ফিনটেক

রিয়েল টাইম গ্রোস সেটলমেন্ট (RTGS)

রিয়েল টাইম গ্রোস সেটলমেন্ট বা আরটিজিএস পদ্ধতি সাধারণত একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা পরিচালিত হয়, কারণ এটি একটি দেশের অর্থনীতির খুব গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসাবে বিবেচিত। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন যে, একটি কার্যকরী জাতীয় পেমেন্ট সিস্টেম পণ্য ও সেবা বিনিময় ব্যয় হ্রাস করে এবং এটি আন্তঃব্যাংক, অর্থ এবং মূলধন বাজারের কাজকর্মের জন্য অপরিহার্য। দেশের আর্থিক অবকাঠামোর মূল উপাদান হিসাবে পেমেন্ট সিস্টেমের উন্নয়নকল্পে RTGS পদ্ধতি ব্যবহার হয়ে থাকে।

RTGS কি?
রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট (আরটিজিএস)। ইংরেজিতে Real time gross settlement (RTGS)। রিয়েল টাইম গ্রোস সেটলমেন্ট (RTGS) হলো একটি বিশেষায়িত অর্থ (Fund) স্থানান্তর ব্যবস্থা যার মাধ্যমে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে তাৎক্ষণিক বা প্রকৃত সময়ে অর্থ স্থানান্তর করা যায়। এটি আরটিজিএস নামেই বহুল পরিচিত। ‘রিয়েল টাইম’ বা প্রকৃত সময় বলতে বুঝায় এখানে লেনদেন সম্পূর্ণ হতে কোন নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করতে হয় না বরং লেনদেন প্রক্রিয়া করার সাথে সাথেই লেনদেন সম্পূর্ণ হয়। আর ‘গ্রস সেটেলমেন্ট’ অর্থ লেনদেনটি অন্য কোনও লেনদেনের সাথে সম্পৃক্ত নয় এবং একবার লেনদেন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হলে সেটাই চূড়ান্ত এবং প্রত্যাহারযোগ্য নয়।

RTGS এর ইতিহাস
১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তিনটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিয়েল টাইম গ্রোস সেটলমেন্ট (আরটিজিএস) পদ্ধতি বাস্তবায়ন করেছিল, যেখানে ২০০৫ সালের শেষ নাগাদ ৯০টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করে। সর্বপ্রথম ১৯৭০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারাল রিজার্ভ ওয়্যার নেটওয়ার্কে আরটিজিএস পদ্ধতি চালু হয়। এটি টেলিগ্রাফের মাধ্যমে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকগুলোর মধ্যে বৈদ্যুতিকভাবে অর্থ স্থানান্তর পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স ১৯৮৪ সালে স্বাধীনভাবে আরটিজিএস পদ্ধতি তৈরি করে। পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে অন্যান্য কয়েকটি উন্নত দেশ এই পদ্ধতি চালু করেছে। যদিও, দেশ ভেদে এই পদ্ধতির প্রযুক্তিগত ও কাজের ধরনের ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সকল দেশে আরটিজিএস ব্যবস্থা চালু আছে। বাংলাদেশে ২০১৫ সালে RTGS চালু হয়েছে।

RTGS যেভাবে কাজ করে
রিয়েল টাইম গ্রোস সেটলমেন্ট (আরটিজিএস) পদ্ধতিতে অর্থের কোনও ফিজিক্যাল এক্সচেঞ্জ বা প্রাকৃত বিনিময় হয় না বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংক লেনদেনকারী ব্যাংকসমুহের হিসাব সমন্নয় করে। যেমন:- ‘ক ব্যাংক’ আরটিজিএস পদ্ধতি ব্যবহার করে ‘খ ব্যাংকে’ ৫ লক্ষ টাকা স্থানান্তর করল। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ক ব্যাংকের’ হিসাব থেকে ৫ লক্ষ টাকা ডেবিট বা বিয়োগ করে ‘খ ব্যাংকের’ হিসাব ক্রেডিট বা যোগ করে দেয়। আবার যখন ‘খ ব্যাংক’ এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ‘ক ব্যাংকে’ টাকা স্থানান্তর করবে, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘খ ব্যাংকের’ হিসাব ডেবিট বা বিয়োগ করে ‘ক ব্যাংকের’ হিসাব ক্রেডিট বা যোগ করে দিবে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রমাগত উভয় ব্যাংকের হিসাব সমন্বয় করে থাকে। অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে থাকা অন্যান্য ব্যাংকসমূহের হিসাবগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্রস ভিত্তিতে সমন্বিত হতে থাকে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি হবে বৈদ্যুতিকভাবে। ফলে এই পদ্ধতিতে প্রাকৃত অর্থের বিনিময় প্রয়োজন হয় না। আরটিজিএস পদ্ধতিতে ছোট-বড় সব ধরনের অর্থ স্থানান্তরণ করা যায়। তবে দেশ ভেদে কেন্দ্রীয় ব্যাংক লেনদেনের একটা নিম্ন সীমা নির্ধারণ করে দিতে পারে। এই পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে লেনদেনের ঝুঁকি হ্রাস করা বিশেষ করে বড় অঙ্কের তহবিল স্থানান্তরের ঝুঁকি হ্রাস করা।

