদালতে নিচের দিকের কর্মচারীদের চেয়ে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সহযোগিতা চাইলে তারা ইতিবাচক দৃষ্টিতে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে।
উপরোক্ত বিনিয়োগ আদায়ের বিষয়ে নেটে সার্চ দিয়ে উপ-কারা মহাপরিদর্শকের মোবাইল নম্বর পেয়ে তাকে ফোন করে আমার পরিচয় দিয়ে উক্ত জেল রক্ষীর বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য জানতে চাই। তিনি আমার কাছ থেকে ফোন পেয়ে আমার সরবরাহ করা তথ্যের নোট নেন এবং যত দ্রুত সম্ভব প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন। আমি যেদিন ফোন দেই, সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার অফিস সময়ের একদম শেষ দিকে। তিনি উল্লেখ করলেন, আজ যেহেতু অফিসের শেষ সময়, তাই আজ সম্ভব না হলে আগামী কর্ম দিবস রবিবার আপনাকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো। এর ঠিক পনের বিশ মিনিটের পরেই তিনি কল ব্যাক করে উপরোক্ত গ্রাহকের নাম ঠিকানা, তার স্থায়ী ঠিকানা, বর্তমান কর্মস্থল, মোবাইল নম্বর, তার নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তার নাম ও মোবাইল নম্বর ইত্যাদি সরবরাহ করেন। আমিও তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। বিনিয়োগ আদায়ে সে গড়িমসি করলে তাকে অবহিত করার অনুরোধ করে।
এরপর আমি উপরোক্ত খেলাপি বিনিয়োগ গ্রাহকের মোবাইল নম্বরে ফোন দিয়ে তার নাম ঠিকানা সর্বশেষ কর্মস্থল ইত্যাদি নিশ্চিত হই এবং এগুলো সে সত্যায়ন করে। সবশেষে আমার পরিচয় দিয়ে সমস্ত ঘটনা খুলে বলি এবং বিনিয়োগ পরিশোধের জন্য এক মাসের সময় দেই, অন্যথায় তার উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের অবহিত করার বিষয়টি অবহিত করি। সে আমার ফোন পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়, সে ভাবছিল যেহেতু সে বদলি হয়ে চলে এসেছে তাই তাকে কেউ চিহ্নিত করতে পারবে না এবং কোনদিন তাকে আর বিনিয়োগটিও পরিশোধ করতে হবে না। সে বারবার দুঃখ প্রকাশ করতে থাকে। তাকে বলি, যদি সে নির্ধারিত এক মাসের মধ্যে পরিশোধ না করে, তবে আমিসহ আমার সংশ্লিষ্ট অফিসার তার গ্রামের ঠিকানায় চলে যাব এবং তার পুরো গ্রামে মাইকিং করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সহযোগিতা চাইবো। এতে সে আরও ভয় পেয়ে যায় এবং বিনিয়োগ পরিশোধের জন্য এক মাসের পরিবর্তে দুই মাসের সময় প্রদানের অনুরোধ করে। তখন আমি তাকে মোট পাওনার অর্ধেক এক মাসের মধ্যে পরিশোধের জন্য নির্দেশ দেই। সে অনুসারে ঠিকই এক মাসের মধ্যে তার মোট পাওনার অর্ধেক এবং অবশিষ্ট পাওনাও বাকী একমাসের মধ্যে পরিশোধ করতে বাধ্য হয়। একটি শতভাগ অনিশ্চিত খেলাপি বিনিয়োগ শুধু একটু বুদ্ধি ও কৌশলের কারণে আদায় হয় এবং আমিও একটি নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করি।
মোঃ জিল্লুর রহমান, ব্যাংক কর্মকর্তা ও ফ্রিল্যান্স লেখক।