ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন প্রসঙ্গে
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদঃ অনেক দিন থেকেই আমরা বাণিজ্যিক ব্যাংকে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা, অনিয়ম বা দুর্নীতির বিষয়গুলো দেখছি। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক চেষ্টা করলেও এর সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। এ পর্যায়ে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন। বিশেষ করে আইনি সংস্কার। আজ আইনি সংস্কারের দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করব। তবে অন্যান্য সংস্কারেরও প্রয়োজন রয়েছে। শুধু আইন প্রণয়ন করলেই হবে না, তার যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। আইন ছাড়াও কিছু নিয়ম-নীতিমালা ও কৌশল দরকার।
বাংলাদেশে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এ মোটামুটি বিস্তারিতভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা ও অন্যান্য নিয়ম-নীতির কথা উল্লেখ রয়েছে। আইনটি অবশ্য বেশ কয়েকবার সংশোধন হয়েছে। বিশেষ করে একটা সংশোধনের কথা বলব, যেখানে ব্যাংক পর্ষদে পরিচালকদের সংখ্যা দুই থেকে চার এবং তাদের মেয়াদ তিন বছর করে তিন মেয়াদে মোট নয় বছর করা হয়েছে। এটি ছিল নেতিবাচক সংস্কার। এ বিধান সংশোধিত আইনে তুলে দেয়া দরকার। কিন্তু নতুন আইনে তা করা হয়নি। পশ্চাত্পদ এ সিদ্ধান্তের কারণে ব্যাংক খাতের অব্যবস্থাপনা আরো চরমে উঠেছে।
দেশের ব্যাংকগুলোয় প্রথম সমস্যা হচ্ছে সুশাসনের অভাব। দ্বিতীয়ত, রয়েছে খেলাপি ঋণ ও ঋণ সম্পর্কিত বিষয়গুলো, যা শেষ পর্যন্ত দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকে উৎসাহিত করে। খেলাপি ঋণের সঙ্গে অনিয়মও জড়িত। তৃতীয় হচ্ছে তদারকির অভাব। ব্যাংকের যে কার্যদর্শন ও তদারকি ব্যবস্থা আছে, সর্বোপরি অ্যাসেট ও লায়াবিলিটি কমিটি ও অডিট কমিটি আছে, তাদের বিষয়গুলো দেখভাল করতে হবে। সবচেয়ে বড় তদারকির দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তাদের অফসাইট তদারকি, অনসাইট তদারকি ও ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সসহ অনেক শাখা রয়েছে। সেগুলোকে আরো শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
উল্লিখিত তিনটি সমস্যা সমাধানে আমাদের কাজ করতে হবে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের সংস্কার, পরিবর্তন, সংযোজন করে ব্যাংক খাত দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। কিন্তু বর্তমানে কিছুটা ভিন্নতা দৃশ্যমান। ব্যাংক খাতের আগের অর্জনগুলোর ওপর ভিত্তি করে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি এক্ষেত্রে অনুপস্থিত। আমরা দেখছি ব্যাংক খাত অনেক বেশি সমস্যাসংকুল হয়েছে এবং এতে আরো অনিয়ম যোগ হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতেই বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
১৯৯১ সালের আইনে বেশ কয়েকটি ধারা আছে, তা মোটেও সুশাসনের জন্য সহায়ক নয়। ব্যাংক অধিগ্রহণ সম্পর্কিত একটা ধারা রয়েছে। যেমন সরকারের অনুমতি ব্যতীত কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্য কোনো ব্যাংক অধিগ্রহণ করতে পারবে না। আইনের এ অসংগতিকে আমি বলব সুশাসনের অন্তরায়। আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়। বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ রয়েছে। বিশ্বের খুব কম দেশেই এ ধরনের ব্যবস্থা আছে। এখানে দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বিদ্যমান। