বিশেষ কলাম

যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক ধস থেকে যা শিখতে পারে বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম বৃহত্তম ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি) কোনো ঋণ কেলেঙ্কারি বা করপোরেট সুশাসনের অভাব ছিল বলে জানা যায়নি না। তবুও ধস এড়াতে পারেনি ব্যাংকটি।মার্কিন অর্থনীতির চলমান সংকটই ২০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের ব্যাংকটির ধসের কারণ বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ব্যাংকটি মূলত প্রযুক্তিভিত্তিক স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিত। অন্যান্য প্রচলিত ব্যাংক থেকে কোনো স্টার্টআপ ঋণ না পেলেও, এসভিবি থেকে পেত। অথচ, কর্তৃপক্ষকে ব্যাংকটির অবসায়ন বা বন্ধ করার পক্ষে অবস্থান নিতে হয়েছে।

বাংলাদেশের ২ জন অর্থনীতিবিদ ও একজন সিনিয়র ব্যাংকারের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকটির পরিণতি দেখে আমাদের দেশের ব্যাংকিংখাতের অনেক কিছু শেখার আছে। তারা বলছেন, বাংলাদেশের অনেক ব্যাংকে দীর্ঘদিন ধরে ঋণ কেলেঙ্কারি ও করপোরেট সুশাসনের সংকটে আছে। এসব ব্যাংক ব্যবসা পরিচালনায় বড় ধরনের সংকটে থাকলেও, তাদের অবসায়নের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এ ধরনের পরিস্থিতি পুরো আর্থিকখাতের জন্য নেতিবাচক।

বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে মার্কিন পন্থা অনুসরণ করা উচিত। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত দুর্বল ব্যাংকগুলো অবসায়ন করার সুযোগ থাকা উচিত। এই ধরনের সুযোগ অর্থনীতির জন্য ভালো।’

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

১৯৮৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরু করার পর গত এক দশকে দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছে এসভিবি। করোনা মহামারির সময়ে প্রযুক্তিভিত্তিক স্টার্টআপগুলোর কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ব্যাংকটি। এসব প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের বেতন ও পরিচালনা ব্যয়ের টাকা রাখতে এসভিবি ব্যাংককেই বেছে নিত। কারণ এ ব্যাংক থেকে তারা সহজেই ঋণও পেত।
অন্যান্য ঋণদাতাদের মতো এসভিবিও এসব আমানতের অধিকাংশই বিনিয়োগ করে। তারা দীর্ঘমেয়াদী মার্কিন ট্রেজারি বন্ডে প্রচুর বিনিয়োগ করে, যা যথেষ্ট নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় সুদহার বারবার বৃদ্ধি করে। এতে ব্যাংকটি চাপে পড়তে শুরু করে। বন্ডের মূল্য ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদহারের মধ্যে পরস্পর বিপরীত সম্পর্ক রয়েছে। সুদহার বেড়ে গেলে, বন্ডের দাম কমে যায়।

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যখন সুদের হার দ্রুত বাড়তে শুরু করে, তখন এসভিবির বিনিয়োগ করা বন্ডের মূল্য উল্লেখযোগ্য হারে কমতে থাকে। এসব বন্ডের মেয়াদ পূর্তির সর্বোচ্চ সময়সীমা ৩০ বছর। এ সময়কাল পর্যন্ত বন্ড ধরে রাখা গেলে, সুদসহ আসল টাকা ফেরত পাওয়া যায়। কিন্তু, ব্যাংকটি তা পারেনি। গত বছর থেকে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে শুরু করে। এর প্রভাব পড়ে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। এর ধারাবাহিকতায় তাদের অনেকেই এসভিবি থেকে আমানত তুলে নিতে শুরু করে। কিন্তু ব্যাংকটির কাছে আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধে পর্যাপ্ত তহবিল ছিল না। কারণ, অন্য ব্যাংকের মতোই এসভিবি এসব আমানত বিনিয়োগ করেছিল।

ফলে, নগদ অর্থের চাহিদা মেটাতে ব্যাংকটি লোকসানেই বন্ড বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এ অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে গত ৮ মার্চ এসভিবি পুঁজিবাজার থেকে পৌনে ২ বিলিয়ন ডলার মূলধন সংগ্রহের ঘোষণা দেয়। এতে গ্রাহকরা মনে করেন, ব্যাংকটি বড় ধরনের আর্থিক সংকটে পড়েছে। এ ধারণা থেকেই ব্যাংক থেকে ব্যাপকভাবে আমানত উত্তোলন করা শুরু করে। এর ২ দিন পরেই ব্যাংকটি বন্ধ হয়ে যায়।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে সিস্টেমিক ফেইলিওরের কারণে গত ১২ মার্চ বন্ধ হয়ে গেছে সিগনেচার ব্যাংকও। এক ব্যাংক সংকটে পড়লে, তা অন্য ব্যাংককেও আক্রান্ত করলে তাকে সিস্টেমিক ফেইলিওর বলা হয়। এ অবস্থায় আমানতকারীদের আস্থা ফেরাতে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ এবং আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত সংস্থা ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন (এফডিআইসি)। বিবৃতিতে বলা হয়, আমানতকারীরা তাদের আমানত ফেরত পাবেন। ১৩ মার্চ থেকে ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের কোনো ক্ষতি বহন করা হবে না। সিগনেচার ব্যাংকের ক্ষেত্রেও একই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষিত থেকে একেবারেই ভিন্ন। কারণ দেশের অনেক ব্যাংকই দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম ও ঋণ কেলেঙ্কারির মধ্যে আছে। একটি আদর্শ পরিস্থিতিতে ক্রমাগত লোকসানে থাকা কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারে না। তিনি বলেন, ব্যাংকও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এখানে দুর্বল ব্যাংকগুলোকেও অবসায়ন করতে দেয় না। এটা অর্থনীতির জন্য ভালো না।

তিনি বলেন, ‘দুর্বল ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা সাধারণত দাবি করেন যে, কোনো ব্যাংক অবসায়ন হলে তা পুরো ব্যাংকিং খাতে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করবে। দুর্নীতি ঢাকার জন্য তারা এ ধরনের দাবি করেন।’ কিন্তু বাস্তবতা হলো, যদি একটি দুর্বল ব্যাংক কার্যক্রম চালিয়ে যায়, তাহলে তা সিস্টেমিক ফেইলিওর তৈরি করে।’ আমাদের উচিত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অবসায়ন করে দেওয়া। অবসায়নের ক্ষেত্রে আমানতকারীদের স্বার্থ পরিপূর্ণভাবে রক্ষা করতে হবে, কিন্তু শেয়ারহোল্ডারদের বা পরিচালকদের নয়।’

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রায় একই অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বাজার ব্যবস্থা নির্ধারণ করবে কোন ব্যাংক টিকে থাকবে আর কোনটি থাকবে না।’

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, দুর্বল আর্থিক অবস্থা থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যাংককে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলে, এর ঝুঁকি অন্যান্য জায়গাতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

সোর্সঃ ডেইলি স্টার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button