এইচএসবিসি ব্যাংককে বিভক্ত করার দাবি উঠেছে কেন
হংকংয়ে অনুষ্ঠিত শেয়ারহোল্ডারদের এক বৈঠকে এইচএসবিসি ব্যাংকের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা সোমবার তাঁদের কৌশলের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে রীতিমতো গলদঘর্ম হচ্ছিলেন। আর হতাশ শেয়ারহোল্ডাররা দাবি জানাচ্ছিলেন, ইউরোপের সবচেয়ে বড় এ ব্যাংক বিভক্ত করা হোক।
সিএনএন জানায়, হংকংয়ে শেয়ারহোল্ডারদের ওই বৈঠক ছিল অনানুষ্ঠানিক। সেখানে ব্যাংকের চেয়ারম্যান মার্ক টাকার ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নোয়েল কুইনের কাছে বিনিয়োগকারীরা প্রশ্ন রাখছিলেন, এইচএসবিসি তাদের ব্যবসা ঢেলে সাজানো সম্পর্কে কী ভাবছে, আর কেনই–বা সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের যুক্তরাজ্য শাখা তারা কিনতে গেল?
ব্যাংকের প্রধান ওই দুই কর্তা গত মে মাসের বার্ষিক সাধারণ সভার প্রসঙ্গ তুলে লিখিত মন্তব্য পাঠ করছিলেন। সে সময় পরিচালনা পর্ষদ সুপারিশ করেছিল, এইচএসবিসির এশিয়াভিত্তিক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে নতুন কিছু করা কিংবা এটি পুনর্গঠিত করার প্রস্তাবের বিপক্ষে শেয়ারহোল্ডাররা ভোট দিক। এশিয়া থেকেই এ ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি মুনাফা আসে।
মার্ক টাকার বলেন, পরিচালনা পর্ষদ ওই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে একমত ছিল। তিনি পরিষ্কার করেই বলেন, ‘ব্যাংকটি বিভক্ত করা আপনাদের স্বার্থের অনুকূলে যাবে না।’
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
মার্ক টাকার বলেন, এইচএসবিসি পুনর্গঠনের বেশ কিছু বিকল্প পরিচালনা পর্ষদ পর্যালোচনা করে দেখেছে এবং এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, এসব বিকল্প ‘বাস্তবে শেয়ারহোল্ডারদের মূল্য ধ্বংস করবে’। শেয়ারধারীদের লভ্যাংশের ওপর এর প্রভাব থাকবে বলেও তিনি সতর্ক করেন।
হংকংয়ের বৈঠকে এক হাজারের বেশি শেয়ারহোল্ডার অংশ নেন। মার্ক টাকার তাদের উদ্দেশে আরও বলেন, ‘আমাদের কৌশল কাজ করছে। আমাদের এখনকার কৌশল হলো লভ্যাংশের পরিমাণ বাড়ানো।’
বিভক্ত করার দাবি কেন
গত বছর থেকে এমন দাবি তোলা হচ্ছে যে ব্যাংকটির বাকি অংশ থেকে এশিয়ার ব্যবসা পৃথক করা হোক। এইচএসবিসির সবচেয়ে ভালো ব্যবসা হংকংয়ে। সেখানে শেয়ারহোল্ডাররা মনে করেন, অন্য অঞ্চলের কার্যক্রম লন্ডনভিত্তিক এ ব্যাংকের সার্বিক ব্যবসায় প্রভাব ফেলছে এবং সব মিলিয়ে এটি খারাপ করছে।
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নোয়েল কুইন অবশ্য সোমবার ওই সব সমালোচনা নাকচ করে দেন। তাঁর বক্তব্য হলো, ‘অন্য অঞ্চলে ব্যাংকের খারাপ ফলাফলের কারণে হংকং ও যুক্তরাজ্যে আমাদের মুনাফা কমে যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে আমাদের ব্যাংকিং গ্রুপ ভালো ফলাফল করছে।’
তবে একজন শেয়ারহোল্ডার প্রসঙ্গটি পরে আবারও তুললে নোয়েল কুইন বলেন, এইচএসবিসি বিভক্ত করলে ‘বড় রকমের রাজস্ব ক্ষতি’ হবে। কারণ, ব্যাংকটির ব্যবসার একটি বড় অংশই নির্ভর করে আন্তসীমান্ত লেনদেনের ওপর।
ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রকদের অনুরোধে এইচএসবিসি ২০২০ সালে লভ্যাংশ বাতিল করেছিল। বিনিয়োগকারীরা তা নিয়েও অসন্তষ্ট। তাই তাঁরা যুক্তি দেন, এশিয়ার ব্যবসা যদি এশিয়ার মধ্যেই সীমিত রাখা যায়, তবে হংকংয়ের শেয়ারহোল্ডাররা অন্য কোনো দেশের অনুরোধ-উপরোধের কারণে ক্ষতির শিকার হবেন না।
হংকংয়ের জেলা পরিষদের এক সদস্য ক্রিস্টিন ফঙ বলেন, তিনি এমন ৫০০ ক্ষুদ্র শেয়ারহোল্ডারকে প্রতিনিধিত্ব করছেন, যাঁরা লভ্যাংশ বাতিল হওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। সিএনএনকে তিনি বলেন, ফুটপাতের হকার, ট্যাক্সিচালক কিংবা শিক্ষক—সবাই বাড়ির ঋণ পরিশোধ, ইনস্যুরেন্স কিস্তি ও স্কুলের ফি দিতে লভ্যাংশের ওপর নির্ভর করেন।
ক্রিস্টিন ফঙ আরও বলেন, ঠিক সে কারণেই তিন বছর আগে এইচএসবিসি যা করেছে, তা এসব ছোট শেয়ারহোল্ডারকে দারুণভাবে বিপর্যস্ত করেছে।