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে অনেক সময় উচ্চপদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শও নেয়া হয় না। কিন্তু কোনো সমস্যা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাঁধে দায় চাপানো হয়। জনগণ মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপারগতার কারণে ব্যাংকগুলো ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু এর নেপথ্যে যে কারণগুলো রয়েছে, তা তারা উপলব্ধি করতে পারে না। এ বিষয়গুলো কিন্তু আইনের বাইরে। তাই শুধু আইনের সংস্কার দিয়ে হবে না, এখানে যেমন প্রশাসনিক সংস্কারের ব্যাপার আছে, তেমনি সরকারের সদিচ্ছার বিষয়গুলোও গুরুত্বপূর্ণ।
এবার আইনের সংশোধন প্রসঙ্গে আসি। সংশোধনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গ। এরপর দুর্বল ব্যাংক পুনরুদ্ধার শিরোনামে আলাদা অধ্যায় যোগ করা হয়েছে। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের শনাক্ত ও চূড়ান্ত করার জন্য ব্যাংকের কমিটি তৈরির কথা বলা হয়েছে। বিষয়গুলো ইতিবাচক। তবে এখানে একটা দুর্বলতা বিদ্যমান। ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, সেখানে বাস্তব প্রয়োগে সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, আমরা কীভাবে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণকে সংজ্ঞায়িত করব? যেমন কেউ ব্যবসা করছেন, তার শেয়ারের দাম বেড়ে গেছে, তার লাভ হচ্ছে কিন্তু তিনি ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের অর্থ ফেরত দিচ্ছেন না। আবার কোনো ব্যবসায়ী হয়তো ব্যবসায় লোকসান করছেন। কেউ হয়তো একটি এলসি খুলেছেন কিন্তু টাকা-পয়সা দিতে পারছেন না কিংবা তার অন্য ঋণ আছে, সেগুলোও তিনি দিতে পারছেন না। তবে শিল্পে লাভ করছেন। এক্ষেত্রে তাকে ইচ্ছাকৃত খেলাপির তালিকাভুক্ত করা সমীচীন হবে না।
এ পর্যায়ে পরিবারের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলব, ব্যাংকের বোর্ডে একই পরিবারে চারজন সদস্য রাখার কথা বলা আছে। এক পরিবার থেকে দুজনের বেশি পরিচালক রাখা ঠিক হবে না। তাছাড়া এক মেয়াদের বেশি রাখাও ঠিক হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মনে করে তার ট্র্যাক রেকর্ড ভালো, তখন একাধিক মেয়াদে তাকে বিবেচনা করা যেতে পারে। পরিচালনা পর্ষদে চারজন সদস্যের বদলে দুজন, মেয়াদ তিন বছর, বিশেষ কারণে ছয় বছর করা যেতে পারে। কিন্তু আমরা দেখছি আইনে পরিবারের সংজ্ঞাটা এতটাই বিস্তৃত হয়েছে যে পরিচালনা পর্ষদে পরিবারের সদস্য দুই বা চার নয়, আট বা তার চেয়েও বেশি বেড়ে যেতে পারে।
আমাদের ব্যাংক কোম্পানি আইনে যে বিষয়টিতে সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা হলো, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। এটিকে আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এ-জাতীয় সমস্যা সমাধানে দক্ষ, সৎ ও শুভবুদ্ধির মানুষগুলোকে নিয়ে ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক একটা প্যানেল করা যেতে পারে। সেখান থেকেই বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। কমিটির সবাইকে যে অর্থনীতিবিদ হতে হবে তা নয়। ওই প্যানেল থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক পরিচালকদের নাম বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে তাদের অনুমোদন দেবে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিএফও, সিইও এবং তার থেকে এক স্তরের অধস্তন কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন নেয়ার বিধান করা এখন সময়ের দাবি।
সদ্য মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইনে বলা আছে, ব্যাংক পরিচালকরা নিজস্ব ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন না। একই সঙ্গে তারা অন্য ব্যাংকের পরিচালকও হতে পারবেন না, যা গুরুত্বপূর্ণ। বিধান করা উচিত কোনো ব্যাংকের পরিচালক কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা বীমা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করব বিষয়টি ভেবে দেখতে।
পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে তার অতীত কাজের রেকর্ড ও অভিজ্ঞতাগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের বিষয়ে সব ব্যাংককেই নিরপেক্ষ, বিজ্ঞ ও দক্ষ লোকের নিয়োগ দেয়া উচিত। ব্যাংকের নীতিনির্ধারক কর্তৃপক্ষের বন্ধুত্ব বা আত্মীয়তার পরিচয়ে কোনো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেয়া সঠিক নয়। অন্ততপক্ষে সম্ভব হলে পরিচালনা পর্ষদে এক-তৃতীয়াংশ স্বতন্ত্র পরিচালক রাখা বাঞ্ছনীয়।
ব্যাংক পরিচালনায় ব্যবসায়ী, বিভিন্ন ট্রেড বডিস ও স্টেকহোল্ডারদের প্রভাবটা কী হবে, সে-সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা দরকার। যেমন অনেক ক্ষেত্রে সুদের হার, ঋণের হার ইত্যাদি ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত চেয়ারম্যান বা পরিচালকরা জোট করে ঠিক করেন। অসুবিধা হচ্ছে, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো বিভাজিত। তারা নিজ নিজ বলয়ে নিজ নিজ গ্রাহকের সঙ্গে কাজ করে। কিন্তু তাদের যখন নিয়ন্ত্রণ করতে যাওয়া হয় তখন সব ব্যাংক আবার এক হয়ে বাধা দেয়। ব্যাংকগুলো মিলে সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করে। এটি পৃথিবীর কোনো দেশে হয় না। সুদের হার নয়-ছয় নির্ধারণ করে সমস্যাই তৈরি করা হয়েছে।
আইনে কত মাস পর একজন ঋণগ্রহীতাকে খেলাপি বলবে, সে বিষয়টা এখন আছে। কিন্তু ঋণখেলাপির মেয়াদ কিংবা অবলোপন কী, এ বিষয়গুলো আইনে না থাকলে ভালো। কারণ আইন থাকায় বিষয়গুলো চট করে খুব সহজে বদলানো যায় না বা আইন সহজে পরিবর্তন করা যায় না। আইনকে রহিত করতে হয় কিংবা পরিবর্তন করার জন্য সংসদ অথবা সরকারের অধ্যাদেশের প্রয়োজন পড়ে। ক্ল্যাসিফিকেশন অব লোন, সিঙ্গেল এক্সপোজার লিমিট, লোন রিশিডিউলিং, পজিশনিং—এ বিষয়গুলো সম্পর্কে আইনের মূলধারা পরিপালন করে বাংলাদেশ ব্যাংক আলাদা সার্কুলার জারি করতে পারে। সে গাইডলাইনগুলো প্রয়োগের ক্ষমতা আইনের ধারার মতোই হতে হবে।
ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের আইনে শাস্তির বিধান নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু যাকে দায়ী করা হচ্ছে, সে সত্যিকার অর্থে সমস্যায় আছে কিনা তা দেখতে হবে। আর এটা তদারক করা কঠিন। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এটা মনিটর করে, তবে এজন্য আলাদা বিভাগ লাগবে। ঋণ দেয় ব্যাংক। যে ঋণ নেয়, এটা শুধু তারই দোষ নয়, ব্যাংকগুলোরও দায়ভার আছে।
এবার ব্যাংকারদেরও শাস্তির বিধান রাখা প্রসঙ্গে আসি। অসৎ উদ্দেশ্যের সঙ্গে ব্যাংকাররা যদি জড়িত থাকেন, তাহলে অবশ্যই তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ঋণগ্রহণকারী ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট আইনের আওতায় শাস্তি হবে। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিলে হবে না, একসঙ্গে প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
ব্যাংক পুনর্গঠন বা একত্রীকরণের বিষয়টিও আরো বেশি পর্যালোচনার ভিত্তিতে নেয়া উচিত। যেকোনো ব্যাংক অবসায়নের আগে অন্য বিকল্পগুলো যত্নসহকারে বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ একটি ব্যাংক অবসায়ন হলে সেটি সব ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদসহ ব্যাপক জনগোষ্ঠী, বিশেষত আমানতকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া আবশ্যক। কারণ এ আইনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
লেখকঃ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।