বিশেষ কলাম

ইসলামী ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনা ও ‘আইবিএলএফ’

মোঃ খায়রুল হাসান, সিএসএএঃ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন কর্মকান্ডে তারল্য বা নগদ অর্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানব দেহে রক্তের যেমন ভূমিকা ব্যাংকে নগদ অর্থের ভূমিকাও তদ্রুপ। রক্তের পরিমান কমে গেলে দেহ যেমন দূর্বল ও গতিহীন হয়ে পড়ে, তেমনি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নগদ প্রবাহের ঘাটতি দেখা দিলে তার দৈনন্দিন লেনদেনে গতিহীনতা চলে আসে। চাহিদা অনুযায়ী ও সময়মত গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে না পারলে ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থায় চির ধরে। আস্তে আস্তে ব্যাংক গ্রাহকপ্রিয়তা হারাতে থাকে। কাজেই যেসকল ব্যাংক তারল্য ব্যবস্থাপনায় বেশি দক্ষ সেসকল ব্যাংককে শক্তিশালী ব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

গ্রাহকদের জমানো আমানতই ব্যাংকগুলোর তহবিলের মূল উৎস। ব্যাংকগুলো এই তহবিল ঋণ বা বিনিয়োগ আকারে গ্রাহকদের মাঝে বিতরণ করে। এসব ঋণ বা বিনিয়োগ থেকে অর্জিত সুদ বা মুনাফাই ব্যাংকগুলোর আয়ের প্রধান উৎস। ব্যাংকগুলো তাদের গচ্ছিত আমানতের সবটুকুই ঋণ বা বিনিয়োগ হিসেবে বিতরণ করতে পারে না। গ্রাহকদের দৈনন্দিন লেনদেন চাহিদা পূরণের জন্য কিছু অংশ তারল্য আকারে রাখতে হয়, যা অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) বা ইনভেস্টমেন্ট ডিপোজিট রেশিও (আইডিআর) হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে এই অনুপাত ইসলামী ব্যাংক ও প্রচলিত ব্যাংকের জন্য যথাক্রমে ৯২ ও ৮৭ শতাংশ। আবার কিছু অংশ সংবিধিবদ্ধ তারল্য হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়।

এক্ষেত্রে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোকে তারল্য সঞ্চিতি ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এসএলআর, ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করতে হয়, যার বিপরীতে তারা সুদ পায়। অপরদিকে শরীআহভিত্তিক ব্যাংকগুলো সুদ থেকে প্রাপ্ত আয় নিতে পারে না, তাই তাদের কম পরিমাণ এসএলআর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নগদ অর্থে রাখা হয়। এ কারণে তাদের তারল্য উদ্বৃত্ত থাকে। কারণ তাদের সংবিধিবদ্ধ তারল্য অনুপাত (এসএলআর) কম রাখার অনুমতি দেওয়া হয়। প্রচলিত ব্যাংককে তাদের আমানতের ১৩ শতাংশ এসএলআর হিসেবে রাখতে হয়, কিন্তু ইসলামী ধারার ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

অতীতে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোতে তারল্য ঘাটতি লক্ষ্যনীয় না থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে গ্রাহকদের নগদ টাকার চাহিদা বৃদ্ধির ফলে ব্যাংকগুলোতে তারল্যের সংকট দেখা দিয়েছে। এ প্রেক্ষিতে শরীআহভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে স্বল্পমেয়াদী তারল্য সুবিধা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক চালু করেছে ‘ইসলামিক ব্যাংক লিকুইডিটি ফ্যাসিলিটি (আইবিএলএফ)’ শিরনামে স্বল্পমেয়াদী তারল্য ঋণ সুবিধা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক এ সুবিধা চালুর সিদ্ধান্ত একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ। প্রচলিত ব্যাংকগুলোর জন্য পুনঃক্রয় (রিপারচেজ) চুক্তির আওতায় স্বল্পমেয়াদী ঋণ সুবিধা থাকলেও ইসলামী শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর জন্য এ ধরনের ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ ছিলো না। আইবিএলএফ-এর ফলে ইসলামী ব্যাংকগুলোর তারল্য সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের সেবার পরিধি আরো সম্প্রসারিত হবে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিএমপি সার্কুলার নং-০৩/২০২২ অনুযায়ী, আইবিএলএফ হলো মুদারাবাহ চুক্তির অধীনে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক শরীআহভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে স্বল্পমেয়াদী তারল্য সুবিধা প্রদানের একটি আইনী কাঠামো যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিয়োগকারী (রব-আল-মাল) এবং ইসলামী ব্যাংকগুলো একটি সম্মত মুনাফা শেয়ারিং অনুপাতের (পিএসআর) অধীনে বিনিয়োগ ব্যবস্থাপক (মুদারিব) হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।

যে সকল শরীআহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করছে তারা আইবিএলএফ-এর আওতায় ১৪ দিনের জন্য তারল্য ঋণ সুবিধা পাবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে তাদের ০৩ (তিন) মাস মেয়াদী এমটিডিআর (মুদারাবা মেয়াদী জমার রসিদ) হারের সমপরিমান মুনাফা বাংলাদেশ ব্যাংকে লভ্যাংশ হিসেবে প্রদান করতে হবে। এ তারল্য ঋণের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর মর্টগেজবিহীন বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট ইনভেস্টমেন্ট সুকুক (বিজিআইএস) জামানত হিসেবে সংরক্ষণ করা হবে। আইবিএলএফ মেয়াদে লিয়েনকৃত সিকিউরিটিজ কোনো কাজে ব্যবহার বা বিক্রি করা যাবে না।

