ব্যাংক আমানতের সুদ বা বাণিজ্যিক সুদ কি জায়েজ-৩
মুহাম্মদ শামসুজ্জামানঃ ব্যাংক আমানতের সুদ বা বাণিজ্যিক সুদ কি জায়েজ? তানতাভীর ফতোয়া ও ইসলামী ব্যাংকিং: তৃতীয় কিস্তি – আল্লাহ তাআলা ব্যবসাকে হালাল করেছেন ও সুদকে হারাম করেছেন। আয়াতটি সুবিদিত,স্পষ্ট ও স্বব্যাখ্যাত!
اَلَّذِیۡنَ یَاۡکُلُوۡنَ الرِّبٰوا لَا یَقُوۡمُوۡنَ اِلَّا کَمَا یَقُوۡمُ الَّذِیۡ یَتَخَبَّطُهُ الشَّیۡطٰنُ مِنَ الۡمَسِّ ؕ ذٰلِکَ بِاَنَّهُمۡ قَالُوۡۤا اِنَّمَا الۡبَیۡعُ مِثۡلُ الرِّبٰوا ۘ وَ اَحَلَّ اللّٰهُ الۡبَیۡعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰوا ؕ فَمَنۡ جَآءَهٗ مَوۡعِظَۃٌ مِّنۡ رَّبِّهٖ فَانۡتَهٰی فَلَهٗ مَا سَلَفَ ؕ وَ اَمۡرُهٗۤ اِلَی اللّٰهِ ؕ وَ مَنۡ عَادَ فَاُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ
যারা সূদ খায়, তারা সেই লোকের মত দাঁড়াবে যাকে শয়ত্বান স্পর্শ দ্বারা বেহুশ করে দেয়, এ শাস্তি এজন্য যে, তারা বলে ‘ক্রয়-বিক্রয় সূদের মতই’, অথচ ব্যবসাকে আল্লাহ হালাল করেছেন এবং তিনি সূদকে হারাম করেছেন। সুতরাং যার নিকট তার প্রতিপালকের পক্ষ হতে উপদেশবাণী পৌঁছল এবং সে বিরত হল, পূর্বে যা (সূদের আদান-প্রদান) হয়ে গেছে, তা তারই, তার বিষয় আল্লাহর জিম্মায় এবং যারা আবার আরম্ভ করবে তারাই অগ্নির বাসিন্দা, তারা তাতে চিরকাল থাকবে। (সূরা বাকারা ২৭৫)
সুদের বিপরীতে আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল সাব্যস্ত করেছেন। ব্যবসা ও সুদের মধ্যে অনেক পার্থক্য। কুরআন কেন সূদকে নিষিদ্ধ করে অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসাবে ব্যবসার কথা আনলেন,আমাদের একটু চিন্তা করা দরকার। ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনীতি সুদভিত্তিক হবে না বরং তা ব্যবসা নির্ভর,ব্যবসা বান্ধব এবং ব্যবসাভিত্তিক হবে। সুদের সামাজিক,আর্থিক ও সাংস্কৃতিক যে সমূহ ক্ষতি হয় তার থেকে বাঁচতে ও জাতিকে বাঁচাতে ব্যবসা বানিজ্যের প্রসার ও উন্নতি ভিন্ন উপায় নেই। কোন কোন স্থূল বুদ্ধির লোক বলে সুদের বিপরীতে ইসলামের কর্জে হাসানা সমাধান। তারা জানেনা যে কর্জে হাসানা ব্যক্তি পর্যায়ে দারিদ্রতা ও অভাব দূরীকরণে অবদান রাখে, কোন সন্দেহ নেই কিন্ত বৃহত্তর পরিসরে শিল্প করাখানা স্থাপন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যবসা বানিজ্য ছাড়া হয়না। এমনকি আন্তর্জাতিক বানিজ্যও।
আরও দেখুন:
◾ ব্যাংক আমানতের সুদ বা বাণিজ্যিক সুদ কি জায়েজ-২
ব্যবসায় ও রিবার মধ্যে নীতিগত পার্থক্য কি? রিবার বৈশিষ্ট কি, যে কারণে তার চেহারা ব্যবসায়ের থেকে ভিন্ন প্রকার দেখায় এবং ইসলাম কেনইবা তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে?
