ফিনটেক

ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা

ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা- বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং খাতের বাস্তবায়ন একটি সময়োচিত পদক্ষেপ। আর একটি উন্নয়নশীল দেশ তথা বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত এ ক্ষেত্রগুলোকে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা যথেষ্ট গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দিয়ে আসছেন। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এখন দেশের ব্যাংকিং খাতের ঋণ ও ব্যাংকিং সুবিধা মূলত ব্যবহার করছে উচ্চ ও মধ্যবিত্তশ্রেণী এবং বড় ও মাঝারি শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষ এবং ছোট শিল্প ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত ব্যাংকের ঋণ ও অন্যান্য সুবিধা যথেষ্ট পরিমাণে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তবে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের প্রচেষ্টায় এবং কিছু ব্যাংকের বিশেষ দক্ষতায় সামগ্রিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে।

বিশেষত সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক খাত সম্পর্কিত সব নীতিমালায় এ বিষয়গুলো যথাযথভাবে প্রতিস্থাপন করেছে এবং বাংলাদেশে নিম্ন আয়ের মানুষ ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং খাতের সেবার আওতায় আনার জন্য উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এহেন পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বেশকিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেশের পশ্চাত্পদ জনগণকে আর্থিক সেবার আওতায় আনার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের এসব কার্যক্রম ও পদক্ষেপ এরই মধ্যেই আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, পরিবেশ-সম্পর্কিত সচেতনতা ও গ্রামীণ উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় পরিবর্তন এনেছে ব্যাংকিং সেবায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার। মনে করা হচ্ছে, ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিংয়ের বিকাশে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে।

আর্থিক অন্তর্ভুক্তি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। দেশের একটি বড় অংশকে এখনো বিদ্যমান ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনা যায়নি। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বেশকিছু ব্যাংকের পদক্ষেপের ফলে একটি বড় অংশের নিম্ন আয়ের মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতায় এলেও তাদের ব্যাংকের ঋণসেবার আওতায় আনার জন্য ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে ঋণ ও সেবা ব্যতীত আমাদের মতো দেশে একটি টেকসই ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ এখনো কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত দেশের কৃষি ও গ্রামীণ খাতের প্রয়োজন অনুযায়ী খুব সামান্যই ঋণ ও আনুষঙ্গিক সেবা প্রদান করতে পেরেছে। প্রকৃতপক্ষে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি এখনো মূলত মহাজন ও ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর ওপর নির্ভরশীল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ব্যাংকিং সেবা যেমন— বিশেষ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, এসএমই ঋণ, ক্ষুদ্রঋণ, মোবাইল ব্যাংকিং ইত্যাদি গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। বিশেষত মোবাইল ব্যাংকিং সেবা স্বল্প সময়ের মধ্যে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে অর্থ লেনদেনের সহজ মাধ্যম হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

মোবাইল ব্যাংকিং এরই মধ্যে অর্থ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে গ্রামীণ জনজীবনে ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ইতিবাচক প্রভাব রেখেছে। বিশেষত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা সম্ভব। অতিসম্প্রতি কয়েকটি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালু করেছে। ফলে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিংয়ের পরিসর আরো বাড়বে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে সহজে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেয়া যাবে। তবে এক্ষেত্রে নিরাপত্তা ঝুঁকি ও সচেতনতার অভাব অনেক বড় চ্যালেঞ্জ, যা মোকাবেলার মাধ্যমে সত্যিকারের সুফল অর্জনই আগামী দিনের ব্যাংকিংয়ের লক্ষ্য।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক সেবার দ্রুত উন্নয়নে এবং স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে আর্থিক সেবা পৌঁছানোর মাধ্যম হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং সেবাকে উৎসাহিত করতে হবে। সেলফোনের ব্যাপক ব্যবহার মোবাইলভিত্তিক ব্যাংকিং সেবা ব্যবহারের ক্ষেত্রকে সহজসাধ্য করলেও শুধু মোবাইলভিত্তিক আর্থিক সেবা বাংলাদেশের জন্য বৈধ নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ ধরনের আর্থিক সেবাকে ব্যাংকের সঙ্গেই সম্পৃক্ত থাকতে হবে। সুতরাং তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি এ সংক্রান্ত ঝুঁকি নিরূপণ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প নেই। সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল এজেন্টের মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে রেমিট্যান্সপ্রবাহের প্রবণতা এ সংক্রান্ত ঝুঁকিকে নীতিনির্ধারকদের মুখোমুখি করেছে।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, যদিও মোবাইল বা ব্যাংকিং এজেন্টের মাধ্যমে খুব সহজে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী ও প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছানো সম্ভব, তবে এ ধরনের সার্বিক কর্মকাণ্ড আর্থিক সেবা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার নজরদারিতে থাকার প্রয়োজন আছে। বিশেষত মোবাইল ও অন্যান্য ব্যাংকিং এজেন্টকে অবশ্যই যথাযথ নজরদারি ও দায়বদ্ধতার আওতায় আনা না হলে তারা অর্থ লেনদেনসংক্রান্ত অবৈধ কাজকর্মে লিপ্ত হতে পারে অথবা অবৈধ চক্রের সহযোগী হয়ে উঠতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে এসংক্রান্ত অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে, যার মাধ্যমে নিম্ন আয়ের বেশকিছু মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ-জাতীয় অপরাধ মোকাবেলায়ও পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ আছে, যা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দরিদ্র জনগোষ্ঠী যদি অর্থ লেনদেনের পর্যায়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে এ পদ্ধতি গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।

বিআইবিএম আয়োজিত ষষ্ঠবার্ষিক ব্যাংকিং সম্মেলনের বিষয় হলো, তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক সেবার উন্নয়ন এবং প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন প্রখ্যাত ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। সব আলোচনা ও প্রবন্ধ উপস্থাপন সেশনের প্রতিপাদ্য রাখা হয়েছে ‘তথ্যপ্রযুক্তি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং’। যথারীতি দুদিনের এ আয়োজনের উদ্বোধন করেছেন বিআইবিএমের গভর্নিং বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। দেশ ও বিদেশ থেকে প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত ১১০টি প্রবন্ধের সারসংক্ষেপ এবং পরবর্তীতে জমাকৃত ৮০টি প্রবন্ধের মধ্য থেকে ২০টি প্রবন্ধ এ সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। প্রথম দিন নির্বাচিত ১২টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় দিন উপস্থাপিত হয়েছে বাকি আটটি প্রবন্ধ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ব্যাংকগুলোর ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডের তথ্যসংবলিত একটি প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। দ্বিতীয় দিনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। এছাড়া ডিজিটাল আর্থিক সেবার ওপর একটি বিশেষজ্ঞ আলোচনা সেশনও পরিচালিত হয়েছে। দুদিনের এ সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান।

লেখক: ড. শাহ্ মো. আহসান হাবীব, বিআইবিএমের অধ্যাপক ও পরিচালক প্রশিক্ষণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button