আইবিএলএফ-এর জন্য নিরাপত্তা জামানতের প্রযোজ্য সীমা তার অভিহিত মূল্যের (ফেইস ভেল্যু) ৫ শতাংশ হতে হবে। আইবিএলএফ প্রদানের সময় একটি নির্দিষ্ট হারে উপযুক্ত জামানতের অভিহিত মূল্যের উপর সীমারেখা নির্ধারণ করা হলেও সম্পূর্ণ জামানত মিলে একটি মাত্র নিরাপত্তা জামানত হিসেবে বিবেচিত হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকসমূহ আইবিএলএফ-এর জামানত হিসেবে ব্যবহৃত বিজিআইএস থেকে অন্তর্বর্তীকালীন মুনাফা পাবে।

আইবিএলএফ তহবিলের জন্য আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল অফিসের সিকিউরিটিজ সেকশনে নির্ধারিত ফর্ম-এর মাধ্যমে প্রত্যেক কার্যদিবসে আবেদন করতে হবে। আইবিএলএফ-এর জন্য প্রযোজ্য পরিমাণ হবে ন্যূনতম ১ কোটি টাকা বা এর গুণিতক পরিমান নগদ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিলাম কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইবিএলএফ বরাদ্দ দেওয়া হবে এবং সরবরাহকৃত তারল্য একই কার্যদিবসের শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পরিচালিত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে জমা করা হবে।

আইবিএলএফ ১৪ দিন অতিবাহিত হওয়া সাপেক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংক মুনাফাসহ (প্রভিশনাল মুনাফা হার অনুসারে) তার বিনিয়োগকৃত টাকা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে ডেবিট করে নেবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের লিয়েন চিহ্নিত সিকিউরিটিজ অবমুক্ত করে দেবে। যদি আইবিএলএফ ছুটির দিনে ম্যাচিউর হয় তাহলে আইবিএলএফ-এর মেয়াদ ছুটির দিনের সংখ্যা দ্বারা বৃদ্ধি করা হবে এবং মুনাফার হিসাব এই বর্ধিত সময়কে অন্তর্ভুক্ত করবে। প্রতি ক্যালেন্ডার বছরান্তে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত মুনাফা অনুযায়ী আইবিএলএফ মুনাফা সমন্বয় করা হবে।

যদি আইবিএলএফ ম্যাচুউরিটির সময়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান আইবিএলএফ নিষ্পত্তির জন্য তার কারেন্ট অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত তহবিল বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক লিয়েন চিহ্নিত সিকিউরিটিজ নিষ্পত্তি করে (নগদায়ন করে) বিনিয়োগের টাকা সমন্বয় করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনে আইবিএলএফ সংক্রান্ত নীতি ও পদ্ধতি পরিবর্তন/পরিমার্জন/সংযোজন বা বিয়োজন করতে পারবে।

আশির দশকে শুরু হওয়া শরীআহভিত্তিক ব্যাংকগুলো দেশে ব্যাপক গ্রাহকপ্রিয়তা অর্জন করে। শরীআহ মোতাবেক মুনাফা প্রাপ্তির আশায় গ্রাহকগণ তাদের বিপুল পরিমান আমানত ইসলামী ব্যাংকগুলোতে জমা রাখে। ফলে এক সময় প্রচুর তারল্য উদ্বৃত্ত থাকতো। এ কারণে বিপুল আমানতের আশায় অনেক প্রচলিত ব্যাংক ইসলামী শাখা ও উন্ডোর মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং সেবা চালু করে। সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামী ব্যাংকগুলোতে নগদ চাহিদা বৃদ্ধির ফলে তারা কিছুটা তারল্য সংকটে পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক আইবিএলএফ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর তারল্য ঘাটতি পূরণ করছে।

বর্তমানে দেশে ১০টি পূর্নাঙ্গ শরীআহভিত্তিক ব্যাংক ১৬শ’ শাখার মাধ্যমে গ্রাহকদের ইসলমী ব্যাংকিং সেবা প্রদান করছে। এছাড়া ৮টি প্রচলিত ধারার ব্যাংক ৪৫টি ইসলামী ব্যাংকিং শাখার এবং ১৩টি প্রচলিত ব্যাংক ২শ’টি উন্ডোর মাধ্যমে শরীআহসম্মত ব্যাংকিং সেবা প্রদান করছে। বর্তমানে দেশে ইসলামী ব্যাংকের মার্কেট শেয়ার আমানতে ২৯ শতাংশ, বিনিয়োগে ২৮ শতাংশ, গ্রাহক সংখ্যায় ৩০ শতাংশ এবং বৈদেশিক রেমিট্যান্স আরোহনে ৪০ শতাংশের ওপর। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মোট ব্যাংকিং সেক্টরের আমানতের ২৬.১৯ শতাংশই এই ব্যাংকগুলোতে হয়েছে। এই সময়ে আমানতের পরিমান দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ১২ হাজার ৩৪১ কোটি টাকায়, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি।

দেশের ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটির আমানত প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। ইসলামী ধারার অন্য ব্যাংকগুলো হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক।

লেখক- মোঃ খায়রুল হাসান বাহরাইন ভিত্তিক দ্য অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড অডিটিং অর্গানাইজেশন ফর ইসলামিক ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউটস (আওফি)-এর সিএসএএ ফেলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button