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
ব্যবসায় বলতে বুঝায়, সেখানে ক্রেতা ও বিক্রেত। দু’টি পক্ষ আছে। বিক্রেতা একটি বস্তু বিক্রির জন্য পেশ করে। ক্রেতা ও বিক্রেতা মিলে এ বস্তুটির একটি মূল্য স্থির করে। এ মূল্যের বিনিময়ে ক্রেতা বস্তুটি কিনে নিয়ে নেয়। এক্ষেত্রে বিক্রেতা নিজে পরিশ্রম করে ও অর্থ ব্যয় করে ঐ বস্তুটি তৈরী করেছে অথবা সে কোথাও থেকে বস্তুটি কিনে এনেছে-এ দুটোর যে কোনো একটি অবস্থার অবশ্যি সৃষ্টি হয়। এ উভয় অবস্থায়ই সে বস্তুটি কেনার বা সংগ্রহ করার ব্যাপারে নিজের যে মূলধন খাটিয়েছে তার সাথে নিজের পরিশ্রমের অধিকার সংযুক্ত করে এবং এটিই তার মুনাফা।
অন্যদিকে রিবা বলতে বুঝায়, এক ব্যক্তি নিজের মূলধন অন্য একজনকে ঋণ দেয়। এ সংগে শর্ত আরোপ করে যে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঋণ- গ্রহীতাকে মূলধনের চাইতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বেশী অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে মূলধনের বিনিময়ে মূলধন এবং নিদিষ্ট সময়ের অবকাশের বিনিময়ে বাড়তি অর্থ লাভ করা হয়-পূর্বাহ্নে একটি শর্ত হিসেবে যেটিকে নির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে। এ বাড়তি অর্থের নাম সুদ বা রিবা। এটি কোনো বিশেষ অর্থ বা বস্তুর বিনিময় নয় বরং নিছক অবকাশের বিনিময়। যদি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারিত হবার পর ক্রেতার নিকট শর্ত’ পেশ করা হয় যে, মূল্য আদায় করতে (মনে করুন) এক মাস দেরী হলে মূল্য একটি নির্দিষ্ট হারে বেড়ে যাবে, তাহলে এ বৃদ্ধি সুদের পর্যায়ভুক্ত হবে।
কাজেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শর্ত সাপেক্ষে মূলধনের উপর যে নির্দিষ্ট পরিমাণ বাড়তি অর্থ গ্রহণ করা হয় তাকেই সুদ বলা হয়। সুদের সংজ্ঞা এভাবেই নিরুপিত হয়। তিনটি অংশের একত্র সংযোজনই সুদের উদ্ভব। এক, মূলধন বৃদ্ধি। দুই, সময়ের অনুপাতে বৃদ্ধির সীমা নির্ধারণ। তিন, এগুলোকে শর্ত হিসেবে গ্রহণ করা। ঋণ সংক্রান্ত যে কোনো লেনদেনের মধ্যে এ তিনটি অংশ পাওয়া গেলে তা সুদী লেনদেনে পরিণত হয়। কোনো সৃষ্টিশীল ও গঠনমূলক কাজে লাগাবার অথবা কোনো ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য এ ঋণ গৃহীত হলেও এবং ঋণগ্রহীতা দরিদ্র বা ধনী যাই হোক না কেন তাতে এর আসল চরিত্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য সূচিত হয় না।
ব্যবসায় ও সুদের মধ্যে নীতিগত মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে নিম্নরূপঃ
এক: ব্যবসায়ে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে মুনাফার বিনিময় হয় সমান পর্যায়ে। কারণ ক্রেতা বিক্রেতার নিকট থেকে যে বস্তুটি ক্রয় করে তা থেকে লাভবান হয়। অন্যদিকে বিক্রেতা ঐ বস্তুটি ক্রেতার জন্য সংগ্রহ করার ব্যাপারে যে পরিশ্রম, বুদ্ধি ও সময় ব্যয় করে তার পারিশ্রমিকই সে লাভ করে। বিপরীতপক্ষে সুদী লেনদেনে সমান পর্যায়ে মুনাফা বিনিময় হয় না। সুদগ্রহীতা ধনের একটি নির্ধারিত পরিমাণ লাভ করে, যা তার জন্যে অবশ্যি লাভজনক হয়। কিন্তু সুদ দাতা কেবলমাত্র সাময়িক অবকাশ লাভ করে, এর লাভজনক হবার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ঋণগ্রহীতা ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য ঋণ গ্রহণ করে থাকলে সাময়িক অবকাশ তার জন্য লাভজনক হয় না বরং নিশ্চিত ক্ষতিকর হয়। আর ব্যবসায়, শিল্প, কারিগরী বা কৃষিতে খাটাবার উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ করে থাকলে অবকাশ তার জন্য একদিকে যেমন লাভের সম্ভাবনা নিয়ে দেখা দেয় তেমনি অন্যদিকে ক্ষতির আশংকা নিয়েও উপস্থিত হয়। কিন্তু ব্যবসায়ে লাভ-লোকসান যাই হোক না কেন ঋণদাতা সর্বাবস্থায় তা থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ মুনাফা লাভ করে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, সুদী কারবারে এক পক্ষের লাভ ও অন্য পক্ষের লোকসান হয় অথবা এক পক্ষের নিশ্চিত ও নির্দিষ্ট লাভ অন্যপক্ষের অনিশ্চিত ও অনির্ধারিত লাভ হয়।