আরও দেখুন:
বাংলাদেশ অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউজ (BACH)
বাংলাদেশ অটোমেটেড চেক প্রসেসিং সিস্টেম (BACPS)
ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশ (NPSB)

বাংলাদেশে RTGS
আভ্যন্তরীন যে কোনো ধরনের আর্থিক (টাকা এবং বৈদেশিক মুদ্রার) লেনদেনকে আরো নিরাপদ, সুরক্ষিত এবং দ্রুতগতি সম্পন্ন করার লক্ষ্যে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রযুক্তিগত সাহায্যে Remittance and Payment Systems Infrastructure Development প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় ২০১৪ সাল হতে RTGS ব্যবস্থা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়।

সুইডিস সফটওয়্যার ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান CMA Small Systems AB এর সহায়তায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সফল সার্থক এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার স্থাপন এবং System Integration Test (SIT) সম্পন্ন হওয়া সাপেক্ষে দেশের সবকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ২৯ অক্টোবর, ২০১৫ তারিখে RTGS ব্যবস্থার লাইভ যাত্রা সম্পন্ন হয় এবং এরই মধ্যে দেশের অভ্যন্তরে তাৎক্ষনিক নিষ্পত্তির বহু কাংখিত স্বপ্নটি বাস্তবায়িত হয়।

বর্তমানে দৈনিক প্রায় ৪০০০ লেনদেন এ ব্যবস্থায় সম্পাদিত হচ্ছে যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৮০০০ কোটি টাকা। বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ৭ হাজার এরও অধিক শাখা বর্তমানে এ ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত। RTGS ব্যবস্থায় বর্তমানে কেবলমাত্র দেশীয় মুদ্রায় সম্পাদিত বড় অংকের আন্তঃব্যাংক লেনদেন সম্পাদিত হলেও অচিরেই দেশের অভ্যন্তরে বৈদেশিক মুদ্রায় যেকোনো অংকের লেনদেন RTGS ব্যবস্থায় সম্পাদিত হওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

RTGS এ লেনদেনকৃত মুদ্রা
RTGS বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন চালু হলে নিম্নলিখিত ছয় (৬) ধরণের মুদ্রায় লেনদেন করা যাবে-
১. বাংলাদেশী টাকা (BDT)
২. ব্রিটিশ পাউন্ড (GBP)
৩. কানাডিয়ান ডলার (CAD)
৪. ইউরো (EUR)
৫. জাপানি ইয়েন (JPY) এবং
৬. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডলার (USD)

RTGS পদ্ধতি ব্যবহার করতে চাইলে আপনাকে যা করতে হবে
১. আপনাকে যেকোন ব্যাংকের হিসাবধারী হতে হবে।
২. লেনদেনের পরিমাণ ন্যূনতম ১ লক্ষ টাকা অথবা যেকোনো মূল্যে বৈদেশিক মুদ্রা হতে হবে।
৩. গ্রাহক অর্থের পরিমাণ, লেনদেনের উদ্দেশ্য এবং প্রাপকের বিভিন্ন তত্ত্ব (নাম, ব্যাংকের নাম ও কোড, হিসাব নম্বর ইত্যাদি) সম্বলিত একটি আদেশ তার নিজ ব্যাংকে প্রদান করবে।
৪. দ্রুতগতির এ লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাংক সর্বোচ্চ ১০০ টাকা সেবা মূল্য গ্রহণ করতে পারবে।