এইচএসবিসি ২০২১ সালে অবশ্য লভ্যাংশ দিয়েছে, যদিও তা আগের তুলনায় কম। তবে ক্রিস্টিন ফঙ এখন সেই শেয়ারহোল্ডাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন, যাঁরা চান ব্যাংকটির এশিয়ার ব্যবসা আলাদা করা হোক।
প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছেন কেন লুই। তিনি সোমবারের বৈঠকে এর পক্ষে সমর্থন চেয়েছেন। মে মাসের বৈঠকে এটি পাস হতে ৭৫ শতাংশ ভোটের প্রয়োজন হবে। অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।’
কেন লুই জানান, এইচএসবিসি ব্যাংকে তাঁর ১০ কোটি হংকং ডলারের (১ কোটি ২৭ লাখ মার্কিন ডলার) শেয়ার রয়েছে। তাঁর সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে এখন পরিকল্পনা করছেন, তাঁদের দাবি নিয়ে কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ারহোল্ডারদের কাছে পৌঁছানো যায়, যাতে এ ব্যাপারে তাঁদের সমর্থন পাওয়া যায়।
সমর্থন জানাচ্ছে বড় শেয়ারহোল্ডারও
এইচএসবিসির সবচেয়ে বড় শেয়ারহোল্ডারের পক্ষ থেকেও চাপ আসছে। চীনের বৃহত্তম বিমা প্রতিষ্ঠান পিং আন এ ব্যাংকের ৮ শতাংশ শেয়ারের মালিক। এ কোম্পানি ব্যাংক পুনর্গঠনের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
পিং আনের সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান হুয়াং ইয়ং গত নভেম্বরে বলেছেন, ‘এইচএসবিসির দক্ষতা ও মূল্য বাড়ে, এমন যেকোনো উদ্যোগকে আমরা সমর্থন করব।’ এর পর থেকে এ বিমা কোম্পানির অবস্থানে পরিবর্তন হয়নি বলে জানিয়েছেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন।
ওই সূত্র সিএনএনকে জানিয়েছে, এইচএসবিসি পুনর্গঠনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে পিং আন আহ্বান জানিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের মূল্যমান বাড়ানো এবং বিশ্বজুড়ে নিয়ন্ত্রকদের অধীন এটি যাতে আরও সহজভাবে কার্যক্রম চালাতে পারে, সেদিকে লক্ষ রাখার জন্যও বলা হয়েছে।
চীনা বিমা কোম্পানিটি অবশ্য নির্দিষ্ট করে কোনো পরামর্শ দেয়নি। আসন্ন বার্ষিক সাধারণ সভায় তারা কীভাবে ভোট দেওয়ার পরিকল্পনা করছে, সে সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হলেও তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
টালমাটাল ব্যাংকিং খাত
যুক্তরাষ্ট্রে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের পতনের পর এর যুক্তরাজ্য শাখা কিনে নিয়েছিল এইচএসবিসি। এর জন্য গত মাসে মাত্র এক পাউন্ড খরচ করে এ বিশাল ব্যাংক। সোমবারের বৈঠকে এ নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। যে দ্রুততার সঙ্গে চুক্তিটি সম্পন্ন করা হয়েছে, সে কারণে প্রশ্ন উঠেছে যে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের গ্রাহকদের বিষয়গুলো এইচএসবিসি কতটা ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে পারবে।
হংকং জেলা পরিষদ সদস্য ক্রিস্টিন ফঙ প্রশ্ন রাখেন, ‘এইচএসবিসি কি এসভিবি গ্রাহকদের বিষয়ে বিস্তারিতভাবে খোঁজখবর নিয়েছে? তাদের আর্থিক বিবরণী দেখেছে? তারা কি ঋণ পরিশোধ করতে পারবে?’
তবে এইচএসবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মার্ক টাকার ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নোয়েল কুইন এসভিবি কেনার বিষয়টি সমর্থন করে বলেছেন, এটি একটি ভালো ব্যবসায়ী সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ, এর মাধ্যমে তাঁরা শত শত উদ্ভাবনী স্টার্টআপকে গ্রাহক হিসেবে পেয়েছেন। এ ব্যাপারে ওঠা সমালোচনাকেও নাকচ করে দেন তাঁরা।
ব্যাংকিং খাতের সাম্প্রতিক অস্থিরতা এইচএসবিসি ব্যাংকে ‘দ্রুত কোনো প্রভাব’ ফেলবে, এমনটা মনে করেন না মার্ক টাকার। তিনি বলেন, কিছু ছোট স্থানীয় ব্যাংকের ধস এবং ক্রেডিট সুইসের অধিগ্রহণের পর সব ব্যাংকের শেয়ারের দামই কমেছে।
কিন্তু মার্ক টাকার বলেন, এতে ব্যাংক খাতে কোনো ‘পদ্ধতিগত ঝুঁকি’ তৈরি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন না। তাঁর মতে, সব কিছু আবার ঠিকঠাক হওয়ার আগে কিছু সময়ের জন্য অনিশ্চয়তা থেকে যাবে।
সোর্সঃ প্রথম আলো