দুইঃ ব্যবসায়ে বিক্রেতা ক্রেতার নিকট থেকে যত বেশী মুনাফা অর্জন করুক না কেন মাত্র একবারই সে তা অর্জন করে। কিন্তু সুদী কারবারে মূলধন দানকারী অনবরত নিজের ধনের বিনিময়ে মুনাফা অর্জন করতে থাকে এবং সময় অতিক্রান্তের সাথে সাথে এ মুনাফার পরিমাণ বেড়ে যেতেও থাকে। তার ধন থেকে ঋণগ্রহীতা যতই লাভবান হোক না কেন তা একটি বিশেষ সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে। কিন্তু এ মূলধনের বিনিময়ে ঋণদাতা যে মুনাফা অর্জন করে তার কোনো সীমা নেই। তার এ সীমাহীন মুনাফা তার সমস্ত উপার্জন, সমস্ত উপায়-উপকরণ ও ধন-দৌলত এবং তার যাবতীয় প্রয়োজনকে ছাপিয়ে যাবার পরও শেষ নাও হতে পারে।
তিনঃ ব্যবসায়ে পণ্য ও তার মূল্যের বিনিময় হবার সাথে সাথেই কারবার শেষ হয়ে যায়। এর পরে ক্রেতা কোনো পণ্য বা বস্তু বিক্রেতাকে ফেরত দেয় না। কিন্তু সুদী কারবারে ঋণগ্রহীতা মূলধন গ্রহণ করার পর তা ব্যয় করে ফেলে অতঃপর এ ব্যয়িত বস্তু পুনর্বার লাভ করে তার সাথে সুদের বাড়তি অংশ সংযুক্ত করে তাকে ফেরত পাঠাতে হয়।
চার: ব্যবসায়, শিল্প, কৃষি ও কারিগরীতে মানুষ পরিশ্রম করে ও বুদ্ধি খাটিয়ে তার ফল লাভ করে। কিন্তু সুদী কারবারে সে নিছক নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন খাটিয়ে কোনো প্রকার পরিশ্রম না করে, চিন্তা ও বুদ্ধি শক্তি ব্যবহার না করে অন্যের উপার্জনের সিংহভাগ দখল করে বসে। পারিভাষিক অর্থে যাকে অংশীদার বলা হয়, যে ব্যক্তি লাভ-লোকসান উভয়তেই অংশীদার থাকে এবং লাভের আনুপাতিক হারে তা থেকে অংশ নেয় সে তেমন ধরনের অংশীদার নয়। বরং সে হয় এমন একজন অংশীদার যে লাভ-লোকসান এবং লাভের আনুপাতিক হারের পরোয়া না করে নিজের নির্ধারিত ও শর্তাবদ্ধ মুনাফার দাবীদার হয়।
এ সমস্ত কারণে আল্লাহ ব্যবসায় হালাল ও সুদ হারাম করেছেন। এ কারণগুলো ছাড়া সুদ হরাম হবার আরো অনেক কারণ আছে। সুদ কার্পণ্য, স্বার্থান্ধতা, হৃদয়-হীনতা, নিষ্ঠুরতা ও লোভের মতো অসৎ গুণাবলী মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে। বিভিন্ন জাতির মধ্যে শত্রুতার বীজ বপন করে। মানুষের মধ্যকার সহানুভূতি ও পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার সম্পর্ক ছিন্ন করে। মানুষের মধ্যে ধন সঞ্চয় করে নিছক নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রবণতা সৃষ্টি করে। সমাজে ধনের অবাধ গতি ও আবর্তনে বাধা দেয়। বরং ধনের আবর্তনের গতি ঘুরিয়ে বিত্তহীনদের থেকে বিত্তবানদের দিকে ফিরিয়ে দেয়। তার কারণে সমগ্র দেশবাসীর ধন সমাজের একটি শ্রেণীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়। এর ফলে সমগ্র সমাজ ধবংসের সম্মুক্ষীণ হয়। অর্থনীতি বিশেষজ্ঞগণের নিকট এ ব্যাপারটি মোটেই প্রচ্ছন্ন নেই। সুদের এ সকল প্রভাব অনস্বীকার্য। কাজেই এ সত্য- টিও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, যে কাঠামোর ভিত্তিতে ইসলাম মানুষের নৈতিক প্রশিক্ষণ, তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন সুসংহত ও তার অর্থনৈতিক জীবন সংগঠন করতে চায় সুদ তার প্রতিটি অংশের পূর্ণ পরিপন্থী। নগণ্যতম সুদী কারবার ও তার আপাত সর্বাধিক নিষ্ফলষ অবস্হাও ইসলামের সমগ্র কাঠামোটা নষ্ট করে দেয়।
এ কারণেই আল্লাহ কোরআন মজীদে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় সুদ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ ذَرُوۡا مَا بَقِیَ مِنَ الرِّبٰۤوا اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ فَاِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلُوۡا فَاۡذَنُوۡا بِحَرۡبٍ مِّنَ اللّٰهِ وَ رَسُوۡلِهٖ ۚ وَ اِنۡ تُبۡتُمۡ فَلَکُمۡ رُءُوۡسُ اَمۡوَالِکُمۡ ۚ لَا تَظۡلِمُوۡنَ وَ لَا تُظۡلَمُوۡنَ
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও যদি তোমরা মুমিন হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না কর তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও, আর যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে। তোমরা যুলম করবে না এবং তোমাদের যুলম করা হবে না।(সূরা বাকারা ২৭৮-২৭৯)