RTGS পদ্ধতিতে অর্থ স্থানান্তরের প্রক্রিয়া
১. গ্রাহকের আদেশ প্রাপ্তির সর্বোচ্চ ৩০ মিনিটের মধ্যে ব্যাংক গ্রাহকের হিসাব বিকলন (কর্তন) করে লেনদেনটি ইলেকট্রনিক উপায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকট প্রেরণ করবে।
২. বাংলাদেশ ব্যাংক লেনদেনটি পাওয়া মাত্রই গ্রাহকের ব্যাংকের হিসাব বিকলন (কর্তন) করে প্রাপকের ব্যাংকের হিসাব অর্থ আকলন (জমা) করবে এবং সে সংক্রান্ত বার্তা প্রাপকের ব্যাংকে প্রেরণ করবে।
৩. প্রাপকের ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকট থেকে উক্ত বার্তা প্রাপ্তির সর্বোচ্চ ৩০ মিনিটের মধ্যেই প্রাপকের হিসাবে টাকা জমা করবে।

RTGS পদ্ধতিতে যেসব লেনদেন নিষ্পন্ন করা সম্ভব
আন্ত ব্যাংক লেনদেনঃ
✓ আন্তঃ ব্যাংক/ কলমানি মার্কেট লেনদেন
✓ সরকারি সিকিউরিটিজ সংক্রান্ত লেনদেন
✓ আভ্যন্তরীণ বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন।
গ্রাহক লেনদেনঃ
✓ বাণিজ্যিক পর্যায়ে: B2B, B2P, B2G
✓ ব্যক্তি পর্যায়ে: P2P, P2B
✓ সরকারি পর্যায়ে: G2B, G2P

RTGS পদ্ধতি ব্যবহারের সুবিধা
নিম্নে RTGSপদ্ধতি ব্যবহারের সুবিধা সমুহ তুলে ধরা হলো-
১. দ্রুততম সময়ে লেনদেনের নিষ্পত্তি নিশ্চিত করে।
২. দ্রুততম উপায় পাওনা টাকা আদায়ে হওয়ায় প্রাপক তার জরুরী আর্থিক প্রয়োজন সহজেই মেটাতে পারে।
৩. প্রাপক তার পাওনা টাকা অধিকতর সম্ভাবনাময় আর্থিক খাতে বিনিয়োগ করতে পারেন।
৪. চেক জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঝুঁকিমুক্ত।
৫. ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনাকে সুদক্ষ করে।
৬. সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেটকে অধিকতর সুদক্ষ করে।
৭. সরকারের মনিটারি পলিসিকে সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে সাহায্য করে।
৮. ব্যাংকসমূহ নতুন নতুন ব্যাংকিং পণ্য ও সেবা উদ্ভাবন করে গ্রাহককে উন্নত বিশ্বের আর্থিক সেবা ভোগের সুযোগ প্রদান করতে পারে।

রিয়েল টাইম গ্রোস সেটলমেন্ট (RTGS) ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে দেশের গ্রাহকের নিকট বিশ্বমানের আর্থিক সেবা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়েছে। এটি একদিকে যেমন দ্রুততম সময়ে লেনদেন নিষ্পত্তি করে অন্যদিকে তেমনি লেনদেনের ক্ষেত্রে চেক জালিয়াতির মতো অর্থ আত্মসাতের ঝুঁকিকেও নির্মূল করেছে। তাৎক্ষণিকভাবে সকল ধরনের লেনদেনের নিষ্পত্তি করা যায় বিধায় রিয়েল টাইম গ্রোস সেটলমেন্ট (RTGS) ব্যবস্থা সরকারের মনিটারি পলিসির সফল বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

সোর্সঃ বাংলাদেশ ব্যাংক ও উইকিপিডিয়া

আরও দেখুন:
ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশ (NPSB) এর সুবিধা
বিডি-আরটিজিএসঃ অপার সম্ভাবনার সমীকরণ
বাংলাদেশ ইলেক্ট্রনিক ফান্ডস ট্রান্সফার নেটওয়ার্ক (BEFTN)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button